আদি-মধ্য ও মধ্যযুগের কৃষক বিদ্রোহ

আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “আদি-মধ্য ও মধ্যযুগের কৃষক বিদ্রোহ” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।

আদি-মধ্য ও মধ্যযুগের কৃষক বিদ্রোহ

আদি-মধ্যযুগে ভূমিদানব্যবস্থার সুচনা ও ব্যাপকতা মধ্যযুগে ভারতের আর্থসামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন আনে। রাজা বা ধনী ব্যক্তিরা প্রাথমিকভাবে ধর্মীয় উদ্দেশ্যে ব্রাহ্মণ বা ধর্মসংগঠনকে ভূমিদান দ্বারা পুণ্যার্জনের কাজ শুরু করেন। ক্রমে ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান, সরকারি কর্মী, এমনকি সামরিক বাহিনীর কর্মীরা বেতনের পরিবর্তে জমি বন্দোবস্ত পেতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে দানপ্রাপ্ত জমি ও কৃষি-পরিচালনার ওপরেও দানগ্রহীতার কর্তৃত্ব কায়েম হয়ে যায়। রাজশক্তির বাইরে ভুস্বামী শ্রেণিকে কেন্দ্র করে নতুন শক্তির কেন্দ্র গড়ে ওঠে। এইভাবে ভারতের কৃষি-অর্থনীতিতে সামন্ততান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলি যুক্ত হয়ে যায়।

নতুন ভূস্বামীদের অধিকাংশই চাষ-আবাদের সাথে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত থাকতেন না। তাদের আয়ের উৎস ছিল কৃষকের (কৃষি-মজুর) মাধ্যমে চাষ করা জমির উৎপাদিত পণ্য বা খাজনা। এক্ষেত্রে ভূস্বামী ও কৃষকের মধ্যে উৎপাদিত পণ্য বণ্টনের কোনো যুক্তিসম্মত রীতি মানা হত না। বলা যায়, উৎপাদন বণ্টনের ক্ষেত্রে অসম অধিকার প্রয়োগ করা হত। তদুপরি ভূস্বামীর ঘরবাড়ি তৈরি করা, পুষ্করিণী খনন বা সংস্কার, পথ নির্মাণ ইত্যাদি কাজে কৃষককে বিনা মজুরিতে শ্রম দিতে বাধ্য করা হত। এদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পেলে কৃষকের পক্ষে সামান্য মজুরিতে জীবনধারণ অসম্ভব হয়ে পড়ে। এর অনিবার্য ফলস্বরূপ কৃষকদের মধ্যে প্রতিবাদের ধ্বনি শ্রুত হয়।

মধ্যযুগের কৃষক-অভ্যুত্থানগুলির বৈচিত্র্য কম ছিল না। এক্ষেত্রে কখনো ভূমিস্বত্বভোগীর সাথে অপর ভূমিস্বত্বভোগীর দ্বন্দ্ব, কখনো ভূস্বামীর সাথে অধীনস্থ কৃষকের, আবার কখনো বা রাজার সাথে প্রজাদের সংঘাত ঘটেছে। নবম শতকের একটি অনুশাসন গাড়োয়ালে পাওয়া গেছে যেখানে দানগ্রহীতাদের সম্ভাব্য সমস্যা এবং সেই সমস্যা থেকে সৃষ্ট প্রজা বিদ্রোহ সম্পর্কে প্রশাসনকে সচেতন থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অধ্যপক রামশরণ শর্মা আদি-মধ্যযুগের বিভিন্ন স্মৃতিশাস্ত্র ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন যে, আদি-মধ্য ও মধ্যযুগের কৃষি-সম্পর্ককেন্দ্রিক দ্বন্দ্বগুলি নানা ধারায় সংঘটিত হত। যেমন আইনের সাহায্যে স্বার্থরক্ষার লড়াই, আত্মবলিদানের মাধ্যমে শোষণের তীব্রতা ও প্রতিবাদের বাণী তুলে ধরা কিংবা প্রকাশ্য সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া। তবে আইনি লড়াইয়ের ক্ষেত্রে সাধারণ কৃষক বা কৃষি-শ্রমিকের বিজয়ের সম্ভাবনা প্রায় ছিলই না। কারণ আদি-মধ্যযুগের ধর্মশাস্ত্রগুলিতে সাধারণভাবে জমি-সংক্রান্ত বিবাদে ভূমিস্বত্বাধিকারীদের পক্ষেই নিষ্পত্তি ঘটানোর ব্যবস্থা জোরালো করা ছিল। রাজকীয় অনুশাসন বা দানপত্রের অধিকারী ভূস্বামীদের স্বার্থরক্ষার তাগিদ তাদের অধীনস্থ মৌখিক প্রতিশ্রুতিপ্রাপ্ত কৃষকদের তুলনায় ছিল অনেক বেশি জোরালো। আত্মাহুতির দ্বারা ভোগপতিদের শোষণের বিরুদ্ধে উচ্চ কর্তৃপক্ষ বা প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণের রীতি দক্ষিণ ভারতে অধিক জনপ্রিয় ছিল। সম্ভবত দক্ষিণ ভারতে জৈনধর্মের প্রাধান্য এবং জৈনধর্মাচারে আমৃত্যু শারীরিক কৃচ্ছ্রসাধনের দ্বারা মোক্ষলাভের রীতি ওই অঞ্চলে প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে আত্মবলিদানের বিষয়টিকে জনপ্রিয় করেছে। তবে যেহেতু ভোগপতিদের অধিকার রাজকীয় অনুশাসন দ্বারা স্বীকৃত ছিল, তাই সাধারণ প্রজার আত্মবলিদান প্রায়শই নিষ্ফলে যেত। রাজকীয় প্রশাসনের কাছে ভূস্বামীর শোষণের বিরুদ্ধে নালিশ করার দৃষ্টান্তও আদি মধ্যযুগে পাওয়া যায়।

একাদশ থেকে ত্রয়োদশ শতকের অন্তর্বর্তীকালে দক্ষিণ ভারতে ব্রাহ্মণ, ভূস্বামী ও কৃষকদের মধ্যে একাধিক হিংসাশ্রয়ী সংঘর্ষ ঘটেছিল বলে শিলালিপির সাক্ষ্য থেকে জানা যায়। এ ধরনের সংঘর্ষের কেন্দ্রভূমি ছিল কর্ণাটক ও অন্ধ্রপ্রদেশ অঞ্চল। ব্রাহ্মণ ভূস্বামীদের সাথে কৃষকদের এই সংগ্রামে ভূস্বামীরা কৃষকদের বাসস্থান ও শস্যাদিতে অগ্নিসংযোগ করে তাদের জব্দ করার চেষ্টা চালাত বলে জানা যায়। দক্ষিণ ভারতে ‘বীর-শিলা’ নামক এক ধরনের বহু শিলাখণ্ড পাওয়া যায়। এগুলিাক স্থানীয় ভাষায় বিরগল বা বিরকল বলা হয়। কৃষক-অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে ভূস্বামী ব্রাহ্মণদের পক্ষ নিয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত যে সকল মানুষ প্রাণ দিয়েছে, তাদের স্মৃতিরক্ষার্থে এই ধরনের শিলাখণ্ড প্রোথিত করা হত। ত্রয়োদশ শতকে সংঘটিত এমন একটি সংঘর্ষে মৃত ব্যক্তির স্মরণার্থে খোদিত একটি শিলালেখ কর্ণাটকের হাসান জেলায় পাওয়া গেছে। এপিগ্রাফিয়া কর্ণাটিকা থেকে জানা যায় যে, কেরেহাল্লির জনগণের সাথে একটি পুষ্করিণী দখলের সংঘর্ষে জনৈক গ্রাম (হাঞ্চ) প্রধান নিহত হয়েছিলেন। তাঁর স্মরণে এই ‘বিরকল ‘টি প্রোথিত হয়। অধ্যপক শর্মার মতে, আদি-মধ্যযুগে পুষ্করিণী দখলকে কেন্দ্র করে কৃষক অভ্যুত্থানের কারণ হল সেকালে পুষ্করিণীর জলই ছিল জমিতে সেচদানের প্রধান উপাদান। বহুক্ষেত্রে গ্রাম-প্রধানরা জলের বেশির ভাগ অংশটা দাবি করতেন। ফলে সাধারণ কৃষকরা জলসেচের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হত। এর প্রতিকারে তারা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হত। একাদশ থেকে চতুর্দশ শতকের মধ্যবর্তীকালে কর্ণাটকে এই ধরনের একাধিক সংঘর্ষের বিবরণ শিলালিপি থেকে জানা যায়।

চোলরাজাদের লিপিগুলি থেকে দক্ষিণ ভারতে কৃষক-বিদ্রোহের তথ্য পাওয়া যায়। চোল রাজকর্মচারী ও ভূস্বামীদের পীড়ন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কৃষকেরা মাঝে মাঝেই প্রতিবাদী আন্দোলনে নেমেছিল। ভি. বেঙ্কটসুব্বা আয়ার পাণ্ড্যরাজা সুন্দর মারবর্মনের রাজত্বকালে খোদিত (১২২৫ খ্রিঃ) লেখ বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, শ্রীরঙ্গম মন্দিরের পরিচালকরা মন্দিরের কাজে নিযুক্ত কর্মীগোষ্ঠীকে (ওট্টর) সংগঠিত করে মন্দিরের প্রধানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। ‘ওট্টর’ বলতে বোঝায় কৃষি-শ্রমিক, ভূমিদাস, দেবদান কর্মী, কারিগর ইত্যাদি নানা স্তরের কর্মী যারা মন্দিরের সাথে চুক্তিবদ্ধ থাকত। মন্দিরের প্রধানের শোষণ ও কর্তৃত্ব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পরিচালকরা শ্রমজীবীদের বিদ্রোহমুখী হতে প্ররোচিত করেছিল।

চোলরাজা তৃতীয় রাজরাজের আমলে সংঘটিত একাধিক বিদ্রোহের কথা জানা যায়। তৃতীয় রাজরাজ ছিলেন দুর্বল এবং নির্বোধ। রাজনৈতিক অস্থিরতার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ সংকট তাঁর শাসনকালকে সংকটময় করে রেখেছিল। পাণ্ড্যদের আক্রমণ ও রাজরাজের পরাজয়ের ফলে অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। তারই প্রতিক্রিয়াস্বরূপ অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দানা বাঁধে। রাজরাজের রাজত্বের ২৩-তম বর্ষের একটি নথি তাঞ্জোরে পাওয়া গেছে। এই নথি থেকে ব্রাহ্মণ বা গ্রামীণ কৃষকদের অভ্যুত্থানের বিবরণ জানা যায়। পাণ্ড্যদের অভিযানের সময় প্রজাদের অভ্যুত্থানের ফলে বহু ভূমিস্বত্ব দলিল নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তৃতীয় রাজরাজ উনিশতম রাজ্যবর্ষে সেই সকল স্বত্ব পুনর্নবীকরণ করে ভূমিস্বত্ব প্রদান করে। এতে কৃষক ও কর্মীদের একাংশ ক্ষুব্ধ হয়ে বিদ্রোহী হয়েছিল। এস. আর. শৰ্মা লিখেছেন, তৃতীয় রাজরাজের রাজত্বের প্রথমদিকে বেশ কয়েকটি গ্রামীণ বিদ্রোহ হয়েছিল। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভূমিসংক্রান্ত নথি হারিয়ে বা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। কৃষকরা ধর্মীয় ভূমিস্বত্বভোগীদের গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিল না। তৃতীয় রাজরাজের শাসনের শেষদিকে সামাজিক বিশৃঙ্খলা এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে শাস্তিদানের ঘটনা সম্পর্কে ‘তাঞ্জোর লেখ’ থেকে জানা যায়। শৈব উপাসকদের সভা শিব ব্রাহ্মণ নামে পরিচিত দুজন মন্দির পুরোহিতকে শাস্তি দেয়। এঁরা দেবমূর্তির অলংকারগুলি প্রিয়জনদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন; মন্দিরের জমির রাজস্ব দিতে অস্বীকার করেছিলেন এবং প্রজাদের শোষণ করে অর্থ আদায় করেছিলেন। তাই গ্রামসভা ‘উর’-এর সমর্থনে মন্দির কর্তৃপক্ষ তাদের সমাজচ্যুত ঘোষণা করে এবং স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নেয়।

রাজদ্রোহিতার অপরাধে তোণ্ডাইমণ্ডলমের প্রজাদের শাস্তিদানের একটি ঘটনা তৃতীয় কুলোতুঙ্গ’র আমলে ঘটেছিল বলে অধ্যাপক শর্মা উল্লেখ করেছেন। তাঁর বিবরণ মতে, চোলরাজা পাণ্ড্যরাজ্যের জনৈক ব্যক্তিকে তোগুাইমণ্ডলমের একটি গ্রামের প্রশাসক নিযুক্ত করেছিলেন। ওই ব্যক্তি দায়িত্বভার গ্রহণ করে প্রথমেই রাজবিরোধী প্রজাদের বিতাড়িত করেন। এই বিদ্রোহে জমির সাথে সম্পর্ক ছিল কিনা, স্পষ্ট নয়। তবে রাজার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হয়েছিল বলেই এমন কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়।

ভূস্বামীদের বিরুদ্ধে উপজাতীয় কৃষকদের কিছু প্রতিবাদী আন্দোলনের বিবরণ কে. নীলকণ্ঠ শাস্ত্রী, এস. বিশ্বনাথন প্রমুখের রচনা থেকে জানা যায়। অষ্টম ও নবম শতকে কলভ্র উপজাতি ব্রাহ্মাণ ভূস্বামীদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে লিপ্ত হয়েছিল। পাণ্ডলিপি থেকে জানা যায় যে, কলভ্রদের বিদ্রোহের পরিণামে বহু ভূস্বামী তাঁদের ব্রহ্মদেয় দান থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন এবং সেই সকল ভূমির ওপর শূদ্রদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অবশ্য নীলকণ্ঠ শাস্ত্রী কলত্রদের ‘সভ্যতার শত্রু’, ‘মানবতার অভিশাপ’ বলে নিন্দা করেছেন। কলভ্রদের পঁচাত্তর বছরের শাসনকালে তামিলনাড়ুতে ‘অন্ধকার যুগ’ চলেছিল বলেই পণ্ডিতদের অভিমত। বিদ্রোহী কলভ্রদের আমলে দক্ষিণ ভারতে সমাজ, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির যে অবক্ষয় ও অস্থিরতা গ্রাস করেছিল, পাণ্ড্যদের শাসনকালে তার অবসান ঘটে।

পূর্ব ভারতে কৈবর্তদের নেতৃতে পালরাজের অপশাসনের বিরুদ্ধে জোরালো বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল। এই আন্দোলনে ধর্ম ও রাজনীতির কিছু ভূমিকা থাকলেও, এটিকে কৃষকশ্রেণির অর্থনৈতিক ক্ষোভজাত আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করার বহু যুক্তি আছে। রমেশচন্দ্র মজুমদার, রামশরণ শর্মা প্রমুখ কৈবর্তদের কৃষক-সত্তার দিকটিকে গুরুত্ব দিয়েছেন। কৈবর্ত-বিদ্রোহের স্বরূপ ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন মত দেখা যায়। পাল রাজবংশের পৃষ্ঠপোষকতাধন্য সন্ধ্যাকর নন্দী’র বক্তব্যকে ভিত্তি করে কেউ কেউ এই অভ্যুত্থানকে ‘ন্যায়ানুগ বা বৈধ সরকারের বিরুদ্ধে স্বার্থান্বেষীদের ষড়যন্ত্র’ বলে মনে করেন। রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, ভারতে ব্রিটিশ শাসনের সমর্থক লেখক গোষ্ঠী এই মতটি সমর্থন করেছেন। অন্যদিকে যদুনাথ সরকার, উপেন্দ্রনাথ ঘোষাল প্রমুখ মনে করেন, এটি ছিল অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে জনসাধারণের গণ-অভ্যুত্থান। অধ্যাপক শর্মার মতে, কৈবর্ত বিদ্রোহের অর্থনৈতিক দিকটি গুরুত্বপূর্ণ। শাসকের অত্যাচার কিংবা সাধারণ মানুষের জাগরণ—এই বিতর্কে কৃষকদের অর্থনৈতিক দুরবস্থার দিকটি উপেক্ষা করা সঠিক হবে না বলে অধ্যাপক শর্মা মনে করেন। আন্দোলনের পশ্চাৎপটে কৈবর্তদের কৃষক-সত্তা ও কৃষিস্বার্থের সক্রিয় ভূমিকা ছিল বলেই এঁরা মনে করেন।

আদি-মধ্য ও মধ্যযুগের কৃষক বিদ্রোহগুলি স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যুত্থান ছিল নাকি সংগঠিত বিদ্রোহ ছিল— এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে আসা কিছুটা কষ্টকর। কারণ তথ্যের অভাব। কৈবর্ত বিদ্রোহের ঘটনাবলি থেকে অনুমান করা যায় যে, তাৎক্ষণিক পরিস্থিতি কৃষকদের বিদ্রোহমুখী করেছিল। পালরাজা কর্তৃক জমিচ্যুত কৃষকরা মূলত বিদ্রোহের মাধ্যমে তাদের হারানো জমি ফিরে পেতে চেয়েছিল। সামাজিক উত্তরণের দিকটিও গুরুত্বপূর্ণ। প্রাক-বিদ্রোহ পর্বে ব্রাহ্মণরা কৈবর্তদের দেওয়া খাদ্যগ্রহণ করত না। সামাজিক ক্ষেত্রে তারা অন্ত্যজ বা অস্পৃশ্য বলে চিহ্নিত হত। পরবর্তী পর্বে কৈবর্তদের ক্ষত্রিয় পিতা ও বৈশ্য মাতার সন্তান রূপে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং ‘সৎ-শূদ্র’ নামে চিহ্নিত করে ব্রাহ্মণদের সাথে সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়। ষোড়শ শতকে রচিত একটি পুঁথি ব্যাখ্যা করে ড. মজুমদার দেখিয়েছেন যে, রাজকীয় উদ্যোগে কৈবর্তদের সামাজিক অবস্থা উন্নীত করা হয়েছিল। কৈবর্ত-প্রধান মহেশের ‘মহামাগুলিক’ উপাধি লাভ তাদের সামাজিক উত্তরণের অন্যতম দৃষ্টান্ত। বি. এন. এস. যাদব, নীহাররঞ্জন রায় প্রমুখ দেখিয়েছেন যে, লক্ষ্মণসেনের আমলে রাজনির্দেশ দ্বারা জেলে-কৈবর্তরা চাষি-কৈবর্তে উন্নীত হয়েছিল। রাজকীয় অনুমোদন দ্বারা কৈবর্তরা চাষি-হালিক হিসেবে পরিগণিত হয়।

অধ্যাপক শৰ্মা সমকালীন ভাবাদর্শ ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন যে, বিদ্রোহী কৃষককুল কর্তৃক ভূমি দখলের অজানা ভীতি সক্রিয় ছিল। ভূমিদানপত্রে দানের শর্তাবলি প্রতিপালনের প্রতি নিষ্ঠাবান হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ভূমিশাসনের শর্ত ভঙ্গ করলে, শর্তভঙ্গের আশঙ্কা ভূমিদাতার উত্তরপুরুষ বা কর্মরত কৃষক পরিবারের তরফ থেকে ছিল, ৬০ হাজার বছরের নরকবার এবং শর্তাদি পালন করলে অনুরূপ সময়ের স্বর্গবাসের বিধান দেওয়া হত। স্বর্গ-নরকের পুরস্কার বা তিরস্কার দ্বারা বিদ্রোহপ্রবণতা রোধ করার প্রয়াস নেওয়া হত।

মধ্যযুগের কৃষক-বিদ্রোহগুলি শেষ পরিণামে সমাজ বা অর্থনীতির ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারত না। কারণ পরিকল্পিত উপায়ে কৃষকদের মধ্যে জাতিগত ভেদাভেদ সৃষ্টি করে কৃত্রিম উপায়ে কৃষক-ঐক্যে ভেদাভেদ ঘটানো হত। এ ছাড়া, ধর্মচিন্তার ক্ষেত্রে ভক্তিবাদের প্রসার ঊর্ধ্বর্তন প্রভুকে ঈশ্বরের প্রতিভূ এবং তাঁর সেবাকর্মকে ঈশ্বর সাধনার নামান্তর বলে প্রচার করলে ভূস্বামী কৃষক সম্পর্কের মধ্যে বৈরিতার পরিবর্তে পারস্পরিক বিশ্বাস ও নির্ভরতার মানসিকতা তৈরি হয়। এইভাবে কৃষক-বিদ্রোহের সম্ভাবনা শিথিল করা সম্ভব হয়।

আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।

Leave a Comment