আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “অতীতের প্রেক্ষাপটে রচিত ‘চুয়াচন্দ্দন’ গল্পে যে মনোজ্ঞ প্রেম কাহিনিটি বিধৃত হয়েছে- তা নিজের ভাষায় ব্যক্ত করো” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
অতীতের প্রেক্ষাপটে রচিত ‘চুয়াচন্দ্দন’ গল্পে যে মনোজ্ঞ প্রেম কাহিনিটি বিধৃত হয়েছে- তা নিজের ভাষায় ব্যক্ত করো
সাহিত্যিক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় একালের লেখকরূপে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করলেও অতীতের বাতাবরণে রোমান্স মূলক কাহিনি নির্মাণে তিনি যে বিশেষ দক্ষ ছিলেন—তাঁর ‘চুয়াচন্দন’ গল্পটি বিশেষ সাক্ষ্য দেয়। গল্পের শুরুতেই পাঠকচিত্তে আগ্রহ প্রকাশের অছিলায়—তিনি লিখেছেন—“একদিন গ্রীষ্মের শেষভাগে সূর্য মধ্যকাশে আরোহণ করিতে তখনও দণ্ড তিনচার বাকি আছে, এমন সময় নবদ্বীপের স্নানঘাটে এক কৌতুহলপ্রদ অভিনয় চলিতেছে।” অভিনয়টা কী তা তিনি অতঃপর ব্যাখ্যা করেছেন। তবে নবদ্বীপের কথা উঠতেই পাঠকচিত্তে হয়তো প্রশ্ন জাগতে পারে—একালে আবার নবদ্বীপের ঘাট। স্মৃতিপটে রোমস্থিত হতে থাকে অতীতের প্রশান্তিময় নিমাই কেন্দ্রিক নবদ্বীপের ইতিহাস। লেখক সকল সংশয় দূর করে সরাসরি জানিয়ে দিলেন—“১৪২৬ শকাব্দের প্রারম্ভে এক কৃষ্ণা চতুর্দশীর প্রারম্ভে বাংলার কেন্দ্র নবদ্বীপের ঘাটে কী হইতেছিল, তাহাই লইয়া এই আখ্যায়িকার আরম্ভ।” পাঠকের বুঝতে আর অসুবিধা হয় না তারা কোন সময়ের কাহিনি পাঠে নিমগ্ন হয়েছেন।
অতঃপর নবদ্বীপ ঘাটের সামগ্রিক চালচিত্র উদ্ঘাটনের পর লেখক পাঠককে সুযোগ করে দিলেন সরাসরি মূল গল্পের অন্দরে প্রবেশের। “বেনের ছেলে নাম চন্দন দাস। সুশ্রী চোখে লাগা চেহারা। বয়স একুশ বাইশ, বুদ্ধিমান। বাকপটু, বিনয়ী….।” অগ্রদ্বীপের প্রসিদ্ধ সওদাগর রূপচাঁদ সাধুর পুত্র সে। কয়েকটি বাণিজ্যতরী নিয়ে বিদেশ থেকে বাণিজ্য সেরে বিশেষ লহবাস হয়ে স্বদেশে ফেরার পথে মাঝি মাল্লাদের বিশেষ ক্লান্ত দেখে নবদ্বীপের ঘাটে নৌকা বেঁধে চন্দন সেন গঙ্গার ঘাটের পথ ধরে নগর দর্শনে বার হয়। পথে যেতে যেতে যেমন নিমাই পণ্ডিতের সাক্ষাত পায় তেমন দেখা হয়ে যায় পরিচারিকা পরিবৃতা নদীতে স্নানে গমনোদ্যত চুয়ার সঙ্গে। চুয়ার অপরূপ রূপ মাধুরীতে আকৃষ্ট হয়ে চন্দন প্রথম দেখায় তাকে মনে মনে প্রেম নিবেদন করে বসে।
চন্দন দাস চুয়ার পিছু নিয়ে ঠিকানা জানতে পেরে চুয়া কেনার অছিলায় চুয়ার পালনকর্ত্রী বৃদ্ধার সঙ্গে সাক্ষাতে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে বৃদ্ধাও তাকে ভীত সন্তস্ত্র চিত্তে অভ্যর্থনা জানায়। উভয়ের কথোপকথনে জানা গেল তাদের অতীত ইতিহাস। বুড়িকে চন্দন জানায়—“তেরো বছর বয়সে বিয়ে হয়ে অয়ি, এক বছর পরেই বউ মরে যায়। তারপর আর বিয়ে করিনি।” এরপর বুড়ি চুয়া সম্পর্কে চন্দনকে জানায়—’চুয়ার বাপের নাম কাঞ্চন দাস।…চুয়ার বয়স যখন সাত বৎসর তখন কাঞ্চন দাস বাণিজ্যের জন্য নৌকা সাজাইয়া সমুদ্রে যাত্রা করিল। কাঞ্চন দাসের নৌকা গঙ্গার বুকে অদৃশ্য হইয়া গেল—আর ফিরিল না। সংবাদ আসিল, নৌকাডুবি হইয়া কাঞ্চন দাস মারা গিয়েছে। এই ঘটনার এক বৎসর পর চুয়ার মাও মরিল। তখন বুড়ি ছাড়া চুয়াকে দেখিবার আর কেহ রহিল না। বুড়ি কাঞ্চন দাসের মাসি-আট বছর বয়স হইতে সে হাতে করিয়া চুয়াকে মানুষ করিয়াছে।”
নৌকাডুবিতে সমস্ত সম্পত্তি ভরাডুবি হলে বুড়ি উপায়ান্তর না দেখে নবদ্বীপের নগরে ছোটো দোকান খুলে বসে জীবিকার তাড়নে। আর বছর দুয়েক গত হলে চুয়ার বয়স যখন দশ তখন এক গৃহস্থ ছেলের সঙ্গে তার বিবাহের সম্বন্ধ পাকা হয়ে যায়। বাদ সাধে জমিদারে লম্পট ভ্রাতুষ্পুত্র মাধব। সে একদিন ঘোড়ায় চড়ে এসে চুয়াকে দেখেই মুগ্ধ হয়ে নির্দেশ জারি করে বর্তমানে তান্ত্রিক সাধনায় বিরত। সাধনায় সিদ্ধিলাভে আর মাত্র দুই দিন বাকি। অর্থাৎ চুয়ার দ্বারা তার ষোলো বছরের কৌমার্যকে সার্থক করে সাধনায় সিদ্ধিলাভ করবে। ততদিনে চুয়া যেমন আছে তেমন থাকবে। মাধবের দাপটে চুয়ার বিবাহ ভেঙে গেল। এমনকি জাতিচ্যুত হওয়ার ভয়ে রাতের অন্ধকারে বুড়ি চুয়াকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে মাধবের কর্মচারীর নিকট ধরা পড়ে তারা নিজ গৃহে নজরবন্দি দশা ভোগ করতে থাকে। মাধবের প্রেরিত চম্পা নামক দাসী তাদের সদাই প্রহরারত।
এই কাহিনি শুনে ব্যথিত হয়ে চুয়াকে নিজের করে পেতে চন্দন মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, এবং কী করে তা সম্ভর মনে কৌশল স্থির করতে থাকে। এরপর কাহিনি দ্রুতগতিতে ক্লাইম্যাক্সের দিকে ধাবিত হয়। শুরু হয় মাধবের সঙ্গে চন্দনের খণ্ড যুদ্ধ, আত্মরক্ষার্তে ঘোড়ায় চড়ে চন্দনের সেস্থান হতে পলায়ন। সাহায্য প্রার্থী হয়ে নিমাই পণ্ডিতের দ্বারস্থ হওয়া। নিমাই সাদরে চন্দনকে অভ্যর্থনা জানায়। অতঃপর ছোট্ট ডিঙি তৈরি করা। নৌকা নিয়ে মাঝিদের মধ্যগঙ্গায় অবস্থান করা, খেয়াপারের মাঝিদের বখশিশের লোভ দেখিয়ে নবদ্বীপের ঘাট থেকে অপর পারে গিয়ে নৌকা ভেড়ানো নির্দিষ্ট দিনে মাধবের নির্দেশে পাইক বরকন্দাজ, পরিচারিকা পরিবৃতা হয়ে রাজা অর্থ দিয়ে গঙ্গার ঘাটে যাত্রা করলে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী চন্দনের চুয়াকে নিয়ে অতর্কিতে নৌকাযোগে গঙ্গার বুকে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া, প্রতিমুহূর্তে চন্দনের সঙ্গে থেকে নিমাই পণ্ডিতের অনুপ্রেরণা যোগানো, এমনকি যথা সময়ে বুড়িকে চন্দনের নিকট পাঠিয়ে দেবার সুব্যবস্থা করা, তারপর নির্দিষ্ট দিনে চুয়াচন্দনের বিবাহের আয়োজন ইত্যাদি কাহিনি ক্রমিক পরম্পরায় সংঘটিত হতে থাকে, এবং তা পাঠকালে পাঠকচিত্ত যে একেবারে মুগ্ধ বিবশ হয়ে পড়ে বলাই বাহুল্য।
প্রবাদে আছে ব্যবসায়ী মাত্রেই বেহিসাবি চলেন না। কিন্তু চন্দন একজন বেনের পুত্র হয়েও যেভাবে চুয়াকে পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল এবং বেহিসারির মতো অজানা অনির্দেশ্য পথে যেভাবে পা বাড়িয়েছিল তা তার মহত্বকে যেমন প্রকট করে তেমনি চুয়ার প্রতি তার তীব্র প্রেমাকর্ষণই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। চুয়াও মনেপ্রাণে চন্দনের প্রতি নিজেকে সমর্পণ করেছিল। মাধবের রোষ দৃষ্টিকে থোড়াই কেয়ার করে এমন ভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চন্দনের সঙ্গে পলায়নে সক্ষম হত না। সব মিলিয়ে আলোচ্য গল্পটিতে চুয়া ও চন্দন তাদের মধ্যেকার যে প্রেমের নিদর্শন রেখেছে তাতে যেমন লেখকের মুন্সীয়ানার পরিচয় মেলে ঠিক তেমনি গল্পটি হয়ে ওঠে রোমান্সের ধ্বজাধারী এবং চিত্তকর্ষক।
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।