‘অবতরণিকা’ গল্পে নারী স্বাধীনতার যে মৃদুস্বর ধ্বনিত হয়েছে তা নিজের ভাষায় ব্যক্ত করো

আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “‘অবতরণিকা’ গল্পে নারী স্বাধীনতার যে মৃদুস্বর ধ্বনিত হয়েছে তা নিজের ভাষায় ব্যক্ত করো” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।

‘অবতরণিকা’ গল্পে নারী স্বাধীনতার যে মৃদুস্বর ধ্বনিত হয়েছে তা নিজের ভাষায় ব্যক্ত করো

সাধারণত সুদূর প্রাচীনকাল থেকেই দৃষ্ট হয় সমাজ ছিল পুরুষশাসিত। নারীরা পুরুষের অঙ্গুলি হেনে তাদের সাধারণ জীবনের সামিল হত। তবে এই ধারণা তো বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না। সময়ের সাথে সাথে যেমন সমস্ত কিছু বদলায়, তেমনি সমাজে পুরুষের প্রাধান্য ক্রমেই হ্রাস পেতে পেতে নারী স্বাধীনতা বশবর্তী হতে বসেছে। দিকে দিকে সর্বভাবেই নারীরা প্রমাণ করতে সচেষ্ট হয়েছে তারা আর দুর্বল নয়, পুরুষের মতো সক্ষম। এই ধারা সমকালীন সাহিত্যেও বিশেষভাবে প্রকাশ পেতে শুরু করেছে, সমালোচ্য গল্পটি তারই প্রতিভূ।

সুব্রত ও আরতি সুখী দম্পতি। সুব্রত একটা পাবলিক ব্যাঙ্কে কমরত। আরতি বাড়ির তথা স্বামী শ্বশুর-শাশুড়ির নিষেধ সত্ত্বেও নিজের উদ্যোগেই একটা কোম্পানিতে চাকরি জুটিয়ে নেয়। সমস্ত প্রতিকূলতাকে অগ্রাহ্য করে আরতি নিয়মমাফিক অফিস করে। রাত্রে বাড়িতে ফেরে। আর শাশুড়ি সরোজিনী তাদের ছোটো কন্যাসন্তানকে অর্থাৎ নাতনিকে সামলাতে ব্যস্ত। ক্রমেই সারা পরিবার জুড়ে শুরু হয় চাপা উত্তেজনা। বাবা মা সুব্রতকে নিয়তই চাপ সৃষ্টি করে—বাড়ির বউকে এভাবে বাইরে চাকরি সূত্রে পড়ে থাকা বড়ই বেমানান। কিন্তু আরতি এসকল শোনা সত্ত্বেও ভ্রুক্ষেপমাত্র করে না। নির্বিকার চিত্তে আপন কর্ম সমাধা করে চলে।

শ্বশুরমশাই প্রিয়গোপালবাবুর একটা নিখদ বক্তব্য—“আমি বেঁচে থাকতে মজুমদার বাড়ির বউ চাকরি করবে আর আমি তা চোখ মেলে দেখব ?” সুব্রত নিজের বউ-এর সম্পর্কে এহেন উক্তি বাবার কণ্ঠে শুনে কোনোরকমে ক্রোধ সম্বরণ করে অপেক্ষায় থাকে কখন আরতি বাড়ি ফিরবে। অবশেষে আরতি বাড়ি ফিরলে সুব্রত চড়া কণ্ঠে তাকে শাসাতে শুরু করলে আরতি তা নির্বিকার চিত্তে মেনে নেয়। বরং নিজেকে আরো শুধরে নিয়ে মজুমদার পরিবারের নিষ্ঠাবান । বধূ হিসাবে নিজেকে প্রমাণ করতে আরতি একেবারে উদগ্রীব হয়ে পড়ল। সমস্ত কিছু সকাল হতে বাড়ির কাজকর্ম নিজের হাতে সামলে রান্না সেরে নিজে খেয়ে সুব্রতকেও খাইয়ে দুজনে অফিস যাত্রা করে। সুব্রত অবাক হয়ে যয়, আরতির এ হেন পরিবর্তনে, সাময়িকের জন্য তার মধ্যেকার উত্তেজনা চাপা পড়ে গেলেও মর্মে মর্মে সে এক অসহ্য যন্ত্রণা অনুভব করতে থাকে। সুযোগের অপেক্ষায় থাকে কেমন করে আরতিকে রোধ করা যায়।

আরতি নিজের ইচ্ছায় চাকরি করতে গেলেও গৃহবধূ হিসাবে কারোর প্রতি কর্তব্য পালনে সে পেছপা হয় না। “প্রথম মাসের মাইনে পেয়ে দেবর, ননদ আর ছেলেমেয়েদের জন্য লজেন্স আর লেবু শাশুড়ির জন্য এক কৌটো ভালো জরদা, অসুস্থ শ্বশুরের জন্য এক ঠোঙা আঙুর, আর স্বামীর জন্য এক প্যাকেট ভালো সিগারেট আর নিজের দুটো ব্লাউজের জন্য দু পিস অরগেন্ডি কিনে এনেছিল আরতি।” তার এহেন কর্মে এমন কোনো ব্যক্তি নেই সন্তুষ্ট না হয়ে পারে। সুব্রতও মনে মনে সন্তুষ্ট হয়েছিল, মুখে কোনোরূপ বাহবা না জানালেও একরকম মৃদু শুভেচ্ছা জানিয়ে ছিল আরতিকে।

তবে সুব্রত মনে মনে এক অশুভ চিন্তা পোষণ করতে থাকে। কী একটা অজানিত আশঙ্কায় তার মন খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু কেবল ব্যক্তিগত সুখ-সুবিধার জন্য মন খারাপ করবার ছেলে সুব্রত নয়। বউ যদি চাকরি করে, আর সে চাকরিতে যদি সময় আর সামর্থ্য দুই বেশি দিতে হয়, দাম্পত্য জীবনের চেহারা তো একটু আধটু বদলাবেই। তাতে আপত্তি নেই সুব্রতর। কিন্তু আরতির মনের চেহারা যেভাবে বদলাতে শুরু করেছে, সেটাকে তেমন সুলক্ষণ বলে ভাবতে পারছে না সুব্রত।” কারণ সম্প্রতি বাইরে বেরোনোর সূত্রে আরতির মধ্যে সাজে-পোষাকে চলনে-বলনে বিশেষ পরিবর্তন এসেছে এটাকে সুব্রত ভালো মনে মেনে নিতে পারবে না। তাই তো একটা সংশয়ের বশবর্তী হয়ে আরতিকে না জানিয়ে একদিন হাজির হয় তার অপিসে। উদ্দেশ্য কোথায় কেমনভাবে আরতি কাজ করছে তার দেখার জন্য। সেখানে কোনোরূপ আপত্তিকর কিছু না আবিষ্কার করতে না পারলেও সুব্রত মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় যে করেই হোক আরতির চাকরি থেকে সে অবসর সে নেওয়াতে বাধ্য করাবে।

সংসারের রোজগার বাড়াতে সুব্রত কয়েকটা পার্ট টাইমে কাজ নেয়। একসময় সত্যিই সে বেঁকে বসে। একেবারে পাকাপাকি ভাবে নোটিশ জারি করে আরতি আর চাকরি করতে পারবে না। একদা রাত্রে আরতি বাড়িতে ফিরলে সরাসরি সুব্রত তা জানিয়েও দেয় কিন্তু—“রাত্রে অত করে নিষেধ করা সত্ত্বেও পরদিন সুব্রতর চোখের সমুখ দিয়ে ফের সেজেগুজে হাইহিল জুতো পরে অপিসে বেরুল আরতি।” এবার সুব্রত আর থেমে থাকতে চাইলো না, আরতির মধ্যে বেপরোয়া ভাব তাকে অসহ্য করে তুলেছে। বাবা প্রিয়গোপালের নির্দেশে সে আলাদা আলাদা থাকার অছিলায় আরতির বাবা মায়ের দ্বারস্থ হয়। আরতির বাবা মাও ক্রমেই স্বাধীনতাকামী আরতির ব্যবহারে অসহ্য হয়ে পড়েছিল। জামাতার আর্জি শুনে তারা ক্রোধ সম্বরণ করতে না পেরে সুব্রত ও আরতির আলাদাভাবে থাকার সম্মতি প্রদান করে।

উভয়ের আলাদা থাকার ব্যবস্থা যখন প্রায় পাকা হতে চলেছে ঠিক সেই মুহূর্তে একটা দুঃসংবাদ এসে পড়ে সুব্রতর কাছে। যে জয়লক্ষ্মী ব্যাঙ্কে সে চাকরি করত তাতে আগামীকাল থেকে দরজায় তালা ঝুলবে এবং চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে। এই দুঃসংবাদের মাঝে সুব্রতর সমস্ত পরিকল্পনা বন্ধ হয়ে যায়। সংসার চলবে কেমন করে ? শেষ সম্বল আরতির চাকরিটা, তাই আর কোনো বাধা নয়। স্বতঃস্ফূর্তভাবে আরতি যাতে তার চাকরিতে বহাল থাকে তার জন্য সুব্রত চেষ্টা চালাতে থাকে। কিন্তু এই ঘটনার কয়েকদিন পরেই এসে গেল আরও একটি দুঃসংবাদ। সহকর্মীর সঙ্গে মালিকের মতানৈক্যের কারণে অপমান বোধ কবে আরতি চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে চলে আসে। এই খবরে শুধু সুব্রত নয়, শ্বশুর প্রিয়গোপাল, শাশুড়ি সরোজিনী, সবাই কেমন ব্যাকুল হয়ে পড়ে। কেমন করে চলবে তাদের সংসার, সবাই বোঝাতে থাকে আরতিকে যাতে সে আবার চাকরিতে ফিরে যায়, ভুল স্বীকার করে। কিন্তু আরতি নিজের সিদ্ধান্তে অচল অনড়। নিজের কোনো অপমানকে মুখ বুজে সয়ে হীনের মতো কোথাও বিকিয়ে দিতে সে নারাজ। অর্থাৎ ইচ্ছায় সে যেমন চাকরি নিয়েছিল আবার চাকরি ছেড়েছে, এই স্বাধীনতা বোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে সে নারী স্বাধীনতার প্রতিভূ হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য।

আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।

Leave a Comment