আদি বৈদিক যুগে রাজনৈতিক অবস্থা

আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “আদি বৈদিক যুগে রাজনৈতিক অবস্থা” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।

আদি বৈদিক যুগে রাজনৈতিক অবস্থা

প্রাচীন ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতির অনুসন্ধানের কাজে বৈদিক যুগের পরিস্থিতি বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে থাকে। সাধারণভাবে বৈদিক সংস্কৃতির সূচনা ও বিকাশকে ভারতীয় প্রেক্ষাপটে দু’টি প্রাথমিক পর্বে ভাগ করা হয়—আদি বৈদিক বা ঋগ্বৈদিক যুগ (১৫০০-১০০০ খ্রিষ্টপূর্ব) এবং পরবর্তী বৈদিক যুগ (১০০০-৬০০ খ্রিষ্টপূর্ব)। বৈদিক যুগের সার্বিক পরিস্থিতি অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে বৈদিক সাহিত্য আমাদের প্রধান উপাদান। সেকারণে প্রাচীনতম গ্রন্থ ঋগ্বেদ এবং পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যের বর্ণনার তারতম্যের ভিত্তিতে ঋগ্বেদ-কেন্দ্রিক আদি বৈদিক জীবন এবং সাম, যজু ও অথর্ব বেদ থেকে পরবর্তী বৈদিক যুগের সমাজ-সংস্কৃতি অনুসন্ধানের প্রয়াস নেওয়া হয়। অবশ্য পরবর্তী বেদাঙ্গ সাহিত্য, উপনিষদ ইত্যাদি নিঃসন্দেহে দুটি পর্বের তারতম্য অনুধাবনের কাজে বিশেষ সহায়তা করে। বলাবাহুল্য জীবনচর্চার তারতম্য, বিশেষত অর্থনৈতিক পরিস্থিতির রূপান্তর বৈদিক যুগের বিভাজন করার ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হয়। কেউ কেউ দাবি করেন ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতির মূল ধারাটি বৈদিক ঐতিহ্য দ্বারা নির্দিষ্ট করা আছে। অর্থাৎ বৈদিক জীবনচর্চা ভারতীয় সংস্কৃতির কেবল মূল ধারা নয়, একমাত্র ধারও বটে। এমন দাবি থেকে প্রমাণিত হয় যে, খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০-৬০০ অব্দে যে সমাজ, সংস্কৃতির সূচনা ভারতে হয়েছিল, তা পরবর্তী প্রায় দুহাজার বছরের বেশী সময় ব্যাপী প্রায় অপরিবর্তিত থেকে গিয়েছিল। ভারতীয় সমাজের এহেন অনড় বা গতিহীন চিত্র ঔপনিবেশিক ইতিহাস চর্চার সাথে খুবই সামঞ্জস্যপূর্ণ। বস্তুত এই মূল্যায়ন যুক্তিসিদ্ধ হতে পারে না। একথা ঠিক যে, ভারতীয় জীবনচর্চার প্রাথমিক সুরটি বৈদিক যুগে বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। তবে বৈদিক জীবনচর্চার পরবর্তী পর্ব থেকেই সেই প্রাথমিক ধারাটি নানা রূপান্তরের মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেছে। পারিবারিক জীবন, জীবিকা, দর্শন, ধর্ম, রাজনীতি ইত্যাদি নানা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হয়েছে, যার প্রাথমিক স্তরটি ঋগ্বৈদিক যুগে গড়ে দেওয়া হয়েছিল।

বৈদিক যুগে রাজনৈতিক অবস্থা :

বৈদিক সাহিত্যে, বিশেষত ঋগ্বেদে আর্যদের রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কিত আলোচনা খুবই সীমিত। রাজ্য এবং রাজতন্ত্র বলতে সাধারণভাবে বোঝানো হয় একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, রাজ্যের অধিবাসীবৃন্দ, শাসনতান্ত্রিক কাঠামো, আইনবিধি ইত্যাদি। রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কিত এমন স্পষ্ট উল্লেখ ঋগ্বেদে নেই এবং পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে পরোক্ষভাবে কিছু কিছু উল্লেখ আছে। ঋগ্বেদে ‘জনপদ’ শব্দটির কোন উল্লেখ নেই, আর ‘রাজ্য’ শব্দটির উল্লেখ আছে মাত্র একবার। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে রাজকীয় যাগযজ্ঞের গুরুত্ব উল্লেখ করা হয়েছে। উপরন্তু বিরাট, একরাট ইত্যাদি উপাধির উল্লেখ পাওয়া যায়, যেগুলিকে বৃহত্তর ও শক্তিশালী রাজতন্ত্রের দ্যোতক বলে মনে করা হয়। অর্থাৎ আদি বৈদিক যুগ ও পরবর্তী বৈদিক যুগে রাজনৈতিক জীবন যে স্বতন্ত্র ছিল, তা স্পষ্ট।

আদি বৈদিক যুগে আর্যরা ছিল মূলত পশুপালক ও যাযাবর প্রবৃত্তিসম্পন্ন। স্বভাবতই কোনরূপ রাজনৈতিক গড়ে তোলার সুযোগ বা সম্ভাবনা তাদের কাছে প্রায় ছিলই না। সপ্তসিন্ধব অঞ্চলে আর্যরা যখন বসতি স্থাপন করে তখন তারা ছোট ছোট উপজাতি গোষ্ঠী হিসেবে সংঘবদ্ধ থাকত। ঋগ্বেদে এমন ত্রিশটি গোষ্ঠীর উল্লেখ পাওয়া যায়। এদের মধ্যে পাঁচটি ছিল প্রধান— পুরু অনু, দ্রুহ, যদু ও তুর্কশ। এদের বলা হত ‘পঞ্জনা’। ঋগ্বেদে জন, গন্, বিশ প্রভৃতি শব্দ দ্বারা এক একটি জনগোষ্ঠীর সমাবেশকে বোঝানো হয়েছে। ‘গ্রাম’ শব্দের উল্লেখ থাকলেও সেটি বর্তমানের গ্রাম সমাজকে বোঝাতো না। রামশরণ শর্মার মতে, কয়েকটি পরিবার নিয়ে গড়ে ওঠা ক্ষুদ্র জনসমষ্টিকে বোঝাতে ‘গ্রাম’ কথাটি প্রয়োগ করা হয়েছে। পরবর্তীকালে এখান থেকেই গ্রামসমাজের উৎপত্তি হয়েছে বলে অনুমিত হয়। গ্রামের চেয়ে বৃহত্তর জনসমষ্টি ছিল, ‘জন’, ‘গণ’, ‘বিশ’ প্রভৃতি। মাইকেল বিজেল এমন প্রায় একশোটি উপজাতি গোষ্ঠী ‘কৌম’ (clan)-এর অস্তিত্ব ছিল বলে মনে করেন। দ্বিজেন্দ্রনারায়ণ ঝা-এর মতে, কয়েকটি ‘বিশ’ নিয়ে একটি ‘জন’ গঠিত হত। অবশ্য এদের অবস্থান ও বৈশিষ্ট্য খুব স্পষ্ট নয়। রাজনৈতিক একক (Unit) হিসেবে এদের ভূমিকা ছিল গৌণ।

আর্যরা ছিল যোদ্ধার জাত। তাদের সাথে ছিল উন্নত ধাতুর তৈরি অস্ত্রাদি। তাই এদেশে প্রবেশ করলে স্থানীয় অধিবাসীদের সাথে আর্যদের সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে ওঠে। এদেশের লোকেদের আর্যরা বলত দাস, দস্যু, পনি, পিশাচ ইত্যাদি। বৈদিক সাহিত্যে দাস ও দস্যুদের বিরুদ্ধে আর্যদের অভিযানের উল্লেখ আছে। আর্যরা সহজেই এদেশের অধিবাসীদের পরাজিত করতে পেরেছিল, কিন্তু নিশ্চিহ্ন করতে সক্ষম হয়নি। আবার আর্যরা নিজেদের মধ্যেও দীর্ঘকাল গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে লিপ্ত ছিল। এদেশে আর্যদের গোষ্ঠীগুলির মধ্যে ভরত ছিল প্রধান। ভরত গোষ্ঠীতে আর্যদের সাথে বহু অনার্য মিশে গিয়েছিল। ফলে আর্যদের মধ্যে বিশুদ্ধ আর্য এবং আর্য-অনার্য সংমিশ্রণে—এই দুটি শ্রেণীর উদ্ভব ঘটেছিল। দ্বন্দ্বটা ছিল মূলত এই দুই শ্রেণীর মধ্যে। ঋগ্বেদে ‘দশ রাজার যুদ্ধের উল্লেখ আছে। সম্ভবত ভরতরাজের সাথে বিশুদ্ধ আর্যদের বাকি দশটি গোষ্ঠীর মধ্যে এই যুদ্ধ হয়েছিল। এই যুদ্ধে ভরত-এর নেতা সুদাসের জয়লাভও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সুদাস রাজক্ষমতার অধিকারী হওয়ার ফলে আর্য-অনার্য মিশ্রিত গোষ্ঠীর প্রাধান্য সূচিত হয়। ‘দশ রাজার যুদ্ধ’-এর উপাখ্যান আর্যদের অভ্যন্তরীণ বিরোধ, সংঘাত এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায় উত্তরণের দৃষ্টান্ত ও প্রয়াস হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। এই আন্তঃআর্যগোষ্ঠী সংঘর্ষের কেন্দ্রে ছিল গবাদি পশুর দখল ও গো-চারণ ভূমির ওপর কর্তৃত্ব বজায় রাখার বাসনা। ঋগ্বেদে রাজন শব্দের প্রয়োগ বহুবার করা হয়েছে। এখানে গোষ্ঠীপ্রধানকেই রাজন উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল। এই রাজন ছিলেন একজন সমর নেতা এবং তাঁর প্রধান কাজ ছিল গবাদি পশু দখল করার যুদ্ধে নিজ গোষ্ঠীকে নেতৃত্ব দেওয়া। ঋগ্বেদে রাজাকে বলা হয়েছে ‘গোপতি’ (গোপতি জনস্য) অর্থাৎ গবাদি পশুর রক্ষক’। ‘নরপতি’ বা মানুষের প্রভু কিংবা ‘ভূপতি’ বা ভূমির প্রভু জাতীয় অভিধা ঋগ্বেদে রাজনের ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হয়নি। তবে আদি বৈদিক যুগের শেষ দিকে রাজন ‘গোপতি’ বা গোসম্পদের রক্ষকের ভূমিকা থেকে গোষ্ঠীর মানুষদের রক্ষকের ভূমিকায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। আর্যগোষ্ঠীগুলির মধ্যে সংঘাতের বিরাম ছিল না। জমির উপর বা পালিত পশুর উপর অধিকারের প্রশ্নে এই ধরনের বিরোধগুলি ঘটত। এছাড়া অনার্যদের সঙ্গেও বিরোধের কমতি ছিল না। অর্থাৎ সামগ্রিক পরিস্থিতি ছিল বিশৃঙ্খলাপূর্ণ। এই অবস্থার অবসান ঘটানোর জন্যই সম্ভবত একজন যোগ্যতাসম্পন্ন শক্তিমান নেতার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। যুদ্ধজয়ের জন্যই যে রাজার প্রয়োজন হয়েছিল তা ঋগ্বেদের একটি কাহিনী থেকে জানা যায়। সেখানে বলা হয়েছে, অসুরদের সাথে যুদ্ধে জয়লাভের জন্য দেবতারা একজনকে রাজা হিসাবে নির্বাচিত করেন। এ থেকে বোঝা যায়, যুদ্ধ পরিচালনায় দক্ষ কোন ব্যক্তিকেই প্রথমে নেতা হিসেবে মেনে নেওয়া হত, যে নেতা তারপর কালক্রমে রাজার সম্মান বা আসন লাভ করতেন। উইল ডুরান্ট তাই বলেছেন, “It was war that makes the chief, the king and the state among the Aryans.” বেণীপ্রসাদও মনে করেন যে, আদিপর্বে যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্যই রাজার প্রয়োজন হয়েছিল। তাছাড়া অনার্যদের কাছ থেকেও আর্যরা রাজপদ-সংক্রান্ত ধারণা পেতে পারে বলে মনে করা হয়।

রাজপদ যেভাবেই সৃষ্টি হোক না কেন প্রচলিত শাসনব্যবস্থা যে রাজাতান্ত্রিক ছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। ঋগ্বেদের বিভিন্ন অংশে, বিশেষত দানস্তুতিতে ‘রাজন’ শব্দটি পাওয়া যায়, বহু রাজার নামও জানা যায়। প্রকৃতপক্ষে প্রত্যেক উপজাতির সামরিক প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তি সেই গোষ্ঠীর রাজা হিসেবে নির্বাচিত হতেন। প্রজারা সকলে মিলে তাঁকে নির্বাচিত করত কিনা তা সঠিকভাবে জানা না গেলেও রাজপদের স্থায়িত্বের জন্য জনসমর্থন লাভ জরুরী ছিল বলেই মনে হয়। রাষ্ট্রগুলির আয়তন সম্ভবত বড় ছিল না। কারণ প্রতিটি উপজাতির জন্য এক-একটি রাষ্ট্র, প্রথমদিকের ব্যবস্থা ছিল এইরূপ। যদিও ঋগ্বেদের অনেক স্থানে এরূপ উল্লেখ আছে যে, একজন রাজা অন্যান্য কয়েকজন রাজার উপর প্রভুত্ব করছেন। তার বিপুল সম্পদের উল্লেখও করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ রাজা কশু কর্তৃক কোন এক ঋষিকে দানের ঘটনাটির উল্লেখ করা যায়। এছাড়াও অনেক রাজাই পুরোহিতদের বহুসংখ্যক গরু, ঘোড়া, স্বর্ণ, বস্ত্র ইত্যাদি দান করছেন এমন বর্ণনা পাওয়া গেছে। ঋগ্বেদে উল্লেখিত ‘সম্রাট’ বা ‘বিশ্বস্য ভূবনস্য রাজা’ ইত্যাদি শব্দগুলিও তাৎপর্যপূর্ণ। অর্থাৎ ঋগ্বেদের যুগে রাজা বলতে একজন উপজাতীয় নেতাকেই সর্বদা বোঝাত না। বহুক্ষেত্রেই রাজা সম্মানে, সম্পদে প্রকৃত রাজকীয় মর্যাদার অধিকারী হতেন। রীতিমত অভিযেক ক্রিয়ার মাধ্যমে তিনি রাজপদে আসীন হতেন, রাজকীয় বস্ত্র পরিধান করতেন ও বৃহৎ অট্টালিকায় বাস করতেন—অর্থাৎ সাধারণ মানুষ অপেক্ষা ভিন্নতর জীবনযাপন করতেন। এইসব বিশেষ সুযোগ-সুবিধা লাভের পরিবর্তে রাজাকে বেশ কিছু কর্তব্যও পালন করতে হত। প্রজার ধনপ্রাণ রক্ষা করাই ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় কর্তব্য। এই কর্তব্য পালনের জন্য তাঁকে যুদ্ধের মাধ্যমে শত্রুর মোকাবিলা করতে হত।

শাসনকার্য পরিচালনার জন্য রাজা নানাপ্রকার কর্মচারীর সাহায্য নিতেন। যেমন—পুরোহিত, সেনানী, গ্রামণী ইত্যাদি। কর্মচারীদের মধ্যে সবার উপরে স্থান ছিল পুরোহিতের। রাজকীয় যাগযজ্ঞ সম্পাদনের জন্য রাজা পুরোহিতদের নিযুক্ত করতেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, প্রাচীন সুমেরীয়, ব্যাবলনীয় সভ্যতায় রাজাই প্রধান পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করতেন। কিন্তু বৈদিক সভ্যতার চিত্র ছিল ভিন্ন। এখানে অন্তত প্রথমদিকের রাজার ধর্মীয় দায়িত্ব খুব বেশি কিছু ছিল না। তাছাড়া প্রথমদিকে রাজা ঈশ্বরের প্রতিনিধি ঐরূপ ধারণাও প্রচলিত ছিল না। কিন্তু ক্রমশ রাজার দৈব অধিকার তত্ত্ব প্রসারিত হতে থাকে। পুরোহিত এই মতবাদ মেনে নেন ও একে মর্যাদাদান করতে কতকগুলি বিশেষ ধরনের যাগযজ্ঞের প্রচলন করেন। এইভাবে রাজা নিজের মর্যাদা বৃদ্ধির কাজে পুরোহিতের সাহায্য নেন, অন্যদিকে পুরোহিতও রাজতন্ত্রে নিজের আসনকে অপরিহার্য ও গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। অর্থাৎ রাজা ও পুরোহিত নিজ নিজ স্বার্থে পরস্পরের উপর নির্ভরশীল হয়। পুরোহিতের অন্যান্য কর্তব্যের মধ্যে রাজাকে পরামর্শদান, প্রজাদের চিকিৎসা করা ইত্যাদিও গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, রাজা শত্রুর বিরুদ্ধে ও আত্মরক্ষার্থে যুদ্ধযাত্রা করতেন। এজন্য তাঁর সংগঠিত সেনাবাহিনী ছিল। এই সেনাবিভাগের সর্বোচ্চে ছিল সেনানী বা প্রধান সেনাপতি। সামরিক-বাহিনীতে পদাতিক, অশ্বারোহী ও রথারোহী সৈন্য উপস্থিত থাকত। এ যুগে তীর-ধনুক ছিল প্রধান যুদ্ধাস্ত্র। তাছাড়া তরবারি, বর্শা, কুঠার প্রভৃতিও অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হত। সামরিক বাদ্য ও শোভাযাত্রা-সহ যুদ্ধ করার রীতি সে যুগে প্রচলিত ছিল। নীতিগতভাবে নিরস্ত্র বা ঘুমন্ত ব্যক্তিদের আক্রমণ করা হত না। নারী, শিশু ও বৃদ্ধবৃদ্ধাদেরও যুদ্ধকালে আক্রমণ না-করার রীতি অনুসরণ করা হত, সামরিকবৃত্তিতে নিযুক্ত ব্যক্তিরা সম্ভবত অসামরিক দায়িত্বও পালন করতেন। আবার যুদ্ধক্ষেত্রেও রাজাকে পরামর্শদানের জন্য পুরোহিত উপস্থিত থাকতেন। রাজা কর্তৃক দূত ও গুপ্তচর নিয়োগের কথাও জানা যায়। এদের কাজ ছিল যথাক্রমে যোগাযোগ রক্ষা বা বার্তাবহন এবং শত্রুপক্ষের উপর নজর রাখা। রাজাকে বিচারবিভাগীয় দায়িত্বও পালন করতে হত। অপরাধের মধ্যে চুরি, ডাকাতি, গো-সম্পদ হরণ ইত্যাদিই ছিল প্রধান। বিচারকার্যে পুরোহিত ও অন্যান্য কর্মচারীরা রাজাকে সাহায্য করতেন বলে মনে হয়। অপরাধীদের ধরার দায়িত্ব ছিল উগ্র-কাপুলিদের উপর। শারীরিক আঘাতজনিত বা রক্তপাতজনিত অপরাধের শাস্তি ছিল ‘শতদার’ বা একশোটি গোরু। রাজা ছাড়াও মধ্যমাসি, গ্রাম্যবাদিন প্রমুখ বিচারকার্যে নিযুক্ত থাকতেন। এই সময়ে সম্ভবত নিয়মিত কোন কর আদায়ের ব্যবস্থা ছিল না। কেননা দানস্তুতি অনুযায়ী জমির উপর রাজার মালিকানা স্বীকৃত ছিল না। তবে ঋগ্বেদে বারবার ‘বলি’ কথাটি উল্লেখিত হয়েছে। এটি ছিল সম্ভবত একপ্রকার অনিয়মিত কর। আবার যুদ্ধে পরাজিত গোষ্ঠীগুলি বিজয়ীগোষ্ঠীর নেতাকে বাধ্যতামূলকভাবে ‘বলি’ প্রদান করত। অন্যদিকে প্রজারাও তাদের প্রতি রাজকর্তব্য পালনের বিনিময়ে স্বেচ্ছায় কর দিত। এই ছিল রাজকোষের আয়ের প্রধান উৎস।

রাজা ছিলেন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, তবে রাজারা স্বৈরাচারী বা স্বেচ্ছাচারী ছিলেন না। রাজশক্তির দ্রুত বিস্তারকে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছিল ‘সভা’ ও ‘সমিতি’ নামক দুটি উপজাতীয় পরিষদের মাধ্যমে। ‘সভার’ উল্লেখ পাওয়া যায় ঋগ্বেদের ষষ্ঠ ও অষ্টম মণ্ডলে। অনুরূপভবে প্রথম ও নবম মণ্ডলে রয়েছে সমিতির নাম। আবার সভা-সমিতি কথা দুটি একসাথেও উল্লেখিত হয়েছে। সম্ভবত সভা ছিল উপজাতীয় বয়োবৃদ্ধদের সমাবেশ এবং সমিতিতে অংশ নিত গোষ্ঠীর সমস্ত মানুষ। সভা ও সমিতির গঠনতন্ত্র সম্পর্কে স্পষ্ট ব্যাখ্যা ঋগ্বেদে নেই। অধ্যাপক লাডউইগ (Ludwig)-এর মতে, সমিতি ছিল সমগ্র জনসমষ্টির পরিষদ এবং সভা ছিল বয়স্কদের পরিষদ। অন্যদিকে জিমার (Zimmer) মনে করেন, সমিতি এবং সভা ছিল যথাক্রমে সমগ্র জনসমষ্টি এবং গ্রামগুলির পরিষদ। কে. পি. জয়শোয়ালের মতে— সমিতি ছিল ‘জাতীয় পরিষদ’ এবং সভা ছিল মনোনীত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের পরিষদ। বৈদিক সাহিত্যে ‘সভা ও সমিতি’কে প্রজাপতির ‘জমজ কন্যা’ বলা হয়েছে। গঠনতন্ত্র যাই হোক, আদি বৈদিক শাসন ব্যবস্থায় জনগণের যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল তাতে সন্দেহ নেই। রোমিলা থাপারের মতে, এমন বহু উপজাতিগোষ্ঠী ছিল, যাদের কোন রাজা ছিল না। সেক্ষেত্রে উপরিলিখিত সংস্থা দুটিই শাসনকাজ পরিচালনা করত। ঋগ্বেদে সভাকে ‘গ্রাম্যপরিষদ ও সমিতিকে ‘জনপরিষদ’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। সভার তুলনায় সমিতি আকারে ও ক্ষমতায় বড় ছিল। সমিতির অধিবেশনে রাজা উপস্থিত থাকতেন। ঋগ্বেদে সমিতির অধিবেশনে যোগদানকারী সদস্যদের ঐক্যবদ্ধতার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। তাদের সমমন, সমমন্ত্রের অধিকারী হতে বলা হয়েছে। এইসব বর্ণনা থেকে সমিতির ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। প্রথমদিকে সমিতি সর্বোচ্চ রাজনৈতিক ক্ষমতা ভোগ করত ও রাজা সমিতির নিয়ন্ত্রণাধীনে থাকতে বাধ্য হতেন। আল্টেকর (Altekar) দেখিয়েছেন যে, “সমিতির কাছে জবাবদিহি করতে করতে রাজার জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠত” (“If the Samiti assumed an obstractive attitude, the life of the king became miserable.”)। অবশ্য পরবর্তীকালে রাজা সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠেন। রাষ্ট্র পরিচালনার নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজে রাজা এই দুই সংস্থার মতামত গ্রহণ করতেন। আবার এও জানা যায়, সভার গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কার্যাদি সমাপ্ত হবার পর ঐ সভাগৃহই পারস্পরিক মেলামেশার জায়গা বা ক্লাবে পরিণত হত। তখন সেখানে সমবেত সকলে একসাথে খাদ্য-পানীয় গ্রহণ করত ও পারস্পরিক কুশল বিনিময় করত। অর্থাৎ ঋগ্বেদের যুগে (১৫০০-১০০০ খ্রিঃ পূঃ) রাজাকে নরপতি বা মহীপতি হিসেবে উপস্থাপিত করা সঠিক হবে না। রাজা ছিলেন ‘কৌমপতি’ যিনি গোষ্ঠীর লোকেদের নেতৃত্ব দেন, নিরাপত্তার পথ দেখান, যিনি যুদ্ধে লুণ্ঠিত সম্পদ কৌমের সদস্যদের মধ্যে বণ্টন করে নেন।

পরবর্তী বৈদিক যুগে (১০০০-৬০০ খ্রিঃ পূঃ) রাজনৈতিক জীবনে পরিবর্তন সূচিত হয়। এই পর্বের রাজনীতিতে সামাজিক ও বস্তুগত পরিবর্তনের প্রভাব পড়ে। এই সময় আর্যদের উপজাতীয় যাযাবর চরিত্র পাল্টে যায় এবং ভূখণ্ড ভিত্তিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা গুরুত্ব পায়। আলোচ্য সময়ে আর্যদের পূর্ব মুখী সম্প্রসারণ, পশুপালন, অর্থনীতির পরিবর্তে কৃষি-অর্থনীতির আবির্ভাব, গোষ্ঠী রাজনীতির পরিবর্তন এবং একাধিক আর্যগোষ্ঠীর সম্মিলন দ্বারা অপেক্ষাকৃত বৃহৎ রাজ্য গঠনের সুযোগ ইত্যাদি রাজার ক্ষমতাবৃদ্ধির সম্ভাবনা তৈরী করেছিল। তিনটি বেদ-সাম, যজু ও অথর্ববেদ এবং ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, উপনিষদ ইত্যাদি বৈদিক সাহিত্যের সাক্ষ্য থেকে পরবর্তী বৈদিক যুগে শক্তিশালী রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা এবং রাজনৈতিক রূপান্তরের বিবরণ পাওয়া যায়।

প্রাপ্ত বিভিন্ন সূত্র থেকে অনুমান করা হয় যে, পরবর্তী-বৈদিক যুগে উত্তর-পশ্চিম ভারত থেকে পূর্ব-ভারতের দিকে আর্যদের অগ্রগতি ঘটেছিল, ফলে গাঙ্গেয় উপত্যকা আর্য-সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আর্যদের এই ক্রম-অগ্রগতির ফলে হিমালয় থেকে বিন্ধ্য পর্বত পর্যন্ত এলাকা আর্য-সংস্কৃতিভুক্ত হয়েছিল। অবশ্য একেবারে পূর্বের বঙ্গ ও আসাম ছিল আর্য-সংস্কৃতি বহির্ভূত। এইসব স্থানে বসবাসকারী অনার্য অধিবাসীগণ সম্ভবত আরো পিছু হটে গিয়েছিল, অথবা ভাগ্যের অনিবার্য পরিণতি স্বরূপ শূদ্রের জীবনযাপনকে মেনে নিয়েছিল। আর্যদের এই অগ্রগতির ফলে যেসব নতুন রাজ্যের উদ্ভব ঘটেছিল, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল কুরু, পাঞ্চাল, কাশী, কোশল, বিদেহ প্রভৃতি। এই সময় সরস্বতী নদীর তীরবর্তী অঞ্চলকে অত্যন্ত পবিত্র বলে মনে করা হত। সরস্বতী ও গঙ্গা নদীর মধ্যবর্তী ভূখণ্ডে বহু যাগযজ্ঞের অনুষ্ঠান হত। এই সময়ে এই অঞ্চলে বসতিস্থাপনকারী আর্যদের কাছে তাদের পূর্ববর্তী বাসস্থান অর্থাৎ উত্তর-পশ্চিম ভারত গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। এমনকি পাঞ্জাব অঞ্চলকে অপবিত্র অঞ্চল বলেও অভিহিত করা হয়েছে, যেহেতু এখানে বৈদিক যাগযজ্ঞ হত না। এই ক্রম-অগ্রগতির ফলে আরো নানা পরিবর্তনের সূচনা হয়। যেমন আগের উল্লেখযোগ্য উপজাতি বা গোষ্ঠীগুলি পরস্পরের সাথে সংযুক্ত হতে থাকে। এই প্রকার সংযুক্তি বৃহৎ রাজ্যগঠনের সম্ভাবনা সৃষ্টি করে। যেমন ভরত ও পুরু গোষ্ঠীর মিলনে উদ্ভব ঘটে কুরু রাজ্যের। প্রথম এই গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে ছিল সরস্বতী ও দৃশদ্বতী নদীর মধ্যবর্তী ভূখণ্ড। কালক্রমে তারা দোয়াব ও দিল্লী অঞ্চল দখল করে নেয়। কুরু (কৌরব) রাজ্যের রাজধানী ছিল হস্তিনাপুর। পরিক্ষিৎ ও জন্মেঞ্জয়-এর আমলে কুরু রাজ্য প্রবল ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছিল। ক্রিবি ও সৃঞ্জয় গোষ্ঠী মিলিত হয়ে শক্তিশালী পাঞ্চাল উপজাতির প্রতিষ্ঠা ঘটেছিল। গঙ্গা-যমুনা দোয়াবের মধ্যবর্তী ভূখণ্ডে পাঞ্চালদের রাজ্য প্রতিষ্ঠিত ছিল। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে কুরু-পাঞ্চাল রাজ্য প্রতিষ্ঠার উল্লেখ এই দুটি অগ্রণী উপজাতি গোষ্ঠীর সম্মিলিত হওয়ার আভাষ দেয়। এদের রাজধানী ছিল কৌশাম্বী। বর্তমানের বেরেলি, বদাউন ও ফারুকাবাদ নিয়ে এটি গড়ে উঠেছিল। অথর্ববেদে মগধ রাজ্যের (দক্ষিণ বিহার) উল্লেখ আছে। যার রাজধানী ছিল অঙ্গ (পূর্ব বিহার)। সম্ভবত এটি কুরু-পাঞ্চাল গোষ্ঠী কর্তৃক বিজিত হয়েছিল। বৈদিক সাহিত্যে কোন উল্লেখ না থাকলেও সমকালীন শক্তিশালী রাজ্য হিসেবে রামায়ণ মহাকাব্যে কোশল (পূর্ব উত্তর প্রদেশ) ও বিদেহ (উত্তর বিহার) নাম দুটি পাওয়া যায়। কোশল রাজ হিসেবে রামচন্দ্র এবং বিদেহ রাজ হিসেবে রামচন্দ্রের পত্নী সীতার পিতা জানকীর নাম পাওয়া যায়। সম্ভবত অতিন্ত্রীয়বাদী মনু ছিলেন কোশল উপজাতিভুক্ত।

ঐতরের ব্রাহ্মণের কিছু বক্তব্য পরবর্তী বৈদিক যুগে রাজনৈতিক রূপান্তর তথা রাজার ক্ষমতা বৃদ্ধির সাক্ষ্য দেয়। এখানে দেবাসুরের সংঘর্ষের কথা বলা হয়েছে। এই যুদ্ধে দেবতারা প্রথমে অসুরের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। তখন তাঁরা উপলব্ধি করেন যে, একজন রাজার নেতৃত্বের অভাব (অরাজন্যতা) তাঁদের বিপর্যয়ের কারণ। অতঃপর দেবতারা তাঁদের মধ্যে বিশেষ উদ্যমী, বীর ও সুযোদ্ধা ইন্দ্রকে রাজা হিসেবে গ্রহণ করেন। অতঃপর ইন্দ্রের নেতৃত্বে দেবতারা অসুরদের পরাজিত করতে সক্ষম হন। পার্থিব প্রয়োজনবোধ থেকে এইভাবে সৃষ্ট রাজা পরবর্তী বৈদিক যুগে আরও গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তির কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। এ. বি. কীখ মনে করেন যে, পরবর্তী-বৈদিক যুগেও রাজারা নিজেদের মধ্যে সর্বদা যুদ্ধে লিপ্ত থাকতেন, তাই কখনও বৃহৎ রাজ্য গঠনের সুযোগ ছিল না। কিন্তু এমত গ্রহণ করা যায় না। কারণ ঐতরেয় ব্রাহ্মণে দেখা যায়, ঐ যুগের রাজারা বিভিন্ন রাজকীয় উপাধি গ্রহণ করতেন। পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণে ভারতের রাজারা যথাক্রমে সম্রাট, স্বরাট, বিরাট ও ভোজ অভিধা গ্রহণ করতেন। মধ্যদেশের রাজাদের অভিধা ছিল শুধুমাত্র রাজন। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে আরো বলা হয়েছে যে, সমস্ত দিকের রাজ্যই যদি কোন একজন রাজা জয় করতে সমর্থ হন তবে তিনি একরাট, বিশ্বজনীন ইত্যাদি অভিধা গ্রহণের উপযুক্ত বলে বিবেচিত হবেন। তাছাড়া, এই যুগে রাজারা রাজ্যবিস্তার ও নিজ নিজ রাজ্যকে সাম্রাজ্যে পরিণত করার উদ্দেশ্যে অশ্বমেধ, রাজসূয় প্রভৃতি যজ্ঞাদির অনুষ্ঠান করতেন। অত্যন্ত জটিল ও ব্যয়বহুল এই সকল ক্ষমতা প্রদর্শনকারী যজ্ঞ পুরোহিতরা পরিচালনা করতেন রাজার মঙ্গলার্থে। এই ধরনের যজ্ঞগুলির মধ্যে অশ্বমেধ যজ্ঞ ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এই যজ্ঞের জন্য নির্দিষ্ট অশ্বকে ছেড়ে দেওয়া হত। এক বছর সেই অশ্ব নিজের খুশিমত বিচরণ করত। একদল সেনা অশ্বকে অনুসরণ করত। ঘোড়া বিনাবাধায় যেসব ভূখণ্ড বা রাজ্য অতিক্রম করত, সেইসব রাজ্য যজ্ঞকারী রাজার অধীনে বলে পরিগণিত হত। কোন রাজা যদি অধীনতা স্বীকারে রাজী না থাকতেন তবে তিনি অশ্বকে বাধা দিতেন। সেক্ষেত্রে যুদ্ধ হত। আর বিনা বাধায় অশ্ব নিজরাজ্যে প্রত্যাবর্তন করতে পারলে তাকে হত্যা করে যজ্ঞের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হত। স্বভাবতই তৎকালীন রাজাগণ সার্থকভাবে অশ্বমেধ যজ্ঞ সম্পন্ন করার অভিলাষ পোষণ করতেন। বাজপেয় যজ্ঞ চলত সতেরো থেকে একবছর ব্যাপী। এই যজ্ঞের লক্ষ্য ছিল যজ্ঞানুষ্ঠানের মাধ্যমে রাজার শক্তি ফিরিয়ে আনা এবং রাজা থেকে সম্রাট পদে উত্তরণের পথ উন্মুক্ত করা। রাজসূয় বা রাজঅভিষেক যজ্ঞ দ্বারা অন্যান্য রাজন্যদের ওপর যজ্ঞকারী রাজার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার দাম্ভিক প্রয়াস নেওয়া হত। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে যজ্ঞানুষ্ঠানের পরিচালক রাজাকে বলা হয়েছে ‘বিশামত্তা’ অর্থাৎ যিনি বিশ বা কৌমের মানুষকে গ্রাস করেন কিংবা ‘বিশ্বস্যভূতস্য অধিপতি’ অর্থাৎ সমগ বিশ্বের এবং সমস্ত প্রাণীর প্রভু। এই সকল অভিধা রাজার ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রমাণ দেয়। কারণ ঋগ্বেদে রাজা বিশপতি বা বিশ্-এর অধিপতি অভিধাতেই সন্তুষ্ট ছিলেন। রাজাকে ‘ক্ষত্র’ শক্তির অধিকারী হিসেবে ক্ষত্রিয় বর্ণভুক্ত করার এবং বৈশ্যকে বিশ্-এর অংশ হিসেবে সামাজিক শ্রেণী বিন্যাসের ব্যবস্থা রাজক্ষমতা বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়।

পরবর্তী বৈদিক যুগে রাজার মধ্যে দৈবসত্বের (Divinity) কল্পনা রাজকীয় ক্ষমতা বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়। শপথ ব্রাহ্মণে রাজাকে সাক্ষাৎ ব্রহ্মার প্রতিনিধি বলা হয়েছে। তৈত্তেরীয় ব্রাহ্মণেও বলা হয়েছে যে, রাজপদ প্রজাপতির (ব্রহ্মা) ইচ্ছায় সৃষ্টি হয়েছে। অর্থব বেদে রাজা পরিক্ষীতকে মানুষের মধ্যে ‘দেবতা’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে। ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, স্মৃতিশাস্ত্র এবং পুরাণসমূহেও রাজার ওপর দেবত্ব আরোপের দৃষ্টান্ত আছে। মনুর ব্যাখ্যানুযায়ী সৃষ্টিকর্তা দেবকূলের গুণাবলীর সমন্বয়ে রাজার চরিত্র গড়ে তুলেছেন। ভাগবত পুরাণ গ্রন্থে বলা হয়েছে রাজার চরিত্রে দেবগুণাবলীর সমাবেশ ঘটেছে এবং অশ্বমেধ, রাজসূয় ইত্যাদি যজ্ঞানুষ্ঠানের মাধ্যমে রাজা দেবত্বের অধিকারী হতে পারেন। জে. ডব্লিউ, স্পেলম্যান-এর মতে, পরবর্তী বৈদিক যুগে রাজাকে দেবতার প্রতিভূ বলা হলেও, তাঁদের দেবত্বে উত্তরণ ঘটেছিল, এমন ধারণা জনমানসে ছিল না।

রাজার ক্ষমতা ও রাজ্যের আয়তন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধির গুরুত্ব পেয়েছিল। অন্যভাবে বলা যায় একদল কর্মীমণ্ডলীর সহায়তায় রাজ্য পরিচালনার উল্লেখ রাজ ক্ষমতা বৃদ্ধির আভাস দেয়। তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণে এদের বলা হয়েছে ‘রঙিন’। অর্থাৎ রাজার কাছে এঁরা ছিলেন রত্নের মতই মহার্ঘ। তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ গ্রন্থে উল্লিখিত রত্নিনদের অন্যতম ছিলেন পুরোহিত (ব্রাক্ষ্মণ), রাজন্য (অভিজাত), মহিষী (প্রধানা রানী), সূত্র (ঘোষক), সেনানী (সৈন্যাধ্যক্ষ), ক্ষত্রী (চঞ্চুকী), সংগ্ৰাহিত্ৰী (কোষাধ্যক্ষ), ভাগদুধ (যিনি রাজার অংশ আদায় করেন), অক্ষবাপ (জুয়াখেলার পরিচালক), গো-বিকর্তন (শিকার সঙ্গী) ইত্যাদি। অনেকের মতে ‘রত্নিন’ ধারণার মধ্যে পরবর্তীকালের মন্ত্রিসভার ধারণা সুপ্ত ছিল। প্রাদেশিক স্তরেও শাসক গোষ্ঠীর উল্লেখ পাওয়া যায়। স্থপতি ও শত্পতি এই দুই শ্রেণীর গুরুত্ব ছিল। স্থপতি ছিলেন সম্ভবত সাম্রাজ্যের প্রান্তিক অঞ্চলে উপজাতি অধ্যুষিত এলাকার শাসক। অন্যদিকে শপতি ছিলেন একশত গ্রামের শাসনভার প্রাপ্ত কর্মী। পুরোহিত রাজার ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করতেন, নাকি ক্ষমতাবৃদ্ধির সহায়ক ছিলেন, এ বিষয়ে সংশয় আছে। সম্ভবত পরবর্তী বৈদিক যুগে রাজা ও পুরোহিতের মধ্যে একধরনের সমঝোতা হয়েছিল। অথর্ববেদের একত্রে রাজাকে বলা হয়েছে ‘ব্রাহ্মণদের রক্ষক কিন্তু প্রজাভক্ষক’। রাজা পুরোহিতের কাছে নিয়ম-নীতি রক্ষার অঙ্গীকার করতে বাধ্য ছিলেন। অন্যত্র বলা হয়েছে রাজা ও পণ্ডিত (ব্রাহ্মণ) একত্রে ধর্মকে রক্ষা করেন। অধ্যাপক ঝা-এর মতে, সামাজিক মর্যাদার প্রশ্নে রাজা ও পুরোহিত শ্রেণীর মধ্যে মাঝে মাঝে বিরোধ থাকলেও এখন থেকে এরা পরস্পরের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধির সহযোগীতে পরিণত হয়েছিল। বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে বিশেষ উল্লেখ পাওয়া যায় না। সম্ভবত রাজা স্বয়ং ছিলেন সর্বোচ্চ বিচারক। অধ্যক্ষ নামক কর্মচারীদের সহায়তায় রাজা বিচার কাজ পরিচালনা করতেন। উপজাতীয় গোষ্ঠী নেতাদের ওপরেও বিচার নিষ্পত্তির দায়িত্ব অর্পিত হত। ব্রাক্ষ্মণ হত্যা, রাজার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ইত্যাদি গুরুতর অপরাধ বলে বিবেচিত হত।

উৎপাদনের ওপর শাসকের আইনগত বা ঘোষিত অধিকার শক্তিশালী রাজতন্ত্রের ইঙ্গিত দেয়। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে শাসককে বলা হয়েছে বলিহ্ৎ, অর্থাৎ যিনি বলি বা রাজস্ব হরণ করেন। ঋগ্বেদে দলপতির উদ্দেশ্যে গোষ্ঠীর সদস্যদের স্বেচ্ছা-উপহারকে বলি নামে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে বলির ওপর শাসকের দাবিকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে, যা রাজকীয় শক্তি বৃদ্ধির দৃষ্টান্ত। রোমিলা থাপারের মতে, বলি বাধ্যতামূলক হলেও, নিয়মিত আদায় করা হত না। সম্ভবত জরুরী প্রয়োজনে, বিশেষ যুদ্ধকালে প্রজাদের বলি প্রদান করতে বাধ্য করা হত।

এই যুগে রাজার ক্ষমতা বিশেষভাবে বৃদ্ধি পেলেও, রাজার উপর যে জনগণের নিয়ন্ত্রণ ছিল তারও বহু প্রমাণ পাওয়া যায়। এই যুগে রাজকীয় অধিকার গণতান্ত্রিক বাধানিষেধের অধীন ছিল। ঐতিহাসিক কোশাম্বীর মতে, রাজ-অধিকার উপজাতীয় প্রথা ও আইন দ্বারা সীমাবদ্ধ ছিল। প্রজাদের রাজা নির্বাচনের অধিকার রাজ-ক্ষমতার এই সীমাবদ্ধতাকেই সূচিত করে। অথর্ববেদের একটি স্তোত্রে বিশ অর্থাৎ জনগণের দ্বারা রাজা নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে। তাছাড়া অযোগ্য রাজাকে বিতাড়িত করার অধিকারও জনগণের ছিল। প্রমাণস্বরূপ বলা যায়, শৃঙ্খয়গণ তাদের রাজা দুষ্ট ঋতুকে সিংহাসনচ্যুত করেছিল। অর্থাৎ জনগণ রাজাকে পদচ্যুত করতে পারত। আরো জানা যায়, প্রজারা প্রয়োজন হলে রাজাকে ধ্বংসকারী বিশেষ এক ধরনের যজ্ঞানুষ্ঠান করত। তাছাড়া অথর্ববেদ ও শতপথ ব্রাক্ষ্মণ থেকে জানা যায়, ঋক্‌বৈদিক যুগের মত এ যুগেও ‘সভা’ ও ‘সমিতি’ নামক প্রতিষ্ঠান দুটির অস্তিত্ব ছিল। সভা ও সমিতিকে ‘প্রজাপতির যমজ কন্যা’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে অথর্ববেদে। শতপথ ব্রাহ্মণেও বলা হয়েছে সভা-সমিতি প্রজাপতির কাছ থেকে রাজার সম-অধিকার লাভ করেছে। যদিও অনেকের মতে, রাজক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং নতুন নতুন রাজকর্মচারী সৃষ্টি হবার ফলে এই যুগে সভা ও সমিতির প্রকৃত ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও শাসনব্যবস্থার উপর জনগণের নিয়ন্ত্রণ যথেষ্ট পরিমাণে বিদ্যমান ছিল। এ প্রসঙ্গে ‘ধর্মন’-এর উল্লেখ করা যায়। এই ‘ধর্মন’ বা পবিত্র বিধানের ব্যাখ্যাকর্তা ছিলেন একমাত্র মুনি ঋষিরাই রাজার এই অধিকার ছিল না।

ড. রামশরণ শর্মার সুচিন্তিত অভিমত হল পরবর্তী বৈদিক যুগেও শ্রেণী ও রাষ্ট্র, এই দুটি সামাজিক সংগঠন সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল না। নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রের প্রাথমিক শর্ত হল ‘বল’ বা শক্তি, যা নিয়মিত সেনাবাহিনী থেকে রাজা অর্জন করেন। বৈদিক সাহিত্যে সেনানী শব্দটির বহু ব্যবহার থাকলেও, সেকালে রাজার অধীনে স্থায়ী সেনাবাহিনী ছিল, এমন প্রমাণ নেই। ঋগ্বৈদিক যুগের পশুচারী সমাজের উপজাতীয় সেনার স্থলে পরবর্তী বৈদিক যুগে কৃষক-সেনার আবির্ভাব ঘটেছিল মাত্র। নিয়মিত সেনা পরিপোষণের জন্য প্রয়োজন ছিল সুনিশ্চিত ও স্বনির্ভর অর্থনৈতিক ভিত্তি। কিন্তু বৈদিক যুগে কোনও নিয়মিত কর ছিল না। অন্যদিকে কৃষক সেনাকে রাজার সাথে সাথে লুণ্ঠিত সম্পদের অধিকারী হতে হত, এমন তথ্য পাওয়া যায়। খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দে রচিত শতপথ ব্রাহ্মণে একজন সামরিক নেতা বা রাজাকে ‘বিশ’-এর সঙ্গে এক পাত্রে ভোজনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। অধ্যাপক শর্মার মতে, পরবর্তী বৈদিক যুগের শেষদিকে পূর্ণ রাজতন্ত্র না থাকলেও, এই সময় নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র গড়ে ওঠার পথের বাধাগুলি অনেকটাই অপসারিত হয়েছিল।

আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।

Leave a Comment