আদি-মধ্য ও মধ্যযুগে উত্তর-পূর্ব ভারতে বারকরী আন্দোলন ও বিঠোবা-উপাসনা

আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “আদি-মধ্য ও মধ্যযুগে উত্তর-পূর্ব ভারতে বারকরী আন্দোলন ও বিঠোবা-উপাসনা” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।

বারকরী আন্দোলন ও বিঠোবা-উপাসনা :

আদি-মধ্য ও মধ্যযুগে উত্তর-পূর্ব ভারতে নিম্নবর্ণের মানুষদের প্রেরণায় যেভাবে সংস্কারবাদী নবধর্ম আন্দোলন শুরু হয়েছিল, দক্ষিণ ভারতে সেরকম কোনো ব্যাপক সংস্কারমুখী আন্দোলন সংগঠিত হয়নি। দক্ষিণ ভারতে প্রচলিত বৈষ্ণব, শৈব ও শাক্ত ধর্মকে ভিত্তি করে যে সকল ধর্মসম্প্রদায় গড়ে ওঠে, তাদের কাজের মধ্যেও সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার আকুলতা লক্ষ্য করা যায়। তবে এই সকল আন্দোলনের নেতৃত্ব উচ্চবর্ণের মানুষদের নিয়ন্ত্রণে থাকার ফলে এরা কার্যত সমাজব্যবস্থার কোনো মৌলিক পরিবর্তনের ডাক দিতে পারেনি। তবে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মতো মহারাষ্ট্রেও মধ্যযুগে ভক্তিবাদী আন্দোলনের বিকাশ ঘটে।

মধ্যযুগে মহারাষ্ট্রে চারটি ভক্তিবাদী সম্প্রদায়ের উদ্ভব ও প্রতিষ্ঠা লক্ষ্য করা যায়। এগুলি হল— মহানুভব, বারকরী (Warkari), ধারকরী ও দত্তাত্রেয়। এদের উপাস্য দেবতা ছিলেন যথাক্রমে শ্রীকৃষ্ণ, বিঠল শ্রীরাম এবং দত্তাত্রেয়। বারকরী সম্প্রদায়ের প্রবক্তা ছিলেন নিবৃত্তিনাথ এবং জ্ঞানদেব (জ্ঞানেশ্বর)। পরবর্তীকালে নামদেব, তুকারাম ও একনাথের উদ্যোগে বারকরী মতবাদ জনপ্রিয়তা লাভ করে।

বারকরী আন্দোলন কর্ণাটকের দাসকূট সম্প্রদায় দ্বারা প্রভাবিত ছিল। দাসকূটদের মতোই বারকরী আন্দোলনের মূলকথা ভক্তি এবং উপাস্য দেবতা। পন্ধারপুরের বিগ্রহ বিঠুল বা বিঠু। পন্ধারপুরের ভীমা নদীর তীরে অবস্থিত বিঠোবার মন্দিরকে কেন্দ্র করে বারকরী আন্দোলন বিকাশলাভ করে। ভাণ্ডারকরের মতে, সংস্কৃত ভাষায় বিষ্ণু কানাড়ি ভাষার অপভ্রংশ হল বিঠু। অর্থাৎ‍ বিঠু হলেন বিষ্ণু। ড. ভাণ্ডারকর তার ‘Vaisnavism, Saivism and Minor Religious System’ শীর্ষক গ্রন্থে লিখেছেন যে, ত্রয়োদশ শতকে পন্ধারপুরে বিঠোবার মন্দিরকে কেন্দ্র করে মহারাষ্ট্রে বৈষ্ণবধর্ম জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। সমকালীন যাদববংশীয় দেবগিরির শাসক কৃষ্ণের একটি তাম্রশাসন থেকে জানা যায় যে, দেবগিরির সেনাপতি ১২৪৯ খ্রিস্টাব্দে একটি সামরিক অভিযানের সময় ভীমরথী নদীতীরবর্তী ‘পৌওরিকাক্ষেত্র’ নামক একটি তীর্থস্থানের নিকটস্থ একটি গ্রাম বিষ্ণু-উপাসকদের দান করেছিলেন । ১২৭০ খ্রিস্টাব্দের (১১৯২ শকাব্দ) আর একটি শিলালেখ থেকে জানা যায় যে, পন্ধারপুরের অপর নাম ছিল ‘পাণ্ডুরঙ্গ’। শিব বা রুদ্রের এক নাম ‘পাণ্ডুরঙ্গ’। লক্ষণীয় যে, পন্ধারপুরে একটি শিবমন্দিরও আছে। ঐতিহাসিকদের অনুমান ‘পৌওরিকাক্ষেত্র’ এবং ‘পন্ধারপুর’ একই স্থানের নাম। সম্ভবত বারকরী আন্দোলন জনপ্রিয় হওয়ার আগে শিব পাণ্ডুরঙ্গই ছিলেন মহারাষ্ট্রের জনপ্রিয় দেবতা। ক্রমে বিঠোবার গুরুত্ব পায় এবং শিবের গুরুত্ব হ্রাস পায়। তবে বিঠোবার মন্দির দর্শনে যাওয়ার পথে পুণ্যার্থীরা আবশ্যিকভাবে শিবের মন্দিরে পূজাপাঠে অংশ নেন। অন্য একটি মতে, মহারাষ্ট্রে বিঠল উপাসনার প্রবর্তক ছিলেন জনৈক পুণ্ডরীক। পদ্ধারপুরকে কেন্দ্র করে তিনি এই মতবাদ প্রচার করেন। তাঁর নামানুসারেই পন্ধারপুর ‘পৌওরীক’ নামেও পরিচিতি লাভ করে।

মহারাষ্ট্রে ভক্তিবাদী আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন জ্ঞানদেব (জ্ঞানেশ্বর)। তাঁর পিতামহ গোবিন্দ রাও এবং প্রপিতামহ ত্রিম্বক পন্থ ছিলেন নাথপন্থী সাধক। জ্ঞানদেবের পিতা বিঠল সন্ন্যাস নিয়েছিলেন। পরে তিনি গৃহীজীবনে প্রত্যাবর্তন করলে তাঁকে বহু সামাজিক নির্যাতন ভোগ করতে হয়। তাঁর জ্যেষ্ঠভ্রাতা নিবৃত্তিনাথ জ্ঞানদেবকে ভক্তিবাদের প্রতি আকৃষ্ট করেন। আনুমানিক ১২৯০ খ্রিস্টাব্দে জ্ঞানদেব গীতার টিকাভাষ্য ‘জ্ঞানেশ্বরী’ রচনা করেন। এ ছাড়াও তিনি ‘অমৃতানুভব’ ও ‘চাঙ্গদের প্রশস্তি নামক আরও দুটি গ্রন্থ ও ‘অভঙ্গ’ পর্যায়ভুক্ত কিছু ভক্তিমার্গী কবিতা রচনা করেন। জ্ঞানদেবের পর নামদেব (১৪ শতক), একনাথ (১৫ শতক), তুকারাম (১৬ শতক) প্রমুখ সাধক মহারাষ্ট্রে ভক্তিবাদী বারকরী আন্দোলনের প্রসার ঘটান।

‘বারকরী’ শব্দের অর্থ ‘তীর্থযাত্রার পথ’ (Pilgrim’s Path)। বারকরী সম্প্রদায়ের ভক্তরা প্রতিবছর পদ্ধারপুরে গিয়ে বিঠোবাকে দর্শন ও পুজাপাঠকে অতি পুণ্যকর্ম বলে বিবেচনা করতেন। তীর্থযাত্রার গুরুত্বকে তুলে ধরার জন্য বিঠোবার অনুগামীরা ‘বারকরী’ নামে পরিচিত হন। বারকরী আন্দোলনের মূল ভিত্তি ছিল ভক্তি। বারকরী সম্প্রদায়ের লোকেরা ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস (Existance of the other World) করেন এবং তাঁদের দৃঢ় ধারণা যে, প্রত্যেক মানুষের পক্ষেই ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করা সম্ভব। মানুষ যেমন ইন্দ্রিয়ানুভূতি দ্বারা সুখ বা দুঃখ উপলব্ধি করতে পারে, তেমনি ঐকান্তিক ভক্তি দ্বারা অধ্যাত্মচেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নিরন্তর প্রশান্তি অর্জন করতে পারে। মানুষ যখন সাধনা দ্বারা ঈশ্বর লাভ করে তখন তার মধ্যে বিষয় ও বিষয়ীর মধ্যে যে স্বাতন্ত্র্য বিরাজমান, পরমজ্ঞানীর অন্তর্লোকে একীভূত হয়ে যায়। সাধনার মাধ্যমে ঈশ্বরলাভের পথ তৈরি করে নিতে হয়। সাধনার সিদ্ধিলাভের জন্য আবশ্যিক হল পবিত্রতা অর্জন করা। নিঃস্বার্থ হয়ে আন্তরিকভাবে (Whole hearted and disinterested) ঈশ্বরকে ভালোবাসার মাধ্যমে এই পবিত্রতা অর্জন করতে হয়। সৎগুরু শিষ্যকে নিঃস্বার্থতা ও ভালোবাসার তত্ত্ব অনুধাবন করতে সাহায্য করেন। জ্ঞানদেব লিখেছেন যে, স্রষ্টা ও সৃষ্টি এক নয়। স্রষ্টা অদৃশ্য, নিরাকার, অনির্বচনীয়। কিন্তু সৃষ্টি দৃশ্যমান। স্রষ্টার ইহজাগতিক প্রকাশ। তাই স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে কোনো দুর্ভেদ্য প্রাচীর নেই। মানুষ সাধনার দ্বারা ঈশ্বর লাভ করতে পারে, কিন্তু সে কখনও ঈশ্বর হয়ে যেতে পারে না। জ্ঞানেশ্বরী’ গ্রন্থের মতে, ঈশ্বর সর্বত্রব্যাপী, অপরিমেয়, অমেয় (immeasurable), পবিত্র ও অবর্ণনীয়। তবে সাধক রামদাস ঈশ্বরের চারটি রূপের কথা বলেছেন— মূর্তি, অবতার, আত্মা ও ঈশ্বর। জ্ঞানদেবের মতে, ঈশ্বরলাভের প্রধান মার্গ হল ‘ভক্তি’। ভক্তির সাথে জ্ঞান, কর্ম, সাধনা ও আনুগত্যের সমন্বয়কালে সাধক ঈশ্বরমুখী হতে পারে। সাধনার পথ সহজ নয়। সাধককে বিষয়-বিমুক্ত হয়ে উদার মনে অবিচলিতভাবে ঈশ্বরের নাম স্মরণ করতে হবে। এজন্য কঠোর কৃচ্ছসাধন বা সন্ন্যাস গ্রহণের প্রয়োজন নেই; সাধনার জন্য নির্জন পাহাড় বা বনবাসে যাওয়ার প্রয়োজন নেই; ইন্দ্রিয়পরায়ণতামুক্ত হয়ে যে-কোনো নির্জন স্থানে সাধনা করা যেতে পারে। পরম ভক্তিসহকারে সাধক তার মান, যশ, গর্ব, লোভ, ভয়, ক্রোধ ইত্যাদি সবকিছুই ঈশ্বরের পায়ে সমর্পণ করলে পরম শান্তিলাভ করতে পারেন।

বারকরী ধর্মদর্শনে জাতিভেদ বা বর্ণভেদের কোনো স্থান নেই। উচ্চ-নীচ কোনো ভেদাভেদ এখানে স্বীকৃত নয়। এই ধর্মের প্রচারক ও অনুগামীদের অনেকেই ছিলেন সমাজের অধঃপতিত ও অবহেলিত অংশের মানুষ। নামদেব নিজেই ছিলেন একজন দরদী। বারকরী সাধকরা সামাজিক বৈষম্য থেকে মানুষকে মুক্ত থাকার শিক্ষা দেন। হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমন্বয় সাধনের পথ এঁরা প্রশস্ত করেন। জ্ঞানদেব-এর মতে, ঈশ্বর জ্ঞানই হল প্রকৃত জ্ঞান। নৈতিকতা, শুচিতা, পবিত্রতা, অহিংসা, নম্রতা ও বহুর মতে একের প্রকাশ দর্শনই হল প্রকৃত জ্ঞান। ভক্তি ও সাধনার নয় প্রকার ভক্তির কথা উল্লেখ করেছেন। এগুলি হল—শ্রবণ, নামকীর্তন, স্মরণ, পদসেবন, অর্চনা, বন্দনা, দাস্যভক্তি, সখ্য ও আত্মনিবেদন। তুকারাম কীর্তনের মাধ্যমে ঈশ্বর আরাধনার ওপর জোর দেন। একনাথ ও রামদাস অর্চনা ও বন্দনার মাধ্যমে আধ্যাত্মিক চেতনা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। একনাথ সাধকের জীবনের নানা স্তরে এই পাঁচটি রীতি অনুশীলনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন।

জ্ঞানদেব (জ্ঞানেশ্বর) বারকরী আন্দোলনের মাধ্যমে মহারাষ্ট্রে যে ভক্তিবাদের সূচনা হয়, তাকে জনপ্রিয় করে তোলেন নামদের (১২৭০-১৩৫১ খ্রিঃ)। নামদেবের জন্ম একটি দর্জি পরিবারে। প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন ডাকাত। পরে অনুতাপে দগ্ধ হয়ে তাঁর মানসিক রূপান্তর ঘটে। তিনি জ্ঞানদেবের সাথে বহুস্থান পর্যটন করেন। জ্ঞানদেবের মতো তিনিও বিঠোবার উপাসনার কথা প্রচার করেন। নিম্নবর্ণের বহু মানুষ তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে সামাজিক মর্যাদা ফিরে পান। নামদেব ঐকান্তিক ভক্তি ও প্রেমের বাণী প্রচার করে মহারাষ্ট্রে জাতি ও বর্ণের বৈষম্য ভেদ করে সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা জাগ্রত করেন।

নামদেবের মৃত্যুর প্রায় দু-শতক পরে একনাথ (১৫৩৩-১৫৯৮ খ্রিঃ) মহারাষ্ট্রে ভক্তিবাদ প্রচার করেন। তিনি ছিলেন প্রখ্যাত সাধক ভানুদাসের প্রপৌত্র। একনাথ জ্ঞানদেব লিখিত ‘জ্ঞানেশ্বরীর’ একটি নবতম সংস্করণ প্রকাশ করেন। তিনি নিজেও বহু ভক্তিগীতি রচনা করেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি নানা সময় জাতিভেদ প্রথাকে অগ্রাহ্য করে প্রচলিত সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রকাশ করেন। একবার তিনি তাঁর পূর্বপুরুষদের প্রদত্ত অন্ন অন্ত্যজ শ্রেণির পারিয়াদের ভক্ষণ করান। উপাস্য দেবতাকে উৎসর্গ করার জন্য নিয়ে আসা গোদাবরীর পবিত্র জল তৃষ্ণার্ত গর্দভকে দান করে নীরবে বিপ্লব ঘটান।

তুকারাম (১৫৯৮-১৬৫০ খ্রিঃ) ছিলেন এক সাধারণ চাষী পরিবারের সন্তান। জ্ঞানদেব, একনাথ প্রমুখের রচনাবলী পাঠ করে তিনি ভক্তিবাদের প্রতি আকৃষ্ট হন। বহু প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে তাঁর সাধকজীবন অতিবাহিত হয়। তিনি বিঠোবার উদ্দেশ্যে অনেকগুলি অভঙ্গ বা ভক্তিসংগীত রচনা করেন। মারাঠা নেতা শিবাজী তাঁর অনুগামী ছিলেন।

মহারাষ্ট্রে ভক্তিবাদের বিশিষ্ট প্রবক্তা ছিলেন রামদাস (১৬০৮-১৬৮১ খ্রিঃ)। তবে তিনি বিঠোবার উপাসক ছিলেন না। তাঁর উপাস্য দেবতা ছিলেন রাম। রামদাস প্রবর্তিত সম্প্রদায় ‘ধারকরী’ নামে পরিচিত। ড. নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের মতে, দর্শনতত্ত্বের বিচারে ধারকরী মতবাদ বারকরী মতবাদের তুলনায় অধিক যুক্তিবাদী ও বাস্তবমুখী ছিল। তিনি ‘দাসবোধ’ নামক বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভক্তিবাদ প্রচার করেন। তাঁর রচনাবলীর মধ্যে কিছু কিছু রাজনৈতিক চিন্তার আভাস পাওয়া যায়। ঈশ্বর উপলব্ধির সঙ্গে সঙ্গে তিনি জাগতিক জ্ঞানচর্চার ওপরেও জোর দেন। তাঁর রচনা ও শিক্ষা মারাঠা জাতিকে শিবাজীর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হতে এবং স্বরাজ্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ঝাঁপ দিতে অনুপ্রাণিত করে।

আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।

Leave a Comment