আমাদের অতি পরিচিত জীবনের মধ্যে যে এত জটিলতা, এত ক্রুরতা এবং শয়তানি আছে তা জগদীশ গুপ্ত নির্মোহ বাস্তবতার সঙ্গে ‘পয়োমুখম’ গল্পে বর্ণনা করেছেন। গল্পটি আলোচনা করে তা দেখাও

আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “আমাদের অতি পরিচিত জীবনের মধ্যে যে এত জটিলতা, এত ক্রুরতা এবং শয়তানি আছে তা জগদীশ গুপ্ত নির্মোহ বাস্তবতার সঙ্গে ‘পয়োমুখম’ গল্পে বর্ণনা করেছেন। গল্পটি আলোচনা করে তা দেখাও” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।

আমাদের অতি পরিচিত জীবনের মধ্যে যে এত জটিলতা, এত ক্রুরতা এবং শয়তানি আছে তা জগদীশ গুপ্ত নির্মোহ বাস্তবতার সঙ্গে ‘পয়োমুখম’ গল্পে বর্ণনা করেছেন। গল্পটি আলোচনা করে তা দেখাও

পরিচিত জগতের মধ্যেও জটিলতা, ক্রুরতা ও শয়তানি থাকে, তাকে নির্মোহ নিরাবেগ নৈপুণ্য দেখিয়েছেন। ভগবান, নৈতিকতা, ধর্ম এ সবই জগদীশ গুপ্তের কাছে মিথ্যা, এ বিশ্বের পরিচালক যদি কেউ তাকে সে নির্মম, নিষ্ঠুর শয়তান। তিনি সর্বত্রই দেখেছেন শয়তানি কার্যকলাপ এবং বিভিন্ন গল্পে একের পর এক সেই শয়তানির রূপ ফুটিয়ে তুলেছেন।

আলোচ্য ‘পয়োমুখম’ গল্পেও জগদীশ গুপ্তের এই জীবন দর্শন প্রকাশিত হয়েছে এবং পারিবারিক পরিবেশে বিরাজমান আপাত স্বাভাবিক একটি চরিত্র কৃষ্ণকান্তের ভয়ংকর শয়তানি মনোবৃত্তি ও পাশবিক নির্মমতা উদ্ঘাটিত হয়েছে।

কবিরাজ কৃষ্ণকান্ত সংসারজীবনে প্রতিষ্ঠিত, পুত্রকে জীবিকার সাহায্যের জন্য স্বয়ং তাকে শিক্ষাদান করছেন। যেহেতু আয়ুর্বেদ শাস্ত্র খাঁটি সংস্কৃতে লেখা, সেহেতু ব্যাকরণ পাঠ দিয়ে তার সংস্কৃত শিক্ষা শুরু হ’ল যদিও পুত্রে ভূতনাথ কবিরাজী শেখার জন্য ব্যাকরণ পাঠের তাৎপর্য বুঝল না। যাই হোক, আয়ুর্বেদ শাস্ত্র পড়তে পড়তেই তাকে বিবাহ করতে হ’ল। কৃষ্ণকান্ত এই বিবাহে সাতশত টাকা পণ নিলেন। পণের অঙ্কটা যথাসম্ভব বেশি তোলার জন্য তাঁর মিথ্যাভাষণে কোনও দ্বিধা দেখা গেল না। পুত্রের দর বৃদ্ধি করার জন্য সে কলকাতার জনৈক বিখ্যাত কবিরাজের প্রিয় ছাত্র বলে বৈবাহিক মহলে প্রচার করলেন। কৃষ্ণকান্ত চরিত্রের অর্থের লোভ ও নীতিহীনতা ঘটনাটিতে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয়। অথচ পুত্রের আয়ুর্বেদ শিক্ষাকে সম্পূর্ণ করবার জন্য তাঁর চেষ্টারও ত্রুটি নেই। ওষুধ প্রস্তুত করা শেখান, বিবিধ রোগবিকারে শাস্ত্রোক্ত বিবিধ ওষুধের শিক্ষা, রোগী দেখার প্রত্যক্ষ জ্ঞানে সাহায্য—এ সবই নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে কৃষ্ণকান্ত পুত্রকে করে থাকেন। তাঁর এরূপ আচরণে সামাজিক জীবনে পিতার পুত্রের প্রতি স্বাভাবিক আচরণ ও দায়িত্বই প্রকাশ পায় বলে মনে হয়, কিন্তু সমগ্র গল্পে কৃষ্ণকান্তের ঐহিক সম্পদের আকাঙ্ক্ষা এবং তা লাভ করার জন্য অমানবিক ক্রুরতা তার মনুষ্যত্বর্জিত যে রূপটি ফুটিয়ে তোলে তা থেকে বোঝা যায় পুত্রের ব্যবহারিক জীবনে সাফল্য ও অর্থাগম নিশ্চিত করবার জন্যই কৃষ্ণকান্তের এ হেন পরিশ্রম ও পুত্রকে শিক্ষা দেওয়ার সযত্ন প্রচেষ্টা। পুত্রবধূ মাত্র নয় বছরের মণিমালিকাকে ওষুধ প্রয়োগে হত্যা করতে কৃষ্ণকান্তের একটুও দ্বিধা হয় না। স্পষ্টতই একটি পরিকল্পনামাফিকই একই হত্যাকাণ্ডে তিনি অগ্রসর হন। কারণ তিনি জানেন ভূতনাথের দ্বিতীয় বিবাহে দ্বিতীয়বার পণলাভে আরও অর্থাগম হবে। আর সমস্ত পণের অর্থ হস্তগত হবে তাঁরই। এই ভয়ংকর চরিত্রটির রূপায়ণে জগদীশ গুপ্ত কোনও দীর্ঘ বর্ণনা দেননি, কোনও আবেগের প্রশ্রয় দেননি, সম্পূর্ণ নিরাবেগে মিতভাষণে ছোটো ছোটো ঘটনার মধ্য দিয়ে চরিত্রটিকে উদ্ঘাটিত করে দিয়েছেন। কৃষ্ণনাথের অন্তরে যে নির্মমতা রয়েছে, হত্যা করবার উপযুক্ত যে কঠিন স্নায়ুর তিনি অধিকারী তা আপতভাবে তাঁকে দেখে বোঝা যায় না। তাঁর অনুপস্থিতিকালে বৈবাহিকের কাছ থেকে আসা মানি অর্ডারের টাকা পুত্র ভূতনাথের হাতে পড়ায় তাঁর ভয়ংকর শয়তানি পুত্রের কাছে ধরা পড়ে যায়। তৃতীয় পুত্রবধূকে ওষুধ প্রয়োগ হত্যার যে আয়োজন তিনি করেছিলেন, তাও পুত্রের কাছে ধরা পড়ে যায় এবং পুত্রের তীব্র অভিযোগের সামনে তাঁকে নির্বাক থাকতে হয়।

কৃষ্ণনাথ তার পরিবার নিয়ে যে জীবনযাপন করে তা অত্যন্ত বাস্তব এবং স্বাভাবিক। কিন্তু জগদীশ গুপ্ত এই স্বাভাবিক সরল পারিবারিক পরিবেশেও কৃষ্ণনাথের মতো এক ভয়ংকর চরিত্রকে আবিষ্কার করেন যা স্বাভাবিক জীবনের অন্তরালবর্তী জটিলতাকে পাঠকের কাছে উদ্ঘাটিত করে দেয়।

প্রথম পুত্রবধূকে হত্যার পর কৃষ্ণকান্ত যখন পুত্রের আবার বিবাহ দিলেন তখন বললেন, স্বয়ং শিবও দুবার বিবাহ করেছিলেন। দ্বিতীয় পুত্রবধূরও জ্বর থেকে সেরে উঠে অন্নপথ্য করার পর ভেদবমি করে জীবনাবসান হল। কৃষ্ণকান্ত প্রথমজনের মৃত্যুর প্রচার করেছিলেন বৈশাখের কাঁচা আম খেয়ে তার মৃত্যু ঘটেছে, দ্বিতীয়জন রোগের ওপর জিদ্বশে গুরুপাক দ্রব্য উদরস্থ করে। তিনি প্রতিবেশীদের সামনে শোকের ভান করলেন। ভূতনাথ আবার বিবাহ করতে না চাওয়ায় কৃষ্ণকান্ত তার ওপর চাপ সৃষ্টি করবার জন্য ধিক্কার, ভর্ৎসনা, অভিযোগ, অনুযোগ এমনকি অনুনয়ের বিভিন্ন পন্থা গ্রহণ করলেন এবং তাঁর অশ্রান্ত তাড়নায় ভূতনাথ মরিয়া হয়ে আত্মসমর্পণ করল। পণ ও পাত্রী ঠিকই ছিল। এবার কন্যার বর্ণ কালো ব’লে পণ পাওয়া গেল আটশত টাকা। কৃষ্ণনাথের অনুপস্থিতিকালে বীণাপাণির পিতার কাছ থেকে মানি-অর্ডারে টাকা আসায় ভূতনাথের কাছে কৃষ্ণকান্তের সব দুষ্কর্ম ফাঁস হয়ে গেল এবং শেষ পর্যন্ত তার স্ত্রী বীণাপাণি মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেল।

আলোচ্য গল্পে লেখক যে পারিবারিক কাঠামোটি উপস্থিত করেছেন এবং পরিবারের গৃহিণী মাতঙ্গিনীর সহজ স্বাভাবিক স্নেহপ্রবণতার প্রকাশ দেখিয়েছেন তাতে মধ্যবিত্ত বাঙালি সুখী পরিবারেই একটি চিত্র পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। কিন্তু এই জাতীয় সুখী পরিবারের সহজ সানন্দ জীবনের অন্তরালে যে অনেক জটিলতা থাকে বাইরে পরিবেশ ও পরিস্থিতি দেখে যে সবকিছু বিচার করা যায় না, এই সত্যের প্রতিই যেন জগদীশ গুপ্ত ইঙ্গিত করেছেন। আপাতদৃষ্টিতে যাকে কর্তব্যপরায়ণ পিতা, দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন গৃহকর্তা এবং পরিবারের প্রতি স্নেহপোষণকারী ব্যক্তি-মানুষ বলে মনে হয়, তারই অন্তরে হয়তো লুকিয়ে থাকে এক অর্থগৃধ্ন শয়তান, লোভের দ্বারা তাড়িত ক্রূর ও নিষ্ঠুর হত্যাকারী—‘পয়োমুখম’ গল্পপাঠে পাঠকের এই উপলব্ধিই হয়।

আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।

Leave a Comment