‘আমার মন’ প্রবন্ধটির বিষয়বস্তুর পরিচয় প্রদান করো এবং এই প্রবন্ধ রচনায় লেখক যে সাহিত্য কুশলতার পরিচয় দিয়েছেন তার আলোচনা করো

আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “‘আমার মন’ প্রবন্ধটির বিষয়বস্তুর পরিচয় প্রদান করো এবং এই প্রবন্ধ রচনায় লেখক যে সাহিত্য কুশলতার পরিচয় দিয়েছেন তার আলোচনা করো” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।

‘আমার মন’ প্রবন্ধটির বিষয়বস্তুর পরিচয় প্রদান করো এবং এই প্রবন্ধ রচনায় লেখক যে সাহিত্য কুশলতার পরিচয় দিয়েছেন তার আলোচনা করো

অহিফেনসেবী কমলাকান্ত হঠাৎ আবিষ্কার করলেন যে তার মনটি চুরি হয়ে গেছে। কে তার মন চুরি করল তা স্থির করতে না পেরে হারানো মনের সন্ধানে তিনি প্রথমে রন্ধনশালায় গমন করলেন। লুচি, কোরমা-কোফতা-পলান্নের লোভে মনের সেখানে যাওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু সেখানে মনের সন্ধান মিলল না।

অতঃপর কমলাকান্তের হারানো মনের সন্ধানে গেলেন প্রসন্ন গোয়ালিনীর নিকট। প্রসন্ন গোয়ালিনীর সহিত কমলাকান্তের প্রণয় অতিশয় পুরাতন। এই প্রণয় গব্যরসাত্মক ও কাব্যরসাত্মক। কমলাকান্ত অহিফেনসেবী তাই গব্যরসের প্রতি তার আসক্তি অতিশয় তীব্র, এবং প্রসন্ন সেই আসক্তির পরিতৃপ্তির জন্য তাকে নির্জ্জলা খাঁটি দুগ্ধ জোগাত। এ ছাড়া বিনামূল্যে ক্ষীর-সর-নবনীও দিত। প্রসন্নর আরেকটা গুণ ছিল। সে অশেষ ধৈর্যসহকারে কমলাকান্তের রচনাবলি শ্রবণ করত। কিন্তু এই প্রসন্নর নিকটও কমলাকান্তের মনের সন্ধান মিলল না। অতঃপর পথে একটি সুন্দর যুবতী দর্শনে কমলাকান্তের ধারণা হল হয়তো ওই যুবতীই তার মনচোর, কিন্তু যুবতীর কটূক্তিতে তার সে ভুল ভাঙল। তখন কমলাকান্ত গভীরভাবে চিন্তা করতে বসলেন। অনেক ভেবে দেখতে পেলেন শারীরিক সুখসুবিধায়, হাস্যপরিহাসে, অধ্যয়নে কোথাও তার মন নেই। অর্থসংগ্রহে তার মন চিরদিনই উদাসীন।

এরপর অনুসন্ধান চলল আরও গুরুগম্ভীরভাবে। কমলাকান্ত চিন্তা করে দেখতে পেলেন লঘুচেতা মানুষের পক্ষে কোনো না কোনো বন্ধন আবশ্যক। মনকে এইভাবে বেঁধে রাখতে না পারলে সে সহজেই উড়ে যায়। মানুষ এ সংসারে শুধু মনকে বাঁধা দিবার জন্য আসে। মনের এই বন্ধন নিজের জন্য নয়, পরের জন্য। কমলাকান্ত চিরদিন শুধু নিজের জন্যই বিব্রত। পরের কথা চিন্তা করবার যার অবকাশ হল না, তার পক্ষে সুখান্বেষণের চেষ্টা বৃথা। ক্ষুদ্র স্বার্থকে পরার্থে বিসর্জ্জন দেওয়াই স্থায়ী সুখের উপায়। ধন-যশ-মান প্রভৃতি মানুষকে স্থায়ী সুখ দিতে পারে না। কেননা তারও আকাঙ্ক্ষার নিবৃত্তি না হয়ে তা উত্তরোত্তর বর্ধিত হতে থাকে। তার ফলেই আসে অতৃপ্তি বা অশান্তি। সুখলাভের সুনিশ্চিত উপায় অপরের সুখবন্ধন। মানুষ যে এ সত্য জেনেও ভোগসর্ব্বস্ব জীবনের প্রতি ধাবিত হয় তা তার মোহগ্রস্ত অবস্থারই পরিচায়ক। কমলাকান্তের নিশ্চিত বিশ্বাস একদিন মানুষের এই মোহাবসান ঘটবে।

প্রাচীন ভারত মানুষকে এই শিক্ষাই দিয়েছে। আড়াই হাজার বৎসর পূর্বে ভগবান বুদ্ধ মানুষের সম্মুখে এই আদর্শই তুলে ধরেছিলেন। তথাপি মানুষের মোহগ্রস্থ অবস্থা দূর হল না। আধুনিক যুগে ভারতবার্ষীয় মানুষকে এই মোহ দৃঢ়ভাবে অধিকার করে বসেছে। তার কারণ ইংরাজ-প্রস্তাব। এই প্রভাবের ফলেই আধুনিক ভারতীয় সমাজে দেখা দিয়েছে “মেটিরিয়াল প্রস্পেরিটি” বা বাহ্যসম্পদের পূজা। এই পূজা এখন প্রাচীন দেবদেবীর পূজাকেও ম্লান করে দিয়েছে। কিন্তু এই বাহ্য সম্পদপূজারিদের কাছে কমলাকান্তের প্রশ্ন— “দেশে বাণিজ্যবিস্তার, রেলওয়ে, টেলিগ্রাফ তো হইতেছে”, কিন্তু তাতে মনের শান্তি বৃদ্ধি পাইবে কি” ? তাই যদি না হল তবে ওইসব উপকরণগুলিকে জঞ্জাল ব্যতীত আর কী বলা চলে ? তথাপি সেই বাহ্যসম্পদ পূজার আয়োজন। এখন টাকাই মানুষের একমাত্র উপাস্য দেবতা—ধৰ্ম্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ, সবকিছুই লাভের উপায়। এডাম স্মিথ, মিল্ প্রভৃতি পণ্ডিতগণ যা শেখাচ্ছেন আমরা তা বেদবাক্য বলে ধরে নিচ্ছি। এই পাশ্চাত্য শিক্ষার ফলেই আমরা সবকিছুকে ইউটিলিটেরিয়ান দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করতে চাই।

কিন্তু কমলাকান্তের মনে এবিষয়ে কোনো সংশয় নেই যে এই বাহ্যসম্পদের পুজার মানুষের স্থায়ী সুখশান্তির সন্ধান মিলবে না। এ পূজা শুধু মানুষের উদরগহ্বরটির বুজাইবার কাজে লাগে । শুধুমাত্র উদরপূর্তিতে মানুষের স্থায়ী সুখের আশা দুরাশা মাত্র—অপর মানুষের প্রতি ভালোবাসার বিস্তারেই সে সুখ লভ্য। যে লোক নিজের কথা চিন্তা করতেই ব্যস্ত, অপরের কথা যার চিন্তায় স্থান পায় না, তাকে কমলাকান্তের মতো সর্ব্বস্ব হারাতে হয়—মুখলাভ তার ভাগ্যে ঘটে না। পরকে আপন করবার একটা উপায় বিবাহ। কিন্তু বিবাহিত হলেই সে গুণটি যে আয়ত্ত করা গেল, তা বলা চলে না। যে বিবাহ মনের মালিন্য দূর হয় না, চিত্তের ঔদার্য্য দেখা যায় না, অপরের প্রতি প্রীতি ভালোবাসা বিস্তৃত হয় না, সে বিবাহ প্রকৃত বিবাহ নয়।

কমলাকান্ত নামক কাল্পনিক পুরুষটি বক্তারের মধ্যে দিয়া বঙ্কিমচন্দ্রের নিজস্ব চিন্তাভাবনাই প্রকাশিত। বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্রই নিৰ্ম্মলশুভ্র হাস্যরসের প্রবর্তক। ‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এ সেই হাস্যরসের উজ্জ্বল প্রকাশ। মনে রাখতে হবে এই হাস্যরস লঘুচেতা ব্যক্তির সাধারণ হাস্যপরিহাস নয়। এতে রহস্য আছে, বিদ্রূপ আছে এবং সর্বোপরি আছে এক দার্শনিক অনুভূতির স্বাদ। হাস্যপরিহাসের মধ্যে দিয়েই জীবন ও জগৎ সম্বন্ধে অনেক সুগভীর তত্ত্ব ব্যক্ত। আফিমখোর কমলাকান্তের মেজাজের সঙ্গে একমাত্র De Quincey রচিত The Confessions of an English Opuium-eater’ এরই তুলনা চলে। কমলাকান্ত যেন নেশার ঘোরে তাঁর মনের কথা উজার করে বলেছেন। সে কথার বাহিরের রূপটি হাস্যরসাত্মক, কিন্তু ভিতরের রূপটি দর্শনাত্মক। আবার কথার অনেক স্থলে প্রকাশ পেয়েছে অপূর্ব্ব গীতিময়তা—এই সব স্থানে গদ্য রচনা হয়ে উঠেছে গানের সুরে বাঁধা গদ্য।

“কমলাকান্তের দপ্তরের ভিতর দিয়া বঙ্কিমচন্দ্রের সমগ্র ব্যক্তি পুরুষটি যেমন করিয়া আমাদের কাছে প্রত্যক্ষ হয়ে উঠে তেমন আর কোথাও নহে।…..বঙ্কিমচন্দ্রের ভিতর একটি কবিপ্রাণ ছিল, একটি চিন্তাশীল দার্শনিক ছিল, একটি অকপট স্বদেশভক্ত ছিল, আর ছিল শুভ্রোজ্জ্বল একটি হাস্যরসিক-একটি-অসহিষ্ণু বীৰ্যশালী শাসক। এই সকল সত্তা একত্রিত হইয়া জাগিয়া উঠিয়াছিল যে একটি অখণ্ড সত্তা তাহারই পরিচয় পাই কমলাকান্তের দপ্তরে।”

আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।

Leave a Comment