‘আমার মন’ প্রবন্ধে একটি গুরুতর বিষয় প্রকাশ করতে বঙ্কিমচন্দ্র কীরূপ হাস্যরসের প্রয়োগ করেছেন, তা বুঝিয়ে দাও

আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “‘আমার মন’ প্রবন্ধে একটি গুরুতর বিষয় প্রকাশ করতে বঙ্কিমচন্দ্র কীরূপ হাস্যরসের প্রয়োগ করেছেন, তা বুঝিয়ে দাও” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।

‘আমার মন’ প্রবন্ধে একটি গুরুতর বিষয় প্রকাশ করতে বঙ্কিমচন্দ্র কীরূপ হাস্যরসের প্রয়োগ করেছেন, তা বুঝিয়ে দাও

সাহিত্য জীবনের সাথে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত। বাস্তবের প্রতিফলন সাহিত্যে ঘটে। তাঁর সমস্যা ও সংগ্রাম সাহিত্যিক বিষয়ে রচনায় বিবৃত করেন, তা নিয়ে আলোচনাও করেন। সাহিত্যে সমাজজীবনের এই প্রতিফলন দু’ভাবে ঘটে—একটি হল গুরুগম্ভীর ভঙ্গিতে, অন্যটি, সহজ-সরস রীতিতে। অনেক ক্ষেত্রে উভয় রীতির মিশ্রণ থাকে। হাস্যরস, তখন, দার্শনিক বের্গসর ভাষায়, ‘সামাজিক হাতিয়ার হয়ে ওঠে।

হাস্যরসের অনেক প্রকরণ আছে। তার মধ্যে তিনটি উল্লেখযোগ্য—উইট, স্যাটায়ার, হিউমার। উইট হচ্ছে বাগ্‌বৈদগ্ধ্য। বাক্যের তির্যক ভঙ্গিতে ভাস্যরস সৃষ্টি। ‘আমার মন’ প্রবন্ধের প্রথম অংশের প্রায় সর্বত্রই এই উইট বা বাগবৈদগ্ধ্যর সমাবেশ হয়েছে। পাকশালার বর্ণনা, প্রসন্ন গোয়ালিনীয় সহিত কমলাকান্তের সম্বন্ধ নির্ণয় ইত্যাদী উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। উইটের চূড়ান্ত হচ্ছে প্রসন্ন গোয়ালিয়ার বর্ণনায়—“প্রসন্ন আছেন, এজন্য সৎ বা সতী বটে তিনি সাধু ঘোষের স্ত্রী এজন্য সাধ্বী ; এবং বিধবাবস্থাতেও পতি-ছাড়া নন, এজন্য ঘোরতর পতিব্রতা”। স্যাটায়ার হল শেষ। বিদ্রুপ ব্যঙ্গের মাধ্যমে অপরকে আঘাত দানই এর লক্ষ্য। প্রবন্ধের দ্বিতীয় অংশে এই স্যাটায়ারের প্রাধান্য। চতুর্দশ অনুচ্ছেদটি সম্পূর্ণভাবে বিদ্রূপাত্মক ; হিন্দু গৃহের পূজা-উৎসবের উপমাটিকে লেখক বাঁকাইয়া চুরির ব্যবহার করেছেন বর্তমান সভ্যতার বিভ্রান্তি বোঝাবার জন্য। হাস্যরসের চূড়ান্ত সিদ্ধি ‘হিউমার’ এ যেখানে লেখকের সংবেদনশীল চিত্ত আঘাত দিলেও ব্যথিত, যেখানে তাঁর এক চক্ষে হাসি, অন্যচক্ষে অশ্রুসজল। কমলকান্তের নিজ চরিত্র বর্ণনায়—‘পূজারি বামুনের জ্বালায় বাগানে ফুল ফুটতে পায় না আর নিন্দুকের জ্বালায় প্রসন্নের কাছে আমার মুখ ফুটতে পারে না।” আমি উভয়েরই নিকট বিনামূল্য বিক্রিত ইত্যাদি রূপ উক্তিতে হিউমারের পরিচয় প্রকাশ পেয়েছে কিন্তু শুধু এই কয়টি বাক্যে নয় সমস্ত রচনাটিই দুর্লভ হিউমারে রসে অভিষিক্ত। কান পাতলে এর হাসির আড়ালে কান্নার নিঃশব্দ সংগীত শোনা যায়।

ক্রন্দনের কারণ—’আমার মন’ আদৌ লঘু হাস্যরসাত্মক নয়, একটি গুরুতর সমস্যামূলক প্রবন্ধ। পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রভাবে স্বদেশবাসী নিজ ঐতিহ্য ও শিক্ষা ভুলেছে, বাহা সম্পদের উপসাগরে উন্মুক্ত হয়েছে। পরসুখ বিসর্জন দিয়ে স্বার্থ পরতার উন্মত্ত হয়ে উঠেছে—এই সমস্যা, এই দুঃখ কমলাকান্ত তথা বঙ্কিমচন্দ্রের চিত্তকে ব্যাকুল করে তুলেছে। তিনি বুঝেছেন, এই পথ মুক্তির ও অমৃতে সমৃদ্ধের পথ নয়, এটা মৃত্যু ও সামূহিক বিনষ্টির সূচনামাত্র। এটাই প্রবন্ধটির মূল বক্তব্য, এবং লেখকের দার্শনিক চিন্তাশীলতা প্রসূত, অথচ দুর্লভ বজ্রভঙ্গিতে রচনাটির অবয়ব আদ্যন্ত নির্মিত হয়েছে।

বক্তব্যটিকে লেখক মোটামুটি দু’ভাবে বিন্যাস্ত করেছেন। প্রথম ভাগে হাস্যরস, দ্বিতীয় ভাগে গাম্ভীর্য। একই প্রবন্ধে তথ্য ও ব্যক্তিত্বের, লঘু ও গুরুর সমন্বয়, আরও লক্ষ করলে দেখা যাবে প্রাথমিক হাস্যরসের মধ্যে ও গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য অনুস্যূত হয়ে আছে। পাকশালা অর্থে অন্ন তথা অর্থনীতি বিজ্ঞানের গোড়াকার কথাই বলা হয়েছে। আবার দ্বিতীয় ভাগের গাম্ভীর্যের মধ্যেও হাস্যরস উচ্চারিত-চতুর্দশ অনুচ্ছেদটি পুনরায় স্মরণীয়। এবং লঘু গুরু হাসি-কান্নার সংগম মুখেই ‘আমার মন’ প্রথম শ্রেণির হিউমার রচনা হয়ে উঠেছে।

আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।

Leave a Comment