আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “‘আমার মন’ রচনাটির বক্তব্য বিষয়ের পশ্চাৎপটে লেখকের ব্যক্তিত্বের যে পরিচয় ফুটেছে, তা লিপিবদ্ধ করো” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
‘আমার মন’ রচনাটির বক্তব্য বিষয়ের পশ্চাৎপটে লেখকের ব্যক্তিত্বের যে পরিচয় ফুটেছে, তা লিপিবদ্ধ করো
‘আমার মন’ প্রবন্ধটি বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ হতে সংকলিত হয়েছে। দপ্তরের রচনাগুলি প্রত্যেকে স্বতন্ত্র বিভিন্ন বিষয়ে লেখা। কিন্তু সবগুলি মিলে লেখকের একটি বৃহৎ বক্তব্য পরিস্ফুট হয়েছে। আলোচ্য রচনাটি তাঁর ব্যতিক্রম নয়।
একদা কমলাকান্তের মনে হল, তাঁর মন-সুখ নেই। পাকশালে প্রসন্ন গোয়ালিনীর গোহালে, কোথাও তাঁর শান্তি নেই। এক যুবতীর কাছে আত্মনিবেদন করতে গিয়ে প্রত্যাহৃত হয়ে ফিরে আসলেন। অবশেষে তিনি উপলব্ধি করলেন—যথার্থ সুখ আত্মদরে নেই, আছে পরার্থে জীবন দানে। তিনি এতদিন নিজের কথাই ভেবেছেন, পরের জন্য চিন্তা করেননি; তাই জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছিয়া তিনি অনুভব করলেন, তিনি নিঃসঙ্গ একক অবসন্ন। এই পর্যন্ত পৌঁছিয়া তিনি অনুভব করলেন, শুধু তিনি একা নন, সমস্ত দেশ জুড়ে আত্মসুখের চর্চা চলছে। পরস্পরকে ভালোবেসে সমাজবদ্ধ হবার আকাঙ্ক্ষা কোথাও নেই।
বস্তুত, সব দেশবাসীর এই মূঢ়তা, এই বিভ্রান্তিই বঙ্কিমচন্দ্রের প্রবন্ধের লক্ষ্যস্থল। তিনি প্রবন্ধের সূচনা করেছেন নিজের কথা বলে এবং ‘আমার মন’ নিয়েই ব্যস্ততা দেখিয়েছেন। কিন্তু লঘু আত্মকথার বিবৃতিই তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। এটা তাঁর আলোচনার সরস শুরুরেখা মাত্র। তাঁর বক্তব্য – ভারতবর্ষ চিরকাল ঐহ্যিক সুখ অপেক্ষা পারত্রিক আনন্দের কথা বলছে। কিন্তু আধুনিক য়োরোপ জ্ঞান-বিজ্ঞান বলীয়ান হয়ে পার্থিব উন্নতিকেই চূড়ান্ত সিদ্ধি বলে মেনে নিয়েছে। এই পাশ্চাত্যে সভ্যতার সংস্পর্শে এসে ভারতবর্ষ তার প্রাচীন শিক্ষা ভুলে গিয়ে অর্থের প্রতি ধাবধান হচ্ছে। বাহ্য সম্পদের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করছে। একা মৃত্যুর পথ অমৃতের পথ নয়। অমৃতলাভের জন্য মানবপ্রেম শিক্ষা ও অনুভব করতে হবে এবং পারিবারিক প্রীতির মধ্যে থেকেই এই বিশ্বপ্রেম জাগ্রত ও প্রসারিত হতে পারে।
‘আমার মন’ প্রবন্ধের বক্তব্য কমলাকান্তের মাধ্যমে বলা হয়েছে। বঙ্কিমের কল্পিত চরিত্র কমলাকান্ত—পাগল নেশাখোর, বাক্যবর্গীশ। দুনিয়ার তাবৎ বিষয়ে তাঁর প্রচণ্ড আগ্রহ, এবং সকল ক্ষেত্রেই তিনি উপদেশক। কিন্তু কমলাকান্ত একটি কাল্পনিক চরিত্র মাত্র নয়। কমলাকান্ত ভারতবর্ষের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের অন্যতম। দেশের বর্তমান সম্পর্কে যাঁরা সচেতন ও শঙ্কিত, কমলাকান্তের জবানীতে তাঁদেরই কথা ব্যক্ত হয়েছে। কখনও কখনও তিনি দেশের অগণ্য জনসাধারণের ও প্রতিনিধি হয়ে বসেন। তাঁর অসুখ—স্বদেশ বাসীরই মুখ্যভাব। অন্যদিকে কমলাকান্ত স্বয়ং লেখক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বঙ্কিম ছিলেন একেধারে সমাজ সংস্কারক ও ত্য প্রণেতা। দেশ ও দেশবাসীকে তিনি অন্তর দিয়ে ভালোবাসতেন। এবং ভালোবাসতেন বলেই তাদের দোষগুলি নিঃসঙ্কোচে তুলে ধরতেন। আশা ছিল, দোষ দর্শনে সচকিত দেশবাসী আসু সংশোধন করবে। এই উদ্দেশ্যে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর উপন্যাসে ও প্রবন্ধের এইসব বিষয় নিয়ে গম্ভীর মহাকারে আলোচনা করেছেন। এখানে সেই একই বক্তব্য প্রকাশিত হইয়াছে সরস তির্যক ভঙ্গিতে। জীবনদার্শনিক বঙ্কিমচন্দ্ৰ কমলাকান্তের মাধ্যমে দেশবাসীর সাথে একাত্মতা অনুভব করেছেন। এই কারণে বঙ্কিমের সঙ্গে কমলাকান্ত বাঙালির এতপ্রিয় লক্ষণীয় এই যে, যুক্তি মূলত সাধারণ প্রবন্ধে লেখকের ব্যক্তিত্ব ছায়াপাত করে না। কিন্তু স্বগত রচনায় ব্যক্তিত্বের মূল থেকেই যাবতীয় বক্তব্যের উদ্ভব হয়ই। স্বগত রচনার ভঙ্গি লঘু এবং ঘরোয়া। যা প্রয়শই কবিত্বময় এবং স্থানে স্থানে হাস্য। বাগ্বৈদগ্ধ প্রভৃতির প্রয়োগ সাতিশয় রমণীয়। দপ্তরের রচনা সমূহে স্বগত ভঙ্গির প্রাধান্য, সুতরাং কমলাকান্তের বা বঙ্কিমচন্দ্রের ব্যক্ত হৃদয়কে আমরা স্পর্শ করতে পারি।
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।