আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “উত্তর-পশ্চিম ভারতে আলেকজান্ডারের অভিযান ও অভিযানের ফলাফল” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
আলেকজান্ডারের আক্রমণের প্রাক্কালে উত্তর-পশ্চিম ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি :
গ্রীকরা ছিল ভারতের বিরুদ্ধে অভিযানকারী দ্বিতীয় বৈদেশিক শক্তি। ম্যাসিডনের অধিপতি গ্রীক বীর আলেকজান্ডার উত্তর-পশ্চিম ভারতের ওপর এই আক্রমণ চালান। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে গ্রীক ও পারসিকদের মধ্যে কর্তৃত্ব দখলের যে লড়াই চলেছিল, তাতে শেষ পর্যন্ত ম্যাসিডন রাজ্যের অধিপতি আলেকজান্ডার পারস্যকে পরাজিত করে এশিয়া মাইনর, ইরাক ও ইরান দখল করতে সক্ষম হন। অতঃপর তাঁর দৃষ্টি পড়ে ভারতের দিকে। ইতিমধ্যেই তিনি ভারতের অতুল বৈভব সম্পর্কে অবহিত হয়েছিলেন। একইসাথে কিংবদন্তীর দিগ্বীজয়ীদের মত তিনিও ভারত অভিযান করে বিজয়ীর গৌরব অর্জন করতে আগ্রহী ছিলেন। সর্বোপরি সেই মুহূর্তে উত্তর-পশ্চিম ভারতের রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা তাঁকে উৎসাহ জোগায়। তখন যেখানে ছিল অসংখ্য ছোট ছোট আঞ্চলিক উপজাতীয় রাজ্য। কোন কেন্দ্রীয় শক্তির অস্তিত্ব ছিল না। উপরন্তু এই রাজ্যগুলি নিরন্তর নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত থেকে প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিল। সেই সকল ক্ষুদ্র রাজ্য ও গণরাজ্যগুলির অন্যতম ছিল নিম্নোক্ত কয়েকটি—
(১) আসপাসিয় (অশ্বক) : কাবুল নদীর উত্তরে অবস্থিত এই অঞ্চলের উপজাতিরা ইরানীয় ‘অস্প’ শব্দের অনুসরণে আসপাসিয় নামে পরিচিত ছিলেন। ‘অস্প’ থেকেই সংস্কৃত ‘অশ্বক’ শব্দটি এসেছে। কাবুলের শাখানদী কুনারের উপত্যকা অঞ্চলে এদের বসবাস ছিল।
(২) আসসাকেনস: পূর্ব মুখে সিন্ধুনদের তীর পর্যন্ত এই রাজ্যটি প্রসারিত ছিল। রাজধানী ছিল মাসমাগা। আলেকজান্ডারের আক্রমণের সময় এখানে রাজত্ব করতেন আসমাকেনস। গ্রীক বিবরণ অনুসারে এই রাজ্যটি যথেষ্ট সামরিক শক্তির অধিকারী ছিল।
(৩) ট্যাক্সায়লা (তক্ষশিলা) : প্রাচীন গান্ধার রাজ্যের পূর্বাংশে এবং বর্তমান পাকিস্তানের অন্তর্গত রাওলপিণ্ডি জেলায় এই নগর রাজ্যের অবস্থান। গ্রীক বীর আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের সময় এখানকার রাজা ছিলেন ট্যাকসিলিস। সিন্ধুনদ ও ঝিলাম নদীর মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত হওয়ার তক্ষশিলার আর্থিক ও সামরিক গুরুত্ব ছিল। রাজা অম্ভির আমলে গ্রীকদের সাথে মর্যাদাহানির কর সম্পর্কের জন্য তক্ষশিলা সমালোচিত হয়।
(৪) পিউকেলাওটেস (পুষ্করাবতী) : প্রাচীন গান্ধার রাজ্যের পশ্চিম অংশ এই পুস্করাবর্তী রাজ্যের রাজধানী ছিল পেশোয়ারের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত চারসাদা। তৎকালীন শাসক ছিলেন আসটাস।
(৫) নিসা প্রজাতন্ত্র : সিন্ধুনদ ও কাবুল নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল ছোট্ট পার্বত্য রাজ্য নিসা। এখানে প্রজাতান্ত্রিক শাসন প্রচলিত ছিল। পণ্ডিতদের অনুমান যে, আলেকজান্ডারের অভিযানের আগেই গ্রীক বণিকের এই উপনিবেশটি গড়ে তুলেছিল। গ্রীক অভিযানের সময় এখানকার রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন আকাউফিস।
(৬) গুরিয়ান রাজ্য : আসপাসীয় ও আসসাকেনীয়দের মধ্যবর্তী অঞ্চলে ছিল গুরিয়ানদের অবস্থান। গুরিয়াস নদী ছিল এই রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ।
(৭) অভিসার : ভৌগোলিক দিক থেকে অভিসার রাজ্যটি ছিল কাশ্মীরের অন্তর্গত পুঞ্জ ও নওসর জেলার সমন্বয়। সম্ভবত এটিও ছিল প্রাচীন কম্বোজ রাজ্যের একটি অংশ। এখানকার শাসক আবিসারেস ছিলেন চতুর রাজনীতিক। আলেকজান্ডার কর্তৃক তক্ষশিলা অভিযানের সময় তিনি গ্রীকরাজ্যের বশ্যতা মেনে নেন। আবার পুরুরাজ আলেকজান্ডারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুললে অভিসার-রাজ পুরুর পক্ষ নেন।
(৮) বড় পুরুর রাজ্য : ঝিলাম ও চেনাব নদীর মধ্যবর্তী বর্তমান গুজরাট-এর কিছু অংশ নিয়ে পুরুর (বড়) রাজ্য গঠিত ছিল। স্ট্যাবো’র’ মতে, নদী বিধৌত হওয়ার কারণে পুরু রাজ্যটি ছিল খুবই সমৃদ্ধ। এর মধ্যে তিনশোটি শহর ছিল। ডায়োডোরাসের মতে, পুরুর পঞ্চাশ হাজার পদাতিক সেনা এবং যথেষ্ট সংখ্যক অশ্বারোহী ও হস্তি বাহিনী ছিল।
(৯) আরসাকিস : বর্তমান হাজারা জেলা নিয়ে গড়ে উঠেছিল আরসাকিস রাজ্য। এটিও ছিল প্রাচীন কম্বোজ রাজ্যের অংশ বিশেষ।
(১০) ম্যাল্লয় (মালব) : রাবি নদীর উপত্যকায় মালবদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত ছিল। পানিনি মালবগণকে ‘অস্ত্রজীবী’ বলে উল্লেখ করেছেন। কার্টিয়াস লিখেছেন যে, ক্ষুদ্রক ও মালবগণ মিলিত ভাবে নব্বই হাজার পদাতিক ও দশ হাজার সৈন্যের অধিকারী ছিল। আলেকজান্ডারের বিরুদ্ধে মালবগণ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল।
(১১) মুসিকানস : বর্তমান সিন্ধুপ্রদেশে অনেকাংশ জুড়ে এই রাজ্য স্থাপিত ছিল। এর রাজধনী ছিল শুককুর জেলার আলোর। স্ট্র্যাবো এই অঞ্চলের মানুষদের জীবনধারাকে স্পার্টানদের প্রায় অনুরূপ বলে মন্তব্য করেছেন। নিয়ারকসের মতে, মুসিকানস রাজ্যে ব্রাহ্মণ শ্রেণীর বিশেষ কর্তৃত্ব বজায় ছিল। আলেকজান্ডারের বিরুদ্ধে ব্রাহ্মণশ্রেণী একটা বিদ্রোহ গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন বলে মনে করা হয়।
এগুলি ছাড়াও অসংখ্য ছোট-বড় রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল। এদের অন্যতম হল—গ্যান্ডারিস রাজ্য, কথাই অয় রাজ্য, আড্রিয়াস্টাই, সফাইটিস, সিবি, অক্সিড্রাকয় (ক্ষুদ্রক) অম্বষ্ঠ, মাস্সানয়, প্যাটালিন, সামরস প্রভৃতি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, উত্তর-পশ্চিম ভারতে এই ব্যাপক আঞ্চলিক রাজ্যের অস্তিত্ব কেন্দ্রীকরণের সম্ভাবনা সুদূরপরাহত করেছিল। এমনকি এই রাজ্যগুলি নিজেদের মধ্যে এতটাই দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকত যে, বিদেশী আক্রমণের বিরুদ্ধে কোনরকম যৌথ প্রোতিরোধ গড়ে তোলাও এদের পক্ষে ছিল এক অলীক কল্পনা। কাটিয়াসের রচনা থেকে স্পষ্ট হয় যে, তক্ষশিলার শাসক অন্তির সাথে আবিসারেস ও বড় পুরুর সম্পর্ক ছিল স্থায়ী ভাবেই শত্রুতার। ম্যাসিডোনীয় অভিযানের সময়েও এদের মধ্যে যুদ্ধ চলছিল। আবার এ্যারিয়ান দেখিয়েছেন যে, আবিসারেস ও বড় পুরুর সাথে প্রতিবেশী স্বশাসিত উপজাতিদের সম্পর্ক মধুর ছিল না। প্রজাতান্ত্রিক ক্ষুদ্রক ও মালবদের সাথে এদের সংঘর্ষ চলত। আবার সামবস ও মুসিকানসদের মধ্যেও বৈরীতার সম্পর্ক ছিল। আলেকজান্ডার ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। ভারতীয় রাজ্যগুলি অন্তর্দ্বন্দ্বের সুযোগে তিনি ভারত বিজয়ের পরিকল্পনা করেন।
উত্তর-পশ্চিম ভারতে আলেকজান্ডারের অভিযান :
আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানকে সাধারণভাবে তাঁর প্রাচ্যদেশ বিজয়ের অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে। পারস্যের আকিমেনিয় বংশের শাসক তৃতীয় দারায়ুষকে পরাজিত করার পর (খ্রিঃপূঃ ৩৩০ অব্দ) তিনি পারস্যের পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব প্রদেশগুলি দখল করতে সক্ষম হন। অতঃপর আলেকজান্ডার আরও পূর্ব মুখে অগ্রসর হয়ে সিন্ধু পরবর্তী অঞ্চলের বিপুল সম্পদ দখল করার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। কাবুল অঞ্চলে ক্ষমতা সংহত করার কাজে তিনি প্রায় দু’বছর কাটিয়ে দেন। কাবুলের বিরূপ উপজাতি গোষ্ঠী এবং কাবুল ও সিন্ধুনদের মধ্যবর্তী অঞ্চলের শত্রু উপজাতিগুলিকে দমন করার পর তিনি সিন্ধুনদের দিকে অগ্রসর হন। ভি. এ. স্মিথ-এর মতে, আলেকজান্ডার এমন সব দুর্গম পার্বত্য উপত্যকা অতিক্রম করেছিলেন যেগুলি পরবর্তীকালে অন্য কোন ইউরোপীয় অভিযানকারী পরিদর্শন করেনি।
ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে অভিযানের প্রাক্কালে আলেকজান্ডার পশ্চাদভাগকে নিরাপদ করার উদ্যোগ নেন। এজন্য তিনি একাধিক দুর্গ-নগরী প্রতিষ্ঠা করেন। কান্দাহারে আলোকজান্দ্রিয়া নগর, হিন্দুকুশ পর্বতের পাদদেশে একই নামের আর একটি নগর প্রতিষ্ঠা করেন। আলেকজান্দ্রিয়া ও কাবুল নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে কারটানা, কাডরুমি এবং নিকিয়া নামে তিনটি নগর গড়ে তোলেন। অতঃপর কাবুল উপত্যকা থেকে তিনি দুর্গমতম খারাপ গিরিপথের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হন। খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৭ অব্দের গোড়ায় ম্যাসিডোনীয় বাহিনী ব্যাকট্রিয়া ও বোখারা জয় করে সিরদরিয়া (জ্যাকসারটেস) নদী পর্যন্ত অগ্রসর হয়। এইভাবে হিন্দুকুশ পর্বতের পূর্বভাগের পারসিক সাম্রাজ্য দখল করে নেন। অবশেষে খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৭ অব্দের মে মাসে আলেকজান্ডার ভারত সীমান্তে উপস্থিত হন।
উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত ঘেঁষা নিকিয়া ঘাঁটি থেকে আলেকজান্ডার তক্ষশিলার রাজা অস্তি ও নিকটস্থ অন্যান্য রাজন্যদের কাছে আনুগত্য দাবি করেন। তবে রাজা অন্তি আলেকজান্ডারের দূত আসার আগেই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে দূত প্রেরণ করে তাঁর বন্ধুত্ব জ্ঞাপন করেছিলেন। কার্টিয়াসের বিবরণ থেকে জানা যায় যে, আলেকজান্ডার তক্ষশিলা রাজ্য আক্রমণ করবেন না, এই শর্তে রাজা অস্তি তাঁকে আনুগত্য জ্ঞাপন ও সহায়তা দানের বার্তা পাঠান। অস্তি মিত্রতার প্রমাণ হিসেবে আলেকজান্ডারকে ৬৫টি হাতি, দশহাজার ভেড়া, তিনহাজার ষাঁড় এবং সাতশো ঘোড়া উপহার দেন। রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, এটিই ছিল ভারতের ইতিহাসে কোন শাসকের বিশ্বাসঘাতকতার প্রথম দৃষ্টান্ত। সম্ভবত রাজা পুরু এবং কিছু বিরোধী উপজাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আলোকজান্ডারের সহায়তা লাভের উদ্দেশ্যে অদ্ভি তাঁর বশ্যতা মেনে নিয়েছিলেন। যাই হোক, ভারতের ইতিহাসে অস্তির এই নির্লজ্য আত্মসমর্পণের ঘটনাটি কাপুরুষতা ও বিশ্বাসঘাতকতার দৃষ্টান্ত বলে বিবেচিত হয়। অদ্ভি ছাড়াও জনৈক পার্বত্য রাজ্যের রাজা সিসিকোটাস (শশীগুপ্ত) আলেকজান্ডারের বশ্যতা স্বীকার করেছিলেন। অবশ্য প্রথমদিকে তিনি ব্যাকট্রিয়দের সাথে হাত মিলিয়ে গ্রীক বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে প্রস্তুত হয়েছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত শক্তিশালী ম্যাসিডন রাজ্যের বশ্যতা মেনে নেন।
পশ্চাদভাগ সুরক্ষিত করার পর আলেকজান্ডার উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশের সিদ্ধান্ত নেন। এই মুহূর্তে তাঁর অধীনে ছিল ত্রিশ হাজার সেনার এক বিশাল বাহিনী। উপরন্তু তাঁর দীর্ঘ বর্শাধারী অশ্বারোহী বাহিনী ভারতীয়দের রথ ও হস্তিবাহিনীর তুলনায় অনেক বেশী গতিশীল, দক্ষ ও কার্যকরী ছিল। তবে আলেকজান্ডারকেও ভারতীয় অভিযানে যথেষ্ট বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল এবং একবার তাঁর প্রাণ সংশয়ও দেখা দেয়। ম্যাসিডোনীয় বাহিনীর অন্যতম দুর্বলতা ছিল তাদের বহুজাতিক চরিত্র। গ্রীস, পারস্য ও হিন্দুকুশের সমতল ভূমি থেকে সংগৃহীত সেনা বাহিনীর মধ্যে স্বভাবতই কোন জাতীয় ঐক্য বোধ ছিল না। ভারতের উপজাতি গোষ্ঠীগুলির অনৈক্য আলেকজান্ডারের সহায়ক হয়েছিল। তবে উপজাতি বহির্ভূত যোদ্ধারা ছিল এক স্থায়ী বিপদ। ভারতীয় দার্শনিক আলোকজান্ডারকে বিব্রত করেছিলেন বলে গ্রীক বিবরণে উল্লেখ আছে। এখানে ‘দার্শনিক শ্ৰেণী’ বলতে ব্রাহ্মণ ও নগ্নদেহী শ্রমণ ভিক্ষুদের কথা বলা হয়েছে। প্লুটার্ক-এর বিবরণ মতে এই শ্রেণী ভারতীয় যোদ্ধাদের কাছে ‘সম্ভ্রমের সাথে মৃত্যুবরণের আদর্শ প্রচার করতেন। ব্রাহ্মণদের এই মানসিকতার পরিচয় ভাগবতগীতা থেকেও জানা যায়। সেখানে বলা হয়েছে যে ব্রাহ্মণ ও পুরোহিতরা যুদ্ধের আগে সেনা বাহিনীকে এভাবেই উদ্বুদ্ধ করতেন। ডি. ডি. কোশাম্বী লিখেছেন যে, আলোকজান্ডারের সময়কালে দার্শনিক বলতে সাধু-সন্ন্যাসী নয় ব্রাহ্মণদের কথাই বলা হয়েছে। তারাই ছিল বিভিন্ন উপজাতির মধ্যেকার যোগসূত্র এবং একটি শ্রেণী, যারা উপজাতির ঊর্ধ্বে এক নতুন সমাজের কথা ভাবতে পারত। আলেকজান্ডার ভেবেছিলেন তাঁর বাহিনীর কাছে ভীত-সন্ত্রস্ত ভারতীয় রাজন্য ও জনগোষ্ঠী বিনাপ্রশ্নে বশ্যতা স্বীকার করবেন। কিন্তু বাস্তবে তাঁর অভিযান এতটা মসৃণ হয়নি এবং শেষ পর্যন্ত তা অসম্পূর্ণ রেখেই তাঁকে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
যাই হোক, আলেকজান্ডার তাঁর সেনাদলকে দু ভাগে বিভক্ত করে অগ্রসর হন। একটি দল নিয়ে তিনি স্বয়ং কুনার নদীর উজানে উত্তর-পূর্ব দিকে এগোতে থাকে। অন্য দলটি সেনাপতি হেফিস্টায়েন এবং পার্ডিকাস-এর নেতৃত্বে কাবুল নদীর দক্ষিণ তীরে ধরে অগ্রসর হয়। এদের পথ পদর্শক ছিলেন বিশ্বাসঘাতক রাজা অস্তি। এই বাহিনী খাইবার গিরিপথ অতিক্রম করে পেশোয়ারের সমতলভূমিতে পৌঁছাতে আকস্মিক বাধার সম্মুখীন হয়। গ্রীক বাহিনীকে বিস্মিত করে পুষ্কলাবতীর রাজা আসটেস্ তাদের বাধা দেন। প্রায় একমাস প্রতিরোধের পর পুষ্কলাবতী গ্রীকদের দখলে আসে। অম্ভির প্রিয়পাত্র সঞ্চয়কে এই রাজ্য দান করা হয়।
আলেকজান্ডারের নেতৃত্বে আগুয়ান অপর বাহিনীটিও উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। আসপাসীয় ও আস্সাকেনীয় উপজাতি রাজ্য গ্রীকদের বাধা দেয়। আসাপাসীয়রা আমরণ লড়াই চালান। আস্সাকেনীয়দের কাছ থেকেও তিনি প্রবল বাধা পান। গ্রীক্ বিবরণ থেকে জানা যায় যে, আস্সাকেনীয়রা ৩০ হাজার অশ্বারোহী, ৩৮ হাজার পদাতিক, ৭২ হাজার ভাড়াটে সেনা এবং ৩০টি হাতির বাহিনী নিয়ে যুদ্ধে নেমেছিল। তাদের নেতৃত্ব দেন রানীমা ক্লিওফেস। এই যুদ্ধে মহিলারাও সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন বলে উল্লেখ আছে। প্রাকৃতিক দিক থেকে সুরক্ষিত মাসসাগা নগর থেকে এদের প্রতিরোধ চালানো হয়। প্রতিবেশী রাজ্য আবিসারিস এর সাথে মিত্রতা স্থাপন করে আস্সাকেনস নিজের হাত শক্ত করেছিল। আলেকজান্ডারের পক্ষে ছিল নিসা নগররাষ্ট্র। শেষ পর্যন্ত উন্নত ম্যাসিডোনীয় যুদ্ধ পদ্ধতির কাছে ভারতের অনুন্নত যুদ্ধ পদ্ধতি হার মানতে বাধ্য হয়। যুদ্ধ শেষে আলেকজান্ডার একটি কাজের মাধ্যমে মানসিক দৈন্য ও নৃশংসতার পরিচয় দেন। পরাজিত ও আত্মসমর্পণকারী উপজাতীয় ভারতীয় সেনাদের তিনি নিজ নিজ এলাকায় ফিরে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি কথার খেলাপ করে পেছন দিক থেকে আকস্মিক আক্রমণ দ্বারা প্রায় সাত হাজার ভাড়াটে সেনাকে হত্যা করেন। কার্টিয়াস আলেকজান্ডারের এহেন আচরণকে কলঙ্কজনক বলে মন্তব্য করেছেন। সম্ভবত আলেকজান্ডার এই ভাড়াটে যুদ্ধজীবী উপজাতীয় সেনাদের হত্যা করে ভবিষ্যত প্রতিরোধের কাঁটা ছেঁটে ফেলতে চেয়েছিলেন। অতঃপর তিনি পুষ্কলাবতী ও সিন্ধুনদের মধ্যবর্তী ছোট ছোট জনপদগুলি দখল করে সেখানে একটি দূর্গ নির্মাণ করেন। এবং অনুগত রাজা শশীগুপ্তের হাতে এই অঞ্চলের শাসনভার তুলে দেন।
অতঃপর আলেকজান্ডার সিন্ধুনদ অতিক্রম করার উদ্যোগ নেন। একটি নৌ-সেতু তৈরী করে তিনি সসৈন্যে সিন্ধুনদ পার হন। এইভাবে খ্রিস্টপূর্ব ৩২৬ অব্দে আলেকজান্ডার ভারতের মাটি স্পর্শ করেন। তক্ষশিলার রাজা অম্ভি তাঁকে অভ্যর্থনা জানান। এখানে এক দরবার আয়োজন করে আলেকজান্ডার স্থানীয় রাজাদের আনুগত্য ও উপঢৌকন লাভ করেন। তক্ষশিলা অতিক্রম করে আলোকজান্ডার ঝিলাম ও চেনার নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে গড়ে ওঠা পুরুর (বড়) রাজ্য আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। আলেকজান্ডার প্রথমে পুরুকে আনুগত্য প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়ে দূত পাঠান। কিন্তু পুরু ছিলেন যথার্থ স্বাধীনচেতা, সাহসী ও আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন শাসক। তিনি ম্যাসিডোনীয় দূতকে জানিয়ে দেন যে যুদ্ধক্ষেত্রেই তাঁদের সাক্ষাৎ হবে। ক্ষুব্ধ আলেকজান্ডার ঝিলাম অতিক্রম করলে যুদ্ধ শুরু হয়। ইতিহাসে এটি ‘হিদাসপিস’-এর যুদ্ধ (খ্রিঃপূঃ ৩২৬ অব্দ) নামে পরিচিত।
এ্যারিয়ানের রচনা থেকে হিদাসপিসের যুদ্ধের বিবরণ জানা যায়। পুরু এই যুদ্ধে ৩০ হাজার পদাতিক, ৪ হাজার অশ্বারোহী, ৩০০ রথ ও ২০০টি হাতির সমন্বয়ে এক বিশাল বাহিনী নিয়োগ করেছিলেন। কিন্তু মাত্র একদিনের যুদ্ধেই পুরুর প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে। কারণ গ্রীক অশ্বারোহী বাহিনী পুরুর রথীবাহিনী বা অশ্বারোহী যোদ্ধাদের তুলনায় ছিল অনেক বেশী উন্নত। ভারতীয়দের হস্তী বাহিনীও এখানে ব্যর্থ হয়। কারণ হস্তীবাহিনীকে রণক্ষেত্রে সংগঠিত করে বিরোধীপক্ষের ক্ষিপ্ত অশ্বারোহীদের বিরুদ্ধে সম্মিলিত অভিযান চালানোর রণকৌশলগত জ্ঞান উপজাতিদের মধ্যে ছিল না। ভারতীয়দের ধনুক ছিল তুলনামুলকভাবে দীর্ঘ। এদের মাধ্যমে বহু দূরের বস্তুকে আঘাত করা সম্ভব ছিল। এমনই এক ধনুক থেকে নিক্ষিপ্ত তীর আলোকজান্ডারের বর্মভেদ করে পাঁজরে ঢুকে গিয়েছিল। ভারত অভিযানে এটিই ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় আঘাত। কিন্তু এই সময় বৃষ্টিপাতের ফলে তীরন্দাজদের নিশানা রাখা কষ্টকর হয়ে পড়ে। বৃষ্টি ভেজা তলদেশ হাতি ও তীরন্দাজ উভয়কেই অকার্যকরী করে দেয়। যাইহোক, পুরু, পরাজিত ও বন্দী হন। কিন্তু আলেকজান্ডার পুরুকে তাঁর হৃত রাজ্য ফিরিয়ে দেন।
পুরুর প্রতি আলেকজান্ডারের এই সহৃদয় ব্যবহারের পেছনে গভীর রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল। পরাজিত পুরুকে তিনি স্বরাজ্যে পুনঃপ্রতিষ্ঠার পাশাপাশি বহু ভূখণ্ডও দান করেন। প্লুটার্কের বিবরণ অনুযায়ী পাঁচ হাজার শহর ও অসংখ্য গ্রামসহ পনেরোটি প্রজাতন্ত্র আলেকজান্ডার পুরুর রাজ্যের সাথে যুক্ত করে দেন। পুরুর বীরত্ব ও সাহসিকতা গ্রীক বীরকে মুগ্ধ করেছিল। ম্যাসিডোনীয় রাজধানী থেকে সুদূর ভারতবর্ষে নিজের বিজিত ভূখণ্ডে সুশাসন কায়েম রাখার জন্য তিনি পুরুর মত দায়িত্বশীল রাজন্যদের ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। ভি. এ. স্মিথ (V. A. Smith) এর মতে, এই উদারতা দ্বারা আলেকজান্ডার ভারতে একজন বিশ্বস্ত মিত্র পেয়ে ছিলেন (“by this political generosity (he) secured for the brief period of his stay in the country a greatful and faithful friend”.)
হিদাসপিসের যুদ্ধে সাফল্যের পর আলেকজান্ডার চেনাব নদী অতিক্রম করে এগোতে চেষ্টা করেন। ইতিমধ্যে তাঁর বিজিত রাজ্যগুলিতে বিদ্রোহ দেখা দিলে তাঁর পরিকল্পনা কিছুটা বিলম্বিত হয়। থ্রেস থেকে সামরিক সাহায্য এলে পরিস্থিতি তাঁর অনুকূলে আসে। অতঃপর তিনি চেনাব নদী অতিক্রম করেন। ঐ অঞ্চলের শাসক দ্বিতীয় পুরু প্রতিরোধ গড়ার পরিবর্তে ভয়ে রাজ্য ত্যাগ করে মগধে নন্দরাজা ধননন্দের রাজ্যে আশ্রয় নেন। আলেকজান্ডার চেনাব ও রাবি নদীর মধ্যবর্তী ভূখণ্ড দখল করে পুরুর (বড়) রাজ্যের সাথে যুক্ত করে দেন। এরপর তিনি রাবি নদী অতিক্রম করেন এবং সাঙলা ধ্বংস করেন। এখানকার উপজাতীয় জনগোষ্ঠী তাঁকে প্রবল বাধা দেয় এবং পরাজিত হয়। উপজাতী রমণীরা আগুনে ঝাঁপ দিয়ে সম্ভ্রম রক্ষা করেন। আরও অগ্রসর হয়ে তিনি বিপাসা নদীর তীরে পৌঁছান এবং বিপাশা অতিক্রম করে ভারতের অভ্যন্তরে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু আকস্মিক তাঁর সেনাদলের একাংশ আর অগ্রসর হতে তীব্র অনিচ্ছা প্রকাশ করে। প্রায় সেনা বিদ্রোহের পরিস্থিতি তৈরী হলে আলেকজান্ডারও নম্রনীতি নেন।
ম্যাসিডোনীয় বাহিনীর বিদ্রোহ প্রবণতার কারণ সম্পর্কে নানা অভিমত পাওয়া যায়। সম্ভবত দীর্ঘ অভিযানে ক্লান্ত এবং গৃহছাড়া সেনারা স্বদেশ ও স্বজনের সান্নিধ্য ফিরে পেতে ব্যাকুল হয়েছিল। তাছাড়া বিপাশা নদী পর্যন্ত দখল করার ফলে আলেকজান্ডার কর্তৃক উত্তর-পশ্চিম ভারতে পারসিক সাম্রাজ্যের সম্পূর্ণ বিজয় করা সম্পূর্ণ হয়েছিল। তাই পরবর্তী অঞ্চলে এগোনোর পরিকল্পনা গ্রীক সেনাদের মনঃপূত হয়নি। আবার প্লুটার্ক আলেকজান্ডারের একটি চিঠির ভিত্তিতে বলেছেন যে, “পুরুর সঙ্গে সংঘর্ষে ম্যাসিডোনীয়দের সাহসের ধার ভোঁতা হয়ে গিয়েছিল। তাই গঙ্গানদী অতিক্রম করে বিপরীত তীরের শত্রু অধ্যুষিত অঞ্চলে এগোনোর সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করাই তারা সঙ্গত মনে করেছিল। কারণ তারা শুনেছিল যে, গঙ্গাহৃদি (গঙ্গারিডি) ও প্রায়েশিয়ান (প্রাচ্য দেশবাসী) দের রাজারা বিশাল পদাতিক, অশ্বারোহী রথী ও হস্তিবাহিনী নিয়ে ম্যাসিডোনীয়দের মোকাবিলা করতে প্রস্তুত হয়ে আছেন। এমন অনুমান সম্পূর্ণ অলীক ছিল না। সেই সময় মগধকে কেন্দ্র করে পূর্ব ভারতে কেন্দ্রীভূত ও শক্তিশালী সাম্রাজ্য গঠনের প্রক্রিয়া অনেকটাই বাস্তবায়িত হয়ে গিয়েছিল। এইভাবে ‘একজন রাজা যিনি কোন দেশ বা জাতির কাছে পরাস্ত হয়নি, তিনি নিজের লোকেদের কাছেই হার মানতে বাধ্য হন। তাঁর প্রাচ্য দেশীয় সাম্রাজ্য গঠনের স্বপ্ন ব্যর্থ হয়ে যায়।
স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের আগে আলেকজান্ডার উত্তর-পশ্চিম ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্রে কিছু পরিবর্তন ঘটান। ইতিপূর্বে সেখানে ছোট ছোট অসংখ্য রাজ্যের বা স্বাধীন জনপদের অস্তিত্ব ছিল। আলেকজান্ডার সেগুলিকে সংযুক্ত করে তিনটি বৃহৎ রাজ্য গঠন করেছেন। ঝিলাম থেকে বিপাশা নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলের ওপর পুরুর অধিকার বলবৎ থাকে। পনেরোটি প্রজাতন্ত্রের ওপর পুরুর অধিকার বলবৎ থাকে। পনেরোটি প্রজাতেন্ত্রর সমন্বয়ে গঠিত এটিই ছিল বৃহত্তম রাজ্য (Satrapy) এবং ভারতীয় শাসকের অধীন। ঝিলাম নদীর পশ্চিম পার্শ্বের শাসন ভার পান অস্তি। কাশ্মীরের শাসনভার পান আবিসারেস। আলেকজান্ডারের সহায়তায় তিনি হাজারা (আরসাকেস) সহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলিকে দখন করতে সক্ষম হন।
প্রত্যাবর্তনের পথেও আলেকজান্ডার একাধিক প্রতিরোধের সম্মুখীন হন। ঝিলাম ও চেনাব নদীর সঙ্গমস্থলে তাঁকে মালব ও ক্ষুদ্রকদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয়। শিবি ও আগালাময় উপজাতি গোষ্ঠীকে তিনি পরাজিত করেন। মুসিকানস অঞ্চলের দার্শনিক শ্রেণী (ব্রাহ্মণগণ) তাঁর গতিরোধের চেষ্টা করেন এবং পরাজিত হন। এইভাবে তিনি পাটালাতে পৌঁছান। পাটালার শাসক তাঁর বশ্যতা মেনে নেন। আলেকজান্ডার সেখানে একটি নৌ-কেন্দ্র গড়ে তোলেন। এখান থেকে তিনি তাঁর বাহিনীকে তিনটি স্বতন্ত্র পথে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের নির্দেশ দেন। ক্রাটেরোস-এর নেতৃত্বে একটি দল স্থলপথে অগ্রসর হয়। অ্যাডমিরাল নিয়ারকসের নেতৃত্বে জলপথে পারস্য উপসাগর ধরে আর একটি দল যাত্রা শুরু করে। আলেকজান্ডার স্বয়ং অবশিষ্ট সেনাদের নিয়ে বালুচিস্তানের মধ্য. দিয়ে ব্যাবিলনে পৌঁছান। ব্যবিলনের সন্নিকটে বর্তমান বাগদাদে তাঁর জীবনাবসান ঘটে (খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৩ অব্দে)।
উত্তর-পশ্চিম ভারতে আলেকজান্ডারের অভিযানের ফলাফল :
তাৎক্ষণিকভাবে আলেকজান্ডারের ভারত-অভিযানের (খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৭-৩২৫ অব্দ) উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক বা সামরিক প্রভাব ছিল না। ভিনসেন্ট স্মিথ (V. A. Smith) আলেকজান্ডারের অভিযানকে ম্যাসিডোনীয় সেনাবাহিনীর চূড়ান্ত সাফল্য এবং ভারতীয়দের রাজনৈতিক ও সামরিক পশ্চাদপদতা ও ব্যর্থতার নিদর্শন বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি আলেকজান্ডারের বিজয় রথের সামনে ভারতীয় সেনাবাহিনীর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ এবং ভারতীয় রাজন্যবর্গের অনৈক্য ও মানসিক দৈন্যের ছবি তুলে ধরেছেন। স্মিথের মতে, বিদেশী আক্রমণ থেকে ভারতীয় রাজনীতিকরা কোন শিক্ষা নেয়নি। ভারতীয়রা অপরিবর্তিত থেকে যায়। যুদ্ধের ক্ষত শীঘ্রই ভারত বিস্মৃত হয়। ভারতের গ্রীককরণ ঘটেনি (Indian remained unchanged. The wounds of battle were quickly healed. India was not Hellenized”.) ভারতীয় রাজনীতিতে আগের মতই চমৎকার বিচ্ছিন্নতা (Splendid Isolation)-এর রীতি বজায় থাকে। এমনকি কোন ভারতীয় লেখক হিন্দু, বৌদ্ধ বা জৈন কেউই আলেকজান্ডার বা তাঁর কার্যাবলী সম্পর্কে সামান্যতম উল্লেখ করেন নি। ঐতিহাসিক রাধাকুমুদ মুখার্জীও আলেকজান্ডারের অভিযানকে গুরুত্বহীন একটি ঘটনা বলে মনে করেন। তাঁর মতে আলেকজান্ডারের অভিযানের ফলে পাঞ্জাবে কোন ম্যাসিডোনীয় শাসনের সূচনা হয়নি। ভারতের সাহিত্য-সংস্কৃতি, জীবনধারা বা শাসনরীতির ওপরেও এর কোন স্থায়ী প্রভাব পড়েনি। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য কর্তৃক পাঙ্খাব দখল হবার পর, আলেকজান্ডারের নামটুকুও মুছে গিয়েছিল। গ্রীস দেশও এই অভিযান থেকে তেমন লাভবান হয়নি। ভারতে আলেকজান্ডারের অবস্থান ছিল খুবই সীমিত। তাছাড়া কেবল যুদ্ধ, হত্যাকান্ড ও রক্তপাতের মাঝেই তাঁর সময় কেটেছিল। ফলে এদেশ থেকে সাহিত্য-শিল্প-দর্শনের রস সংগ্রহ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। সুতরাং ভারত ও গ্রীস উভয়ের দিক থেকেই এই অভিযানকে গুরুত্বহীন বা নিষ্ফলা বলা যায়।
তাৎক্ষণিক ভাবে নিষ্ফলা মনে হলেও আলেকজান্ডারের অভিযানের দূরবর্তী ফলাফলগুলি গুরুত্বহীন ছিল না। আলেকজান্ডারের অভিযান ও অবস্থান ভারতে স্বল্পকালীন হলেও ভারতের ভবিষ্যত আর্থ-রাজনৈতিক জীবনে এর বিশেষ প্রভাব ছিল। ম্যাসিডোনীয় আক্রমণের প্রাক্কালে উত্তর-পশ্চিম ভারতে অসংখ্য ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের অস্তিত ছিল। রাজনৈতিক ঐক্যের পথে এই সকল উপজাতীয় স্বাধীন রাষ্ট্রসংঘের অস্তিত্ব ছিল বড় বাধা। আলেকজান্ডার এদের পরাজিত করে আঞ্চলিক বা বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্র ব্যবস্থার দুর্বলতা তুলে ধরেন। উপরন্তু তিনি পুরু, অন্তি ও আবিসারেসের অধীনে তিনটি বৃহদাকার রাষ্ট্রগঠন করে ভবিষ্যতে বৃহত্তর সাম্রাজ্য গঠনের পথ পরিষ্কার করে দেন। পরবর্তীকালে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য কর্তৃক এই রাজ্যগুলিকে মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করার পশ্চাদপটে ম্যাসিডোনীয় অভিযানের প্রভাব অস্বীকার করা যায় না।
গ্রীক সেনাবাহিনী গ্রীস থেকে পশ্চিম-এশিয়া ও ইরানের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিল। এইভাবে কিছু বাণিজ্যপথ সৃষ্টি হয় এবং পুরানো পথগুলিও পুনরুজ্জীবিত হতে পারে। ভি. স্মিথ-এর মতে, আলেকজান্ডার প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে যোগসূত্র গড়ে তোলেন। ইউরোপের সাথে প্রাচ্যের যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে এই অভিযানের সূত্রে কাবুল, বালুচিস্তানের মুল্লা গিরিপথ ও মাকরানের মধ্য দিয়ে তিনটি স্থল পথ এবং নিয়ারকস্ মাকরান উপকূল ধরে পারস্য উপসাগরে মধ্য দিয়ে একটি জলপথ আবিষ্কার করেন। রোমিলা থাপার মনে করেন যে, এই সব বাণিজ্য পথের সাহায্যে এবং ভারতের গ্রীক অধিবাসীদের আগ্রহে পূর্ব ও পশ্চিম বিশ্বের মধ্যে বাণিজ্য প্রসারিত হয়েছিল। অবশ্য হ্যাভেল (Havell) মনে করেন যে, আলেকজান্ডারের অভিযান কোন নতুন পথের সন্ধান দেয়নি। ইতিপূর্বেই পারসিকরা এই সকল পথ ধরে ভারতে প্রবেশ করেছিল। হ্যাভেলের মন্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। বস্তুত আলেকজান্ডারের অভিযানের পরেই এই সকল পথ ধরে বাণিজ্যিক লেনদেনের আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছিল।
আলেকজান্ডার এই অভিযানে কেবল সেনাবাহিনী নিয়ে আসেন নি। তাঁর সাথে এ্যারিস্টোবুলাস, ওনেসিক্রিটাস, নিয়ারকস্ প্রমুখ গ্রীক লেখকগণ ভারতে এসে ছিলেন। গ্রীক লেখকদের বিররণ থেকেই আমরা এই অভিযানের বিবরণ জানতে পারি। গ্রীক ঐতিহাসিকদের হাত ধরে ভারতের লিখিত ইতিহাসের সূচনা হয়। গ্রীক লেখকদের বিবরণ থেকে এদেশের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কিত চর্চা গুরুত্ব পায়। ভারতের কালানুক্রমিক ইতিহাস রচনার কাজও আলেকজান্ডারের অভিযানের সময় থেকে শুরু হয়। সমকালীন ভারতের সমাজ ও অর্থনীতি সম্পর্কে গ্রীক্দের বিবরণ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয়। গ্রীক তথ্য থেকেই দরিদ্র পরিবারের কন্যা সন্তান বিক্রয় এবং উত্তর-পশ্চিম ভারতে উন্নত গো-প্রজননের কথা জানা যায়। প্রাচীন ভারতে সতীদাহ প্রথার অস্তিত্ব ছিল বলেও গ্রীকরা উল্লেখ করেছেন। ভারতীয় কারুশিল্পীদের বিপুল দক্ষতার এঁরা প্রশংসা করেছেন।
আলেকজান্ডারের আক্রমণের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ফল ছিল উত্তর-পশ্চিম অংশে একাধিক উপনিবেশের প্রতিষ্ঠা। আলেকজান্দ্রিয়া, বুকিফালা, নিকিয়া ইত্যাদি গ্রিক (যবন) উপনিবেশগুলি গ্রীক ও ভারতীয় সংস্কৃতির আদান প্রদানের মাধ্যম হিসেবে কাজ করত। মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠার পরেও উপনিবেশগুলির অস্তিত্ব ও সক্রিয়তা ছিল। কারণ মৌর্য শাসকরা এই উপনিবেশগুলির সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক গুরুত্ব উপলব্ধি করতে ভুল করেন নি। ভারতীয় শিল্প-স্থাপত্য, ধর্ম, দর্শন ইত্যাদি ক্ষেত্রে এই অভিযানের প্রভাব দেখা যায়। গান্ধার শিল্পের ওপর গ্রীক ভাস্কর্যের প্রভাব অনস্বীকার্য। গ্রীকদের কাছ থেকেই মহাযান বৌদ্ধধর্মে বুদ্ধের মূর্তি নির্মাণের প্রেরণা এসেছিল। ভারতীয়রা গ্রীকদের কাছ থেকে মুদ্রা, জ্যোতিবিজ্ঞান বিষয়েও নিজেদের জ্ঞান সমৃদ্ধ করতে পেরেছিল। অন্যদিকে গ্রীকরাও ভারতের কাছ থেকে দর্শন, গণিতশাস্ত্র, ভেষজবিদ্যা বিষয়ে অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছিল। গ্রীকদের মাধ্যমে ভারতীয় ধ্যান ধারণা রোম সহ ইউরোপের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়তে পারে।
কেউ কেউ মনে করেন যে, এই সকল প্রভাবের কৃতিত্ব আলেকজান্ডারের অভিযানের পরিণতি নয়। এজন্য পরবর্তীকালের ইন্দো-পার্থিয় এবং ইন্দো ব্যাকট্রিয় উপনিবেশগুলির অবদান বেশী। কিন্তু মনে রাখার দরকার যে, পরবর্তীকালে উত্তর-পশ্চিম ভারতে ব্যাকট্রিয় গ্রীকদের উপস্থিতি আলোকজান্ডারের অভিযানেরই অন্যতম পরোক্ষ ফল। আলেকজান্ডার পারসিক অধিকারের অবসান ঘটিয়ে গ্রীক সংস্কৃতি ও রাজনীতিকে ভারতের সন্নিকটে এনে দিয়েছিলেন—একথা অস্বীকার করা যায় না। বস্তুত আলেকজান্ডারের অভিযান ভারতের সমাজ, রাজনীত সংস্কৃতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিল, কিংবা ম্যাসিডোনীয় অভিযানের প্রভাব ছিল শূন্য—এই দুটি চরম প্রতিক্রিয়ার মাঝামাঝিই প্রকৃত সত্য খুঁজে পাওয়া সম্ভব।
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।