আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “‘একরাত্রি’ গল্পে গীতিপ্রাণতা বা লিরিকধর্ম কতটা প্রকাশিত আলোচনা করো” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
‘একরাত্রি’ গল্পে গীতিপ্রাণতা বা লিরিকধর্ম কতটা প্রকাশিত আলোচনা করো
রবীন্দ্রনাথের ‘গল্পগুচ্ছের’ প্রথম পর্যায়ের গল্প ‘একরাত্রি’। রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্পের স্বর্ণযুগ হল এই প্রথম পর্যায়ের গল্পসমূহ। ‘একরাত্রি’ গল্পটি একটি সমাজ-সমস্যামূলক গল্প। দেশে তখন অরাজকতা, শাসনের নামে শোষণের বঞ্চনা দেশকে গ্রাস করে ফেলেছে। এমতাবস্থায় রবীন্দ্রনাথ ইহাকে গল্পের পটভূমি করে একটি সুন্দর গল্প রচনা করলেন। ‘একরাত্রি’ একটি অপূর্ব সৃষ্টি, প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত একটি সুগীত সঙ্গীতের মতো ধ্বনিও হইয়াছে। লিরিক বা গীতিকবিতার অপরিহার্যতম গুণ হইতেছে রচনার উপর লেখকের ব্যক্তিত্বের প্রক্ষেপ। অন্য শ্রেণির রচনাতেও লেখকের ব্যক্তিত্ব ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় প্রক্ষিপ্ত হইতে পারে, কিন্তু রচনার পক্ষে তারা অবশ্যম্ভাবী নয়, বরঞ্চ অনেক সময়েই দোষের কারণ। কিন্তু গীতিকাব্যে ইহা অত্যাবশ্যক মাত্র নয়। উহাই গীতিকাব্যের প্রাণ। অন্যান্য লেখক নিজেই গীতিকাব্যের মধ্যে ঢুকিয়া প্রাণস্বরূপ বিরাজ করেন। এখানে সৃষ্টি ও স্রষ্টা এক। ইহাই গীতিকবিতার অপরিহার্যতম গুণ।
গীতিকবিতার প্রধান লক্ষণগুলি সুস্পষ্ট ভাবে ব্যক্ত করিলে ব্যাপারটি আরও সহজবোধ্য হইবে—
- (১) গীতিকবিতা কবির একান্ত ব্যক্তিগতকথা।
- (২) গীতিকবিতায় কবি ও পাঠক একত্র অবস্থান করে। উভয়ের রসসংযোগেই গীতিকবিতার সৌন্দর্য। এদিক থেকে গীতিকবিতা ও ছোটোগল্প যমজ-ভাই এর মতো।
- (৩) গীতিকবিতায় কবির একান্ত ব্যক্তিক অনুভূতি ও উপলব্ধি হলেও এতে থাকে এক শাশ্বত ও সার্বজনীন আবেদন।।
- (৪) গীতিকবিতার প্রকাশ হবে সাবলীল, ব্যঞ্জনাময় ও সংহত।
উপরিউক্ত বৈশিষ্ট্যগুলির নিরিখে আমরা রবীন্দ্রনাথের ‘একরাত্রি’ গল্পের গীতিপ্রাণতা বা লিরিক ধর্মীতা বিচার করব।
‘একরাত্রি’ গল্পে একটা বক্তব্য আছে যে বক্তব্য সংসারিক বা সামাজিক প্রেক্ষিতে আবদ্ধ নয়। কোনো তত্ত্বকথার হাল বিস্তারও করেননি। কোনও চরিত্রচিত্রনের প্রকাশত এই গল্পে একেবারেই গৌণ। কাহিনির প্রথমাংশে কাহিনির বিস্তার ঘটলেও ; গল্পের প্রয়োজনে এতে কিছু কিছু ঘটনার বিন্যাস ঘটলেও কাহিনির পরিমাণ ঘটনাগত নয়, ভাবগত। অবান্তর ভাব ও ঘটনার শাখা-প্রশাখা না থাকায় গল্পগুলি প্রথম শেষ পর্যন্ত একটি সুগীত সঙ্গীতের মতো ধ্বনিত হইয়াছে। ‘একরাত্রি’ গল্পে বর্ষণমুখর ঝড়ের রাতের নিসর্গ বর্ণনায় গল্পটির আবহ রচনায় লেখক অসাধারণ নৈপুণ্য ও সংযমের পরিচয় দিয়েছেন। একরাত্রির নায়কের দুঃখ বর্ণনাতেই গল্পের আরম্ভ ও শেষ— ওই দুঃখ বর্ণনার ছলেই নায়কের জবানীতে অর্থাৎ উত্তমপুরুষে কাহিনি বিবৃত হইয়াছে। যদিও গল্পের প্রথমাংশ প্রধানত বর্ণনানির্ভর।
আলোচ্য গল্পটিতে বহিরঙ্গগত আয়োজন ছিল, একেবারে গল্পের নায়ক ও নায়িকার বাল্যবয়সে থেকে সে কাহিনির বিস্তারও ঘটেছিল। নায়ক-নায়িকার দুজনে বাল্য ও কৈশোরে বউ বউ খেলা। এর মধ্যেই লেখাপড়া শিখে আদালতের লজির বা হেডক্লার্ক হওয়ার উচ্চাশা নায়ককে নিয়ে এল কলকাতায়। কলকাতায় এসে তার জীবনের ধারা বদল ঘটল। ‘ম্যাৎসিনী’ ও ‘গ্যারিবল্ডী’ হওয়ার নেশা তাকে পেয়ে বসল। পড়াশোনার সঙ্গে দেশের কাজে প্রাণমন সমর্পণ করল সে।
এরমধ্যে গল্পের নায়ক সুরবালার জীবন থেকে শতমোহন দূরে সরে এসেছে। তাদের দুজনের বিয়ের ব্যবস্থা যখন পাকা তখন নায়ক অনিচ্ছায় এই সম্বন্ধ ভেঙে দিল, নেমে এল নিরাশার বাঁধ ভাঙা জলোচ্ছাস। সুরবালার শেষ পর্যন্ত অন্যত্র বিয়ে এল। এনট্রান্স ও এফ. এ পাস করার পর হঠাৎ পিতৃবিয়োগের ফলে বিধবা মাতা ও দুই ভগ্নীর দায়িত্ব এসে পড়ল কাঁধে। পড়াশোনা ছেড়ে নোয়াখালি অঞ্চলে একটা স্কুলের সেকেন্ড মাস্টারের চাকরি জোটালো। এই হল গল্পের মূল কাহিনি।
স্কুলের সেকেন্ড মাস্টারের পদে চাকরি করার সূত্রে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটল সুরবালার। তবে সে সুরবালা আর আগের মতো নায়কের কল্পিত সুরবালা নয়, এ-সুরবালা বধূবেশে আবির্ভূত। সরকারি উকিল রামলোচন রায়ের স্ত্রী। একদিন দেশের দূরবস্থা প্রসঙ্গে রামলোচনবাবুর বাসায় হাজির হলে সে দেখল—“…….বিশ্বাস সরলতা এবং শৈশবপ্রীতিতে চলচল দুখানি বড়ো বড়ো চোখ, কালো কালো তারা, ঘনকৃষ্ণ পল্লব, স্থিরস্নিগ্ধ দৃষ্টি। সহসা হৃৎপিণ্ডকে কে যেন একটা কঠিন মুষ্টির দ্বারা চাপিয়া ধরিল এবং বেদনায় ভিতরটা টনটন করিয়া উঠিল”।
অপ্রাপনীয়ের যন্ত্রণার সেই হল আরম্ভ, গ্রামের একান্তে মাস্টারি জীবনের নিঃসঙ্গতা উদাস প্রকৃতি, দুপুরের ঝাঁ ঝাঁ রোদ, ঈষৎ উত্তপ্ত বাতাসে নিম-মঞ্জরির সুগন্ধ, সুপারি নারিকেলের অর্থহীন মর্মরধ্বনি—সবকিছু মিলেমিশে মনের এই একাকিত্বের যন্ত্রণাকে আরও বাড়িয়ে তুলল। মনের ভিতর কে বলিল,—“তখন যাহাকে ইচ্ছা করিলেই পাইতে পারিতে এখন মাথা খুঁড়িয়া মরিলেও তাহাকে একবার চক্ষে দেখিবার অধিকারটুকুও পাইবে না”।
তারপর এল সেই ‘একরাত্রি’। স্কুলের চালাঘরে নায়ক একা। রামলোচনের বাড়িতে সুরবালাও একা। বাইরে প্রবল বর্ষণ, নায়কের অস্থিরতা এগিয়ে নিয়ে চলল সুরবালার বাড়ির দিকে, কিন্তু না ওই পর্যন্তই। মাঝরাস্তায় দণ্ডায়মান, মাঝখানে এক বড়ো পুষ্করিণীর ব্যবধান। মহা দুর্যোগের ঘনরাত্রে প্রাণ বাঁচাতে স্কুলের লাগোয়া ঘর ছেড়ে পুকুরের দশ-বারো হাত উঁচু পাড়ের ওপর আশ্রয় নিল মাস্টার। আর ঠিক তখনই অপর পাড় হতে উঠে এল আর এক মানুষ। বলাবাহুল্য নায়ক উপলব্ধি করল সে আর কেউ নয়, স্বয়ং সুরবালা। নায়কের উপলব্ধিতে ফুটে উঠল—“আর সমস্ত জলমগ্ন হইয়া গেছে, কেবল হাত-পাঁচ ছয় দ্বীপের উপর আমরা দুটি প্রাণী আসিয়া দাঁড়াইলাম।” বললে অনেক কিছুই বলতে পারত দুজনে, কিন্তু দুজনে যেন পরস্পর কী এক শক্তির টানে বাকরুদ্ধ হইয়া গেল। “কেবল দুইজনে অন্ধকারের দিকে চাহিয়া রহিলাম। পদতলে গাঢ় কৃষ্ণবর্ণ উন্মত্ত মৃত্যুস্রোত গর্জন করিয়া ছুটিয়া চলিল।” বাল্যকালে কোনো এক সময়ে দুজনে এইভাবে মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল। আজ আবার দুর্যোগের ভয়ংকর রাতে দুজনেই আবার যেন একটা বিন্দুতে এসে পরস্পরের মুখোমুখি, “এখন কেবল আর একটা ঢেউ আসিলেই পৃথিবীর এই প্রান্তটুকু হইতে, বিচ্ছেদের এই বৃত্তটুকু হইতে, খসিয়া আমরা দুজনে এক হইয়া যাই।”
কিন্তু না। সে মিলন-কামনা কাম্য নয়। কামনা-বাসনা নিয়ে প্রবল প্রহবমান জলস্রোতে ঘেরা ছোট্ট দ্বীপে দাঁড়িয়েও সঙ্গলিপ্সা আসঙ্গলিপ্সায় আবর্তিত হতে গিয়েই, সেই পরম ক্ষণেই নায়কের মনে নিঃশব্দ প্রার্থনার মতো উচ্চারিত হল : “স্বামী-সংসার নিয়ে সুরবালা সুখে থাকুক।” এইভাবে দুজনে দুজনের গন্থব্যস্থলে ফিরে গেল।
এখন নায়কের ভূষিত হৃদয় চাকত পাখির মতো গুণ টেনে চলেছে। ভাবনার এই উত্তরণের মধ্যে ঘটেছে নায়ক-মনের আনন্দময় মুক্তি। গল্পটির সঙ্গে ‘পরশ-পাথর’ কবিতাটির যেন মর্মগত মিল। পরশ পাথরের সন্ন্যাসীর মতো গল্পের নায়কও।
“অর্ধেক জীবন খুঁজি কোন্ ক্ষণে চক্ষু বুজি
স্পর্শ লভেছিল যার এক পলভর
বাকি অর্ধ ভগ্ন-প্রাণ আবার করিছে দান
ফিরিয়া খুঁজিতে সেই পরশ পাথর।”
নায়কের পক্ষে সুরবালাই পরশ পাথর। সেই নারীর স্পর্শে তাহার স্মৃতির মাদুলী সোনা হইয়া গিয়েছিল। কিন্তু তখন কি সে বুঝিয়েছিল। আজ বহুদিন পরে যখন পরশ পাথর সম্পূর্ণভাবে আয়ত্তের অতীত, তখন সে মাদুলির রূপান্তর দেখিয়া চমকিয়া উঠিয়াছে। ক্ষ্যাপা সন্ন্যাসীর পুনরায় সন্ধানের সান্ত্বনাটুকু আছে, গল্পের নায়কের বুঝি তাহাও নাই। ভাবিলাম, আমি নাজির হই নাই, সেরেস্তাদারও হই নাই, গ্যারিবডি ও হই নাই, এক ভাঙা স্কুলের সেকেন্ড মাস্টার…..সমস্ত দিনরাত্রির মধ্যে সেই একটি মাত্র রাত্রিই তুচ্ছ জীবনের একমাত্র চরম সার্থকতা।”
রবীন্দ্রনাথের রোমান্টিক যুগের তুঙ্গ শিখরে এই গল্পের অবস্থান। এ যেন রবীন্দ্রনাথেরই নিজস্ব উপলব্ধি। কবি মনের ভাবনা গল্পটিকে যেমন বিশালতা দিয়েছে, তেমনি গল্প আসরে এনে দিয়েছে চিরন্তনতা। গীতিকবিতার সমস্ত লক্ষণই গল্পটির পরতে পরতে মিশে রয়েছে। সেই হিসাবে গল্পকার রবীন্দ্রনাথ ও কবি রবীন্দ্রনাথ যেন একই বৃত্তে প্রস্ফুটিত।
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।