আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “একালে সাহিত্য সমালোচনার যে বিচিত্র পদ্ধতির উদ্ভব ঘটেছে, তার মধ্যে যে-কোনো দুটি পদ্ধতির সম্পর্কে আলোচনা করো। প্রতিটি পদ্ধতির একটি করে প্রবন্ধের নিদর্শন দিয়ে তোমার বক্তব্য সুস্পষ্ট করো” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
একালের সাহিত্য সমালোচনার যে বিচিত্র পদ্ধতির উদ্ভব ঘটেছে তার মধ্যে বস্তুনিষ্ঠ পদ্ধতি ও তুলনামূলক পদ্ধতি সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করলাম—
বস্তুনিষ্ঠ পদ্ধতি : বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা বা objective criticism-এ বিচার্য বিষয় কেবলমাত্র সাহিত্যকৃতিটুকু। তা কীভাবে রচিত হয়েছিল কবি বা লেখক কীরকম মানসিকতা নিয়ে তা রচনা করেছিলেন, রচনার সামাজিক বা রাজনৈতিক প্রেক্ষিত কেমন ছিল এই ধরনের কোনোরকম ভাবনা-চিন্তা এই রীতির সমালোচনায় করা যায় না। অর্থাৎ সাহিত্য বিচারে যুগ চেতনা বা সামাজিক বিধিনিষেধ কিংবা আর্থ সামাজিক পরিস্থিতি আদৌ মূল্যবান নয় বলে এই সাহিত্য বিচার পদ্ধতিতে মেনে নেওয়া হয়। এক কথায় সাহিত্য ছাড়া অন্য কিছুই এই ধরনের সাহিত্য বিচারে বিবেচ্য নয়।
ঠিক এই ধরনের সমালোচনা পদ্ধতির উদ্ভব ঘটে ইংরেজি সাহিত্য ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে। আমেরিকার শিকাগো শহরে আবির্ভূত ‘নব্য সমালোচকবৃন্দ’ও এই জাতীয় সমালোচনায় বিশ্বাসী ছিলেন।
তুলনামূলক পদ্ধতি : যে সমালোচনায় দেশীয় সাহিত্যের সঙ্গে বিদেশি সাহিত্যের অথবা আধুনিক সাহিত্যের সঙ্গে প্রাচীন সাহিত্যের তুলনার মাধ্যমে সাহিত্য কর্মের মূল্যায়ন এবং একটি সাহিত্য কর্মে দেশীয় অথবা বিদেশি সাহিত্যের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব কোথায় কীভাবে পড়েছে তার অনুসন্ধান করা হয়, তাকে তুলনামূলক পদ্ধতি বলে।
উনিশ শতকের এই পদ্ধতির শুভসূচনা, মধুসূদনের বিভিন্ন চিঠি পত্রে হোমার, মিল্টন, শেকসপিয়রের লেখা সম্পর্কে তুলনামূলক আলোচনা করেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘উত্তর ভারত’, ‘শকুন্তলা’ ‘মিরান্দা দেসদিমোনা, জয়দেব ও বিদ্যাপতি রবীন্দ্রনাথ তার প্রাচীন সাহিত্য এই পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন।
নিম্নে আধুনিক সাহিত্য সমালোচনার পদ্ধতির নিদর্শন দিলাম।—
(১) অনুকরণবাদী পদ্ধতি : যেমন—অ্যারিস্টটল তাঁর poetics-এ সাহিত্যকে অনুকরণ বা numesis রূপে কিংবা ফিলিপ সিডনি তাঁর An Apology for Poetry-তে লিখেছেন poesy is an art of imitation for so Aristotle fermeth it in his word mimesis.
(২) সংরূপগত পদ্ধতি : যেমন—বঙ্কিমচন্দ্রের ‘গীতিকাব্য’ রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদীর মহাকাব্যের লক্ষণ রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সমালোচনা থেকে শুরু করে সঞ্জয় ভট্টাচার্যের কবিতা বিচার।
(৩) প্রকাশবাদী পদ্ধতি : যেমন-নব্য ভাববাদী সমালোচক বেলোদিত্তো ক্রোচে এই সমালোচনা পদ্ধতির অন্যতম হোতা।
(৪) বস্তুনিষ্ঠ পদ্ধতি : যেমন—গোপাল হালদার, অশোক মিত্র, ভবতোষ দত্ত বস্তুনিষ্ঠ আলোচনায় বিশেষ আগ্রহ দেখিয়েছিলেন।
(৫) তুলনামূলক পদ্ধতি : বাংলা সাহিত্য ধারার এই সমালোচনার সার্থক প্রবর্তনা ঘটিয়েছেন বঙ্কিমচন্দ্র। তাঁর উত্তরচরিত, জয়দেব, বিদ্যাপতি, শকুন্তলা, মিরান্দা ও দেস দিমোনা প্রবন্ধের নাম এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।
(৬) পরিসংখ্যানমূলক পদ্ধতি : বাংলা সমালোচনার ক্ষেত্রভুক্ত এই ধারার আলোকে বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস-এর শিল্পরীতি; তারাশংকরের উপন্যাস শিল্পরীতি ইত্যাদি গ্রন্থে এই প্রকার সমালোচনার পরিচয় রয়েছে।
(৭) ঐতিহাসিক পদ্ধতি : বিনয় ঘোষের নতুন সাহিত্য সমালোচনা অরবিন্দ পোদ্দারের ‘বঙ্কিম মানস’ সীতাংশু মৈত্রের ‘যুগান্ধর মধুসূদন রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর কাব্যের লক্ষণ এই পদ্ধতির দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা।
(৮) মনোবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি : যেমন—তারাশংকরের ‘বিচারক’ এছাড়া ইংরাজি সাহিত্য Herbert Read এই শ্রেণির সমালোচনার সূচনা করেন।
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।