‘কমলাকান্তের দপ্তর’ গ্রন্থটির পরিকল্পনায় ইংরাজি সাহিত্যের প্রভাব রয়েছে কী ? বাংলা সাহিত্যে এই গ্রন্থের প্রবন্ধগুলি নুতন আঙ্গিকের শিল্পশৈলীর যে পরিচয় আছে তা আলোচনা করো। এই প্রবন্ধগুলো কোন্ শ্রেণিভুক্ত বলে তোমার মনে হয়

আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “‘কমলাকান্তের দপ্তর’ গ্রন্থটির পরিকল্পনায় ইংরাজি সাহিত্যের প্রভাব রয়েছে কী ? বাংলা সাহিত্যে এই গ্রন্থের প্রবন্ধগুলি নুতন আঙ্গিকের শিল্পশৈলীর যে পরিচয় আছে তা আলোচনা করো। এই প্রবন্ধগুলো কোন্ শ্রেণিভুক্ত বলে তোমার মনে হয়” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।

‘কমলাকান্তের দপ্তর’ গ্রন্থটির পরিকল্পনায় ইংরাজি সাহিত্যের প্রভাব রয়েছে কী ? বাংলা সাহিত্যে এই গ্রন্থের প্রবন্ধগুলি নুতন আঙ্গিকের শিল্পশৈলীর যে পরিচয় আছে তা আলোচনা করো। এই প্রবন্ধগুলো কোন্ শ্রেণিভুক্ত বলে তোমার মনে হয়

যে কোনো প্রথম শ্রেণির শিল্পীর মধ্যেই আত্মপ্রকাশের মাধ্যম হিসাবে প্রথাসিদ্ধ আঙ্গিকের বন্ধন অতিক্রম করার প্রবণতা দেখা যায়। আত্মপ্রকাশের সেই তীব্র তাড়না থেকেই যেমন কমলাকান্ত নামক এক অভিনব চরিত্রের জন্ম, তেমনি বাংলা সাহিত্যে আত্মপ্রকাশ ঘটল এক ভিন্নতর শিল্পরীতির। এজন্য বঙ্কিমচন্দ্র ইংরাজি সাহিত্যের কাছে ঋণী। এই গ্রন্থ পরিকল্পনার ক্ষেত্রে ইংরাজি সাহিত্যের তিন দিকপাল লেখকের চিন্তা-চেতনার সঙ্গে বঙ্কিমের মানসিকতার যোগ এবং ঐক্য খুঁজে পেয়েছেন সমালোচকবৃন্দ। আমাদের মনে হয়, ইংরাজি সাহিত্যের একজন নিবিষ্ট পাঠক হিসাবে বঙ্কিমচন্দ্র গ্রহণীয় বিষয়গুলিকে সচেতন ভাবেই তাঁর রচনার স্থান দিয়েছেন। ডি. কুইন্সের “দি কনফেশনস্ অফ অ্যান্ ইংলিশ ওপিয়াম-ইটার” গ্রন্থ থেকে গৃহীত হয়েছে কমলাকান্তের আফিং-এর নেশায় দিবাস্বপ্ন দেখার ছাঁচটি। ওয়ালটার স্কটের “টেলস্ অব মাই ল্যান্ডলড” উপন্যাসে জেডেডিয়া ক্লেইশবোথাম চরিত্রটির সঙ্গে সাদৃশ্য দেখা যায় ভীষ্মদেব খোশনবীশ এর। উভয়েই লেখক কর্তৃক পরিত্যক্ত রচনাবলী প্রকাশের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। চালর্স ডিকেন্সের “এ ম্যাড ম্যাস্ ম্যানাসক্রিপ্ট” থেকেই আংশিকভাবে এই সূত্রটি গৃহীত হতে পারে। “কমলাকান্তের জোবানবন্দি” অংশটি তুলনীয় ডিকেন্সের “সাম ওয়েলারের” সঙ্গে। এছাড়া এডিসনের রোজার-ডি-কভর্লির সঙ্গে কমলাকান্তের সাদৃশ্য দেখা যায়।

কিন্তু এইসব সাদৃশ্য বা অনুকরণ নিতান্তই উপরিতলের। ডি. কুইন্সি, স্কট, ডিকেন্স ইত্যাদিদের সঙ্গে মানসিকতার ঐক্য ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের। তার ঊনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণে পাশ্চাত্ত্য প্রভাব তো সর্বত্র স্বীকৃত। আধুনিক ছোটোগল্প, উপন্যাস, ব্যক্তিবাদী কাব্যধারা ইত্যাদি সাহিত্যের নানা আঙ্গিকের য়ুরোপীয় প্রভাব খুঁজে পাওয়া যাবে। তবু অস্বীকার করা যাবে না তার স্বতন্ত্র শিল্প মূল্য তার মৌলিকতা। “কমলাকান্তের” ক্ষেত্রেও লক্ষ্য করব, প্রভাব বা অনুসরণের আপাত গন্ডী অতিক্রম করে বঙ্কিমচন্দ্র বহু দূর অগ্রসর হয়েছেন—যার ছায়াপাত দেখি রবীন্দ্রনাথের “বিচিত্র প্রবন্ধের” কোনো কোনো রচনায়।

“কমলাকান্ত”-এ বঙ্কিমচন্দ্রের মৌলিকতার প্রসঙ্গটি নানা দিক থেকেই আলোচিত হতে পারে। ইতিপূর্বে আমরা বলেছি, যে, কয়েকজন ইংরেজ লেখকের সৃষ্ট চরিত্র বা শিল্পশৈলীর সঙ্গে কমলাকান্তের সাদৃশ্য রয়েছে কিন্তু এ-কথাও মনে রাখা দরকার যে, আপাতত নির্লিপ্ততার মধ্যে এবং পরিহাস রসিকতার আড়ালে যে অর্ন্তদৃষ্টি, জীবনবোধ ও দার্শনিকতার পরিচয় কমলাকান্তের চরিত্রে পাওয়া যায়—তা লভ্য নয়—ওপিয়াম্ ইটার কিংবা স্যাম ওয়েলার কিংবা রোজার-ডি-কভার্লির চরিত্রে। কমলাকান্ত বস্তুত বঙ্কিমচন্দ্রেরই দ্বিতীয় সত্তা এবং তার সৃষ্টি পরিকল্পনা করতে গিয়ে হয়তো লেখক সামনে রেখেছিলেন সংস্কৃত সাহিত্যের বিদূষক এবং আমাদের নাটকের বিবেক চরিত্রকেও। কমলকান্ত যেন আমাদের মানবিকতার অথবা আমাদের অস্তিত্বের প্রহরী।

আসলে দ্রষ্টা এবং সমাজশিক্ষক বঙ্কিমচন্দ্র প্রাত্যহিকতার দৈন্য থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে কমলাকান্ত-সত্তায় আত্মপ্রকাশ করেছেন। এই গ্রন্থে এবং এর দ্বারাই অর্জন করেছেন সমাজ সমালোচকের অধিকার। এ প্রয়াসে যথেষ্ট অভিনবত্ব আছে।

আরও একটা কথা বলা দরকার : এ গ্রন্থে কমলাকান্তকে পূর্ণ করে তুলেছে নসীরাম বাবু, প্রসন্ন গোয়ালিনী ভীষ্মদেব খোশনবীশ প্রভৃতি চরিত্রগুলি। জনৈক সমালোচকের মতে, এদের সমাবায়ে কলমাকান্তের পত্রগুলি “অর্ধ ঔপন্যাসিক” হয়েছে।

কমলাকান্তের সমস্ত পত্রগুলি পর্যালোচনা করলে সে যুগের বাংলাদেশকে সামাজিক চিত্রবালী সূত্রাকারে আমাদের চোখের সামনে উপস্থিত হয়। কমলাকান্ত সহ সমস্ত চরিত্রগুলি খাঁটি বাঙালি চরিত্র। অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতকের মোসায়েব পরিবৃত জমিদার সমাজের প্রতিনিধি হচ্ছে নসীরামবাবু। কমলাকান্ত আবহমান কালের দরিদ্র ব্রাহ্মণ—জমিদারের পৃষ্ঠপোষকতায় যাঁর ছন্নছাড়া জীবন অতিবাহিত হয়। প্রসন্ন গোয়ালিনী একদিকে দুধে জল মেশায় অন্য দিকে তার দেব-দ্বিজে ভক্তি ব্রাহ্মণের সত্যবাদীতার প্রতি আস্থা আমাদের অব্যহিত পূর্বাকালের মূল্য বোধকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। ভীষ্মদেব খোশনবীশকেও লেখক সংগ্রহ করেছিলেন তাঁর দীর্ঘ-পরিচিত আইন আদালতের প্রাঙ্গন থেকে।

অতএব দেশি-বিদেশি অনুসঙ্গ এবং আপন স্বকীয়তার বলে “কমলাকান্তের” মতো যে অভিনব শিল্প বঙ্কিমচন্দ্র উপহার দিলেন বাংলা সাহিত্যকে—তাঁকে অভিহিত করব কি নামে ? বঙ্কিমচন্দ্র নিজে বলেছেন “সন্দর্ভ” কিংবা কখনও “পত্র”। “বিজ্ঞান” রহস্য “বিবিধ প্রবন্ধ” (দুই খণ্ড), “সাম্য”, “কৃষ্ণচরিত্র”, “ধর্মতত্ত্ব” “লোকরহস্য”, ইত্যাদি বহু বিস্তৃত বঙ্কিমের প্রবন্ধ জগতে আঙ্গিকের দিকে থেকে একমাত্র “লোকরহস্যই” ‘কমলাকান্তের” কাছাকাছি। উভয়তঃই লেখক রঙ্গ-ব্যঙ্গের ছলে দেশপ্রীতি, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, অন্ধ ইংরেজ অনুকরণের অন্তঃসারশূন্যতা প্রচলিত নানা সামাজিক রীতিনীতির হাস্যকরতা ব্যক্তি চরিত্রের অসঙ্গতি, শিল্প সাহিত্যের অবনমন-প্রসঙ্গ ইত্যাদি নানা দিক তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিনিক্ষেপ করেছেন। যেমন বক্তব্য বিষয়ে প্রাধান্য এখানে অনস্বীকার্য তেমনি কয়েকটা রচনাগুলিকে আমরা “ব্যক্তিগত” প্রবন্ধই বলব। যেখানে লেখক গুরুতর বিষয়গুলিকে আলোচ্য মনে করেছেন সেখানেও কমলাকান্তরূপী বঙ্কিমচন্দ্রের অনুভূতির স্পর্শে এবং রঙ্গব্যঙ্গের ছোঁয়ায় প্রচলিত শিল্পের বস্তুতান্ত্রিক জগৎ থেকে দূরে সরে এসে বাঙালি পাঠকের সামনে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে দিয়েছে। এগুলি “স্কেচ” বা “নকশা” নয়। কারণ নকশার অ-গভীরতা যেমন এখানে নেই এবং সেই সঙ্গেই লক্ষণীয় সমস্ত রচনাগুলির মধ্যেই এক অখন্ড চেতনার প্রবাহ। “লঘু প্রবন্ধ” বলব না, কারণ, প্রকাশরীতিতে লঘুতা থাকলে বিষয় কখনই লঘু নয়। তাই আমাদের বিচারে “কমলাকান্ত” ব্যক্তিগত প্রবন্ধ”।

আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।

Leave a Comment