আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “‘কমলাকান্ত দপ্তর’-এর প্রবন্ধগুলি সমাজচেতনার প্রতীক—আলোচনা করো” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
‘কমলাকান্ত দপ্তর’-এর প্রবন্ধগুলি সমাজচেতনার প্রতীক—আলোচনা করো
দেশ-প্রীতি, ঈশ্বরপ্রীতি, এবং মানবপ্রীতিকে অবলম্বন করেই কমলাকান্তের প্রীতিতত্ত্বের সূত্রটি গ্রথিত। আমরা বিশেষভাবে দৃষ্টি দেব মানবপ্রীতির ওপর যার মধ্যে দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের সমাজতান্ত্রিক চেতনা আত্মপ্রকাশ করেছে। বলা বাহুল্য, এই চেতনা সে যুগের পক্ষে যথেষ্টই অভিনব। আপাতত দৃষ্টিতে মুক্ত পুরুষ হলেও কমলাকান্ত চক্রবর্তী তাঁর চতুর্দিকের প্রাত্যহিক জগতের সঙ্গে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পরিচিত; যথার্থ শিল্পী গগনচারী হতে পারে না। তাঁর অবস্থান পরিচিত সামাজিক পরিবেষ্টনের মধ্যেই, অন্তদৃষ্টির মধ্যেই—তাদের স্বাতন্ত্র্য এই সন্ধানী দৃষ্টি মেলেছিলেন কমলাকান্ত সমাজের প্রতিটি অনালোকিত প্রকোষ্ঠে ; ‘কমলাকান্তের’ অনেকগুলি রচনায় এই ভাবে আহৃত হয়েছে বঙ্কিমচন্দ্রের নিপুণ সমাজ পর্যবেক্ষণ।
‘মনুষ্য ফল-এ’ আমাদের সমাজের নানা শ্রেণির মানুষকে এক এক জাতীয় ফলের সঙ্গে তুলনা করে কৌতুকের মধ্যে দিয়ে তাঁর বিশ্লেষণী সমাজ সচেতনকে দৃষ্টির পরিচয় পাওয়া যায়। কমলাকান্তের অনুভূতিতে সমাজের বড়োমানুষের কাঁঠালের সঙ্গে তুলনীয়, সিভিল সার্ভিসের লোকেরা আমের সঙ্গে তুলনীয় এবং “রমণীমন্ডলী” এ সংসারের নারিকেল। কেবল মন্তব্য নয় নিজের সিদ্ধান্তকে ব্যাখ্যার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করেছেন কমলাকান্ত। ছদ্ম দেশপ্রেমিকেরা তাঁর চোখে শিমুল ফুল, “অধ্যাপক ব্রাহ্মণগণ সংসারের ধুতুরা ফুল”, দেশি লেখকরা তেঁতুল এবং দেশি হাকিমরা কুষ্মান্ডের সঙ্গে তুলনীয়। নারীজাতিকে নারিকেলের সঙ্গে তুলনা করে নারিকেলের চারিটি সামগ্রী জল, শস্য, মালা আর ছোবড়ার সঙ্গে কমলাকান্ত যথাক্রমে নারীজাতির স্নেহ, বুদ্ধি আর রূপের সাদৃশ্য প্রদর্শন করেছেন। এই বিশ্লেষণ কেবল অভিনব বঙ্কিমচন্দ্রের এই জাতীয় দার্শনিক দৃষ্টিরও পরিচায়ক ; নারীদেহের রূপ অনিত্য, তা কেবল মোহ সৃষ্টি করে, সংসারে প্রকৃত হিতের পথ রুদ্ধ করে দেয়—কেবল মনুষ্য-প্রতঙ্গকে সেই দিকে ধাবিত করে, যার পরিণাম মৃত্যু। “পতঙ্গ” রচনার প্রধান বক্তব্যই হ’ল নানা দাহ যার প্রধান হ’ল রূপবহ্নি। বঙ্কিমের আদর্শ নারীসমাজ ‘মূর্তিমতী সহিষ্ণুতা, ভক্তি ও প্রীতির’ আশ্রয় স্থল। “মাতার আদর স্ত্রীর, প্রেম, কন্যার ভক্তি, ইহার অপেক্ষা…আর কি সুখের আছে ? রূপের ভূমিকা সেখানে বড়ো নয়। এই বক্তব্য আরও কোনো কোনো প্রবন্ধেও উপস্থিত।
“আমার মন” কমলাকান্ত রূপী বঙ্কিমচন্দ্রের স্বগতচিন্তার বাহক হলেও তাতে প্রচ্ছন্ন রয়েছে সমাজ চেতনা। বিবাহ বন্ধনের মধ্য দিয়ে যে সমাজ আমরা গড়ে তুলি তার মূল উদ্দেশ্য হ’ল আত্মপ্রিয়তা বিসর্জন দিয়ে মার্জিত চিত্তে সমস্ত মনুষ্যজাতিকে ভালোবাসা। “বড়োবাজার” রচনাটিতে কমলাকান্তের বিশ্লেষণী সমাজচেতনাকে দৃষ্টিভঙ্গি যথেষ্ট কটাক্ষ মিশ্রিত—“মনুষ্য এমনই মূল্যপ্রিয় যে, বিনামূল্যে মন্দ সামগ্রীও কেহ কাহাকে দেয় না। যে বিষ খাইয়ে মরিবার বাসনা করো, তাহাও তোমাকে বাজার হইতে মূল্য দিয়া কিনিতে হবে।” পৃথিবীর সেই বড়োবাজারের রূপের হাটে পৃথিবীর রূপসী সমস্ত নারীর মাছরূপে লেজ ঝটফট্ করছে খরিদ্দারের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ? “যত বেলা বাড়িতেছে, তত বিক্রয়ের জন্য খাবি খাইতেছে”। এইরকম অসাধারণ রূপকের আড়ালে সমাজচেতনা বড়োবাজারেই পাওয়া যায় সেখানে বিদ্যার হাটে ইংরেজ দোকানদার দেশি খরিদ্দারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে “আয় কালা বালক, এক্সপেরীমেন্টাল সায়েন্স খাবি আয়”। তাছাড়া সাহিত্যের বাজারে কমলাকান্ত বাংলা সাহিত্যকে দেখলেন অপক্ক কদলী রূপে; যশের বাজার দুর্গন্ধময়, কলুর বাজার কেবল উমেদারীতে পরিপূর্ণ আর বিচারের বাজারটা কসাইখানা।
এই ধরনের সমাজ চেতনা বঙ্কিমের পূর্বে তো নয়ই, পরবর্তীকালের বাংলা সাহিত্যেও সুলভ নয়। চতুর্দিকের জগৎ এবং জীবন সম্পর্কে স্পষ্ট ও সূক্ষ্ম দৃষ্টি, জীবনমুখীতা এবং অস্তিত্ববাদী দৃষ্টি না থাকলে এ সৃষ্টি সম্ভব নয়। ‘বসন্তের কোকিল’-এ বর্ণিত সমাজের সুখ বিলাসী অস্তিত্বগুলোই অহঃরহ আমাদের চতুর্দিকে দেখা যায়। এরাই সেই ‘শিমূল ফুল’ কিংবা ‘বাবু’ । সমাজসচেতন বঙ্কিম আমাদেরও সচেতন করে দিয়েছেন এঁদের সম্পর্কে। কেবল সুকণ্ঠের জোরে বা আকর্ষণীয় বাচনভঙ্গির বলে এই শ্রেণির বসন্তের কোকিলরা সর্বত্রই সুবিধাভোগী।
‘বিড়াল’ প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্রের সমাজ চেতনা এক নতুনতর বোধের জগতে উত্তীর্ণ হয়েছে। এই রচনায় চুরি করে দুধ খেতে এসেছে যে বিড়াল সে মূলত সোস্যালিস্ট সমাজের ধনবৈষম্য, বঞ্চিতের ওপর নীতিধর্মের অসার উপদেশ বর্ষণ এবং তার প্রতিবাদে সমাজতন্ত্রবাদী বঙ্কিমচন্দ্রের তীব্র প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠেছে ‘বিড়াল’ সামাজিক ধন সঞ্চয়ের সুফল যদি সমাজে প্রতিটি প্রাণীর ভোগ্য না হয় তবে তা অর্থহীন। বিড়ালের দুধের দাবী সমস্ত সর্বহারার নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠ ভাষা পেয়েছে বিড়ালের মধ্যেও অপেক্ষা শতগুণে দোষী …..তোমাদের পেট ভরা, আমাদের পেটের / তেলা মাথায় তেল দেওয়া মনুষ্যজাতির রোগ।….পাঁচশত দরিদ্রকে বঞ্চিত করিয়া, একজন পাঁচশত লোকের আহার্য সংগ্রহ করিবে কেন?”
মার্কসীয় দর্শনের সঙ্গে সাযুজ্যমন্ডিত বঙ্কিমচন্দ্রের এই সমাজচেতনার বিস্তৃত রূপ দেখি ‘সাম্য’ রচনায়। পাশ্চাত্ত্যে দর্শনে অনুরাগী বঙ্কিমচন্দ্র এখানে ভলতেয়ার, রুশো প্রভৃতি বিপ্লবী দার্শনিকদের স্থান নির্দিষ্ট করেছেন যীশুখ্রিস্ট, বুদ্ধদেবের পাশাপাশি। কিন্তু উপস্থাপনার অভিনবত্বের জন্য “বিড়াল” অনেক বেশি আকর্ষণীয়। এছাড়া “কমলাকান্তের” জোবানবন্দি ও বঙ্কিমচন্দ্রের সমাজ মনস্কতার পরিচয় পাওয়া যায়।
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।