আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “কুষাণ সাম্রাজ্য : প্রথম কণিষ্ক, কুষাণ শাসনব্যবস্থা, কণিষ্ক-পরবর্তী কুষাণ সম্রাটগণ, কুষাণ রাজনীতির উপর অর্থনীতির প্রভাব” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
কুষাণ সাম্রাজ্য : প্রথম কণিষ্ক, কুষাণ শাসনব্যবস্থা, কণিষ্ক-পরবর্তী কুষাণ সম্রাটগণ, কুষাণ রাজনীতির উপর অর্থনীতির প্রভাব
কুষাণ সাম্রাজ্য:
পার্থিয়দের শাসন কর্তৃত্বের অবসানের পর উত্তর-পশ্চিম ভারতে মধ্য-এশিয়া থেকে আগত কুষাণ উপজাতির শাসন প্রবর্তিত হয়েছিল। মৌর্য শাসনের অবসানের পর যেসব বিদেশী জাতি ভারতে এসে শাসন প্রবর্তন করেছিল, তাদের মধ্যে সব দিক থেকেই অগণী ছিল কুষাণরা। পার্থিয়দের বিতাড়িত করে উত্তর-পশ্চিম ভারতের বিস্তৃত এলাকায় কুষাণরা নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। কুষাণদের ভারতীয় সাম্রাজ্য ও তাদের ব্যাকট্রিয়ার শাসনক্ষেত্র মিলিতভাবে একদিকে রোম সাম্রাজ্যের পূর্বতম প্রান্ত এবং অন্যদিকে চীন সাম্রাজ্যের সীমানা স্পর্শ করেছিল। উল্লেখ্য যে, কুষাণরা ভারতে বিশাল এলাকায় কর্তৃত্ব স্থাপনে সক্ষম হলেও, তাদের কর্তৃত্ব ও শক্তির কেন্দ্র ছিল ব্যাকট্রিয়া (বাহ্লিক দেশ)। এখান থেকেই তারা মহাদেশের অন্যান্য অংশে কর্তৃত্ব বিস্তারে উদ্যোগী হয়েছিল। ড. ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় গবেষণা করে প্রমাণ করেছেন যে, ব্যাকট্রিয়া অঞ্চল থেকে কুষাণদের ভারতমুখী সম্প্রসারণের পশ্চাদপটে রাজনৈতিক কর্তৃত্বের লক্ষ্য নয়, অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বেশী সক্রিয় ছিল। ভারতে দীর্ঘ দু’শত বছরের কিছু বেশী সময় কুষাণদের শাসন টিকে ছিল। তবে কুষাণ শাসনের গৌরবজনক অধ্যায় ছিল প্রথম একশতক কাল।
কুষাণ উপজাতির আদি পর্বের ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে আমাদের প্রাথমিক উপাদান হল চৈনিক সাহিত্য। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল সু-মা কিয়েন সংকলিত ‘সি-চি’ (ঐতিহাসিক নথি), প্যান-কু রচিত ‘ছিয়েন-হান-সু’ (১ম হানবংশের ইতিহাস), ফ্যান-ই রচিত ‘হৌ-হান-সু’ (পরবর্তী হান বংশের ইতিহাস), মা-তোয়ান-লিন রচিত বিশ্বকোষ। এছাড়া স্ট্যাবো, জাস্টিন, বরদেসানিম প্রমুখের গ্রন্থ থেকেও এই উপজাতির নানা তথ্য জানা যায়। ‘টলেমী’র ভূগোল, পেরিপ্লাস গ্রন্থ, বৌদ্ধগ্রন্থ দিব্যবদান, নাগার্জুনের ‘মাধ্যমিক সূত্র’ প্রভৃতি থেকেও কিছু তথ্য পাওয়া যায়। কুষাণ রাজাদের লেখ ও মুদ্রাগুলি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম কনিষ্কের পূর্ববর্তী শাসকদের লেখগুলি পাওয়া গেছে মূলত উত্তর-পশ্চিম ভারত ও আফগানিস্তানের নানা স্থানে। অন্যদিকে কনিষ্কের লেখগুলি পাওয়া যায় কৌশাম্বি, সারনাথ, থানিকিয়ালা, সুই বিহার প্রভৃতি স্থানে। পরবর্তী শাসকগণ যেমন বাসিষ্ক, হুবিদ্ধ, বাসুদেব প্রমুখের মুদ্রা পাওয়া গেছে মথুরা, কামরা প্রভৃতি স্থানে। কুষাণদের লেখ ও মুদ্রায় ব্যবহৃত ভাষা তোখারীয়, যা ইন্দো-ইউরোপীয় একটি গোষ্ঠী ব্যবহার করত। এই কারণে স্ট্র্যাবোর বিবরণে এদের ‘তোখারয়’ বলা হয়েছে। ডব্লিউ. বি. হেনিং (W. B. Henning) এই ভাষাকে ‘ব্যাকট্রিয় আখ্যা দিয়েছেন। অধিকাংশ কুষাণ রাজা এই ভাষা ব্যবহার করেছেন। আবার বাসিষ্কের রাজত্বের বিংশ বছরে উৎকীর্ণ কামরা লেখতে প্রাকৃত ভাষা এবং ব্রাহ্মী ও খরোষ্ঠী লিপির ব্যবহার লক্ষণীয়।
চৈনিক রচনা থেকে জানা যায় কুষাণরা আদিতে ছিল মধ্য এশিয়ার অন্যতম যাযাবর ইউ-চি জাতির একটি শাখা। ইউ-চিদের বাসস্থান ছিল চীনের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত কান-সু ও নিং-চিয়া প্রদেশে। দ্বিতীয় খ্রিষ্টপূর্বাব্দে হিউং-নু (হুন) নামে অপর এক যাযাবর জাতির আক্রমণে বাসভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে ‘ইউ-চি’রা পশ্চিমে অগ্রসর হয় এবং তাকলামাকান অঞ্চলে উপস্থিত হয়। এখানে ‘ইউ-চি’রা আর এক যাযাবর জাতি উ-শুনদের নেতাকে হত্যা করে এবং দুটি শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়। একটি শাখা দক্ষিণ দিকে এগিয়ে যায়। এই গোষ্ঠী পরিচিত হয় ‘ক্ষুদ্র ইউ-চি’ নামে। অপর শাখাটি পশ্চিমদিকে অগ্রসর হয়ে শিরদরিয়া নদীর তীরে উপস্থিত হয়। এটি পরিচিত হয় ‘বৃহৎ ইউ-চি’ নামে। সিরদরিয়া অঞ্চলে ‘ইউ-চিরা’ বেশিদিন বসবাস করতে পারেনি। কারণ ‘উ-শুন’ জাতি ‘হিউং-নুদের সাহায্য নিয়ে এখানে ‘ইউ-চি’দের আক্রমণ করে ও বিতাড়িত করে। অতঃপর ‘ইউ-চি’ জাতি ব্যাকট্রিয়া অঞ্চলে উপস্থিত হয় এবং শকদের বিতাড়িত করে এই অঞ্চলে বসবাস শুরু করে। চৈনিক বিবরণ থেকে জানা যায়, ব্যাকট্রিয়ায় বসবাসের পর ‘ইউ-চি’রা তাদের যাযাবর বৃত্তি ত্যাগ করে। এখানেই দলগত সংহতির অভাবহেতু ‘ইউ-চি’রা পাঁচটি শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়ে (শুয়াং-সি, হিউ-সি, কু-শুয়াং, হি-টুন এবং কাউ-ফু)। প্রথম দিকে এই শাখাগুলি ইউ-চি গোষ্ঠীর কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বের অনুগত ছিল। ইউ-চিদের কর্তৃত্বের প্রধান কেন্দ্র ছিল অক্ষু নদীর উত্তর ভাগে। অন্যদিকে কু-শুয়াংদের কর্তৃত্ব ছিল অক্ষু নদীর দক্ষিণ অংশে পূর্ব ব্যাকট্রিয়া (তা-হিয়া) অঞ্চলে। কালক্রমে কু-শুয়াং গোষ্ঠী বিশেষ শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং অন্য চারটি শাখাকে নিজেদের অধীনে নিয়ে আসে। কু-শুয়া গোষ্ঠী কুষাণ নামে পরিচিত হয়। কালক্রমে কুষাণরা এক বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলে।
মুদ্রার সাক্ষ্য থেকে জানা যায় যে, ইউ-চি কর্তৃত্ব থেকে মুক্ত প্রথম কুষাণ শাসক ছিলেন মিয়াত্তস। তাঁর অধিকারে ছিল ব্যাকট্রিয়া বা বাহ্লীক দেশ। সম্ভবত অক্ষু নদের উত্তরে কিছু অংশেও তাঁর কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়েছিল। ভারতীয় সীমান্তে কুষাণদের ক্ষমতা সম্প্রসারণের কাজ শুরু করেন পরবর্তী শাসক কুজুল কদফিসেস। চৈনিক গ্রন্থের ছিউ-চিউ-ছুয়ে এবং তাম্রমুদ্রায় উল্লেখিত কুজুল কদফিসেস অভিন্ন ব্যক্তি বলেই গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। হৌ-হান-সু থেকে জানা যায় যে, কুষাণদের নেতা হওয়ার পর তিনি অন্যান্য ইউ-চি শাখাগুলির অধীন অঞ্চল জয় করে নিজেকে তাদের রাজা বলে ঘোষণা করেন। সম্ভবত তাঁর উত্থান ঘটেছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৩০ অব্দের কিছু পরে। চৈনিক সূত্র থেকে জানা যায় যে, কুজুল পার্থিয় রাজ্য আন-সি আক্রমণ করেছিলেন এবং কাও-ফু (কাবুল), পু-ত (পেশোয়ারের দক্ষিণ-পূর্বের স্থান) এবং কি-পিন (কাশ্মীর) দখল করেন। আসাকীয়দের কাছ থেকে কাবুল এবং পার্থিয়দের কাছ থেকে কাশ্মীর দখল করে কুজুল কুষাণদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। চৈনিক সাক্ষ্য অনুসারে তিনি আশি বছর জীবিত ছিলেন। সম্ভবত খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকের প্রথম দিকে তাঁর শাসন জারী ছিল। কুজুল কাশ্মীর দখল করলেও ভারতের অভ্যন্তরে রাজ্য বিস্তারের কোন চেষ্টা করেন নি। কিছু মুদ্রায় গ্রীক রাজা হারমাইয়স ও কুজুল কদফিসের নাম পাওয়া যায়। অনুমিত হয় যে, জীবনের প্রথম দিকে তিনি হারমাইয়সের অধীনস্থ শাসক বা সহ-শাসক ছিলেন। র্যাপসন, ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ মনে করেন যে, হারমাইয়সের রাজত্বকাল কুজুল কদফিসেসের অনেক আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। হতে পারে গ্রীক মুদ্রার ওপর কুজুল নিজ নাম উৎকীর্ণ করেছিলেন। অবশ্য কুজুলের মুদ্রায় রোম সম্রাট ক্লডিয়াসের আবক্ষমূর্তির অনুরূপ কুজুলের আবক্ষ মূর্তি দেখা যায়। এঁদের রাজত্বকালের মধ্যে সময়ের ব্যবধানও কম। সম্ভবত কুজুল গ্রীক মুদ্রার অনুকরণ করেছিলেন। পণ্ডিতদের অনুমান তিনি বৌদ্ধধর্মের অনুসারী ছিলেন। প্রমাণ হিসেবে তাঁর মুদ্রায় উৎকীর্ণ ‘সত্যধর্মস্থিত’ কথাটি উল্লেখ করা যায়।
হৌ-হান-সু থেকে জানা যায়, কুজুলের অন্যতম পুত্রের নাম ইয়েন-কাও-চেন, যাঁকে গবেষকরা বিম কদফিসেসের সাথে অভিন্ন বলেছেন। সম্প্রতি একটি লেখতে সদন্ধন নামে কুজুলের এক পুত্রের কথা বলা হয়েছে। ড. ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের মতে সদস্কন এবং বিম কদফিসেস অভিন্ন ব্যক্তি। প্রথম শতকের মাঝামাঝি কোন এক সময় বিম কদফিসেস সিংহাসনে বসেছিলেন। বিম কদফিস পার্থিয় সম্রাট এবং ইন্দো-পার্থিয়দের পরাজিত করে রাজ্যসীমা সম্প্রসারিত করেন। তিনি নিম্ন সিন্ধু অববাহিকা এবং সিন্ধুর ব-দ্বীপ এলাকা দখল করলে কুষাণদের শক্তি অনেকটাই বৃদ্ধি পায়। তাঁর মুদ্রায় বেদির সামনে উৎসর্গর্রত রাজার মূর্তি পাওয়া যায়, তার সাথে আর্সাকীয় রাজা দ্বিতীয় গোরটাজেসের মুদ্রার হুবহু মিল পাওয়া যায়। দ্বিতীয় গোরটাজেসের শাসনকাল ৩৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৫১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। তাই অনুমান করা হয় যে, বিম কদফিস আর্সাকীয় রাজ্যের সমসাময়িক ছিলেন এবং তাঁর রাজ্যাংশ দখল করেছিলেন। অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় দেখিয়েছেন যে তিনি ইন্দো-পার্থিয়দের কাছ থেকে কান্দাহার (আরকোসিয়া) এবং নিম্ন সিন্ধু উপত্যকা (সেন-টু) দখল করেছিলেন। মথুরার মাট্ থেকে প্রাপ্ত তাঁর রাজকীয় মূর্তি এবং পাদদেশে উৎকীর্ণ লেখটি ঐ অঞ্চলে কুষাণদের অধিকার বিস্তারের ইঙ্গিত দেয়। কর্তৃত্ব ও পরাক্রমের নিদর্শন হিসেবে বিম কদফিসেস মহারাজ, রাজাধিরাজ, মহীশ্বর ইত্যাদি রাজকীয় উপাধি নিয়েছিলেন।
ভারতবর্ষে স্বর্ণমুদ্রা প্রচলন করার কৃতিত্ব বিম কদফিসের প্রাপ্য। এই সোনার যোগান আসত রোম থেকে। কুজুল ও বিম কদফিসের রাজ্য জয়ের ফলে ভারত ও রোম সাম্রাজ্যের মধ্যে স্থল বাণিজ্যের পথ উন্মুক্ত হয়। পাঞ্জাব, যমুনা ও গাঙ্গেয় উপত্যকা থেকে ব্যাকট্রিয়া ও আফগানিস্তানের মধ্যে এই বাণিজ্য প্রসারিত ছিল। ইউফ্রেটিস নদী ও গঙ্গা নদীর অন্তবর্তী ভূখণ্ডে এই বাণিজ্য ধারা কুষাণদের অর্থনীতিকে সজীব করে তোলে।
প্রথম কণিষ্ক :
কুষাণ বংশের শ্রেষ্ঠ শাসক ছিলেন প্রথম কণিষ্ক। তাঁর নেতৃত্বে কুষাণ সাম্রাজ্য ক্ষমতার শিখরে পৌঁছায় এবং বিস্তীর্ণ এলাকা কুষাণ শাসনের অন্তর্ভুক্ত হয়। প্রাথমিক ভাবে অনেকে মনে করেছিলেন যে কদফিসেস শাসকদের বংশ ও কণিষ্কের বংশ স্বতন্ত্র। কারণ কণিষ্ক বা তাঁর বংশধররা কেউই ‘কদফিসেস’ উপাধি নেননি। সম্প্রতি এই ধারণাটি ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে। বর্তমানে মনে করা হয়। যে, কদফিসে শব্দটি প্রাচীন ইরানীয় শব্দ ‘কাত-পৈস’ (অর্থাৎ সম্মানিত রূপ) শব্দ থেকে উদ্ভব হয়েছে। অর্থাৎ এটি একটি অভিধা মাত্র।
ড. বি. এন. মুখার্জী তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, বাসিস্কের কামরা লেখতে তিনি নিজেকে মহান রাজা ‘কলকবিস সর্চ ধর্মথিত’র বংশভুক্ত বলেছেন। এই ‘সত্যধর্মস্থিত’ রাজা যে কুজুল কদফিসেস, তা প্রমাণিত। সুতরাং বাসিদ্ধ ছিলেন কুজুল কদফিসের বংশোদ্ভূত। মথুরার সন্নিকটে মট্ নামক স্থানে প্রাপ্ত দুটি লেখ একই সাক্ষ্য দেয়। একটিতে একটি দেবকুল এবং বিম কদফিসেসের মূর্তি নির্মাণের উল্লেখ আছে। অন্য লেখতে বলা হয়েছে যে, এই দেবকুল হুবিস্কের পিতামহের দেবকুল। অর্থাৎ তিনি ছিলেন বিম কদফিসেসের পৌত্র। তবে প্রথম কণিষ্কের সিংহাসনারোহণের তারিখ সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। ড. ফ্লীট-এর মতে, কণিষ্ক ৫৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন। কিন্তু এ মত গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ প্রথম খ্রিষ্টপূর্বাব্দে গান্ধারে কুষাণ-কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়নি।
অথচ একথা সত্য যে, গান্ধার কণিষ্কের রাজ্যভুক্ত ছিল। পরস্তু মুদ্রার সাক্ষ্যের ভিত্তিতে একথা প্রমাণিত হয়েছে যে, কদফিসেস গোষ্ঠীর শাসনের পরে কণিষ্কের শাসন শুরু হয়েছিল। স্মিথ, মার্শাল প্রমুখের মতে, কণিষ্ক ১২৫ খ্রিষ্টাব্দে সিংহাসনে বসেছিলেন। কিন্তু এমতও যুক্তগ্রাহ্য নয়। কারণ দ্বিতীয় শতকে শকরাজ রুদ্রদামন নিম্নসিন্ধু অঞ্চলে রাজত্ব করতেন। কাজেই একই সময়ে একই অঞ্চলে দুটি শক্তিশালী রাজবংশ শাসন করতে পারে না। তাছাড়া, একথা প্রমাণিত যে, কণিষ্ক একটি অব্দের প্রচলন করেছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় শতকে কোন নতুন অব্দের প্রচলন হয়নি। র্যাপসন, ফারগুসন প্রমুখ পণ্ডিতের মতে, কণিষ্ক ৭৮ খ্রিষ্টাব্দে সিংহাসনে বসেছিলেন এবং ঐ বৎসরই তিনি শকাব্দ প্রচলন করেন। এই তারিখটি অধিকাংশ পণ্ডিত গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন। অনেকের জিজ্ঞাসা কণিষ্ক শক নন, তাহলে তাঁর প্রবর্তিত অব্দ শকাব্দ হল কেন? সম্ভবত পশ্চিম-ভারতের শকদের মধ্যে এই অব্দটি দীর্ঘকাল প্রচলিত থাকায় এটি ‘শকাব্দ’ নামে অভিহিত হয়েছে। ড. হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী, ড. ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ নানা যুক্তির ভিত্তিতে ৭৮ খ্রিষ্টাব্দকে কণিষ্কের সিংহাসনারোহণের কাল বলে সমর্থন করেছেন। ড. রায়চৌধুরী গবেষক জন মার্শাল কর্তৃক তক্ষশিলায় আবিষ্কৃত শিলালেখর উল্লেখ করেছেন। ১৩৬ সমবৎসর চিহ্নিত এই লেখর সময়কাল বিক্রম-সম্বত অনুযায়ী ৭৮ খ্রিষ্টাব্দ। এই দলিলে ‘মহারাজস রাজাতিরাজস্ব দেবপুত্রস খুসানস’ অভিধাটির উল্লেখ আছে। তাঁর মতে, ‘দেবপুত্র’ অভিধাটি কণিষ্কের অস্তিত্ব প্রমাণ করে। ড. মুখোপাধ্যায় দেখিয়েছেন যে, উত্তরপ্রদেশে কোসামে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন-এর ভিত্তিতে অনুমিত হয় যে, কুষাণ আধিপত্যের কিছুকাল পরে মঘবংশীয় রাজাদের শাসন সূচিত হয়েছিল। মঘদের ব্যবহৃত অব্দ এবং শকাব্দ অভিন্ন। অথচ মঘরা কোন নতুন অব্দ চালু করেনি। তাই ধরে নেওয়া যায় কুষাণদের শকাব্দই তারা অনুসরণ করেছিল। শকাব্দের প্রবর্তক যদি কণিষ্ক হন, তাহলে ৭৮ অব্দকে তাঁর সিংহাসনে বসার সময়কাল হিসেবে ধরা যায়।
বিম কদফিসের উত্তরাধিকারী হিসেবে কণিষ্ক যে বিশাল সাম্রাজ্য লাভ করেন, তাকে নিজ বাহুবলে বিশালতর করে তোলেন। তাঁর শিলালেখ ও মুদ্রার প্রাপ্তিস্থান থেকে তাঁর সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি সম্পর্কে জানা যায়। উত্তর-পশ্চিম ভারতের সুইবিহার, জেদা, পেশোয়ার ও মানিকিয়ালায় প্রাপ্ত লেখগুলি থেকে বোঝা যায় যে সিন্ধু, পাঞ্জাব ও গান্ধার তাঁর রাজ্যভুক্ত ছিল। কৌশাম্বী, শ্রাবন্তী, সারনাথ ও মথুরায় প্রাপ্ত লেখগুলি প্রমাণ করে যে, উত্তরপ্রদেশ তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। সম্ভবত মধ্যপ্রদেশও তাঁর কর্তৃত্বাধীন ছিল। কারণ সাঁচীতে ঠিক তাঁর পরবর্তী নৃপতি বাসিষ্কের একটি শিলালেখ পাওয়া গেছে। লেখয় উল্লেখিত তারিখ (কণিষ্কাব্দের ২২-তম বর্ষ) থেকে অনুমিত হয় যে, ঐ সময়ে বাসিদ্ধ কণিষ্কের সহকারী ছিলেন। সাহিত্যিক উপাদান থেকেও তাঁর রাজ্যজয়ের কথা জানা যায়। রাজতরঙ্গিনী অনুযায়ী তিনি কাশ্মীর জয় করেছিলেন। চৈনিক ও তিব্বতীয় সূত্র থেকে জানা যায় কণিষ্ক পাটলিপুত্র দখল করেছিলেন। বৌদ্ধ কিংবদন্তী অনুসারে দার্শনিক অশ্বঘোষ এখানে ধৃত হয়ে কণিষ্কের রাজধানী পুরুষপুরে আনীত হয়েছিলেন। বাংলায় তাঁর কিছু মুদ্রা পাওয়া গেছে। কিন্তু এর ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় না যে বাংলা পর্যন্ত তাঁর সাম্রাজ্য সম্প্রসারিত হয়েছিল। অলবেরুণীর বিবরণ থেকে জানা যায় যে, আফগানিস্তান কণিষ্কের সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। সুরথ কোটালে প্রাপ্ত একটি লেখও এ বিষয়ে পরোক্ষ সাক্ষ্য দেয়। উজ্জয়িনীর শকদের সাথে তাঁর সম্পর্কের বিষয়টি অনিশ্চিত। অনেকে মনে করেন শক-ক্ষত্রপ চস্টন তাঁর বশ্যতা স্বীকার করেছিলেন। সেক্ষেত্রে কুষাণ সাম্রাজ্য পশ্চিম দিকে গুজরাট তথা কাথিয়াবাড় পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। কনিষ্কের লেখগুলির সাক্ষ্য থেকে স্পষ্ট যে বর্তমান পাকিস্তানের প্রায় সমগ্র এলাকা কুষাণ সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। কণিষ্ক মধ্য-এশিয়ার চীনা কর্তৃত্বনাশের জন্য অভিযান চালান। তবে প্রথম যুদ্ধে তিনি চীনা সেনাপতি প্যানচাও-এর নিকট পরাজিত হয়ে করপ্রদানে স্বীকৃত হন। তবে প্যানচাও-এর মৃত্যুর পর কণিষ্ক চীনাদের পরাজিত করে কাশগড়, খোটান, ইয়ারখন্দ নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করেছিলেন। এইভাবে কণিষ্ক এক বিশাল অঞ্চলে নিজ-কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন, যার মধ্যে উত্তর-ভারতের সমগ্র অংশ ছাড়াও ভারতের বাইরের ব্যাকট্রিয়া, আফগানিস্তান, সোভিয়েট, মধ্য-এশিয়ার বেশ কিছু অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত ছিল।
অশোকের মত কণিষ্ক ছিলেন বৌদ্ধধর্মের একজন একনিষ্ঠ সেবক। ড. হেমচন্দ্র রায়চৌধুরীর মতে, “বিজেতা অপেক্ষা শাক্যমুনির ধর্মের অনুরাগী হিসেবে কণিষ্ক ইতিহাসে স্থায়ী কৃতিত্বের অধিকারী হয়েছেন।” কণিষ্ক প্রথম জীবনে ছিলেন শৈব। পরে তিনি বৌদ্ধধর্মে আকৃষ্ট হন। তাঁর প্রচেষ্টায় বৌদ্ধধর্ম দেশ-বিদেশে প্রসার লাভ করে। হিউয়েন-সাঙ-এর বিবরণ থেকে জানা যায় যে, তিনি পুরুষপুরে একটি বহুতল চৈত্য নির্মাণ করেছিলেন। সম্ভবত এজেসিলাস নামক জনৈক গ্রীক স্থপতি এই চৈত্যের নকশা তৈরি করেছিলেন। এছাড়া, কণিষ্ক বহু স্তূপও নির্মাণ করান। তাঁর চেষ্টায় বৌদ্ধধর্ম চীন ও মধ্য-এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রসারলাভ করেছিল। কণিষ্কের আমলের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল চতুর্থ বৌদ্ধসংগীতি অনুষ্ঠান। ইতিপূর্বে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে কিছু কিছু নীতিগত ও আচারগত মতভেদ দেখা দিয়েছিল। এই মতভেদ দূর করার উদ্দেশ্যে কণিষ্ক কাশ্মীরে (মতান্তরে জলন্ধরে) একটি বৌদ্ধ ধর্ম-সম্মেলন আহ্বান করেন। এই সম্মেলনের সভাপতি ছিলেন বৌদ্ধশাস্ত্রজ্ঞ বসুমিত্র। এছাড়া পার্শ্ব, অশ্বঘোষ প্রমুখ পণ্ডিত এই সভায় উপস্থিত ছিলেন। এখানেই বৌদ্ধগ্রন্থ ত্রিপিটক-এর উপর অসংখ্য টিকা রচিত হয়েছিল। এই সংগীতিতে বৌদ্ধ ধর্ম মতের যথার্থ ব্যাখ্যা গৃহীত হয় এবং তা একটি তাম্রফলকে উৎকীর্ণ করে একটি স্তূপে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। এই সম্মেলনে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা ‘হীনযান’ ও ‘মহাযান’ এই দুই গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে যান। মহাযান মত সরকারীভাবে গৃহীত হয়।
কণিষ্কের পৃষ্ঠপোষকতায় শিল্প ও সাহিত্যের প্রভূত বিকাশ ঘটেছিল। কবি, সাহিত্যিক-দার্শনিক অশ্বঘোষ, কণিষ্কের রাজসভা অলংকৃত করেছিলেন। তাঁর রচিত বুদ্ধচরিত, সৌন্দরানন্দ কাব্য, বজ্রসূচী প্রভৃতি গ্রন্থ উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ‘প্রজ্ঞা পারমিতা-শত-সহস্রিকা’ প্রণেতা নাগার্জুন, ‘মহাবিভাষ্য’ গ্রন্থের রচয়িতা বসুমিত্র, ‘আয়ুর্বেদশাস্ত্র’ প্রণেতা চরক প্রমুখ কণিষ্কের রাজত্বকালকে গৌরবমণ্ডিত করেছিলেন। শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষক রূপেও কণিষ্ক খ্যাতির অধিকারী ছিলেন। স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রকলার বিকাশে তাঁর বিশেষ অবদান ছিল। পেশোয়ারে নির্মিত মঠ, মথুরা ও কণিষ্কপুর নগরী, সারনাথ, গান্ধার, অমরাবতীতে নির্মিত অসংখ্য চৈত, মঠ ও বৌদ্ধমূর্তি সে যুগের শিল্পকলার প্রমাণ বহন করে। কণিষ্কের রাজত্বকালেই গ্রীক ও ভারতীয় শিল্পরীতির সংমিশ্রণে উদ্ভূত ‘গান্ধার শিল্প’ উন্নতির চরম শিখরে উঠেছিল।
উপরের আলোচনার ভিত্তিতে বলা যায়, কণিষ্ক ছিলেন প্রাচীন ভারতের শ্রেষ্ঠ শাসদের অন্যতম এবং বহিরাগত ভারতীয় শাসকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম। কেবল সাম্রাজ্য সংগঠন নয়, সুশাসন, শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশের মাধ্যমে সেই সাম্রাজ্য এক পরিপূর্ণতা লাভ করেছিল কণিষ্কের কৃতিত্বে।
কণিষ্ক-পরবর্তী কুষাণ সম্রাটগণ :
কণিষ্ক নিজ অব্দের ২৩-তম বর্ষ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। অর্থাৎ তাঁর রাজ্যকাল শেষ হয় ১০১ খ্রিষ্টাব্দে। এই ২৩ বছরের শেষ তিন বছর বাসিন্ধ তাঁর সাথে যুগ্মভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করেছিলেন। কারণ বাসিষ্কের কামরা লেখর তারিখ কণিষ্কাব্দের ২০-তম বর্ষ।
আর বাসিষ্ক অন্তত কণিষ্কাব্দের ২৮-তম বর্ষ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন, তা জানা যায় তাঁর সাঁচীলেখ থেকে। সুতরাং তিনি ৯৮-১০৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। কামরা ও সাঁচীলেখ ছাড়াও কণিষ্কাব্দের ২৪ তম বর্ষের ইসাপুর লেখ থেকেও বাসিদ্ধ সম্পর্কে জানা যায়। সাঁচীলেখতে তাঁর সম্পর্কে ‘মহারাজ রাজাতিরাজ দেব পুত্র শাহী’ অভিধা ব্যবহার করা হয়েছে। এ থেকে অনুমিত হয় যে, কণিষ্কের বিশাল সাম্রাজ্যের বিস্তৃত অংশই তাঁর অধিকারভুক্ত ছিল। রাজত্বের শেষ দুবছর পরবর্তী শাসক হুবিদ্ধ তাঁর সাথে যুগ্মভাবে শাসন পরিচালনা করেছিলেন। কারণ প্রাপ্ত লেখ থেকে জানা যায়; হুবিদ্ধ কণিষ্কাব্দের ২৬ থেকে ৬০-তম বর্ষ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। অর্থাৎ তাঁর রাজ্যকাল ছিল ১০৪ থেকে ১৩৮ খ্রিষ্টাব্দ, এই দীর্ঘ ৩৪ বছর। রাজতরঙ্গিণীতে হুষ্ক বলে যে শাসকের উল্লেখ আছে, তিনি ও হুবিদ্ধ একই ব্যক্তি ছিলেন বলে মনে হয়। তা হলে কাশ্মীর তাঁর রাজ্যের অন্তর্গত ছিল বলা চলে। রাজতরঙ্গিণী অনুযায়ী তিনি কাশ্মীরে হুষ্কপুর বলে একটি নগরও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। হুবিষ্কের লেখ আফগানিস্তানে পাওয়া গেছে।
এ থেকে প্রমাণিত হয় আফগানিস্তানের উপরে তাঁর নিয়ন্ত্রণ ছিল। হুবিষ্কের বহু স্বর্ণমুদ্রা ও তাম্রমুদ্রা পাওয়া গেছে, যা তাঁর সময়ের সাম্রাজ্যের আর্থিক সমৃদ্ধির পরিচায়ক। এই সব মুদ্রায় ভারতীয়, গ্রীক, জোরাথুষ্ট্রীয় দেবদেবীর প্রতিকৃতি মুদ্রিত রয়েছে। এ থেকে মনে হয় যে, তিনি ধর্মবিষয়ে উদার ছিলেন। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে প্রাপ্ত আরা লেখ থেকে কুষাণবংশীয় আর একজন নৃপতির কথা জানা যায়, যার নামও ছিল কণিষ্ঠ। ইনি সম্ভবত বাসিষ্কের পুত্র ছিলেন ও কণিষ্কাব্দের ২০ তম বর্ষে এঁর জন্ম হয়। এঁকে ‘দ্বিতীয় কণিষ্ক’ বলা হয়ে থাকে। আরা লেখর তারিখ কণিষ্কাব্দের ৪১ তম বর্ষ। ঐ লেখর সাক্ষ্য থেকে মনে হয় যে, দ্বিতীয় কণিষ্ক কিছুদিন হুবিষ্কের সহকারী হিসেবে শাসন পরিচালনা করেছিলেন। এঁর সম্পর্কে আর বিশেষ কিছু জানা যায় না। এর পর রাজা হন প্রথম বাসুদেব, যিনি ৬৪ কিংবা ৬৭ কণিষ্কাব্দ থেকে ৯৮ কণিষ্কাব্দ (১৪২/১৪৫-১৭৬ খ্রিঃ) পর্যন্ত রাজত্ব করেন।
এঁর সময়ে কুষাণ সাম্রাজ্য আকারে অনেক ক্ষুদ্র হয়ে পড়ে। বাসুদেব শৈবধর্মের প্রতি অনুরাগী ছিলেন। এই বাসুদেবের সময় পর্যন্তই ভারতের অভ্যন্তরে কুষাণ অধিকার বজায় ছিল। এরপরেও কুষাণগণ বেশ কিছুকাল শাসন করেন। কিন্তু সেই সময় কাবুল উপত্যকা, পাঞ্জাব ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের মধ্যেই কুষাণদের রাজত্ব সীমাবদ্ধ ছিল। এ সময়ের রাজাদের মধ্যে তৃতীয় কণিষ্ক ও দ্বিতীয় বাসুদেবের নাম করা যায়। ভারতের অভ্যন্তরের যে বিশাল ভূ-ভাগ কুষাণগণ শাসন করতেন, তা ক্রমশ খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে বিভিন্ন স্থানীয় শাসকদের অধীনস্থ হয়ে পড়ে। পশ্চিম ভারতে শকগণ শক্তিশালী হয়ে ওঠে, মথুরা অঞ্চল চলে যায় নাগদের অধীনে, রাজপুতানা ও মধ্যপ্রদেশে মালব, অর্জুনায়ণ, যৌধেয় প্রভৃতি প্রজাতান্ত্রিক শক্তির উদ্ভব ঘটে। বহির্ভারতে কুষাণ সাম্রাজ্য যে অংশটুকুতে টিকে ছিল, খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতকের মধ্যভাগে শাসানীয় সাম্রাজ্যের উত্থানের ফলে তারও অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে দাঁড়ায়। পরিশেষে কুষাণগণ শাসানীয়দের বশ্যতা স্বীকার করে নেয়।
কুষাণ রাজনীতির উপর অর্থনীতির প্রভাব :
দীর্ঘকাল ধরে মনে করা হত যে, কুষাণ সাম্রাজ্য ছিল বিদেশীদের দ্বারা শাসিত একটি ভারতীয় সাম্রাজ্য, কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণার ফলে এই ধারণার পরিবর্তন ঘটেছে। ড. ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এর ভারতীয় কুষাণ সাম্রাজ্য, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিষয়ে গবেষণার পর ভারত ইতিহাসের নতুন দিক উন্মোচিত হয়েছে। ড. মুখোপাধ্যায় দেখিয়েছেন যে, চৈনিক উপাদান কিয়েন-হান-সু এবং হৌ-হান-সু অনুসারে প্রথমদিকে কুষাণ সাম্রাজ্যের মূলকেন্দ্র ছিল পূর্ব ব্যাকট্রিয়া। পতনের অব্যহিত পূর্বে কুষাণদের রাজধানী ছিল ব্যাকট্রিয়ার অন্তর্গত বাল্ল্খ। ঐতিহাসিকদের ধারণা ব্যাকট্রিয়া ছিল কুষাণ সাম্রাজ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও আকর্ষণীয় অংশ। প্রসঙ্গত মনে রাখা দরকার যে, ভারত উপমহাদেশে প্রবেশের আগে মধ্য এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল কুষাণদের অধিকার ছিল অর্থাৎ কুষাণ সাম্রাজ্য প্রকৃতপক্ষে একটি ভারতীয় সাম্রাজ্য ছিল না। এটি ছিল মূলত একটি মধ্যএশীয় সাম্রাজ্যে। ভারতের বিভিন্ন অংশ এই মধ্যএশীয় সাম্রাজ্যের সাথে কিছুকালের জন্য যুক্ত হয়েছিল মাত্র।
প্রশ্ন হওয়া স্বাভাবিক ভারত উপমহাদেশে রাজ্যজয়ের পেছনে কুষাণদের মূল প্রেরণা কি ছিল। আপাত দৃষ্টিতে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, রাজনৈতিক কর্তৃত্বের প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা কুষাণদের ভারতীয় রাজ্যজয়ের ইন্ধন যুগিয়েছিল। কিন্তু ড. মুখোপাধ্যায় মনে করেন যে, সেই সময়ে সমৃদ্ধ ভারতে রোম বাণিজ্য এবং নিম্ন সিন্ধু উপত্যকা অর্থনীতির কথা মনে রাখলে শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণের মধ্যে এই সম্প্রসারণের ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। হৌ-হান-শুর গ্রন্থ থেকে অনুমান করা যায় যে, কুষাণদের রাজনৈতিক কর্মসূচীর সাথে অর্থনৈতিক স্বার্থ গভীরভাবে জড়িত ছিল। সেন-টু বা সিন্ধু উপত্যকা জয়ের ফলে কুষাণরা বিশেষভাবে ধনী ও শক্তিশালী হয়েছিল। উত্তরাঞ্চলে কুষাণদের কাছে নিম্ন সিন্ধু উপত্যকা ভৌগোলিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। তা সত্ত্বেও সেন-টু দখলের ফলে অর্থনৈতিকভাবে কুষাণদের শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছিল।
চৈনিক উপাদান থেকে জানা যায় যে, ইউ-চি অধিকারের সময় সেন-টুর সাথে রোম সাম্রাজ্যের নিয়মিত বাণিজ্য চলছিল। রোম সম্রাট অগাস্টাস এই সময় থেকে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পার্থিয়ার মধ্য দিয়ে প্রসারিত পথটি পরিহারের কথা ভাবেন। কারণ পার্থিয়গণ কেবল শত্রুভাবাপন্ন ছিল তাই নয়, তারা উচ্চহারের বাণিজ্য শুল্ক দিতে বাধ্য করত। তাই এই বাণিজ্যের বেশিরভাগ মধ্য এশিয়া থেকে ভারতীয় বন্দরগুলি স্থানান্তরিত হয়েছিল। পেরিপ্লাস গ্রন্থ থেকে চীনের রেশম ও রেশমজাত বাণিজ্যের ভারতীয় বন্দরগুলির গুরুত্বের কথা জানা যায়। স্কাইথিয়া থেকে রেশম সুতোর রপ্তানির কথা জানা যায়। এই সুতো নিশ্চয় নিম্ন-সিন্ধু এলাকায় নিয়ে যাওয়া হত। এই সকল যুক্তির ভিত্তিতে ড. ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় মনে করেন যে, নিম্ন সিন্ধু উপত্যকায় বাণিজ্যিক গুরুত্ব দ্বিতীয় কদফিসকে এই অঞ্চল জয়ের প্রলুব্ধ করেছিল। তিনি বুঝেছিলেন যে, এই অঞ্চল জয় করলে কুষাণরা চীনের প্রভাব মুক্ত এবং সমুদ্র পর্যন্ত প্রসারিত রেশম বাণিজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে। কারণ পরিবর্তিত পথের বাণিজ্যের জন্য চীন-রোম বাণিজ্যের জন্য ব্যবসায়ীদের খুব বেশি সংখ্যক বন্দরে শুল্ক দিতে হবে না। তাছাড়া শক্তিশালী সরকার কর্তৃক সুরক্ষিত এই বাণিজ্য পথে বাণিজ্যতরী নিরাপদে যাতায়াত করতে পারবে। এইভাবে নিম্ন সিন্ধু অঞ্চলের মধ্য দিয়ে তখন একদিকে মধ্য এশিয়ার সাথে উত্তর পশ্চিম ভারতে অন্যদিকে রোম সাম্রাজ্যের সাথে অন্যান্য পশ্চিমি দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তাই এই অঞ্চল অধিকারের মধ্য দিয়ে কুষাণরা দ্বিমুখী বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ এবং তা থেকে শুল্ক আদায়ের সুযোগ পেয়েছিল।
কুষাণ সাম্রাজ্যের ক্রমাবনতির ইতিহাস থেকেও এই বহির্বাণিজ্যের ওপর তাদের নির্ভরতার প্রমাণ পাওয়া যায়। খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতকের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে রোম সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চলে এবং নিম্নসিন্ধু এলাকার মধ্যে বাণিজ্যের অবনতি ঘটেছিল। রোমের বণিকরা যখন সমুদ্র যাত্রার জন্য বাণিজ্য বায়ুশক্তির ব্যবহার শিখেছিল। তাই তারা নিম্নসিন্ধু এলাকা পরিহার করে সরাসরি দক্ষিণ ভারতে পাড়ি জমাতে পারত। তাই একদা এই অঞ্চল যে সমৃদ্ধ বাণিজ্য চলত খ্রিষ্টপূৰ্ব দ্বিতীয় শতকের মধ্যভাগে তা আর অবশিষ্ট ছিল না। প্রায় একই সময়ে কুষাণ সাম্রাজ্যের অবনতি ঘটেছিল। এই পরিস্থিতি থেকে ধরে নেওয়া সম্ভব যে, ভারতীয় রাজনীতি থেকে কুষাণদের সরে যাওয়ার পেছনে অর্থনৈতিক বিপর্যয় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
কুষাণ শাসনব্যবস্থা :
কুষাণদের শাসনব্যবস্থার প্রধান রূপকার ছিলেন প্রথম কণিষ্ক। তাঁর উত্তরসূরীরা কণিষ্ক প্রতিষ্ঠিত শাসন রীতিকেই অনুসরণ করেছেন। তাই কণিষ্কের শাসন ব্যবস্থা ও কুষাণ শাসনব্যবস্থা অভিন্ন বলা যায়। সাম্রাজ্য গঠনের পাশাপাশি কণিষ্ক সাম্রাজ্যের সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য একটি দক্ষ ও গতিশীল শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। কুষাণ শাসকরা রাজার দৈব অধিকারে (Divine rights) বিশ্বাস কণিষ্ক নিজেকে ‘দেবপুত্র’ বলে অভিহিত করেছেন। কুজুল কদফিসেস কুষাণদের দৈব অধিকার তত্ত্বের প্রচারক বলে অনেকে মনে করেন। মুদ্রায় অঙ্কিত কুষাণ রাজাদের প্রতিকৃতিতে মাথার পিছনে জ্যোতির্বলয়ের অস্তিত্ব, কুষাণ রাজাদের নামে মন্দির স্থাপন ইত্যাদি থেকে অনুমিত হয় যে, প্রজাসাধারণের শ্রদ্ধা ও আনুগত্য সুনিশ্চিত করার জন্য কুষাণ রাজারা নিজেদের দেবতার মনোনীত প্রতিনিধি বা দেবতাদের সমপর্যায়ভুক্ত বলে প্রচার করতেন। তবে নীতিগতভাবে কুষাণ শাসকরা স্বৈরাচারী ছিলেন না। প্রথম কণিষ্ক যে বিকেন্দ্রীভূত শাসন ধারা প্রবর্তন করেছিলেন, তাতে রাজার নিরঙ্কুশ স্বৈরাচারের সুযোগ ছিল না। কার্যত নানা স্তরের ও ক্ষমতাবিশিষ্ট রাজকর্মচারী ও প্রতিষ্ঠান রাজার স্বৈরতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারত। কণিষ্ক প্রশাসনিক বহু ক্ষমতা প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের হাতে অর্পণ করেছিলেন। তাছাড়া তাঁর শাসন এলাকার মধ্যে অনেকগুলি অর্ধ-স্বাধীন রাজ্য বা স্বশাসিত উপজাতি গোষ্ঠীর অস্তিত্ব ছিল। সর্বোপরি, একটি মন্ত্রিপরিষদ রাজার পরামর্শদাতা হিসেবে সক্রিয় ছিল।
কুষাণ রাজাদের মধ্যে দ্বৈত রাজত্বের বিষয়টি প্রচলিত ছিল। অর্থাৎ রাজত্বকারী রাজা বেশ কিছু বছর রাজত্ব করার পর সিংহাসনের সম্ভাব্য উত্তরাধিকারীকে নিজের সহকারী সম্রাটের মর্যাদা দিতেন। শিলালেখতে বিভিন্ন কুষাণরাজার রাজত্বকাল উল্লেখিত হয়েছে। এ থেকেই ব্যাপারটি স্পষ্ট হয়। যেমন, কণিষ্ক নিজ অব্দের ২৩-তম বর্ষ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। কিন্তু তাঁর পরবর্তী শাসক বাসিঙ্ক রাজত্ব করেন কণিষ্কাব্দের ২০-২৮-তম বর্ষ পর্যন্ত। এর থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, কণিষ্ঠ তাঁর রাজত্বের শেষ তিন বছর ও বাসিদ্ধ তাঁর রাজত্বে প্রথম তিন বছর (২০-২৩ কণিষ্কাব্দ) যুগ্মভাবে রাজ্য পরিচালনা করেছিলেন। এই রীতি এর পরবর্তী কুষাণ রাজাদের ক্ষেত্রেও অব্যাহত ছিল। বাসিদ্ধ সম্রাট হওয়ার কয়েক বছর পর হুবিষ্ককে সহযোগী সম্রাটের মর্যাদা দেন। হুবিদ্ধ পুরোপুরি সম্রাট পদে কিছুকাল কাটানোর পর দ্বিতীয় কণিষ্ক সহকারী সম্রাটের মর্যাদা পেয়েছিলেন।
কণিষ্ক শাসন পরিচালনার কাজে তাঁর মনোনীত স্থানীয় শাসকদের হাতে প্রচুর ক্ষমতা দেন। শক্-পার্থিয়দের মত তিনি ক্ষত্রপ ও ‘মহাক্ষত্রপ’ মর্যাদার অধিকারী কর্মীদের মাধ্যমে শাসন চালাতেন। সম্ভবত কণিষ্ক সমকালীন পারস্যে প্রচলিত শাসনরীতি দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে এই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। তবে কুষাণ সাম্রাজ্যে ক্ষত্রপ ও মহাক্ষত্রপদের সাথে পারস্যের প্রচলিত ব্যবস্থার কিছু প্রভেদ ছিল। কুষাণ আমলে ক্ষত্রপ বা মহাক্ষত্রপদের ক্ষমতা ও অধিকার তুলনামূলক বিচারে বেশী ছিল। ক্ষত্রপগণ কখনও বা ‘রাজা’ উপাধি ধারণ করতে পারতেন। কণিষ্কের রাজত্বের তৃতীয় বছরে উৎকীর্ণ সারনাথ লেখ থেকে জানা যায় যে, মহাক্ষত্রপ, ক্ষরপল্লন এবং ক্ষত্রপ বনস্পা তাঁর সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চল শাসন করতেন। সম্ভবত এঁরা পিতা-পুত্র ছিলেন। তাঁর একাদশ রাজ্য বর্ষে উৎকীর্ণ জেডা লেখতে লিয়াকা নামক এক ক্ষত্রপের উল্লেখ পাওয়া যায়। অষ্টাদশ রাজ্যবর্ষে রচিত রাওলপিণ্ডি লেখতে (মানিকিয়ালা) ক্ষত্রপ বেসপাসির উল্লেখ আছে। তিনি সম্ভবত তক্ষশিলার শাসনদায়িত্বে ছিলেন। অনেকে মনে করেন যে, পশ্চিম ভারতের শক শাসক নহপান এবং চষ্টন একদা কণিষ্কের অধীন ক্ষত্রপ ছিলেন। তবে দূরবর্তী প্রদেশের শাসক হিসেবে তাঁরা ‘রাজন’ (রাজা) উপাধি গ্রহণে অধিকারী হয়েছিলেন। এবং নিজ নামে মুদ্রা প্রচলন করেছিলেন। এই অনুমান সত্য হলে কণিষ্কের রাজ্য পশ্চিম দিকে গুজরাট তথা কাথিয়াবাড় পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। কণিষ্কের সাম্রাজ্যের অধীনে কয়েকটি প্রজাতন্ত্র শাসিত উপজাতির অস্তিত্ব ছিল। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল সুরাষ্ট্রের অভিরগণ, রাজস্থান ও মালবের মালবগণ, ভরতপুরের যৌধেয়গণ, আগ্রার সন্নিকটে অর্জুনায়ণগণ প্রমুখ।
কণিষ্ক তথা কুষাণ শাসন কাঠামোর সর্বনিম্ন একক ছিল গ্রাম। গ্রামের মূখ্য শাসন ‘গ্রামিক’ নামে অভিহিত হতেন। গ্রামগুলি কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্বশাসনের অধিকার ভোগ করত। ‘শ্রেণী’ বা গিল্ড (Guild) জাতীয় সংগঠনগুলির শাসনব্যবস্থায় বিশেষ ভূমিকা পালন করত। শিল্পী, কারিগর ও ব্যবসায়ীদের স্বার্থ সংরক্ষণ, পণ্যদ্রব্যের গুণমান রক্ষা করা, ধর্মীয় দান সম্পর্কে তত্ত্বাবধান ইত্যাদি কাজ শ্রেণী বা সংঘের হাতে অর্পিত ছিল।
একটি মন্ত্রিপরিষদ কুষাণ রাজার প্রশাসনে সাহায্য করত। মূলত প্রশাসনিক পরামর্শদাতার ভূমিকা নিত মন্ত্রিপরিষদ। কণিষ্কের আমলে মন্ত্রিপরিষদের আয়তন যথেষ্ট বড় ছিল। তাঁর প্রধানমন্ত্রি ছিলেন মাথর। অশ্বঘোষ, চরক, সংঘরক্ষা প্রমুখ দার্শনিক, চিকিৎসক কণিষ্কের পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করতেন। সূত্রালংকার গ্রন্থে কণিষ্কের আমলের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রি হিসেবে জনৈক দেবধর্ম এর নাম পাওয়া যায়। অশ্বঘোষ ছিলেন কণিষ্কের ধর্মীয় পরামর্শদাতা। চিকিৎসা বিষয়ে পরামর্শ দিতেন। চিকিৎসক চরক। দণ্ডনায়ক নামক একজন কর্মীর নাম পাওয়া যায়। পণ্ডিতদের মতে দণ্ডনায়ক ছিলেন প্রাদেশিক শাসকদের সহকারী। সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন সেনাপতি। সেনাপতি বা দণ্ডনায়ক পদে সম্রাটের আত্মীয় বা অতি বিশ্বস্ত ব্যক্তিরা নিয়োগের সুযোগ পেতেন।
কুষাণদের রাজনৈতিক কাঠামোকে কেউ কেউ ‘ক্রমোচ্চ শ্রেণীবিন্যস্ত সামন্ততন্ত্র’ বলেছেন। এঁরা মনে করেন যে, কুষাণ রাজারা কার্যত একটি কঠোর কেন্দ্রীকরণ বিশিষ্ট শাসন কায়েম করতে আগ্রহী ছিলেন। ড. ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের মতে, কুষাণ সাম্রাজ্যে তিন ধরনের শাসনাধীন এলাকা ছিল। সম্রাটের প্রত্যক্ষ শাসনাধীন কিছু এলাকা ছিল যেখানে ক্ষত্রপ, মহাক্ষত্রপ উপাধিধারী রাজকর্মীরা শাসন পরিচালনা করতেন। ব্যাকট্রিয়া থেকে উত্তরে বেনারস পর্যন্ত এই ধরনের শাসন চালু ছিল। মুদ্রার সাক্ষ্য থেকে নিশ্চিত যে, চষ্টন কুষাণদের আনুগত্যের বিনিময়ে নিজ অঞ্চলে স্বাধীনভাবে শাসন পরিচালনা করতেন। এছাড়া ছিল কিছু সামন্তরাজ্য। এগুলি করদান ও আনুগত্য প্রদর্শন করে স্বাধীন শাসন কর্তৃত্ব ভোগ করত। অর্থাৎ আরসাকীয় বা হান সাম্রাজ্যের মত কুষাণ সাম্রাজ্যও কয়েকটি এলাকায় বিভক্ত ছিল এবং সর্বত্র শাসন ব্যবস্থার প্রকৃতি এক ছিল না। মধ্যযুগের ইউরোপে দাসশ্রম নির্ভর (ভূমিদাস) যে আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা ছিল, তার সাথে কুষাণ যুগের অবশ্যই মিল ছিল না। ডি. ডি. কোশান্তি ‘ওপর থেকে সামন্ততন্ত্র’ বিষয়ে যে মত ব্যক্ত করেছেন, তার আভাস কুষাণ শাসন রীতিতে পাওয়া যায়। এই ব্যবস্থায় সম্রাট বা রাজা নির্দিষ্ট কর প্রদানের শর্তে তাঁর অধীনস্ত ব্যক্তিকে আপন এলাকায় স্বাধীনভাবে শাসন পরিচালনার অনুমতি দেন। অন্যত্র সম্রাটের মনোনীত কর্মচারীরাই শাসন চালাতেন এবং এই শাসন ব্যবস্থার কেন্দ্রে ছিল সম্রাটের অধিষ্ঠান।
কুষাণ সাম্রাজ্যের পতনের কারণ বিষয়ে প্রাথমিকভাবে মনে করা হত যে, ভারতে বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তির উত্থান স্বাধীনতা ঘোষণা কুষাণদের পতন ডেকে এনেছিল। সাম্প্রতিক গবেষণায় মনে করা হয় যে, অভ্যন্তরীণ বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির উত্থান কুষাণ সাম্রাজ্যের পতনের জন্য যথেষ্ট ছিল না। আসলে অন্য কারণে পতনোন্মুখ কুষাণ সাম্রাজ্যের ধ্বংসস্তূপের ওপর তারা রাজ্য প্রতিষ্ঠার সুযোগ পেয়েছিল। ড. মুখোপাধ্যায় মনে করেন যে, ইরানে সাসানীয় বংশের উত্থান ও তাদের কাছে কুষাণদের আত্মসমর্পণ এই সাম্রাজ্যের পতনের মূল কারণ। ইরানের সাথে কুষাণদের শত্রুতা খুব প্রাচীন। আসাকীয় বা পার্থিয়দের আমল থেকেই ইরানের সাথে কুষাণদের যুদ্ধবিগ্রহ লেগেছিল। অদেশির নেতৃত্বে ইরানে শক্তিশালী সাসানীয় সাম্রাজ্য স্থাপিত হলে (২২৫-২২৬ খ্রিঃ) সেই শত্ৰুতা জোরালো হয়। অদেশির ও তাঁর পুত্র শাহপুর (২৪১-‘৭২ খ্রিঃ) ক্রমাগত পূর্বদিকে অগ্রসর হতে থাকেন। ব্যাকট্রিয়া অদেশির অধীনস্থ হলে কুষাণদের শক্তির মূল কেন্দ্র ধ্বসে পড়ে। শাহপুর পেশোয়ার, কাশগড়, সগডিয়ানা, তাসখন্দ অঞ্চল দখল করে নিলে কুষাণদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়। এই সুযোগে ভারতে যৌধেয়, মালব, অর্জুনায়ণ প্রভৃতি অরাজতান্ত্রিক গোষ্ঠী এদেশে কুষাণ শাসনের বিনাশ ঘটাতে তৎপর হয়। পতনের পরেও উত্তর-পশ্চিম ভারতে কুষাণ উপাধিধারী কিছু রাজা এবং কুষাণ মুদ্রার অনুরূপ মুদ্রার সন্ধান পাওয়া গেছে। তবে এই রাজাদের সাথে কুষাণদের রক্তের সম্পর্ক কিনা স্পষ্ট নয়। সম্ভবত এঁরা কুষাণ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত এলাকা শাসন করার কারণে কুষাণদের অনুরূপ উপাধি নিতেন এবং মুদ্রা অনুকরণ করতেন। তবে এই শাসকগণ অবশ্যই বিদেশীয় ছিলেন।
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।