আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের জৈন ধর্মমত” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের জৈন ধর্মমত
জৈন ঐতিহ্য অনুসারে মোট চব্বিশ জন তীর্থঙ্কর বিভিন্ন সময়ে অবতীর্ণ হয়ে জৈনদর্শন প্রচার করেছেন। সংসারের দুঃখ-কষ্ট থেকে ‘মুক্তি লাভের ‘ঘাট’ বা তীর্থ এঁরা প্রদর্শন করেছেন বলেই এদের অভিধা ‘তীর্থঙ্কর’। প্রথম তীর্থঙ্কর ছিলেন সম্ভবত ঋষভদের বা আদিনাথ। পরবর্তী তীর্থঙ্কররা নিজেদের যুগের উপযোগী করে জৈন জীবনচর্চার পরামর্শ দেন। শেষ দু’জন তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথ ও মহাবীরের আমলে জৈন দর্শনের গুণগত পরিবর্তন ঘটে। তবে প্রথম বাইশ জন তীর্থঙ্করের ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। শেষ দু’জন তীর্থঙ্কর ঐতিহাসিক ব্যক্তি বলে মনে করা হয়। জৈন বিবরণ মতে, পার্শ্ব খ্রিঃ পূঃ ৮১৭ অব্দে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতা অশ্বসেন সম্ভবত কাশী অঞ্চলের একজন গোষ্ঠীপতি ছিলেন। পার্শ্বনাথের মাতা বামা এবং পত্নী প্রভাবতী অযোধ্যা দেহত্যাগ করেন। পার্শ্ব চারটি পালনীয় কর্তব্যের ওপর জোর দেন—১. কারো প্রাণহানী না করা (অহিংসা); ২. মিথ্যা ভাষণ পরিহার করা (অনৃত); ৩ আহরণ না করা (অস্তেয়); এবং ৪. ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারী না হওয়া (অপরিগ্রহ)। এগুলি একত্রে ‘চতুর্যাম’ নামে খ্যাত।
জৈনধর্মের চব্বিশতম তথা শেষ তীর্থঙ্কর ছিলেন মহাবীর। পার্শ্বনাথে দেহত্যাগের প্রায় ২৫০ বছর পরে মহাবীরের আবির্ভাব ঘটেছিল। আনুমানিক ৫৪০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মজঃফরপুর জেলার অন্তর্গত ‘কুন্দপুর’ নামক স্থানে মহাবীরের জন্ম হয়। তাঁর বাল্যনাম ছিল বর্ধমান। তাঁর পিতা সিদ্ধার্থ ছিলেন জ্ঞাতৃক উপজাতির নেতা। মা ত্রিশলা ছিলেন লিচ্ছবি নেতা চেতকের বোন। যশোদা নামী এক ক্ষত্রিয় রাজকন্যার সাথে তাঁর বিবাহ হয়েছিল। একটি কন্যাসন্তানও ছিল। এরপর তিনি সংসারবিমুখ হন এবং ত্রিশ বছর বয়সে সংসার ত্যাগ করে কঠোর তপস্যায় রত হন। তাঁর সন্ন্যাসজীবনের অন্যতম সঙ্গী ও পথপ্রদর্শক ছিলেন আজীবিক (আজীবক) সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা ‘গোশাল’। সন্ন্যাস-জীবনের ষষ্ঠ বছরের মতদ্বৈততার কারণে গোশাল বর্ধমানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন এবং আজীবিক সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করেন। অতঃপর আরো ছয় বছর বর্ধমান নানা স্থানে পরিভ্রমণ করেন। অবশেষে সুকঠোর তপশ্চর্যার শেষে ঋজুপালিকা নদীর তীরে ভৃত্তিকা গ্রামে একটি শালবৃক্ষের নীচে উপবিষ্ট থাকা কালে ত্রয়োদশ বর্ষে তিনি বিশুদ্ধ জ্ঞান বা কৈবল্য লাভ করেন। জ্ঞান অর্জন করার ফলে তিনি সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষাকে জয় করতে সক্ষম হন। তাই তিনি ‘জিন’ (জয়ী) এবং ‘মহাবীর’ নামে পরিচিত হন। তাঁর শিষ্যরা ‘জৈন’ নামে পরিচিত হন এবং মহাবীর প্রচারিত ধর্মমত ‘জৈনধর্ম’ নামে অভিহিত হয়। সিদ্ধিলাভের পর তিনি দীর্ঘ ত্রিশ বছর তাঁর উপদেশ প্রচার করেন। আনুমানিক ৭২ বছর বয়সে রাজগৃহের সন্নিকটে পাবা নগরীতে তিনি অনশনে স্বেচ্ছামৃত্যু গ্রহণ করেন (৪৬৮ খ্রিঃ পূঃ)।
প্রত্যক্ষ, অনুমান ও আপ্তবাক্য — এই ত্রিবিধ পথে বিশ্ব-ব্রষ্মাণ্ড সম্পর্কে জ্ঞানলাভ হয় বলে জৈনদর্শনে স্বীকার করা হয়েছে। প্রত্যক্ষ দ্বারা দৃশ্য বস্তুর (Matter), অনুমান দ্বারা স্থানের (Space) এবং আপ্তবাক্য দ্বারা অতীন্দ্রিয় পদার্থের জ্ঞানলাভ সম্ভব হয়। জৈন মতে, কেবল প্রত্যজ্ঞ লম্বজ্ঞান সম্পূর্ণ হতে পারে না। যেমন রজ্জুকে সর্প বলে ভ্রম হয়। জৈনধর্ম নিরীশ্বরবাদী। এখানে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করা হয়নি। ঈশ্বরের ধারণাকে জৈন দার্শনিকরা কঠোরভাবে খণ্ডন করেছেন। জৈন গ্রন্থ ‘স্যাদবাদমঞ্জুরী’, টিকাগ্রন্থ ‘তর্করহস্যদীপিকা’ প্রভৃতিতে ঈশ্বর খণ্ডনের যুক্তিগুলি পাওয়া যায়। মূলত ‘ন্যায়বৈশেষিক দর্শনের ঈশ্বরতত্ত্বের প্রতিবাদ জৈন দর্শনে পাওয়া যায়। ন্যায় বৈশেষিকদের যুক্তি ছিল যে, জাগতিক সকল যৌগিক বস্তু পরমাণুসমূহের সংযোগে গঠিত। এই কাজ পরিচালনার জন্য একজন জ্ঞানী কর্তার প্রয়োজন। যেমন কর্তারূপী কুম্ভকার উপাদানরূপী মৃত্তিকাকে সংযুক্ত করে নানা আকারে পুনর্গঠিত করতে পারেন। কুম্ভকার যেমন মৃত্তিকা থেকে পাত্রের সৃষ্টি করেন, তেমনি ঈশ্বর পরমাণুসমূহকে সংযুক্ত করে বস্তুজগৎ সৃষ্টি করেন। জৈনদের মতে, এক্ষেত্রে জ্ঞান, ইচ্ছা ও ক্ষমতার জন্য ঈশ্বরকেও দেহ ধারণ করতে হবে এবং জন্ম-মৃত্যুর কালচক্রে পড়তে হবে। তাহলে ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যে প্রভেদ কোথায়। তাছাড়া ঈশ্বর যদি নিছক জ্ঞানের জন্য জগৎ সৃষ্টিকারী হল, তাহলে যোগীরাও তা হতে পারেন। কারণ তাঁরাও জ্ঞানের অধিকারী। তবে ব্রহ্মাণ্ডের পরিচালন ক্রিয়ায় ঈশ্বরের কর্তৃত্ব স্বীকার করা হয়নি। জৈন মতানুসারে ব্রহ্মাণ্ডের ক্রিয়াকলাপ এক শাশ্বত নিয়মে চালিত হচ্ছে। যে বিশেষ শক্তির দ্বারা বস্তুসমূহের স্থিতি (rest) ও গতি (motion) সাধিত হচ্ছে, জৈনদর্শনে তাই হল যথাক্রমে ‘ধর্ম ও ‘অধর্ম’। জৈনধর্মের মূল ভিত্তি হল জীব (soul) ও অজীব (matter)। জৈনদের কাছে জীব হল আধ্যাত্মিক চেতনার প্রকাশ এবং অজীব হল বাস্তবতার দ্যোতক। অবশ্য এই দু’টি সত্তার মধ্যে কঠোর কোন সীমারেখা টানা হয়নি। জীব ও অজীবের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়েই ব্রহ্মাণ্ডের গতি অব্যাহত আছে। জৈন মতে, ‘জীব ও অজীব (জড়) সব কিছুরই একটি আত্মা আছে।’ এখানে ধূলিকণাতেও আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়। এই অসংখ্য আত্মাই হল জীব। এই জীব বস্তু বা অজীব-এর সংস্পর্শে এসেই পৃথক হয়। জৈনরা মনে করেন যে, সকল আত্মার চৈতন্য সমান নয়। কিন্তু পূর্ণ সুখ, শান্তি ও চৈতন্য অর্জন করার শক্তি সকল আত্মারই আছে। কিন্তু কর্ম বা অজীব আত্মার এই শক্তিকে ব্যাহত করে। কর্মকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারলেই আত্মা বন্ধনমুক্ত হয়ে পুর্ণতা লাভ করতে পারবে।
জৈন তীর্থঙ্করদের উপদেশ সেই পূর্ণতাপ্রাপ্তির পথের সন্ধান দেয়। এই উপদেশ হল ‘পঞ্চমহাব্রত’ পালন। পার্শ্বনাথের চতুর্যামের সাথে মহাবীর আর একটি পালনীয় কর্তব্য যোগ করেছেন। এটি হল অনাশক্তি বা ব্রহ্মচর্য। এই পাঁচটিই মিলিতভাবে “পঞ্চমহাব্রত” নামে পরিচিত। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘সৎ-বিশ্বাস’, ‘সৎ-আচরণ’ ও ‘সৎ-জ্ঞান’। এগুলি ‘ত্রিরত্ন’ নামে পরিচিত। ‘পঞ্চমহাব্রত’ ও ‘ত্রিরত্ন’ পরিপালন আত্মাকে পূর্ণতায় উপনীত করতে পারে এবং এই পূর্ণতাই হল ‘মোক্ষ’। ব্যক্তি অবস্থায় উপনীত হলে সে দেবতারও উপরে স্থান পাওয়ার যোগ্য হয়। কারণ দেবতারাও কর্মের বন্ধনে আবদ্ধ। মোক্ষ বা মুক্তিলাভের জন্য দেবতাকেও মানুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করতে হয়। জৈনধর্মে -মানুষ এই মুক্তির পথ খুবই কঠিন। কঠোর তপশ্চর্যা, আত্মত্যাগ ও আত্মপীড়ন দ্বারাই মুক্তি অর্জন করতে হয়। তাই গৃহীর পক্ষে পরমা মুক্তি সম্ভব নয়। একমাত্র সন্ন্যাসীর আত্মাই মুক্তি পেতে পারে। অবশ্য ধর্মানুসরণের জন্য জৈনধর্মে গৃহীদের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধের কঠোরতা কিছু হ্রাস করা হয়েছে।
গৃহীদের জন্যও মহাবীর ‘পঞ্চ মহাব্রত’ পালনের নির্দেশ দিয়েছেন। তবে সেগুলির তাৎপর্য কিছুটা স্বতন্ত্র্য। কারণ সন্ন্যাসীর পক্ষে যা সম্ভব গৃহীদের পক্ষে তা সম্ভব নাও হতে পারে। ‘তত্ত্ব’ হিসেবে গৃহীরাও ‘পঞ্চমহাব্রত’ স্মরণ করবেন, কিন্তু আচারের দিক থেকে তা হবে বাস্তববাদী। যেমন, আচরণের দিক থেকে অহিংসা বলতে বোঝাবে কৃষিকর্ম ও বাণিজ্যে ব্যবহৃত পশুদের নির্যাতন না-করা। সত্য বলতে বোঝাবে অন্যের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ না-আনা, কাউকে মিথ্যা শাস্তি না দেওয়া। অস্তেয় বলতে বোঝাবে ব্যবসার প্রয়োজনে চোরাই মাল না-রাখা। ওজন ও মাপ সঠিক রাখা ইত্যাদি। ব্রহ্মচর্য বলতে বোঝাবে পরস্ত্রীর সাথে সম্পর্ক না রাখা, ব্যাভিচার থেকে বিরত থাকা এবং অপরিগ্রহ বলতে বোঝাবে জায়গা-জমি, পশু, মূল্যবান ধাতু ইত্যাদি বৈষয়িক ক্ষেত্রে লোভের দ্বারা পরিচালিত না-হওয়া। বস্তুত গৃহীদের জন্য মহাবীরের পরামর্শগুলি খুবই বাস্তববাদী এবং প্রাসঙ্গিক। সামাজিক জীবনে নৈতিকতার প্রতিষ্ঠা করে সামাজিক ন্যায়-প্রতিষ্ঠার কাজে মহাবীরের উপদেশগুলির তাৎপর্য অসীম ও কালজয়ী।
জৈনধর্মে অহিংসার উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কেবল সচেতন হিংসা নয়, অচেতন ভাবে সামান্য হিংসাকর্মও জৈনধর্মে স্বীকৃত নয়। যেমন নিজের অজ্ঞাতসারে একটা পিঁপড়ে হত্যা করাও পাপ এবং মুক্তিলাভের পথে বাধাস্বরূপ। কিংবা জলে একটি প্রস্তরখণ্ড ছুঁড়লে যেহেতু জল ও পাথর উভয়েই আঘাতপ্রাপ্ত হয়—তাই এটিও একটি পাপ এবং কঠোরভাবে বর্জনীয়। বলা যায়, জৈনধর্মের ভারকেন্দ্র অহিংসা, অহিংসার মাপকাঠিতেই একজন জৈনর ধর্মপ্রাণতা বিচার করা হয়ে থাকে। তবে এই সকল নিয়মকানুন জৈন সন্ন্যাসীদের পক্ষে যতটা কঠোরভাবে পালনীয়, গৃহীদের পক্ষে ততটা নয়। সন্ন্যাসী ও গৃহীদের ব্রতকে যথাক্রমে মহাব্রত ও অনুব্রত বলা হয়। অনুব্রত বা গৃহীর ক্ষেত্রে কেবল জীব হত্যা না করলেই অহিংসা পালন করা হয়। কিন্তু মহাব্রত অর্থাৎ সন্ন্যাসীর ক্ষেত্রে কোনো প্রাণীকে সামান্য বেদনা দিলেও তা অহিংসাব্রত ভঙ্গ করা হিসেবে দেখা হবে। অনুরুপভাবে জৈনধর্মে উপবাসসহ কৃচ্ছ্রসাধনের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। কৃচ্ছসাধনকে ধর্মাচারের অঙ্গ বলেই মনে করা হয়। এমনকি উপবাস করতে করতে মৃত্যুবরণ করাও ধর্মকার্য বলে বিবেচিত হয়।
মহাবীর তাঁর গভীর সাংগঠনিক দক্ষতা দ্বারা জৈন দর্শনকে জনপ্রিয় করে তোলেন। ধর্মপ্রচারের কাজে তাঁর প্রধান সহায়ক ছিলেন তাঁর মাতুল চেটক, মগধরাজ কুনিক এবং কৌশাম্বী রাজ স্থানক। বছরের অধিকাংশ সময় কোনো না কোনো স্থান পরিভ্রমণ করে তিনি দর্শন জ্ঞান প্রচার করেতেন।
বর্ষাকালে পূর্ব ভারতের কোনো নগরে অবস্থান করতেন। জৈন ঐতিহ্য অনুসারে ধর্মপ্রচারের লক্ষ্যে তিনি প্রথমে যান অস্থিক গ্রামে। তারপর চম্পা, বৈশালী, রাজগৃহ, মিথিলা, ভদ্রিকা প্রভৃতি স্থানে লব্ধ জ্ঞান প্রচার করেন। বিয়াল্লিশ বছরের প্রচারক জীবনের শেষ বছরটি কাটান পাবা নগরীতে। এখানেই রাজা হস্তিপালের গৃহে তাঁর জীবনাবসান ঘটে। মহাবীরের মহানির্বান উপলক্ষ্যে মল্ল ও লিছবিরা দীপাবলী উৎসব পালন করেন। মহাবীরের মৃত্যুর পর জৈন সংঘের প্রধান (বা গণধর) হন তাঁর শিষ্য ইন্দ্রভৃতি গৌতম। বারো বছর তিনি সংঘ পরিচালনা করেন। পরবর্তী গণধর সুধর্মাও বারো বছর নেতৃত্ব দেন। অতঃপর জম্বুস্বামী, প্রভব, সয়ম্ভর, যশোভদ্র প্রমুখ গণধরের দায়িত্ব পালন করেন। মৌর্যসম্রাট চন্দ্রগুপ্তের সমকালে জৈন গণধর ছিলেন ভদ্রবাহ্। ভদ্রবাহুর “কল্পসূত্র গ্রন্থে সুধর্মা থেকে তেত্রিশতম গণধর স্কন্দিল-এর নামের তালিকা পাওয়া যায়। তবে কল্পসূত্রের অন্য একটি তালিকার ষষ্ঠ গণধর ভদ্রবাহু থেকে চতুর্দশ গণধর বজ্রসেন পর্যন্ত গণধরদের শিষ্যবর্গ ও নানা শাখা ও কুলগুলির বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হয়েছে।
জৈন, শাস্ত্র অনুযায়ী মৌর্যরাজ চন্দ্রগুপ্তের আমলে, যখন জৈন গণধর ছিলেন ভদ্রবাহু, তখন মগধে এক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ফলে ভদ্রবাহু তাঁর বারো হাজার অনুগামীসহ দক্ষিণ ভারতে চলে যান। এমতাবস্থায় জৈন দর্শন হারিয়ে যাবার আকাঙ্ক্ষা দেখা দেয়। তখন স্থূলভদ্র মগধে অবস্থানকারী অবশিষ্ট বারো হাজার জৈন ভিক্ষুর এক সমাবেশ আহ্বান করেন। পাটলিপুত্রে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে এগারোটি অঙ্গ শাস্ত্র সংকলিত হয়। দ্বাদশতম অঙ্গ যার মধ্যে সর্বপ্রাচীন জৈনশাস্ত্র ‘পূর্ব’ বজায় ছিল, সেটি সংকলিত করা সম্ভব হয়নি। বহুকাল পরে ভদ্রবাহু স্বপার্ষদ মগধে ফিরে আসেন, কিন্তু পাটলিপুত্রের সংকলিত একাদশ অঙ্গের প্রামাণ্যতা মানতে অস্বীকার করেন। ফলে জৈন সংঘে বিরোধ ও ভাঙ্গন দেখা দেয়। কয়েকটি ব্যবহারিক ও নীতিগত মতভেদ সেই বিভেদ অনিবার্য করে। স্থূলভদ্রের অনুগামী মগধের জৈনরা শ্বেতবস্ত্র পরিধান করতেন। কিন্তু ভদ্রবাহুর অনুগামী শিষ্যরা মনে করতেন যে জৈন ধর্মের ত্যাগের আদর্শ চূড়ান্ত ও সার্বিক। তাই পরিধানের জন্য সামান্য বস্ত্রখণ্ডও রাখা সমীচিন নয়। এ কারণে তাঁরা উলঙ্গ থাকাই সঠিক মনে করতেন। এই কারণে স্থূলভদ্রের অনুগামীরা শ্বেতাম্বর এবং ভদ্রবাহুর অনুগামীরা দিগম্বর নামে পরিচিত হন। এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে অন্যান্য মতভেদগুলি হল—১. দিগম্বর মতে, নারীরা কৈবল্য লাভের অধিকারী নন; কিন্তু শ্বেতাম্বররা নারী-পুরুষ উভয়কেই সমান অধিকারী মনে করতেন। ২. দিগম্বরদের বিশ্বাস যে, মহাবীর কদাপি বিবাহ করেন নি; কিন্তু শ্বেতাম্বররা মহাবীরের প্রাক্-সন্ন্যাস সংসার জীবনে বিশ্বাসী। ৩. দিগম্বর মতে সংকলিত শাস্ত্রসমূহ অচল। কারণ তা মনুষ্য সৃষ্ট; কিন্তু শ্বেতাম্বররা সংকলিত দ্বাদশ অঙ্গে আস্থাশীল। সুলতানী আমলে দিগম্বররা একখণ্ড কাপড় পরতে শুরু করলেও, উভয় সম্প্রদায় পূর্ব নামেই বর্তমান।
জৈন ধর্মের বিস্তারের সাথে জৈন গুরু ও ধর্মাবলম্বীদের স্থানান্তর গমন ও বসতি স্থাপনের বিশেষ যোগ আছে। মহাবীরের ভ্রমণসূচী থেকে জৈন ধর্মের বিস্তারের গোড়ার ছবিটি পাওয়া যায়। তাঁর ভ্রমণসূচীর অন্তর্ভুক্ত ছিল কোশল, বিদেহ, মগধ ও অঙ্গ। জৈনগ্রন্থ ‘ছেদসূত্রে’ জৈন সন্ন্যাসীদের বিচরণ ক্ষেত্রের সীমানা হিসেবে পূর্বদিকে অঙ্গ-মগধ, দক্ষিণে কৌশাম্বী, পশ্চিমে স্থূনা এবং উত্তর দিকে কুনালা নির্দিষ্ট করা হয়েছে। জৈনদের প্রথম স্থানান্তর গমন ঘটে কলিঙ্গ দেশে। হাতিগুম্ফা লিপি থেকে জানা যায় এই স্থানান্তর গমন ঘটেছিল খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকে। কলিঙ্গরাজা খারবেল জৈন ধর্মের অনুরাগী ছিলেন এবং ‘ভিক্ষু রাজা’ নামেও অভিহিত হতেন। উদয়গিরি, খণ্ডগিরির জৈন গুহাসমূহ এবং পাভার-এর জৈনমঠ কলিগদেশে জৈন ধর্মের বিস্তারের প্রমাণ দেয়। পশ্চিমে মুখরা পর্যন্ত জৈন ধর্মের বিস্তার ঘটেছিল। খ্রিষ্টপূর্বকালে স্থাপিত জৈন মন্দিরের ধ্বংস স্তূপ এবং খ্রিষ্টীয় প্রথম ও দ্বিতীয় শতকের মূর্তি ও লেখমালা তার প্রমাণ দেয়। মথুরা ও সন্নিহিত অঞ্চলে প্রাপ্ত নিবেদন ফলকগুলি থেকে বিভিন্ন দাতাদের গুরু, তাঁর গোত্র, কুল, শাখা ইত্যাদির ধারণা পাওয়া যায়।
দক্ষিণ দিকে উজ্জয়িনী ও মালব অঞ্চলে জৈনধর্মের অস্তিত্ব দেখা যায়। জৈন সূত্র অনুসারে অশোকের পৌত্র সম্প্রতি উজ্জয়িনীতে জৈনধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন। সম্রাট অশোকের অনুকরণে রাজা সম্প্রতি অন্ধ্র ও দ্রাবিড় দেশে ধর্মপ্রচারক পাঠিয়ে ছিলেন। তই ধরে নেওয়া যায় যে, খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে মালব দেশে জৈন ধর্মপ্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতকে উৎকীর্ণ রুদ্রসিংহের জুনাগড় লেখ থেকে ঐ অঞ্চলে জৈন ধর্মের অস্তিত্বের আভাস পাওয়া যায়। ঐ লেখতে ‘কেবলি জ্ঞান’ সম্পন্ন মানুষদের কথা উল্লেখ আছে, যা জৈন ধর্মতত্ত্বের সাথে সামঞ্ঝস্যপূর্ণ। তাছাড়া যে গুহাতে লেখটি আবিষ্কৃত হয়েছে সেখানে বিভিন্ন জৈন মঙ্গল প্রতীক যেমন স্বস্তিকা, মীনযুগল ইত্যাদি উৎকীর্ণ ছিল। সম্ভবত এখানে জৈন সন্ন্যাসীরা বসবাস করতেন।
দক্ষিণ ভারতের জৈনধর্ম প্রসারের সময়কাল সম্পর্কে কিছু সংশয় আছে। প্রাথমিকভাবে ভদ্রবাহুর দক্ষিণ ভারতে স্থানান্তর গমনের সাথে বিষয়টিকে যুক্ত করা যায়। দিগম্বর জৈন ঐতিহ্য অনুসারে খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ দশকের শেষ দিকে মগধে দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনার কথা জানতে পেরে (রত্না নন্দিন রচিত ‘ভদ্রবাহু চরিত’ গ্রন্থের মতে ভদ্রবাহু ভবিষ্যৎ দ্রষ্ঠা ছিলেন) ভদ্রবাহু দক্ষিণ ভারতে চলে গেলে সেখানে জৈনধর্ম প্রসার লাভ করে। তবে শ্বেতাম্বর ঐতিহ্য মতে, দ্বিতীয় ভদ্রবাহুর আমলে বিশাখাচার্য বা প্রভাচন্দ্রের নেতৃত্বে দক্ষিণ ভারতে জৈন দর্শন প্রসারিত হয়েছিল। গুপ্তযুগের বিভিন্ন লেখমালা থেকে মথুরা, উদয়গিরি অঞ্চলে জৈনধর্মের অস্তিত্বের কথা জানা যায়। পাহাড়পুর তাম্রশাসনসমূহ থেকে (৪৭৮ খ্রিঃ) উত্তরবঙ্গে জৈনধর্মের জনপ্রিয়তার প্রমাণ মেলে।
জৈন ধর্মের প্রতি রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার যুগেও কঠোর অহিংসবাদী জৈন ধর্মতত্ত্বের প্রতি রাজপুরুষদের আকর্ষণ এই ধর্মমতের জীবনমুখীনতার গভীরতা প্রমাণ করে। মগধ সাম্রাজ্য গড়ার কারিগর বিম্বিসার ও অজাতশত্রু জৈন ধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত তাঁর রাজত্বের শেষ দিকে জৈন ধর্ম গ্রহণ করেন। সম্ভবত ধর্মতত্ত্বের ত্যাগ ও কৃচ্ছ্রসাধনের আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে শেষ জীবনে রাজক্ষমতা ত্যাগ করে জৈন ভিক্ষু হন এবং দাক্ষিণাত্যে অবস্থানকালে অনশনে প্রাণ দেন। অশোকের পুত্র সম্প্রতি জৈনধর্মের পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি ধর্মপ্রচারের জন্য অন্ধ ও দ্রাবিড় দেশে (তামিল অঞ্চল) দুতও প্রেরণ করেছিলেন। গুর্জর-রাজ প্রথম জয়ভট্ট ও দ্বিতীয় দদ্দ (৭ম শতক) জৈনধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। মহীশূরের গঙ্গু বংশীয় রাজারা, বাদামির চালুক্য রাজার, কাঞ্ঝীর পল্লব রাজারা জৈনধর্মের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। পাণ্ড্যদেশে জৈন ধর্মের অস্তিত্ব ছিল বলে হিউয়েন সাঙ উল্লেখ করেছেন। গুর্জর-প্রতিহার রাজা বৎসরাজ, দ্বিতীয় নাগভট্ট, ভোজরাজ, রাষ্ট্রকূট রাজা অমোঘবর্য প্রমুখ দক্ষিণ ভারতীয় শক্তিশালী রাজন্যরা জৈন ধর্মের নিষ্ঠাবান অনুগামী ছিলেন। এছাড়াও বহু স্থানীয় বা আঞ্চলিক শাসন জৈন ধর্মের অনুগামী ও প্রচারক হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। নিঃসন্দেহে এই বিপুল রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা ভারতবর্ষে জৈন ধর্মের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি ও স্থায়িত্বের সহায়ক হয়েছিল।
জৈন ধর্মগ্রন্থ সংকলনে প্রথম উদ্যোগ গৃহীত হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে। স্থূলভদ্রের উদ্যোগে পাটলিপুত্র সম্মেলনে (খ্রিঃপূঃ ৩য় শতক) তাঁর অনুগামীরা এগারোটি অঙ্গশাস্ত্র নতুনভাবে সংকলিত করেন। তবে প্রাচীনতম জৈনশাস্ত্র ‘১৪ পূব্ব’ যথাযথভাবে বজায় ছিল বলে নতুন করে সংকলন করার প্রয়োজন হয়নি। তবে ভদ্রবাহুর অনুগামী দিগম্বর জৈন সম্প্রদায় এই সংকলনকে প্রামাণ্য জৈন গ্রন্থ বলে মানতে অস্বীকার করেন। তবে দ্বাদশ অঙ্গের প্রচলিত আখ্যান রচিত হয়েছে অনেক পরে। খ্রিষ্টীয় পঞ্চম-ষষ্ঠ শতকে শ্বেতাম্বর জৈনদের উদ্যোগে গুজরাতের বলভী নামক স্থানে আয়োজিত এক সম্মেলনে দ্বাদশ অঙ্গ সংকলিত হয়। এখানে সভাপতিত্ব করেন শ্রমণ দেবর্ষি। পরবর্তীকালে দ্বাদশ অঙ্গকে ভিত্তি করে অন্যান্য জৈন ধর্মগ্রন্থ সংকলন বলা হয়।
শ্বেতাম্বর জৈন সম্প্রদায় সংকলিত জৈন গ্রন্থমালার দুটি প্রধান নাম হল (১) দ্বাদশ অঙ্গ ও (২) দ্বাদশ উপাঙ্গ। দ্বাদশ অঙ্গের প্রথমটি হল ‘আয়ার’ বা ‘আচারাঙ্গ সূত্র। এখানে জৈন সন্ন্যাসীদের আচরণ বিধি নির্দেশ করা হয়েছে। দ্বিতীয়টি হল কৃতাঙ্গ। এখানে জৈন ধর্মমতের স্বপক্ষে এবং অন্যান্য মতাদর্শের বিপক্ষে যুক্তিকাল রচনা করা হয়েছে। পঞ্চম অঙ্গটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এর নাম ‘ভগবতীসূত্র’ (বিয়াহসম্মতি)। এই অংশ জৈন মতবাদ ব্যাখ্যা করা হয়েছে। মহাবীর ও তাঁর পূর্ববর্তী তীর্থঙ্করদের বিবরণ, স্বর্গ-নরক সম্পর্কে জৈনমতবাদ ইত্যাদি আলোচিত আছে। দশম অঙ্গে জৈন ধর্মের দশটি মূল পালনীয় বিধি এবং দশটি নিষিদ্ধ কর্মের উল্লেখ আছে। একাদশ অঙ্গ (বিপাক সূত্র)-এর বিষয়বস্তু হল সৎকর্মের জন্য পুরস্কার এবং অসৎ কর্মের জন্য শাস্তি সম্পর্কে আলোচনা। দ্বাদশ অঙ্গের আলোচ্য বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে সৃষ্টির রহস্য, জন্ম ও মৃত্যু সম্পর্কিত সমস্যাবলী, তন্ত্র-মন্ত্র এবং সত্তদের জীবন কাহিনী উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিটি অঙ্গ সাহিত্যের সাথে একটি করে উপাঙ্গ যুক্ত আছে। এগুলিতে জৈন ধর্মাবলম্বী মগধ রাজাদের কথোপকথন, সৃষ্টিতত্ত্ব, জ্যোতিষবিদ্যা ইত্যাদির আলোচনা স্থান পেয়েছে। এছাড়া জৈন সাহিত্যের মধ্যে আছে ‘দশ প্রকীর্ণ’। প্রকীর্ণ শব্দের অর্থ ছড়ানো। বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে ছড়িয়ে থাকে ‘সত্য’ সম্পর্কে এখানে বলা হয়েছে। আরো আছে ছয়টি ছেদসূত্র, চারটি মূলসূত্র ও দুই চুলিকাসূত্র। শেষোক্ত সাহিত্যকে ‘বিশ্বকোষ’ এর সাথে তুলনা করা যায়। এতে ধর্ম ছাড়াও জ্ঞানের বিভিন্ন শাখা যেমন—কামশাস্ত্র, অর্থশাস্ত্র, কাব্যালংকার ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা সন্নিবিষ্ঠ আছে।
জৈন সাহিত্যের মূল আলোচ্য বিষয় নিঃসন্দেহে জৈন ধর্মতত্ত্ব, দার্শনিক ব্যাখ্যা এবং জৈনদের আচারবিধি। একই সঙ্গে এগুলি থেকে সমকালীন সমাজ ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কেও আভাস পাওয়া যায়। জৈন সাহিত্যগুলি যে ভাষায় লেখা হয়েছে তাকে অধিকাংশ পণ্ডিত ‘অর্ধ-মাগধ’ বলেই মনে করেন। কেউ কেউ এই ভাষাকে ‘জৈন-প্ৰাকৃত’ বা ‘আর্য প্রাকৃত’ ভাষা বলেছেন। প্রাচীন মহারাষ্ট্রী ভাষার দিকে জৈন সাহিত্যের ঝোঁক কিছুটা বেশী বলে জ্যাকবি মন্তব্য করেছেন। যাই হোক সমগ্র জৈনসাহিত্যে ভাষার রূপ একরকম নয়। রচনার সময় কালের প্রেক্ষিতে ভাষা পরিবর্তনের ছাপ দেখা যায়।
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।