আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০-৩০০ অব্দে সামাজিক অবস্থা : জাতিবর্ণপ্রথা” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০-৩০০ অব্দে সামাজিক অবস্থা : জাতিবর্ণপ্রথা
খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০-৩০০ শতক পর্যন্ত সময়কালের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস পুনর্গঠনের উপাদান হিসেবে সাহিত্যগত ও প্রত্নতাত্ত্বিক উভয় উপাদানই গুরুত্বপূর্ণ। সাহিত্যগত উপাদানের মধ্যে বৌদ্ধ ত্রিপিটক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া পালিতে রচিত মিলিন্দপএ্যহো, মহাবংস, চুন্ডুবংস, দীপবংস প্রভৃতি গ্রন্থাবলী এবং সংস্কৃতে (মিশ্র) রচিত দিব্যাবদান, ললিতবিস্তর, মহাবস্তু প্রভৃতি, প্রাকৃত ভাষায় লেখা জৈন অঙ্গশাস্ত্রসমূহ নানাভাবে আলোচ্যকালের ইতিহাসের উপর আলোকপাত করে। ধর্মসূত্রগুলিও উপাদান হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। এদের রচনাকাল খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ থেকে ৩০০ শতকের মধ্যে। অনুরূপভাবে পানিনির অষ্টাধ্যায়ী খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকে রচিত হয়েছিল। এর বিষয়বস্তু মূলত ব্যাকরণ হলেও, বহু সামাজিক প্রসঙ্গ এতে স্থান পেয়েছে। পানিনির ব্যাকরণের ব্যাখ্যা হিসেবে খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে রচিত কাত্যায়নের ‘বার্তিকসমূহ’ থেকে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। মহাভারত ও রামায়ণ দীর্ঘকাল ধরে রচিত বা সংকলিত হয়েছিল। তবে এদের বর্ণনা থেকে আলোচ্যকালের নানা তথ্য আহরণ করা সম্ভব। বৈদেশিক বিবরণের মধ্যে হেকাসিওস (খ্রিঃপূঃ ৫৫০ অব্দ), হেরোডোটাস (খ্রিঃপূঃ ৪৯০-৪২৪ অব্দ) ইত্যাদি উত্তর-পশ্চিম ভারতের কিছু বিবরণে সমৃদ্ধ। তবে ভাষাগত ভিন্নতার কারণে এবং কৃষ্টিগত দৃষ্টিভঙ্গীর বৈপরিত্যর কারণে বিদেশীদের রচনা থেকে উপাদান সংগ্রহের ক্ষেত্রে বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন জরুরী।
পরবর্তী বৈদিক যুগের শেষ পর্ব থেকে মৌর্য শাসন প্রতিষ্ঠার অন্তবর্তী পর্যায় (খ্রিঃ পূঃ ৬০০ ৩০০ অব্দ) ভারতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের কাল হিসেবে চিহ্নিত হয়। পরবর্তী বৈদিক যুগে কৃষকের উৎপাদন নগরায়ণের বা বাণিজ্যের উপযোগী ছিল না। এটিকে সম্পূর্ণরূপে শ্রেণী বিভক্ত বা বর্ণভিত্তিক সমাজ বলা যায় না। এই কৃষক সমাজে উপজাতীয় বৈশিষ্ট্যগুলি সক্রিয় ছিল। কৃষক শ্রেণী বৈশ্য এবং তারা রাজা বা গোষ্ঠী প্রধানকে মান্যতা দিতে বাধ্য, ব্রাহ্মণদের এই বিধান শ্রেণীভেদকে প্রকট রূপ দেয়নি। উদ্বৃত্তের অভাব এর প্রধান কারণ। উপজাতীয় রীতি অনুসারে কৃষির সম্প্রসারণ তথা হাল চালনাও ছিল রাজার কর্তব্য। ফলে বৈশ্য ও রাজার মধ্যে বিশেষ দূরত্ব ছিল না। খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে কৃষিতে লৌহ উপকরণের ব্যবহার শুরু হলে উপজাতীয়, পশুচারী ও প্রায় সমতাবাদী বৈদিক সমাজে পরিবর্তন অনিবার্য হয় এবং পূর্ণ বিকশিত কৃষিভিত্তিক ও শ্রেণী বিভক্ত সমাজ গঠনের সম্ভাবনা দৃঢ় হয়। কৃষি কাজের জন্য ‘দাস’ ও ভাড়াটে মজুর নিয়োজিত হয়। এইভাবে কৃষক, কারিগর কৃষি মজুর ও কৃষি দাসদের সামাজিক উদ্বৃত্ত উপভোগের জন্য বর্ণ ব্যবস্থার কঠোরতা আরোপিত হয়। অর্থনীতির নানা ক্ষেত্রে এই অভাবনীয় পরিবর্তনের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল লোহার ব্যাপক ব্যবহার, নগরের প্রতিষ্ঠা ও বিকাশ (দ্বিতীয় নগরায়ণ), মধ্য গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলে ব্যাপক কৃষি উৎপাদন, বিভিন্ন প্রকার হস্তশিল্পের প্রসার, অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রসার, মুদ্রা অর্থনীতির প্রবর্তন ইত্যাদি। প্রত্নতত্ত্বের বিচারে খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে উত্তরের উজ্জ্বল কৃষ্ণবর্ণ মৃৎপাত্রের পর্ব শুরু হয়। এই বিলাসী মৃৎপাত্র নির্মাণ ও ব্যবহারের পাশাপাশি লৌহ কৃষি উপকরণ, অস্ত্রাদির ব্যবহার, কর আদায় এবং অঙ্গ চিহ্নিত মুদ্রার ব্যবহার ভারতের অর্থনীতিতে নতুন গতি সঞ্চার করে।
খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ ও তৃতীয় শতকে সামাজিক অবস্থা : জাতিবর্ণপ্রথা
খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ ও তৃতীয় শতকের অন্তবর্তীকালে ভারতে রাজ্যগঠন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হলেও, সমাজ ব্যবস্থাকে প্রায় অপরিবর্তনীয় রূপে ধরে রাখার প্রয়াস স্পষ্ট। ইতিমধ্যে যজ্ঞ সম্পর্কিত ব্রাহ্মণ সাহিত্যগুলির আবেদন কিছু ক্ষীণ হয়ে পড়েছিল। এমতাবস্থায় সনাতন সমাজব্যবস্থার কাঠামোটিকে রক্ষা করার লক্ষ্যে রচিত হয় সূত্র সাহিত্যগুলি। সূত্রসাহিত্য তিন প্রকার শ্রৌতসূত্র, গৃহ্যসূত্র এবং ধর্মসূত্র। ধর্মীয় যাগযজ্ঞের গুরুত্ব ও রীতি বিশ্লেষণ করে প্রথমে রচিত হয় শ্রৌতসূত্রগুলি। কিছুকাল পরে সামাজিক ও পারিবারিক আচার-অনুষ্ঠান সম্পর্কে রচিত হয় গৃহ্যসূত্র। নামকরণ, চূড়াকরণ, উপনয়ন, বিবাহ সংক্রান্ত নির্দেশিকা এই গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করা হয়। বর্ণাশ্রম ভিত্তিক সমাজব্যবস্থার উল্লেখ গৃহ্যসূত্রে প্রথম পাওয়া যায়। এখানে বৈদিক সাহিত্যের অনুরণন স্পষ্ট।
ধর্মসূত্রের বিষয়বস্তু মানুষের সামাজিক আচরণ। ধর্মসূত্রের অন্তর্ভুক্ত হল গৌতম, বৌধায়ন, আপস্তম্ব ও বশিষ্ঠ প্রমুখ ঋষির রচনা। সূত্রসাহিত্যের রচনাকাল আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক থেকে তৃতীয় শতকের মধ্যে (কারও কারও মতে খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক)। গৃহ্যসূত্রে পারিবারিক আচার আচরণ আলোচিত হয়েছে, কিন্তু ধর্মসূত্রে পাওয়া যায় সমাজচিত্র।
সূত্রসাহিত্য থেকে বৈদিক যুগের শেষ থেকে মৌর্য যুগের সূচনাকালের অন্তবর্তী সময়ের (খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০-৩০০ অব্দ) সমাজ, ধর্ম, বর্ণ, বৃত্তি ইত্যাদির আভাস পাওয়া যায়। সূত্র সাহিত্যে বৈদিক বর্ণ ব্যবস্থাকেই কঠোরভাবে অনুশীলনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। চতুবর্ণ ব্যবস্থার অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র, কাঠামো এই সময়ে অব্যাহত ছিল। সূত্র সাহিত্যের রচনাকাররাও ছিলেন ব্রাহ্মণ। স্বভাবতই বৈদিক সাহিত্যের মত এখানেও বর্ণভেদের কঠোরতা, ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় বর্ণের সামাজিক উচ্চস্থান এবং নিম্ন দুই বর্ণের জন্য কায়িক শ্রম ও সেবা দানের বিধান রাখা হয়েছে। প্রথম তিন বর্ণ দ্বিজত্বের অধিকারী। শূদ্রবর্ণ আগের মতই সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিল এবং উচ্চবর্ণের সেবা করাই ছিল তাদের জন্য শাস্ত্র নির্দিষ্ট বিধান। এ যুগেও সবর্ণ বিবাহকে উৎসাহ দেওয়া হত। তবে পরবর্তী বৈদিক যুগেই ‘অনুলোম’ (উচ্চবর্ণভুক্ত পুরুষ + নিম্নতর বর্ণের নারী) বিবাহ এবং প্রতিলোম (নিম্নতর বর্ণের পুরুষ + উচ্চতর বর্ণের নারী) বিবাহের প্রচলন ঘটেছিল। বুদ্ধের আমলেও মিশ্র বিবাহ স্বীকৃতি পায়নি। তবে এই ধরনের বিবাহজাত সন্তানদের একটা সামাজিক স্থান সূত্র সাহিত্যে নির্দিষ্ট করা হয়। বস্তুত সূত্র সাহিত্যেই বর্ণসংকর বা মিশ্র জাতি উদ্ভবের বিষয়টি এবং সামাজিক স্থান প্রথম নির্দিষ্ট করা হয়। বলা বাহুল্য এদের চতুবর্ণ ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি এবং সামাজিক বা পেশাগত মর্যাদাও ছিল প্রথম তিনবর্ণের নীচে। বৌদ্ধ ও জৈনধর্ম শূদ্রদের সামাজিক অবস্থান পাল্টাতে পারেনি। এই দুটি ধর্ম গ্রহণের ক্ষেত্রে বর্ণগত কোন বিধিনিষেধ ছিল না ঠিকই, কিন্তু সামাজিক ক্ষেত্রে শূদ্রদের অবস্থান সর্বনিম্নেই দাঁড়িয়ে ছিল। কথিত আছে যে, গৌতম বুদ্ধ ব্রাক্ষ্মণ, ক্ষত্রিয় ও গহপতি (বিত্তশালী পরিবারের কর্তা) দের সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু শূদ্রদের সমাবেশে যোগদানের কোন উল্লেখ নেই। পালিগ্রন্থেও চণ্ডালসহ নিম্নবৃত্তিতে যুক্ত দশটি শ্রেণীর উল্লেখ আছে এবং তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে ‘হীন’ বলে। অন্যদিকে ক্ষত্রিয় ও বাত্মণদের ‘উত্তম’ বলে প্রশংসা করা হয়েছে।
সূত্র সাহিত্যের রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গী ও সনাতন বর্ণব্যবস্থা রক্ষা করার প্রয়াসের কিছুটা ব্যতিক্রম বৌদ্ধ পালি সাহিত্যে দেখা যায়। বুদ্ধ চতুবর্ণ ব্যবস্থার প্রতি আস্থাশীল ছিলেন না। বৌদ্ধসংঘে যোগদানের ক্ষেত্রে বর্ণগত প্রভেদ গুরুত্ব পেত না। এ প্রসঙ্গে স্বয়ং বুদ্ধ বলেছেন যে, বিভিন্ন নদী সমুদ্রে মিশে গেলে তাদের পৃথক অস্তিত্ব যেমন লুপ্ত হয়, তেমনি বৌদ্ধ সংঘে যোগ দিলে বর্ণগত অবস্থান লোপ পায়। বৌদ্ধ পালি সাহিত্যে সামাজিক গোষ্ঠী সম্পর্কিত আলোচনার ক্ষেত্রে ‘বর্ণ’ (বন) বা জাতি শব্দের বিশেষ প্রয়োগ নেই। সেক্ষেত্রে কুল বা পরিবার শব্দটিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ব্রাহ্মণ সাহিত্যে বর্ণগত ভেদাভেদ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ‘জন্ম’কে মাপকাঠি করা হয়েছে। কিন্তু বৌদ্ধ সাহিত্যে সামাজিক মর্যাদার মাপকাঠি হিসেবে জন্ম নয় ব্যক্তির আচরণ (শীল) কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এমনকি বুদ্ধদেব চতুবর্ণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে ব্রাহ্মণের আগে ক্ষত্রিয়কে স্থান দিয়েছেন।
গৌতমবুদ্ধ জাতিবর্ণপ্রথার বাস্তব ও কার্যকরী দিগুলিকে অস্বীকার করেন নি। তবে তিনি জাতি কাঠামোর নিম্নক্রমের মানুষদেরও আধ্যাত্মিক উৎকর্ষতা সম্ভব বলেই মনে করতেন। সুত্তনিপাতে বলা হয়েছে যে, জন্মের কারণে কেউ ব্রাহ্মণ বা শূদ্র হয় না, কেবল কর্মের দ্বারাই কেউ নিচু বা উঁচু বর্ণভূক্ত হতে পারে। পরিবার বা জন্মসূত্রে কেউ ব্রাক্ষ্মণ হয় না। যার মধ্যে আত্মসংযম, অনাসক্তি, ন্যায় পরায়নতা ও সততা বর্তমান সেই ব্রাক্ষ্মণ। আলোচ্যকালে বৃত্তির তারতম্য অনুসারে ব্রাহ্মণদের সামাজিক মর্যাদার তারতম্য ছিল। ‘দসব্রাক্ষ্মণ’ জাতকে দশ প্রকার বৃত্তিধারী ব্রাহ্মণের উল্লেখ আছে। অধিকাংশ বৌদ্ধ গ্রন্থে চতুর্বর্ণ কাঠামোয় ক্ষত্রিয়দের ব্রাহ্মণদের তুলনায় শ্রেষ্ঠতর বলা হয়েছে। কারণ কৌম সমাজের মানুষ হলেও বুদ্ধ তাঁর উপজাতিকে ক্ষত্রিয় বলে দাবি করতেন। ‘ললিত বিস্তার’ গ্রন্থে দাবি করা হয়েছে যে, বোধিসত্ত্ব কখনও নিম্ন জাতিতে জন্মগ্রহণ করেন নি। তাঁদের জন্ম ঘটে ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয়কূলে। তবে যেহেতু বৌদ্ধরা ক্ষত্রিয়দের বর্ণশ্রেষ্ঠ মনে করেন, তাই তাঁদের বিশ্বাস যে মূলত ক্ষত্রিয়কূলেই বোধিসত্ত্বদের জন্ম হয় অর্থাৎ ব্রাহ্মণের বর্ণ শ্রেষ্ঠত্বের তত্ত্ব তিনি অস্বীকার করে বর্ণ ব্যবস্থার মৌলিকত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন। পক্ষান্তরে ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় বুদ্ধকে ‘লোকোত্তর পুরুষ’ বলে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করেছে এবং তাঁকে সাধারণ মানুষ রূপে পরিগণিত করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেছে।
পালি সাহিত্যে বর্ণিত ‘উত্তম’ বা উৎকৃষ্ঠ সামাজিক গোষ্ঠীর মধ্যে আছে ব্রাক্ষ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং গহপতি। ইতিপূর্বে গহপতি নামে কোন সামাজিক গোষ্ঠীর উল্লেখ কোন সাহিত্যে পাওয়া যায়নি, অনেকের মতে সংস্কৃত ‘গৃহপতি’ শব্দ থেকেই পালি ‘গহপতি’ শব্দটি নেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে ‘গহপতি’ বলতে বোঝায় গৃহের কর্তা বা পরিবারের প্রধান। আবার পালি সাহিত্যেই ‘গিহি’ বা ‘গহ’ শব্দ দ্বারা গৃহস্থকে চিহ্নিত করা হয়েছে। সুতরাং ‘গহপতি’ এবং বৈদিক সাহিত্যের ‘গৃহপতি’কে একই পর্যায়ভুক্ত বলা যায় না। ‘সংযুক্ত নিকায়’ গ্রন্থে গৃহপতিদের মধ্যে উদয়ন, জীবক, লোহিচ্চ, অনাথপিণ্ডক প্রমুখের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এঁরা ছিলেন যথাক্রমে রাজা, চিকিৎসক, ধনী ব্যক্তিত্ব ইত্যাদি। অর্থাৎ কোন বিশেষ পেশা বা বিশেষ বর্ণ কিংবা সাধারণ পরিবারের কর্তাকে নির্দেশ করে গহপতি শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি। নরেন্দ্র ওয়াগলে তাঁরা Society at the Time of Buddha গ্রন্থে পালিগ্রন্থের গহপতি বলতে সম্পদশালী ও ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে সনাক্ত করেছেন। তাঁর মতে, সমাজের বিত্তশালী যে কোন বর্ণের মানুষই ‘গহপতি’ পর্যায়ভুক্ত হতে পারতেন। গবেষক উমা চক্রবর্তীও এই মতের স্বপক্ষে যুক্তি দিয়েছেন। এঁদের মতে, পরিবারের প্রধান বৈদিক, সাহিত্যের গৃহপতি বা গহপতি। কিন্তু পালি সাহিত্যের ‘গহপতি’ হিসেবে অভিহিত হয়েছেন কেবল বিত্তশালী মানুষেরা।
আলোচ্য সময়কালে গহপতি ছাড়াও বিত্তশালী গোষ্ঠী হিসেবে ‘শ্রেষ্ঠী’ বা ‘সেঠি’ নামক গোষ্ঠীর উল্লেখ জাতক কাহিনীগুলিতে পাওয়া যায়। কেউ কেউ ‘গহপতি’ ও ‘সেটি’কে অভিন্ন বলে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু ড. রণবীর চক্রবর্তী এ বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। ডি. ডি. কোশাম্বী, রামশরণ শর্মা প্রমুখ দেখিয়েছেন যে গহপতির সম্পদের উৎস কৃষিকাজ। পালিগ্রন্থে গহপতিদের বিশাল ভূ-সম্পত্তির অধিকারী বলা হয়েছে। ভৃত্য, ক্রীতদাস এবং কৃষি শ্রমিকের সাহায্যে সেই বিশাল জমিতে কৃষি উৎপাদন করা হত। ড. চক্রবর্তী দেখিয়েছেন যে, গহপতিরা কেবল সম্পদশালী ছিলেন তা নয়, প্রশাসনিক কাজেও তাঁদের যথেষ্ট প্রভাব ও সহযোগিতা ছিল। বৈদিক বর্ণাশ্রম প্রথানুযায়ী কৃষি বা বাণিজ্যে লিপ্ত বৈশ্য সমাজে তৃতীয় স্তরভূক্ত বিবেচিত হতেন। কিন্তু একই বৃত্তিতে নিযুক্ত গহপতি ও সেটিদের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিপত্তি বৈদিক বর্ণাশ্রম প্রথার প্রতিবাদ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। অন্যদিকে ‘শোঠি’দের বিত্তের উৎস ছিল বাণিজ্য। জাতক কাহিনীতে বাণিজ্য কর্মে লিপ্ত বণিকদের তাদের বাণিজ্যের পরিমাণ ও বাণিজ্য পণ্যের বিচারে ভিন্ন ভিন্ন নামে উল্লেখ করা হয়েছে, যেমন—বৈদেহক (সাধারণ বণিক), সার্থবাহ (ভ্রাম্যমান বণিক), দক্ষিণ ভারতের উল্লুবণিক (লবণ ব্যবসায়ী) ইত্যাদি। বিত্ত ও প্রভাবের দিক থেকে অগ্রণী বণিককে বলা হত শ্রেষ্ঠী বা সেঠি। অর্থাৎ বিপুল পুঁজির অধিকারী এবং বাণিজ্য কর্মে অগ্রণী হিসেবে যিনি শ্রেষ্ঠ তিনিই শ্রেষ্ঠী’ বা সেঠি নামে অভিহিত হতেন। কালক্রমে কৃষিকাজের সূত্রে বিপুল সম্পদের অধিকারী গহপতিরাও তাঁদের উদ্বৃত্ত পুঁজি বাণিজ্যে বিনিয়োগ শুরু করেন। এবং সেই কাজে সাফল্য ও অগ্রণী ভূমিকার প্রেক্ষিতে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে গহপতিও একজন ‘শেঠি’ নামে অভিহিত হতে পারতেন।
খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকে পানিনি ‘অষ্টাধ্যায়ী’ রচনা করেন। এটি মূলত ব্যাকরণ গ্রন্থ হলেও, ব্যাকরণের সূত্রগুলি ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে তিনি যেসব দৃষ্টান্ত প্রয়োগ করেছেন সেগুলি সমাজজীবনের পরোক্ষ আভাস দেয়। পানিনি চণ্ডাল ও মৃত পশু ভক্ষণকারীদের শূদ্র শ্রেণীভূক্ত বলেছেন। তিনি শূদ্রদের ‘অনিরবসিত’ ও ‘নিরবসিত’ এই দু’ভাগে ভাগ করেছেন। যে সকল শূদ্র লোকালয়ে অন্যান্য জাতির সাথে বসবাস করত তাদের বলেছেন ‘অনিরবসিত’। অন্যদিকে লোকালয়ের বাইরে নিজের সমাজে বসবাসকারীদের বলেছেন ‘নিরবসিত’। পরবর্তী সমাজে ‘সৎ শূদ্র’ ও ‘অসৎ শূদ্র’ পৃথকীকরণের পূর্বাভাস খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০-৩০০ অব্দের সমাজেই নিহিত ছিল। শূদ্র শ্রেণীভূক্ত বহু পেশাগত জাতির অস্তিত্ব পানিনি উল্লেখ করেছেন, যেমন রজক, ক্ষত্রিয়, তক্ষণ, কুলাল, তন্তুবায় প্রভৃতি। ধর্মসূত্রে এদের শংকর জাতি বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রাক্-মৌর্য যুগে দাস প্রথার অস্তিত্ব ভারতীয় সমাজেও ছিল। তবে রোম, গ্রীস প্রভৃতি দেশের মত এই প্রথার বাড়াবাড়ি ছিল না। অতি সীমিত পরিসরে ও সীমিত প্রয়োজনে দাসদের কেনা-বেচা চলত। কেউ কেউ স্বেচ্ছায় দাসত্ব গ্রহণ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তবে পররাজ্য জয় করে দাস। সংগ্রহ করার রীতি অবশ্যই প্রাচীন ভারতে ছিল না। ভারতের জাতিবর্ণ প্রথার সাথে দাসপ্রথা আদৌ সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাই মেগাস্থিনিস ভারতে দাসপ্রথার অস্তিত্ব খুঁজে পাননি। এখানে দাস কেনা হত বা উপহার হিসেবে পাওয়া যেত বা বেতনভোগী পরিচারক দাস নামে অভিহিত হতেন। পুরাণ কাহিনীমতে রাজা হরিশচন্দ্র স্বেচ্ছায় বিশ্বামিত্রের দাসত্ব নিয়েছিলেন। পরিচারক, পরিচারিকাদের দাস-দাসী বলা হত।
মহাজনপদের যুগের সমাজেও পিতৃতান্ত্রিকতার আদর্শ গুরুত্ব পেত। সূত্র সাহিত্যে নারীর অধিকার বা সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির স্বপক্ষে বিশেষ কোন বার্তা দেওয়া হয়নি। নির্দিষ্ট বয়ঃসীমার মধ্যে বিবাহ এবং পতি ও পরিবারের সেবা করাকেই নারীর পবিত্র ও প্রধান কর্তব্য বলে তুলে ধরা হয়েছে। পুত্রবর্তী নারীকে পরিবারে বিশেষ মর্যাদা দানের কথা বলা হয়েছে। বিধবা নারীর জন্য কঠোর কৃচ্ছ্রসাধনের নির্দেশ এ যুগেও বলবৎ ছিল। আগের মতই নারীকে কুমারী জীবনে পিতার অধীন, যৌবনে স্বামীর অধীন এবং বার্ধক্যে পুত্রের অধীন বলে সূত্র সাহিত্যে স্বীকার করা হয়েছে। তবে গৌতম বুদ্ধ নারীর মর্যাদা ও স্বাধীনতা বৃদ্ধির নীরব প্রয়াস গ্রহণ করেছিলেন। বৌদ্ধসংঘে নারীর যোগদানের স্বীকৃতি, নারীর স্বাতন্ত্র্যতা রক্ষার অন্যতম প্রয়াস ছিল। নারীকে দীক্ষা প্রদান করে কিংবা পতিতা আম্রপালীর প্রদত্ত দান গ্রহণ করে বুদ্ধ স্বয়ং নারীর মর্যাদা সম্পর্কে সমাজকে একটা বার্তা দিয়েছিলেন। তবে বিবাহিতা নারীর ক্ষেত্রে পরিবারের প্রতি প্রশ্নহীন দায়বদ্ধতাকে বুদ্ধও অস্বীকার করেন নি। পরন্তু তিনি স্বয়ং স্ত্রীকে স্বামীর প্রতি দাসীসমা হওয়ার বিধান দিয়েছিলেন, ফলে নারীর অসহায়তা জনপদের যুগে আদৌ শিথীল হয়নি।
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।