আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “ছোটোগল্পরূপে রবীন্দ্রনাথের ‘অতিথি’ গল্পটির সার্থকতা বিচার করো” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
ছোটোগল্পরূপে রবীন্দ্রনাথের ‘অতিথি’ গল্পটির সার্থকতা বিচার করো
ছোটোগল্পের বিষয়বস্তু যে-কোনো বিষয়কেই নিয়ে হতে পারে। অর্থাৎ নানান অভিধায় ছোটোগল্পের পরিচয় দেখ যায়। গল্পস্রষ্টার চেতনা ও উপলব্ধিজাত মানব জীবনের চলমান স্রোতের যে-কোনো মুহূর্তকেই ছোটোগল্পে রূপায়িত করা যায়। উপন্যাসে সন্ধানী আলো ফেলে জীবনকে তন্নতন্ন করে দেখানো হয়। ছোটো-গল্প টর্চ-লাইট; যেখানে আলো পড়ে, সেটুকুই দেখা যায়, বাদবাকি থাকে অন্ধকারে। ছোটোগল্প হল জীবন-নদী থেকে তুলে নেওয়া এক আঁজলা জল। রবীন্দ্রনাথের ‘অতিথি’ গল্পে উপরিউক্ত লক্ষণগুলি কতটা বিরাজমান, সেটাই আমাদের বিচার্য্য বিষয়।
রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছের প্রথম দুটি খণ্ডে বাৎসল্য রসের নিপুণ ব্যবহার পাঠক-হৃদয়কে ভরিয়ে রাখে। প্রায় কুড়িটি গল্পের মূল রস বাৎসল্য রস। গিরিবালা (মেঘ ও রৌদ্র), রতন (পোস্টমাস্টার), মৃন্ময়ী (সমাপ্তি), সুভা (সুভা), প্রভা (সম্পাদক), মিনি (কাবুলীওয়ালা—এইসব নায়িকা চরিত্রে কন্যার ভাব প্রবল। আবার বেশ কিন্তু বালক-চরিত্রও লেখকের স্নেহ-রসে সিক্ত ৷ গোকুল (সম্পত্তি সমর্পণ), সুশীল চন্দ্র (ইচ্ছাপূরণ), কালিপদ (রাসমণির ছেলে), রসিক (পণরক্ষা), তারাপদ (অতিথি)—এসব চরিত্র লেখকের বাৎসল্য রসের প্রাবল্য।
গল্পগুচ্ছের তৃতীয় খণ্ডের ‘সবুজপত্র’ পর্বে—লেখক যখন প্রখরভাবে দেশ-কাল-সচেতন ও ঝাঁঝালো গল্প রচনায় আগ্রহী তখনও বালক-জীবন ও বাৎসল্য-নির্ভর গল্প রচনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ।
রবীন্দ্রনাথের বাৎসল্য রসের গল্পগুলির মধ্যে ‘অতিথি’ বিশিষ্ট। গল্পটিতে সংসার বন্ধনহীন, মুক্ত স্বভাব তারাপদ বহিঃপ্রকৃতির প্রাণ লীলাচঞ্চল, নিয়ত অগ্রসরমাণ মর্মসত্তার একটি অপূর্ব স্ফুরণ। তারাপদর মতো এমন সংসার-উদাসীন, আত্মভোলা অথচ সর্বকর্মে -নিপুণ, এমন সুখ-দুঃখে বীতস্পৃহ, এমন কবিত্ব গুণসম্পন্ন, নিসর্গ-সৌন্দর্য মুগ্ধ চরিত্র রবীন্দ্র-গল্প লোকেও বিরল। তাকে স্বাভাবিক করার জন্য যে পল্লি পরিবেশ রচিত হয়েছে, অন্যান্য মানুষের সঙ্গে তার যে সম্পর্ক নির্দেশ করা হয়েছে তাতে লেখকের জীবন অভিজ্ঞতা ও শিল্পসঙ্গতির মধ্যে একটা অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে।
‘অতিথি’ গল্পটি ছয়টি পরিচ্ছেদে সমাপ্ত। এগুলির মধ্যে প্রথম পরিচ্ছেদটি দীর্ঘতম। গল্প বিন্যাসের আর্টের খাতিরে রবীন্দ্রনাথ প্রথম পরিচ্ছেদে তারাপদর জীবনে ‘ফ্ল্যাশ-ব্যাক’ তুলে ধরেছেন। গল্পটি পরম্পরায় বিচার করলে লক্ষ করা যায় নানা ঘাত-প্রতিঘাত তার জীবনের কলঙ্কের রেখার মতো সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে কবিগান, পাঁচালি, গান, বাঁশিবাজান প্রভৃতি দলে নানা বিদ্যা আয়ত্ত করলেও প্রকৃতি প্রভাবে কোনো দলেরই বিশেষত্ব পাইনি। অন্তরের মধ্যে যে ছিল সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত ও একক ছেলেটির নাম তারাপদ। তার “বড়োবড়ো চক্ষু এবং হাস্যময় ওষ্ঠাধার একটি সুললিত সৌকুমার্য প্রকাশ পাইতেছে”—মাত্র একটি বাক্যে রবীন্দ্রনাথ তারাপদর দৈহিক সৌন্দর্য পাঠক-চক্ষুর সম্মুখে তুলে ধরলেন। এখানেই লেখকের শিল্পীসত্তা, যা ছোটোগল্পের অন্যতম প্রকাশ-বৈশিষ্ট্য।
‘অতিথি’ গল্পের প্রকৃতি কোনো বিচ্ছিন্ন সত্তা নয়—কিশোর তারাপদর জীবনের সঙ্গে তা যেন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাইতো তারাপদকে প্রকৃতির পটভূমিকায় তারই জীবনবর্ণনার মাধ্যমে তাকে একেবারে মিশিয়ে ফেলেছেন। সবশেষে দেখা যায় সমস্ত বন্ধন থেকে শেকল কেটে কুড়ুলকটায় নাগবাবুদের এলাকায় বিরাট রথযাত্রার মেলায় জ্যোৎস্নাভরা সন্ধ্যায় তারাপদ দেখল—কোথাও নাগরদোলা, কোনোটায় যাত্রার দল, কোনোটায় পণ্যদ্রব্যের রাশি, কোনোটায় বা কন্সার্টের দল, সবমিলে চারদিক সরগরম। ব্যতিক্রম শুধু কাঁঠালিয়া। সে অঝোরে ঘুমচ্ছে। আর তারাপদর দেশের বাড়ি থেকে বিবাহের কারণে আগত মা ও ভায়েরা কাঁঠালিয়ায় এসে দেখল, তারাপদ নেই। তারাপদর এই শেষ নিরুদ্দেশ যাত্রাও একা প্রতীকী ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে। বাস্তব পল্লিজীবনের পরিবেশ এক বিশেষ চরিত্র সৃষ্টি করে রবীন্দ্রনাথ তাঁর দার্শনিক ভাবনাকে তার মধ্যে অনুসৃত করে দিয়েছেন কিন্তু গল্পের প্রয়োজনে সম্পূর্ণ গ্রহণযোগ্য করে তুলেছেন।
জন্মসূত্রে পথিক তারাপদর অন্তরের সব রস-রহস্যকে অপূর্ব দক্ষতার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ তুলে ধরেছেন ‘অতিথি’ গল্পে। অতিথি শব্দের অর্থ যিনি তিথি দেখে আসেন না এবং যিনি হঠাৎ এসে হঠাৎই চলে যান। তারাপদ ভাই বিশ্বের নিত্য অতিথি। বাবা-মা ভাইবোন—আত্মীয়স্বজন তারাপদকে বাঁধবেন কী করে। যে কেবল পালিয়ে বেড়ায়, দৃষ্টি এড়ায়, ডাক দিয়ে যায় ইঙ্গিতে, তাকে স্নেহ-ভালোবাসা-বিবাহের বন্ধনে বাঁধা যায় না। তাইতো তারাপদ অবহেলায়, অবলীলায় জীবনের সবকিছু কিছুক্ষণের জন্য ছুঁয়ে তারপরে দূরে সরে গেছে। নীল আকাশের মতো, সমুদ্রের মতো যার মন সুদূরে পরিব্যাপ্ত, ভালোবাসার শেকলে তাকে বাঁধা যায় না, তা সোনার শেকল হলেও না। রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’ নাটকের অমল কিংবা হফম্যানের ‘হ্যানেল’ নাটকের হ্যানলকে আমরা দেখেছি, দেখেছি শরৎচন্দ্রের ইন্দ্রনাথকে। এরা কেউই তারাপদর সগোত্র নয়। তারাপদ দ্বিতীয় রোহিত। পৃথিবীর নিঃশ্বাস প্রশ্বাস, সঙ্গীতের সুর যেন তারাপদর মানব রূপ দিয়েছে। তারাপদ বিশ্ব-গল্পলোকের এক নিঃসঙ্গ যাত্রী।
সুতরাং ছোটোগল্পের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ‘অতিথি’ গল্পটি একটি সার্থক ও রসোত্তীর্ণ ছোটোগল্প বলে মেনে নিতেই হয়।
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।