ছোটোগল্প হিসাবে ‘ফসিল’ এর অভিনবত্ব বিচার করো

আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “ছোটোগল্প হিসাবে ‘ফসিল’ এর অভিনবত্ব বিচার করো” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।

ছোটোগল্প হিসাবে ‘ফসিল’ এর অভিনবত্ব বিচার করো

সামন্ততন্ত্রের অবসান ও ধনতন্ত্রের সমৃদ্ধির এক সংকটময় মুহূর্তকে এ গল্পের প্রেক্ষাপটে স্থাপন করে লেখক গল্পটিকে বিস্তৃত কালের পটভূমিতে মুক্তি দিয়েছেন। এ গল্পে দেখানো হয়েছে। অবলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য সামন্ততন্ত্রের মরিয়া প্রচেষ্টা, অন্য দিকে প্রভুত্ব। বিস্তারের জন্যে ধনতন্ত্রের বেপরোয়া প্রমাণ। সামাজিক প্রভুর লাভের তাগিদে এই উভয় শ্রেণির অনিবার্য সংঘাতে বিপন্ন অসহায় হয়ে পড়েছে কৃষিজীবী ও শ্রমজীবী জনগোষ্ঠী। আবার স্বীয় স্বার্থরক্ষার তাগিদে এ পরস্পর যুযুরাম দুই পক্ষ গোপন সমঝোতায় মিলিত হয়েছে। তাঁদের অশুভ আঁতাতের ফলশ্রুত নির্মমতায় স্তব্ধ হয়ে গেছে শোষিত নিপীড়িত মানুষের বিদ্রোহের প্রমাণ। অবশেষে গল্পের নির্মম পরিণতিটিকে লেখক স্থাপিত করেছেন মানব সভ্যতার চিরন্তন পটভূমিকায়। বিশাল এই থিমটিকে ছোটোগল্পের সংক্ষিপ্ত পরিসরে স্থাপন করে লেখক আদ্যন্ত ব্যাঙ্গাত্মক কৃষিকোষ থেকে গল্পটি বলেছেন। “নেটিভষ্টেট অল্ড্রনগড়, আয়তন কাঁটার সাড়ে আটষটি বর্গমাইল। তবুও নেটিভ ষ্টেট, বাঘের বাচ্চা বাঘই ….” এইভাবে লেখক কয়েকটি সাধারণ সহযোগে লেখক অঞ্জনগড় স্টেটের বর্ণনা সেরেছেন। অর্থাৎ তীক্ষ্ণ বিদ্রূপে লেখক ফসিল গল্পে সামন্ততন্ত্রের ও ধনতন্ত্রের নগ্নরূপটিকে প্রকট করে তুলেছেন। লেখকের এস বিদ্রুপ প্রবণ দৃষ্টিভঙ্গি যেমন ছোটোগল্পের উপযোগী ভাষা গড়ে তুলতে বর্ণনাত্মক বাহুল্যতাকে প্রশ্রয় দেয়নি তেমনি অত্যন্ত জটিল একটি থিমকে ছোটোগল্পের ফর্মের উপযোগী করে তুলেছেন।

ফসিল গল্পের প্রকরণগত অভিনবত্বের একটি উল্লেখযোগ্য দিক নিহিত আছে এ গল্পের পরিণতিতে। স্বীয় অস্তিত্ব ও স্বার্থরক্ষার তাগিদে এ গল্পের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী সামন্ততন্ত্র ও ধনতন্ত্র হাতে হাত মিলিয়েছে, প্যালেসের একটি প্রকোষ্টে উজ্জ্বল বিজলী বাতির আলোক বন্যায় ভাসতে ভাসতে, সুদীর্ঘ মেহগনি টেবিলে উপচে পড়া পানীয়ের রসাবেশে ডুব দিতে দিতে মহারাজা সচিবোত্তম আর ফৌজদার গিবসন। ম্যাককেনা, মূর আর প্যাটাসন গোপন সমঝোতায় মিলিত হয়ে মহুষ্যত্ব ও মানবতার কফিনে শেষ পেরেক ঢুকে নিয়েছে। উভয়ের নরহত্যা জনিত পাপকে লুকোতে যেমন ঘোড়ানিমের ঘোড়া নিমের জঙ্গল থেকে টেনে নিয়ে আসা হতভাগ্য কুমি প্রজাদের লাশগুলোকে চৌদ্দনম্বর পীটের খনিগহ্বরে ফেলে দেওয়া হয়েছে তেমনই মহারাজও খনি দুর্ঘটনার পশ্চাতে সিন্ডিকেটে গাফলতিকে নীরবে হজম করে নিয়েছেন। আর এ গল্পের বলিষ্ঠ প্রতিবাদী চরিত্র, সমাজ শাসকদের পাপের একমাত্র সাক্ষী, দুলাল মাহাতোর অন্তীম পরিণতি ওই খনি গহ্বরের মৃত্যু লীলায় নির্দিষ্ট হয়েগেছে। সমান্ততন্ত্র ও ধনতন্ত্রের এই মিলিত নির্মমতাাা, এ গল্পের কৃষিজীবী ও শ্রমজীবী মানুষের অসহায় বিপন্নতা ও ভয়ংকর পরিণতির দেখিয়ে পাঠকের মানকে আমূল বিদ্ধ করে লেখক গল্পটিকে কোনো নির্দিষ্ট কালসীমায় আবদ্ধ না রেখে তিনি মহাকালের ব্যাপক বিস্তৃত পটভূমিতে স্থাপন করেছেন। গল্পটির নামকরণের মধ্যেই নিহিত আছে গল্পটির তাৎপর্যগত পরিণতিটা।

‘ফসিল’ শব্দের সাধারণ অর্থ জীবাশ্ম, লক্ষ লক্ষ সুর আগে চাপাপড়ে ভূগর্ভের মৃত্তিকার স্তরে আবদ্ধ থাকা প্রাণীদের শিল্পীভূত কঙ্কাল বা হাড়ের খণ্ডকে ওপর গবেষণা করেই অতীতে ধ্বংসপ্রাপ্ত বহুবিচিত্র প্রাণীর পশ্চাতে দাঁড়িয়ে থাকে লক্ষ লক্ষ বছর ব্যপ্ত এক বিশাল পটভূমিতে স্থাপন করেছেন। সামন্ততন্ত্রের অবক্ষয় ও অস্তিত্ব রক্ষার তীব্র প্রয়াস। সামন্ততন্ত্রের অবক্ষয় ও অস্তিত্ব রক্ষার তীব্র প্রয়াস, ধনতন্ত্রের শ্রীবৃদ্ধি ও নির্মম আগ্রাসন, শ্রেণি দ্বন্দ্বের নিষ্ঠুর চিত্র, কৃষিজীবীর শ্রমজীবীতে রূপান্তর, শ্রমজীবী মানুষের মর্মান্তিক পরিণতি, নানাচিত্র ফসিল গল্পে অতি সুকৌশলে অঙ্কিত করে লেখক গল্পটিকে স্থাপন করেছেন নির্দিষ্ট কাল সীমার বাইরে। ফলত শোষক আর শোষিতের লড়াইয়ে মানুষের জন পরাভব এ গল্পে খণ্ডচিত্র, রূপে আভাসিত ছিল অন্তহীন চিরন্তনতায় ব্যপ্ত হয়েছে। ভবিষ্যতের সমাজ বদলে গেলেও শাসকের শোষণের যে কোনো সমাপ্তি নেই—এই নির্মম সত্যটি গল্পের অস্তিমে পরিস্ফুট হয়েছে। মানুষের সভ্যতার নিরাসক্ত অর্থহীনতাকে প্রকট করেছে মুখার্জীর ছলছলে চোখ আর দূরগামী ভাবনা—“লক্ষ লক্ষ বছর পরে এই পৃথিবীর কোনো এক যাদুঘরে জ্ঞানবৃদ্ধি ও প্রত্নতাত্ত্বিকের দল উগ্র কৌতুহলে স্থির দৃষ্টি মেলে দেখছে কতকগুলি ফসিল।” মুখার্জীর ভাবনার মধ্য দিয়ে গল্পের পাঠক ও লক্ষ্য লক্ষ্য বছর পেরিয়ে গিয়ে যখন আজকের অঞ্জনগড়ের ঘটনাটিকে দেখছেন, তখনত আজকের শ্রেণি দ্বন্দ্ব সংঘাত ও রক্তক্ষয়ী পটভূমিকা অন্তর্হিত হয়ে গেছেন।

যে মুহূর্তে ফসিল গুলিকে ‘যার হিউম্যান শ্রেণির বলা হচ্ছে সেই মুহূর্তেই শ্রমিকেরা চিরন্তন অনাহত্বই প্রকট হয়ে উঠেছে আর তথাকথিত হিউম্যানের শ্রেণির প্রতিনিধি হিসাবে চোখের সামনে ভেসে উঠেছে—মহারাজ, গিবসন, ফৌজদার, সচিবোত্তম, ম্যাককেনা, মূর, প্যটামিন প্রমুখ চরিত্রগুলি, নিদারুণ বিদ্রুপ ও ব্যঙ্গে লেখক মানুষ ও সভ্যতার সম্ভাবনাহীন অন্তসার শূন্যতাকে বিদ্ধ করেছেন। ‘ছোটো গল্পের বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন করায় ক্ষণকালের ছবিতে ফুটিয়ে তোলে চিরকালের বাণী।” ফসিল গল্পটির নামকরণ পরিণতি—সব কিছুইতো এই সত্যকে দ্যোতিক করে। এক বিশেষ কালের শ্রেণিদ্বন্দ্বের চিত্র থেকে লেখক পৌঁছে যেতে চেয়েছেন মানব সভ্যতার তাৎপর্য। অতএব গল্পের কাহিনি রেখা যদিও একটি বিশেষ সময় সীমায় আবদ্ধ—মুখার্জীর ভবিষ্যৎ চিন্তা ও নামকরণের মধ্য দিয়ে লেখক অনায়াসে এ গল্পে সঞ্চারিত করেছেন মানব সভ্যতার লক্ষ্য বছরের বিস্তৃতি ও ফসিলের নিরক্ত সাদা রং-এর গভীরে নিহিত রক্তাক্ত তাৎপর্য। এই তাৎপর্যের মধ্য দিয়ে মুখার্জী চরিত্রটি ও উজ্জ্বল রূপে আত্মপ্রকাশ করার অবকাশ পেয়েছে। মুখার্জী আদর্শবাদী, স্বপ্ন বিলাসী। বাস্তবের সঙ্গে তার যোগ কম। সুতরাং বাস্তবের সঙ্গে তার মানসিকতার সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। এই সংঘাতের সূচনা স্কুল তৈরিকে কেন্দ্র করে। মহারাজকে স্কুল তৈরির করার প্রস্তাব দেওয়া মাত্র মহারাজার স্পষ্ট জবাব—’কভি নেহি’। অর্থাৎ মুখার্জীর স্বপ্ন দেখা জগতে এক বিরাট প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়।

গল্পের পরবর্তী পর্যায়ে সামন্ততন্ত্র ও ধনতন্ত্রের মধ্যে সংঘাত যখন অনিবার্য হয়ে উঠেছে। মুখার্জী তখন উভয়পক্ষে সুষ্ট মীমাংসার জন্য আন্তরিক ভাবে সচেষ্ট হয়েছে। প্রজাদের বিদ্রোহ দমন করতে সে দুলাল মাহাতোর কাছে গেছে। অবশেষে একইদিনে ঘটে দেওয়া দুটি অঘটন মহারাজা ও মাইনিং সিন্ডিকেট উভয়ের মাথায় বিপর্যয়ের কালোমেঘ ঘটিয়ে তোলে। মহারাজের ডাক পড়ে। মুখার্জী এসে বুদ্ধি জোগায়, দুলাল মাহাতোকে আটক করতে বলে। তবে দুলালকে ধরার পরামর্শ দিয়ে মুখার্জী অশুস্থতা অনুভব করে কারণ যে মানুষটি তাকে ‘এজেন্ট বাবা’ বাবা বলে সম্বোধন করেছিল তাকে আটক করতে বলে মুখার্জী বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। মুখার্জীর আদর্শবাদী মানসিকতার অপমৃত্যু ঘটেছে যখন প্যালেসে মহারাজ ও সিন্ডিকেটের অপমৃত্যু ঘটেছে যখন প্যালেসে মহারাজ ও সিন্ডিকেটের গোপন সমাঝোতার সিদ্ধান্ত তার কানে কানে সংক্ষেপে শুনিয়ে দিয়েছে ফৌজদার। নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য মুখার্জী এবারেও নিরুত্তরে মেনে নিয়েছে, আপোষ করেছে মানবতার বিরুদ্ধে সেই চরমতম অন্যায়ের সঙ্গে। গভীর আত্মগ্লামী ও অন্তবিরোধের বহিপ্রকাশ স্বরূপ : “মুখার্জী চমকে ওঠে, ফ্যাকাশে হয়ে যায় মুখ। তারপর হাতের চেটোয় মুখ গুঁজে বসে থাকে।”

সর্বোপরি প্রতিবাদহীন আপোষকামিতা মুখার্জী চরিত্রের যাবতীয় কল্যাণকামী স্বপ্ন ও আদর্শবাদ, মানবিকতা ও মূল্যবোধের অপমৃত্যু ঘটলেও মধ্যবিত্ত মানবিকতা জনিত আত্মগ্লানী ও অনুশোচনা সে মুক্ত হতে পারেনি, সহজে আত্মগ্লামী ও অনুষোচনা যে মুক্ত হতে পারেনি, সহজে মেনে নিতে পারেনি মানবতা ও মনুষ্যত্বের ওপর নির্মম কশাঘাতকে। তাই শ্যাম্পেনের পাতলা নেশা আর চরুটের ধোঁয়ায় ছল ছল করে উঠেছে মুখার্জীর চোখ দুটো, আর গাড়ির বাম্পারে বসে এক সব হারানো মানুষের উদাসীনতায় সে ডুবে গেছে দূরগামী ভাবনার জগতে। মুখার্জী এই ঔদাসীনের মধ্যেই নিহিত ফসিল গল্পের মূল ভাবসত্য।

আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।

Leave a Comment