জীবনানন্দ দাশের প্রেমচেতনার কবিতার ধারায় ‘সুচেতনা’ কবিতাটির স্থান নির্ণয় করো

আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “জীবনানন্দ দাশের প্রেমচেতনার কবিতার ধারায় ‘সুচেতনা’ কবিতাটির স্থান নির্ণয় করো” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।

জীবনানন্দ দাশের প্রেমচেতনার কবিতার ধারায় ‘সুচেতনা’ কবিতাটির স্থান নির্ণয় করো

প্রকৃতি ইতিহাস সময় ও সমাজ অনুধ্যানের পাশাপাশি অনেকটা সমান্তরাল, কখনও বা কিছুটা উচ্চতর ভূমিকায় যে বিষয়টি জীবনানন্দ দাশের কাব্যে পূর্বাপর প্রাণরস সঞ্জীবিত করেছে, তা’হল প্রেম। কখনো কখনো মনে হয় তাঁর কাব্যের মুখ্য আবেদন প্রকৃতির কাছে নয়, প্রেমেরই কাছে। জীবনানন্দ নিজেই এক সময় বলেছিলেন, ‘প্রকৃতির শোভা ভূমিকায় প্রেম’ এসেছে বারবার তাঁর কাব্যে। মানবের অস্তিত্ববাদের যে সার্থক রূপায়ণ কবি বারবার খুঁজেছিলেন, সেই সন্ধান উৎস নিরুক্তির রূপ ধরে পরম্পরা ও প্রবণতা সাপেক্ষ বিশ্লেষণের পথ ধরে প্রেমের মুখ্যতম স্বরূপে পৌঁছে দিয়েছে তাঁর কবিতাকে। জীবনানন্দের বিকাশপ্রবণ চেতনায় প্রেমের স্থান তাই মহিমময়—একথা ভাবা যেতেই পারে।

প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরাপালক’-এর কবিতাগুলি লক্ষ করলে দেখা যায়, স্বকীয় প্রেম মহিমার উচ্চারণ সেখানে অনুপস্থিত, কিন্তু এমন কিছু ধ্বনি ও ভাববিশিষ্টতা সেখানে এসেছে যা প্রেমের ব্যক্তিগত প্রসঙ্গের উত্তাপ সঞ্চারিত করে দেবার পরিবর্তে এক অনিৰ্দেশ্য ব্যাকুলতার জন্ম দিয়েছে। অতীতের লুপ্ত গরিমা, বিষাদ ও মৃত্যুর সমাচ্ছন্ন এক জগৎ পেরিয়ে যা বাঞ্ছিতকে বারবার খুঁজে ফিরেছে। এই ভাবনা তাঁর কাব্যকে পৌঁছে দিয়েছে বাস্তব থেকে দুরস্থিত এমন এক কল্পনায় যথার্থ উজ্জীবন বা স্বপ্নেও যা আশ্বস্ত নয়। ‘ঝরাপালকে’র কবির প্রেম তাই যেন পিপাসার অগ্নিভিসার, ‘হৃদয়ের পাণ্ডুলিপি’ যে ‘অনন্ত অঙ্গারে’ রচনা করে। এ পর্যায়ের বেশ কিছু কবিতার সূত্র ধরে বলা যায় কবি যে নায়ককে এখানে উপস্থিত করতে চেয়েছেন, তিনি যেন অনেক বেশি ভাবের উচ্ছ্বাসে জারিত। আত্মবিস্মৃত কবির কণ্ঠে প্রেমময় শব্দ-কাব্য ধ্বনি যেন আপ্লুত হয়ে উঠেছে অতীত ইতিহাস, পুরাণ, লোককথার নিজস্ব আঙ্গিকে। ‘ব্যাবিলনের ধূসর মরু সঙ্কটে’ কিংবা ‘ইসিসের বেদিকার মূলে’ কখনও সম্রাটের মতো, জলদস্যুর চিরাভ্যস্ত অস্থিরতার নির্মম মায়াবী আলোয় কবি চিরকিশোর একটি কবি সত্তাকে লালন করেছেন। ‘ঝরাপালকে’র ‘অস্তচাঁদ’ কিংবা ‘ছায়াপ্রিয়া’র মতো কবিতাগুলি পাঠ করলেই বোঝা যায় কবির প্রেম এ পর্যায়ের নিভৃত নিবিড় সৌন্দর্যের এক স্বপ্নাভিসার। এক শঙ্খমালা নারীর কল্পনা এ পর্যায়ে কবি চেতনাকে আন্দোলিত করেছে। যাকে স্বপ্নে ও জাগরণে কবির স্মৃতিচেতনার রন্ধ্র জুড়ে হয়ে উঠতে হয়েছে আশরীরী বিষণ্নতার প্রতিমূর্তি। যেন সেই ম্লান বিষাদময়ী নারীর চেতনাকেই কবি দুচোখ ভরে এঁকে নিয়েছিলেন তাই শঙ্খমালা সেই নারীর প্রত্যাবর্তনও এমন নিরলস বিষাদের সমাহিত উচ্চারণে।

“মীনকুমারীর মতো কোন্ দূর সিন্ধুর অতলে

ঘুরেছে সে মোর লাগি !

……..নরম লালিমা

জ্বলে গেছে নগ্নহাত—নাই শাঁখা, হারায়েছে বুলি 

এলোমেলো কালোচুল খসে গেছে খোঁপা তার,

বেণী গেছে খুলি।”

‘ঝরাপালক’ থেকে ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ পর্যায়ে পৌঁছে জীবনানন্দ প্রেমকে নিয়ে এসেছেন বিষণ্ণ শীতার্ত অথচ রোমান্টিক এক দীর্ঘনিঃশ্বাসের পটভূমি হিসাবে। কাব্যের প্রথম কবিতা ‘নির্জন স্বাক্ষর’-এ পরিব্যাপ্ত অনিত্যতার পাশে মানবিক প্রেমকে কবি মৃত্যুহীনতার পরপারে পৌঁছে দিয়ে, এমন এক রূপ দিয়েছেন, যা ইন্দ্রিয়বেদ্য যাবতীয় জাগতিক মধুরিমার থেকে অনেক বেশি বিস্ময় এনে দিয়েছে। এ পর্যায়ে কবির কাব্যে প্রেম জগতের সবকিছু থেকে অনেক বড়ো বিস্ময়রূপেই প্রতিভাত।

“কোনো এক মানুষীর মনে 

কোনো এক মানুষের তরে

যে জিনিস বেঁচে থাকে হৃদয়ের গভীর গহ্বরে।

নক্ষত্রের চেয়ে আরো নিঃশব্দ আসনে

কোনো এক মানুষের তরে এক মানুষীর মনে।”

নক্ষত্রে সমাকীর্ণ রাত্রির আকাশ কিংবা সমুদ্রের অন্তহীন জল যার স্পর্শ জানে না। কারণ অনন্ত বিস্ময় সে। কবি যেন বলতে চাইছেন, পারিপার্শ্বের এই অজস্র নবীনের যাওয়া আসায়, নতুন সময় ও নতুন নক্ষত্রের ভিড় সত্ত্বেও মানুষের অন্তরে যে প্রেমের দিব্য প্রকাশ, তা ইন্দ্রিয়বেদ্য মধুরিমার চেয়ে অনেক বড়ো। চির আকাঙ্ক্ষিতের জন্য অপ্রাপনীয়তার বেদনা সঞ্জাত এই রোমান্টিকবোধ বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনা নিয়ে ‘নির্জন স্বাক্ষরে’ ও এ পর্যায়ের অনেক কবিতায় ছায়া ফেলেছে। মৃত্যু ও জীবনের প্রবল অসম টানাপোড়েনে জীর্ণ হতে হতে চির অতৃপ্ত কবি আকাঙ্ক্ষায় জারিত করে দিয়েছেন তার নায়ককে।

আমি চলে যাবো, তবু জীবন অগাধ 

তোমারে রাখিবে ধরে সেই দিন পৃথিবীর ‘পরে ;

আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ করে ;

অবশ্য প্রেমের চিরন্তন মহিমার উপলব্ধি ‘নির্জন স্বাক্ষরে’র কবিকে প্রত্যয়ী করে তুললেও এর পাশাপাশি বিপরীত সংক্ষোভজাত প্রেমের ক্ষণশাশ্বতী স্বরূপ প্রকাশক বেশ কিছু কবিতাও রয়েছে। ‘সহজ’, ‘১৩৩৩’, ‘কয়েকটি লাইন’ এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। তবে এই নশ্বরতার বেদনা, স্বপ্নভঙ্গের গ্লানিই ধূসর ‘পাণ্ডুলিপি’র শেষ কথা নয়। ভালোবাসার চিরন্তনতায় প্রেমিকের ব্যগ্র আকাঙ্ক্ষা সর্বকালীন হয়ে ধরা দিয়েছে এ পর্যায়ের কবিতায়। ‘মৃত্যুর আগে’ কবিতাটি ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র কবিতায় এমনি এক প্রগাঢ় সংযোজন। নিসর্গের অজস্র ও অনুপুঙ্খ মাধুরী এ কবিতায় পাঠকের দৃষ্টিকে শুধু আবিষ্টই করেনি, তাকে চালিত করে নিয়ে গেছে ভারাক্রান্ত এক দীর্ঘশ্বাসে —

“সব রাঙা কামনার শিয়রে যে দেয়ালের মত এসে জাগে

ধূসর মৃত্যুর মুখ….”

বৈশাখের প্রাপ্তরের সবুজ-বাতাস, নীলাভ নোনার বুকে আকাঙ্ক্ষায় গাঢ় হয়ে নেমে আসা রস, নিসর্গের বর্ণময়তাকে ছাপিয়ে হয়ে উঠেছে মৃত্যুস্পষ্ট প্রেমের অন্য এক প্রতিচ্ছবি। আবার ‘বিকেলবেলার ধূসরতা’য় ‘পৃথিবীর কঙ্কাবতী’কে অন্ধকার নদী কেড়ে নিয়ে যায়। আর লোককাহিনির রূপসী বিয়োগান্তক নায়িকা ‘কঙ্কাবতী’ সেই অন্ধকার নদীতে ভেসে গিয়ে পায় ‘ম্লান ধূপের শরীর’। সাঁঝবাতির ক্রমক্ষয়িষ্ণু আলোয় নদীর ওপর অন্ধকারের জমে ওঠা, আর অস্পষ্ট এক নারী শরীরের হারিয়ে যাওয়ার এই চিত্রকল্পটি মৃত্যুস্পৃষ্ট প্রেম সৌন্দর্যের অপরূপ প্রতিমা হয়ে উঠেছে। দেহাতীত সৌন্দর্যের দিব্যমাধুরী বিদ্যুৎদিপ্তীর মতোই যেন এখানে প্রলম্বিত। তবে মৃত্যুজয়ের অনুভবে বলশালী কবির এ অনুভব সমগ্র ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ সম্পর্কে সত্য নয়। নশ্বরতার বোধও পীড়িত করেছে তাঁর কবিসত্তাকে। সেই অনুভবে পৌঁছে কবি উচ্চারণ করেছেন— “সূর্যের চেয়ে, আকাশের নক্ষত্রের চেয়ে প্রেমের প্রাণের শক্তি বেশি”। প্রেমকে সঞ্জিবনী করে তুলে আবার তাকে মৃত্যুর কাছে পরাহত করে দিয়েছেন কবি। বলেছেন, মানুষের জীবন ‘প্রার্থনার গানের মতন’ হয়ে ওঠে প্রেম আছে বলে।

জীবনানন্দ দাশের কবিতায় প্রেম চেতনার প্রতিভাস বিশ্লেষণ করতে হলে তার শ্রেষ্ঠ প্রেম কবিতার ধারাগুলিকে পার করে আসতে হবে আমাদের, যা ছড়িয়ে রয়েছে ‘রূপসী বাংলা’ ও ‘বনলতা সেন’-এর মতন কাব্যগ্রন্থে। ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’তে প্রেম ছিল মৃত্যুস্পষ্ট বেদনার এক অসীম উৎসার রূপে। তবে সেখানেও প্রেম ইহজগতে অস্তিত্বের সীমারেখা প্রবলভাবে লঙ্ঘন করেনি। কারণ এখনও জীবনানন্দ জানেন,

“নক্ষত্রের পানে যেতে যেতে

পথ ভুলে পৃথিবীর পথে

জন্মিতেছি আমি এক সবুজ ফসল।”

লক্ষণীয় ‘জন্মিতেছি’ এই ক্রিয়াপদটির অন্তহীন প্রবহমান মানব জীবনধারার অনবদ্য প্রয়োগটি। সেইসঙ্গে অন্তহীন পিপাসাও তা জাগিয়ে রাখে। তাই ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র মৃত্যুময় প্রেম পিপাসার্ত হৃদয় নিয়ে মৃত আহত ব্যর্থতার গ্লানিকেও উত্তীর্ণ করে গেল। আর তা সম্ভব হল নিবিড় মর্ত্য প্রাণের রূপ পিপাসায়। রূপসী বাংলার কবিতায় তাই আঞ্চলিক স্বাদ ও রমণীয়তার জাদুর সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে এক গভীর বিস্ময়বোধ। সেই বিস্ময়বোধেই কবি বলে উঠেছেন—

তোমার মুখের রূপ নিয়ে তুমি বেঁচেছিলে তোমার শরীরে

তাইতো মসৃণ তুলি হাতে লয়ে জীবনেরে এঁকেছি এমন

অনেক গভীর রঙে ভরে দিয়ে চেয়ে দেখ ঘাসের শোভা কি 

লাগেনি সুন্দর আরো একবার তোমার মুখের থেকে ফিরে 

যখন দেখেছি ঘাস ঢেউ রোদ মিশে আছে তোমার শরীরে।

এই অশ্রুত বাক্‌বিন্যাসের পরেই ‘প্রকৃতির শোভা ভূমিকায় প্রেম’-এর তাৎপর্য অনুধাবন করা সম্ভব।

প্রতীকায়নের প্রবণতা সূচনালগ্ন থেকেই কম-বেশি ছিল কিন্তু ‘বনলতা সেন’ কাব্য পর্যায়ে তা যেন অনেক বেশি গাঢ় হয়ে উঠল, পেল এক সংহত রূপ। তবে এই প্রতীকায়ন কতগুলি নৈসর্গিক উপকরণেই আবিষ্ট হয়নি, বিষয় বা ভাববস্তুকে ঘিরে তা হয়ে উঠেছে এক একটি সার্থক উপস্থাপনা। ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’-‘রূপসী বাংলা’ পর্যায়ের প্রেম কবিতা থেকে ‘বনলতা সেন’-এর অন্তর্ভুক্ত প্রেম কবিতার স্বাদ তাই অনেকটাই স্বতন্ত্র। সেখানে প্রেম যেন বঞ্চনা, হতাশা, ক্ষোভ, যন্ত্রণার বিষই বহন করে এনেছিল, আর ‘বনলতা সেন’ পর্যায়ে প্রেম যেন আরও বড়ো, আরও গভীর চেতনার আলোকে মূল্যায়িত। এখানে নারী নাম বারবার এসেছে। ক্ষয়িষ্ণু মূল্যবোধগুলিকে পুনর্জাগরিত করবার ব্যাকুল প্রয়াসেই যেন মূল্যবোধের আধার স্বরূপা এই নারীনামের ব্যবহার। প্রকৃতির সমস্ত প্রশান্তির চিরকালীন অযুত সম্ভার নিয়ে বনলতা সেন যেন অপেক্ষা করে আছেন অন্বেষণ ক্লান্ত মানবাত্মার জন্য। ‘সুদর্শনা’, ‘সুচেতনা’, ‘সুরঞ্জনা’, ‘শ্যামলী’ এইসব ব্যক্তির নামগুলিকে আপাতদৃষ্টিতে নারী বা মানবীর নাম, প্রেম সম্পর্কিত বিষয়ীভূত বলে মনে হতে পারে, কিন্তু একটু নিবিড় অনুধ্যানে এসব কবিতার প্রতীকী বিন্যাস ধরা পড়ে যায়।

নারীপ্রেমের রূপককে আশ্রয় করে কবিতার বিস্তার জীবনানন্দের প্রেমচেতনায় নতুনত্ব আনলেও এই ধারাটি পরম্পরাগত ঐতিহ্যে একেবারে অজ্ঞাত ছিল না। রবীন্দ্রকাব্যেও এর অজস্র উদাহরণ আছে। শক্তির মহিমাকে কখনও আশ্রয়রূপে কখনও একাত্রের সাধনারূপে নারীর রূপের সীমায় প্রকাশিত হতে রবীন্দ্রনাথও দেখেছিলেন। জীবনানন্দ সেই দেখায় সংযোজিত করেছিলেন মানবের চৈতন্যগত শুভবোধ, কল্যাণ ও ঐশ্বর্যশক্তির প্রেরণা। তাই তাঁর ‘সুরঞ্জনা’, ‘সুদর্শনা’, ‘সুচেতনা’, ‘বনলতা’ ‘শ্যামলী’, ‘অরুণিমা’, ‘সবিতা’ শুধু রক্তমাংসের শরীরী নারীর প্রতিমূর্তি হয়েই কবিতায় উপস্থাপিত হয়নি, তারা এসেছেন মানবচৈতন্যের দুর্মর প্রেমবোধ, শুভবোধ নিসর্গমুখীন সৌন্দর্য পিপাসার্ত মানবের অন্তলীন সত্তায় ইতিহাস ও পরম্পরার সৌরপ্রেরণা হয়ে।

‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণে ‘সুচেতনা’ কবিতাটি প্রথম গ্রন্থভুক্ত হয়। প্রথম সংস্করণে কবিতাটির না থাকা এবং পরবর্তী সংস্করণে কবিতাটির গ্রন্থভুক্ত হবার পিছনেও একটি বিশেষ ভাবনা ক্রিয়াশীল ছিল বলে মনে হয়। আসলে ‘সুচেতনা’ হীন ‘বনলতা সেনে’র প্রথম সংস্করণটি একটি বিশেষ বার্তা পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে পারছিল না। সেটি হল—

“পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন 

মানুষ তবুও ঋণী পৃথিবীর কাছে।”

এই কথাটিই বহু বিখ্যাত কবিতা সহযোগে প্রস্তুত ‘বনলতা সেনে’র প্রথম সংস্করণটি পৌঁছে দিতে পারেনি মানুষের কাছে। ‘সুচেতনা’ কবিতাটি সেই অসম্পূর্ণতাকে দূরে সরিয়ে পাঠকের অনুভবকে সম্পূর্ণতা দান করেছিল সেদিন। পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্যের অভিজ্ঞান সম্পূর্ণতা পায় সু-চেতনার স্পর্শে। একথা জেনেছিলেন বলেই দ্বিতীয় সংস্করণে কবিতাটির অন্তর্ভুক্তি ঘটেছিল।

সুচেতনা কোনো নাম নয়, সুচেতনা কোনো নারী নয়। সে বোধ ও অনুভবের মিলনে গড়ে ওঠা এক চিন্ময়ী চেতনা, আবেগ ও প্রজ্ঞার যুগল সম্মেলনে তার জন্ম কবি হৃদয়ে। এই পৃথিবী, এই মাটি, অরণ্য আকাশ সভ্যতা থেকে বহুদূরে বিকেলের নক্ষত্রের কাছে যে নির্জনতা আছে, সেখানে ‘দারুচিনি বনানী’র ফাঁকে জেগে আছে সুচেতনা। সত্যই সে এক দূরতর দ্বীপের মতো। কারণ এই পৃথিবীর গতানুগতিক স্রোত অর্থাৎ প্রেম-অপ্রেম, রণ রক্ত, কোলাহল ও সফলতার সে কেউ নয়। সে এক পবিত্র বাতাস। সেই অবলীন বাতাসের প্রিয়কণ্ঠ হয়ে কবিকে সে আহ্বান করে গেছে বারবার, কবিও তার ডাক শুনেছেন কারণ সেই ডাকই কবিকে জানিয়ে দিয়ে গেছে—

“এই পৃথিবীর রণ রক্ত সফলতা 

সত্য, তবু শেষ সত্য নয়।”

কবি জেনেছিলেন, তার স্বপ্নের শহর কলকাতা একদিন তিলোত্তমা হয়ে উঠবে। বাতাসের প্রিয়কণ্ঠ এ শহরে কল্লোলিনী হয়ে উঠবে। কিন্তু তবুও এ শহরের কাছে আত্মনিবেদন করেননি তিনি। কারণ কবি জানেন, সভ্যতা ভাঙে-গড়ে। ধ্বংস হয় এ জীবনের পরিমিত যা কিছু। মানব সমাজও বিবর্তিত হতে হতে একসময় রূপান্তরিত হয়। কিন্তু মানুষের কোনো পরিবর্তন হয় না। এক মানুষ সহস্র অভিধায় নিজেকে জয়যুক্ত করে চলে। তাই কল্লোলিনী তিলোত্তমার মোহে আবিষ্ট না হয়ে মানবের শুভ চৈতন্য— সুচেতনার কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন কবি।

নিজের জীবন অভিজ্ঞতার মধ্য থেকেই কবি অনুভবকে উপলব্ধির সীমায় নিয়ে গিয়ে বুঝেছিলেন ‘এই পৃথিবীর রণ রক্ত সফলতা’ সত্য হলেও একমাত্র এবং শেষ সত্য নয়। একদিন এ পৃথিবীর মানুষকে মানুষেরই অপরিমেয় ভালোবাসা দিয়েছিলেন কবি। কিন্তু রূঢ় বাস্তব তাকে মূল্য দেয়নি এতটুকু। তিনি জেনেছেন মানুষের লালসার কোনো শেষ নেই একই সঙ্গে দেখেছেন—

“অবৈধ সংগম ছাড়া সুখ

অপরের মুখ ম্লান করে দেওয়া ছাড়া প্রিয় সাধ নেই।”

মানুষ তাই এক আত্মঘাতী ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে গেছে আজ। পরম আত্মীয়ের শব চারিদিকে পড়ে থাকতে দেখেও মানুষ আজ নির্বিকার। এরা সকলেই আমাদের ভাই-বন্ধু পরিজন। প্রিয়জনকে ভালোবাসার জন্য হৃদয় সাজালেও এ পৃথিবীর বিশ্বায়ন, বাজার অর্থনীতি স্বার্থের অনতিক্রম্য দেয়াল তুলে এক আত্মক্ষয়ী সর্বনাশের আগুন জ্বেলে দিয়েছে প্রতিটি মানুষের অন্তগূঢ়সত্তায়। কবি লিখেছেন।

“পৃথিবীর মানুষকে মানুষের মতো

ভালোবাসা দিতে গিয়ে তবু 

দেখেছি আমারি হাতে হয়ত নিহত

ভাইবোন বন্ধু পরিজন পড়ে আছে”

কিন্তু মানুষকে এই আত্ম অবলোপী করে তোলার বিষমন্ত্র কোথা থেকে এল, এই প্রশ্নের উত্তরও খুঁজেছেন কবি। দেখেছেন সভ্যতার জৌলুষ, নাগরিক শ্রীবিলাসের নানা উপকরণই মানুষকে খুনী করে তুলেছে। আর এই আত্মক্ষয়ী বীভৎসতার স্থায়ী চিত্র দেখতে দেখতেই কবি স্বগতোক্তির মতো উচ্চারণ করেছেন, ‘পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন’। কবির মনে হয়েছে, এ পৃথিবীর সর্বত্রই ক্রমবিস্তারি এক বাণিজ্যবাজার, মানুষকেও যা মহাপণ্যে রূপান্তরিত করে চলেছে। অগণিত প্রিয়মানুষের শব সভ্যতার বাণিজ্য-তরীতে পণ্য হয়ে মানুষকে তার প্রেম-ভালোবাসা-বিবেকবোধের বিসর্জনে করে তুলেছে উদ্যত। মনুষ্যত্ব অবলোপী এই ভাবনা-চিন্তা কিন্তু শুধু অর্থের পিছনে নিয়ত ছুটে চলার জন্য। মানুষের বিবেকবোধ আজ তাই স্বর্ণের পিছনে ধাবমান। তিনি দেখেছেন— 

“কেবলই জাহাজ এসে আমাদের বন্দরের রোদে

দেখেছি ফসল নিয়ে উপনীত হয়

সেই শস্য অগণন মানুষের শব ।”

প্রেমে-ভালোবাসা-বিবেকবোধের মতো মানবিক চেতনাগুলির পরিবর্তে এই পৃথিবীতে এখন শুধু আত্মপর মানুষের লোভের স্বর্ণভাণ্ডার দেখা যায়। দুই মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী পর্বে রচিত এ কবিতা রাষ্ট্রনায়ক ও বাণিজ্যজীবী মানুষের প্রবল আগ্রাসী মানসিকতার প্রতিই ইঙ্গিত করে। এ প্রসঙ্গে মনে রাখা প্রয়োজন একই সময়পর্বে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ‘রক্তকরবী’র মতো নাটক, ‘নৈবেদ্যে’র মতো কবিতার সম্ভার। মনীষীদের শুভ চৈতন্যকেও সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতার এই আগ্রাসীনীতি একদিন স্তব্ধ করেছিল। প্রাণ উন্মোচনের সেই মূক চেতনায় মানুষের লোভ-লালসা-শোষণের নির্লজ্জতা আমাদের শুভবোধকে স্তম্ভিত করে, বিমূঢ় করে দেয়। তবু এ সভ্যতার চারপাশে রণক্লান্ত কাজের এই দুর্মর আহ্বান।

তবু জীবনানন্দ অন্তহীন জীবন অন্বেষার কবি। দূরতর দ্বীপে অবলীন বাতাসের প্রিয় কণ্ঠ যেখান থেকে ভেসে আসে সেখানেই কবি প্রকৃত জীবন বাসা বেঁধে আছে দেখতে পান। সে জীবন সুচেতনার ছোঁয়ায় গড়ে ওঠা প্রকৃত মানবজীবন। কিন্তু এই মানবজীবন কে গড়ে দেবে?—এ প্রশ্নের উত্তরটিও কবি দিয়েছেন কবিতাতেই। বলেছেন ‘সে অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ’ চেতনার শুভ উদ্বোধন হৃদয়ে-মন জারিত করে প্রকৃত মানবজীবন ধারা গড়ে তুলতে হলে বহু শতাব্দী অপেক্ষা করতে হবে। এ সংসারের নিরন্তর কর্মী মানুষের অনলস, ক্লান্তিহীন কর্মধারার মধ্য দিয়েই দূর প্রভাতের দূরতর দ্বীপ সুচেতনায় পৌঁছে যাওয়া আমাদের সম্ভব হবে। কবি বলেছেন—

“প্রায় ততদূর ভালো মানবসমাজ

আমাদের মতো ক্লান্ত ক্লান্তিহীন নাবিকের হাতে

গড়ে দেব, আজ নয়, ঢের দূর অন্তিম প্রভাতে।”

এ প্রসঙ্গে মনে রাখা প্রয়োজন কবি মানবসভ্যতায় বিশ্বাসী নন, মানব সমাজ গড়ে তোলার কথা বলেছেন তিনি। এর কারণ জীবনানন্দ দেখেছেন, সভ্যতার পিছনে পিছনে মানুষের লোভ-লালসা অহংকার, অন্যকে পদদলিত করে রাখার হিংস্র আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। সভ্যতা গড়ে তোলার কথা তাই বলেননি তিনি, বলেছেন সমাজের কথা। কারণ সমাজে মানুষ মানবিক প্রবৃত্তিগুলিকে বাহিত করে চলে। আর এই মানবিক মূল্যবোধগুলিকেই জীবনের প্রবহমানতায় সমার্থক করে তুলতে চেয়েছেন কবি। আবার মানবের শুভবোধই সমাজে শ্রেণিহীনতার ব্যঞ্জনা নিয়ে আসে। তাই শুধু মানব নয়, মানব সমাজই একদিন দূরতর দ্বীপে শুভ চৈতনের উদ্বোধন ঘটাবে।

সুচেতনা কোনো শরীরি সত্তা নয়, সুচেতনা মানবের শুভ চৈতন্য। নলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থে নারী নাম ব্যঞ্জক একাধিক কবিতা রয়েছে। এই সমস্ত কবিতার নামের আদ্যক্ষর ‘সু’। সুন্দর, শুভ লক্ষণা এই নারীরা প্রত্যেকেই কবি জীবনের আকাঙ্ক্ষিত নারী। সমালোচকেরা এই নারী নামের আড়ালে প্রেমিকার শরীরি সত্তাটিকে খোঁজবার চেষ্টা করলেও আমাদের মনে হয় সুচেতনা কবির শুদ্ধ মানসিক আশ্রয় ভূমি। আত্মবিনাশী অনিকেত বিপন্ন জীবন সুচেতনার কাছেই খুঁজে পায় আশ্রয়।

নিসর্গ চেতনার ছায়ায় মানবচৈতন্যকে শুভ পথে নিয়ে আসবার জন্যেই জ্যোতিঃপ্রভা স্বরূপিনী সেই নারী পথ দেখিয়ে আনে। সভ্যতার মহাসঙ্কটে, মূল্যবোধ বিপর্যস্ত পৃথিবীতে এই সূর্যপ্রতিম নারীকে কবি যেন হারিয়ে ফেলেছিলেন সাময়িকভাবে। কিন্তু উপলব্ধির গভীর তীব্রতায়, আন্তরিক একাত্ববোধে সেই নারী কবির প্রেমভাবনাকে বৃক্ষের মতো দিব্যবোধের অন্বেষায় নিয়ত ঊর্ধ্বমুখীন করে রেখে, নিজেকে রেখে গেছে এক লোকোত্তরের ব্যঞ্জনায়। আর এই ভালোবাসার ঐশী প্রসাদেই মানবচিত্তে অঙ্কুরিত হয়ে চলে শুভ প্রয়াণের শক্তি ও প্রেরণা। এভাবেই জীবনানন্দের কবিতার প্রেমচেতনা শুভ ও সুন্দরের প্রেরণায় মানবচেতনার দেশ-কালাতীত, অন্বেষার মহত্তম বিন্যাসে চিরকালীন যুগমানবের সুচেতনার অংশভাগিনী হয়ে উঠেছে। ব্যক্তিপ্রেমের উপলব্ধি লৌকিক ও লোকোত্তরের অন্বয়সাধন করেও মর্ত্যবিমুখ করে তোলেনি কবিকে। মাটির পৃথিবীর সবটুকু ঐহিকতা থেকেই সে বৃক্ষের মতো ঊর্ধ্বায়িত। তাই সে মানবের কল্পনায় শুভ ও সুন্দরের সৌরচেতনা— সুচেতনা। জীবনানন্দের কবিতার ক্ষেত্রে যার অপর নাম প্রেম।

“ওরা আসে, লীন হয়ে যায়, হে মহাপৃথিবী

সূর্যকরোজ্জ্বল মানুষের প্রেমচেতনার ভূমি।”

আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।

Leave a Comment