তিনসঙ্গীর গল্পের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের আধুনিকতার প্রতিমূর্তি ‘ল্যাবরেটির’ গল্পের পরিচয় দাও | ‘ল্যাবরেটরি’ গল্প অবলম্বনে সমালোচকের গ্রহণযোগ্যতা বিচার করো

আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “তিনসঙ্গীর গল্পের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের আধুনিকতার প্রতিমূর্তি ‘ল্যাবরেটির’ গল্পের পরিচয় দাও | ‘ল্যাবরেটরি’ গল্প অবলম্বনে সমালোচকের গ্রহণযোগ্যতা বিচার করো” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।

তিনসঙ্গীর গল্পের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের আধুনিকতার প্রতিমূর্তি ‘ল্যাবরেটির’ গল্পের পরিচয় দাও | ‘ল্যাবরেটরি’ গল্প অবলম্বনে সমালোচকের গ্রহণযোগ্যতা বিচার করো

রবীন্দ্রনাথের শেষ তিনটি গল্প নিয়ে ‘তিনসঙ্গী’ গ্রন্থটি সংকলিত। এর সর্বশেষ গল্প ‘ল্যাবরেটরি’ গ্রন্থটির সবচেয়ে বড়ো আকর্ষণ। ১৩৪৭ বঙ্গাব্দে শারদীয়া আনন্দবাজার যখন গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয় তখন প্রবল চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছিল। সোহানী চরিত্রের কল্পনায় দুঃসাহসিকতা তার কারণ। গল্পটি সম্পর্কে আলোড়ন উঠবে সে সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ওয়াকিবহাল ছিল। প্রশান্ত মহান লবীশের কাছে তিনি বলেছিলেন—’আর সকালে কি কি বলছে ? একেবারে ছিঃ ছিঃ কাণ্ডতো ? নিন্দায় আর মুখ দেখানো যাবে না। আশি বছর বয়সে কবি কবিঠাকুরের মাথা খারাপ হয়েছে—সোহিনীর মতো এমন একটা মেয়ের সম্বন্ধে এমন করে লিখেছে?

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মুখে বাংলা ছোটোগল্পে তখন ভাঁটার টান। মন্বন্তরের আগুন থেকে ক্রোধাহুত নতুনদের তখনও আবির্ভাব হয়নি। কল্লোলীয়রা শ্রান্ত ও স্তিমিত। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় অসুস্থ চিন্তা ও অস্বচ্ছ আঙ্গিকে আচ্ছন্ন, প্রেমের মিত্র নীরব, শৈলজানন্দ চলচ্চিত্রকারী, অচিন্তকুমার সরকারি চাকুরি সূত্রে তখনও উপকরণ সংগ্রহে রত, দুর্গত প্রাচীন জগদীশ গুপ্ত নিষ্প্রভ, অপূর্ব সুবোধ ঘোষ নেপথ্যে, এই লগ্নে ‘তিনসঙ্গী’ গল্প ত্রয়েরীর আবির্ভাব, বিস্ময়কর আবির্ভাব।

স্বভাবতই বাঙালি পাঠক উচ্চকিত হয়ে উঠেছিলেন। রচনার দিক থেকে গল্পটি তীক্ষ্ণ, ঝলকিত, আশ্চর্য রকমের আধুনিক। স্ত্রীম লাইন ভাষা বাঁকে বাঁকে সূর্যেকবোজ্জ্বল wit-এর ফেলপুঞ্জ। বহিরঙ্গে কলোধ্বনি পরিণামে ভগীর মন্ত্রীত। শ্রেষ্ঠ জীবনবাদী শিল্পীর মতো রবীন্দ্রনাথ চিরদিন যুগসচেতন। আশ্চর্য তাঁর গ্রহণশীলতা, অকুণ্ঠ তার চিত্ত ঔদার্য। অগ্রণী কালের সঙ্গে তার অসাঙ্গি পদচারণা। বিশ্বমানবের সামগ্রিক শুভ পরিণামের প্রতি অবিকল প্রত্যয়। ইউরোপের দূরন্ত যান্ত্রিক অভিযানের প্রতি সশ্রদ্ধ বিস্ময় সত্ত্বেও এখানে একটি সংশয় তার অটল আশাবাদ এবং যুগচেতনাকে বার বার পীড়িত করেছে। আ-শৈশব ভারতীয় ভাবধারার একটি স্থির আদর্শ তাঁর চিত্ত ক্ষেত্রে ধ্যানস্থ শিবের মতো স্থির প্রতিষ্ঠিত। শোষণবাদী যান্ত্রিকতার বিকৃতি এবং রূঢ়তা সেই শিল্পবোধের ওপর আঘাত হয়েছে। তার যন্ত্রণা প্রকাশিত ‘রক্তকরবী’তে, ‘মুক্তধারা’য়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের আন্তরিক বিরূপতা যান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে, যন্ত্রের বিরুদ্ধে নয়। তিনি ভারতীয় ভাব-সত্যের সঙ্গে ইউরোপের বিজ্ঞান-প্রচেষ্টার একটা সুষম সামঞ্জস্য গড়ে তুলতে চেয়েছিল। ‘রবিবার’ ‘শেষকথা’র মতো ‘ল্যাবরেটরি’ গল্পে ও সেই মানস সংকটের ছায়া পড়েছে।

রবীন্দ্রনাথ ‘ল্যাবরেটরি’ গল্প সম্পর্কে প্রশান্ত বাবুকে যে উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন তা অসত্য হয়নি। বাংলাদেশের পাঠক ল্যাবরেটরি গল্পের ক্ষেত্রে বেরসিক মনের পরিচয় দেননি। বৈজ্ঞানিক এবং সর্ববিধ সংস্কার মুক্ত নন্দ কিশোরের ব্যক্তিত্বের ছায়াই সমস্ত গল্পটির ওপর পূর্বাপর বিকীর্ণ হয়ে আছে। যদিও গল্পের সূচনাতেই তাঁর কায়িক মৃত্যু ঘটেছে। তার জীবন সাঙ্গনী (স্ত্রী বলা সঙ্গত হবে কি ?) সোহিনী এ গল্পের অধিনায়িকা। নন্দকিশোরের ল্যাবরেটরির যোগ্য অধিকারীর জন্য সোহিনীর সন্ধান এবং পরিণামে তার সকরুণ ব্যর্থতায় গল্পের মূল বক্তব্য। ল্যাবরেটরির স্তর বিন্যাস অপূর্ব।

তিনসঙ্গীর প্রথম গল্প দুটি প্রেমকেন্দ্রিক। ‘ল্যাবরেটরি’ আইডিয়া ও প্রতীক প্রধান। ‘রবিবার’ বা ‘শেষকথা’র নামকরণ বিশেষ কোনো অর্থবহ নয়। কিন্তু ল্যাবেটরির নামকরণের মধ্যে গল্পটির বক্তব্য উচ্চারিত হয়েছে। এই ল্যাবরেটরিতে সোহিনী পৌরুষের পরীক্ষা নিতে হয়েছে। কে আছে এমন দৃঢ়কেতা পুরুষ। যে ব্রজ দৃঢ় মন নিয়ে এই ল্যাবরেটরিতে জ্ঞানের সাধানায় বসতে পারে ? এমন নির্মোহ জিতেন্দ্রিয় কে আছে ? যে উগ্র মদের মতো নীলার বিষক্তি যৌবনের প্রলোভন করিয়ে তপস্যায় মগ্ন হয়ে যেতে পারে। সোহিনীর পরীক্ষার ফল নেগেটিভ। ড. রেবতী ভট্টাচার্যের পরাভব সোহিনীর করুণতম বেদনায় রঞ্জিত। সোহিনীর কোনো রুচিময় ভদ্র পরিবার থেকে পরিবেশ থেকে আবির্ভাব হয়নি। নন্দকিশোরের সঙ্গে তার মিলনের শয়তানের সঙ্গে শয়তানীর আত্মিক ঐক্য। নৈতিক চরিত্রের বিচারে সে নিরঙ্কুশ। নন্দকিশোরের মেয়ে বলে পরিচিতা নীলা আসলে যে কার সন্তান সোহিনী নিজেও জানে না। তবুও আমৃত্যু সোহিনী নন্দকিশোরের স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়নি। তার কারণ সোহিনীর শক্তি তার ‘ক্যারেকটারের তেজ’। সেইজন্য মৃত্যুকালে নন্দকিশোর তার সমস্ত বিষয় সম্পত্তি আর ল্যাবরেটরির ভার তার ওপর সঙ্গে দিয়ে গেছেন।

নন্দকিশোর জানেন সোহিনী ল্যাবরেটরির সত্যকার মর্যাদা রক্ষা করতে পারবে। সুতরাং শুরু হয়েছে সোহিনীর উত্তর সাধকের সন্ধান। আর সঙ্গী অধ্যাপক মন্মথ চৌধুরী যিনি অভিজ্ঞতা, প্রখর বুদ্ধি, আর নির্মোহ প্রভাব অধিকারী। এই অধ্যাপক চৌধুরী রেবতীর সন্ধান দিয়েছেন। অসীম সম্ভাবনা এবং রেবতীর মধ্যে। অসামান্য মেধবী পুরুষ সে। কিন্তু তাঁর ভাগ্যকামনা জুড়ে আছে একটি ‘স্ত্রী বাহু’, তিনি তার পিশিমা। এই পিশিমা গ্রস্থ রেবতীকে উদ্ধার করতে আর এক নারীকে ব্যবহার করলো মোহিনী, নীলা, তারই গর্ভজাত কন্যা। উগ্ররূপ লোভ আর সোহিনীর কামনার সমস্ত কলুষ নিয়ে গড়া এই নীলা-রেবতীকে টেনে আসার জন্য মেয়ের সম্মোহনী সাদকতাকে উপকার করলো। সোহিনী, রেবতী এলে নীলা চাইল সোহেব জালে তাকে জড়িয়ে নিজের স্বার্থ সিদ্ধ করতে। সোহিনী চাইল তাকে নন্দকিশোরের সাধনার আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে। মা আর মেয়ের এই নগ্ন নিষ্ঠুর প্রতিযোগিতায় কেউ-ই জয়ী হতে পারল না।–“হঠাৎ একটা ছায়া পড়ল দেওয়ালে, পিশ্চিমা এসে দাঁড়ালেন, বললেন—বেরি চলে আর। সুড়সুড় করে রেবতীর পিছনে পিছনে চলে গেল, একবার ফিরেও তাকাল না।” একটা চরম ট্র্যাজেডির মধ্যে গল্পের যবনিকা পতন হল।

মোহিনীর Convention, ভাঙা চরিত্র কল্পনায়। নীলার লালসার নির্লজ্জতায় কিংবা অতি আধুনিকদের বোহেমিয়ান উদ্দামতায়। আপাত সৃষ্টিতে ল্যাবরেটরি চমকপ্রদ। স্বামীর সাধনের সম্পূর্ণ করার জন্য ব্রতপরিণীর মতো সাত্ত্বিক সন্ধানের যে দায়িত্ব সোহিনী নিয়েছে তা তার ব্যক্তি জীবনের সতীত্ব ও অসতীত্বের সমস্ত প্রসঙ্গের অবাস্তব হয়েছে। নীলার চরিত্রকে একটা উগ্র ও জান্তর করে তোলা হয়েছে শুধু রেবতী চরিত্রকে যাচাই করে নেওয়ার জন্যে, সোহিনীর প্রত্যাশা ব্যর্থ হয়ে গেছে। নীলার রূপ বর্ণনা থেকে আরম্ভ করে। জাগানী ক্লার্ভের নারী হরণের রিহার্সাল পর্যন্ত যে উগ্র আধুনিকতার অঙ্গ সজ্জা এই গল্পে আছে, ল্যাবরেটরির ক্লাসিক নীতি মূলকথা তার প্রেক্ষাপট মাত্র। এর জ্ঞান জিজ্ঞাসার উজ্জ্বল সত্যটিকে ফুটিয়ে তুলতে এরা Contrast-এর ভূমিকা নিয়েছে।

আসলে এ গল্পে রবীন্দ্রনাথ পুরোপুরি পিউরিটান। পাপের রং গভীর কালো হলেই পুণ্যের শুভ্রতা যেমন বেশি প্রদীপ্ত হয়ে ওঠে ল্যাবরেটরির কল্যাণ ধ্রুব বক্তব্যটিও তেমন করে এসে আপাত অসংযমের ওপর শিক্ষার মতো প্রজ্জলিত। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য-সাধক রবীন্দ্রনাথের আমৃত্যু কামনা ছিল। এই গল্পে আমরা সেই পরিণতিই প্রত্যক্ষ করি। বৈজ্ঞানিক হতে হবে পাশ্চাত্যের আইনস্টাইনের এর মতো অথচ ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি থাকবে ভালোবাসার অটল কিন্তু প্রলোভন বিজয়ী ৷৷

আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।

Leave a Comment