আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “দিল্লি-সুলতানির পতনে মহম্মদ তুঘলকের দায়িত্ব” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
দিল্লি-সুলতানির পতনে মহম্মদ তুঘলকের দায়িত্ব
সুলতান মহম্মদ-বিন্-তুঘলকের জীবন ও পরিণতির সাথে আব্বাসিদ খলিফা আল-মামুন (৭৮৬ ৮৩৩ খ্রিঃ)-এর জীবনের অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। মামুনের নেতৃত্বে খিলাফত শক্তিও মর্যাদার শীর্ষে আরোহণ করেছিল। মহম্মদ তুঘলকের নেতৃত্বে দিল্লি-সুলতানিও স্পর্শ করেছিল মর্যাদা ও প্রতিপত্তির শীর্ষ দেশ। উভয়েই ছিলেন যুক্তিবাদী ও গোঁড়ামিমুক্ত। দুজনেই মনে করতেন যে, দার্শনিক ও বিজ্ঞানী ঈশ্বর-নির্দিষ্ট পুরুষ হিসেবে মানবতাবাদ প্রতিষ্ঠার কাজ করবেন। দেশবিদেশের শিক্ষা সংস্কৃতির প্রতি দুজনেরই ছিল গভীর শ্রদ্ধাবোধ। আবার এঁদের আমলেই স্ব স্ব রাজ্যের অবক্ষয় ও পতনমুখী প্রক্রিয়া স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। মহত্ত্ব ও উদারতা সত্ত্বেও ওঁরা দুজনেই শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছিলেন। মহম্মদ তুঘলকের প্রশাসনিক দক্ষতা এবং একজন ‘প্রায় বিকৃতমস্তিষ্ক’ শাসক হিসেবে সাম্রাজ্যের ভাঙন ডেকে আনার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে সমকালীন লেখকের বিবরণী থেকে। ইবন বতুতা, বারাণী ও ইসামী নানা দিক থেকে মহম্মদ তুঘলকের কার্যাবলির বিরূপ সমালোচনা করে জনমনে এই ধারণার সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন যে, ইলতুৎমিস, বলবন ও আলাউদ্দিনের আত্মত্যাগ যে সাম্রাজ্যের ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল, মহম্মদ তুঘলকের ভ্রান্ত ও হটকারী সিদ্ধান্তের ফলেই তা তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছিল। কিন্তু মধ্যযুগে ভারতীয় শাসকদের মধ্যে সর্বাধিক জ্ঞানী ও নিরপেক্ষ একজন শাসকের মূল্যায়নে এত সরলীকরণ সিদ্ধান্ত সঠিক নয়। আমরা যেন ভুলে না যাই যে বারাণী, ইসামী ও ইবন বতুতা—তিনজনেই নানা কারণে মহম্মদ তুঘলকের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। তাই ঐতিহাসিকের নিরপেক্ষতা তাঁদের লেখনীতে ছিল না। এঁদের ইতিহাসচর্চা ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার ভিত্তিতে পরিচালিত হয়েছে। এবং সেই কারণে এঁদের বিশ্লেষণে স্ববিরোধিতার ছাপ পাওয়া যায়। যেমন, বারাণী যে সকল কঠোরতার কারণে মহম্মদ তুঘলকের নিন্দাবাদ করেছেন; ঠিক সেই ধরনের কঠোরতা অবলম্বন করা সত্ত্বেও আলাউদ্দিন খলজির প্রশংসা করে গেছেন।
মহম্মদ তুঘলকের কিছু সীমাবদ্ধতা নিশ্চয়ই ছিল। তাঁর কিছু কিছু সিদ্ধান্ত সাম্রাজ্যের পক্ষে সুদূরপ্রসারী বিরূপ প্রতিক্রিয়াও সৃষ্টি করেছিল। আদর্শ ও বাস্তবের টানাপোড়েনে শেষ পর্যন্ত আদর্শ অকার্যকর প্রতিপন্ন হয়েছিল। কিন্তু এটাও সত্য যে, তাঁর আমলের সবকিছুই অবিমিশ্র অশুভ ছিল না। এক্ষেত্রে স্মরণে রাখা আবশ্যিক যে, মহম্মদ-বিন্-তুঘলক দিল্লি-সুলতানির প্রতিষ্ঠার ১১৯ বছর পরে সিংহাসনে বসেছিলেন। এবং তাঁর মৃত্যুর পরেও ১৭৫ বছর সুলতানি টিকেছিল। তাঁর আগমনের পূর্বে ইলতুৎমিস, বলবন, আলাউদ্দিন খলজির মতো প্রতিভাবান শাসকেরা সিংহাসনে বসেছিলেন। কিন্তু মহম্মদের মৃত্যুর পর একমাত্র ফিরোজ তুঘলক ছাড়া প্রকৃত অর্থে কোনো দক্ষ ব্যক্তি দিল্লির সিংহাসনে বসেননি। তবুও সাম্রাজ্য টিকেছিল একশো পঁচাত্তর বছর। এ থেকে প্রমাণ করা সম্ভব যে, মহম্মদ-বিন্-তুঘলক এককভাবে এমন কিছু ভুল বা অন্যায় করেননি, যা সুলতানির পতন অনিবার্য করে তুলেছিল। আরও লক্ষণীয় যে, মহম্মদের আমলেই সুলতানি সাম্রাজ্যের সীমানা সর্বাধিক বিস্তৃতি লাভ করেছিল। আসাম, উড়িষ্যা ও কাশ্মীর ছাড়া সমগ্র ভারতবর্ষে প্রসারিত হয়েছিল মহম্মদের রাজকর্তৃত্ব। সুদূর দক্ষিণে উড্ডীন হয়েছিল দিল্লি-সুলতানির বিজয়পতাকা।
মহম্মদ স্বয়ং ছিলেন দক্ষ যোদ্ধা এবং কর্মোদ্যোগী। তাঁর কট্টর সমালোচক বারাণীও স্বীকার করেছেন যে, রাজকর্তব্য সম্পাদনে মহম্মদ তুঘলক কখনোই ক্লান্তিবোধ করতেন না। সৈনিক হিসেবে তিনি কর্মজীবন শুরু করেছিলেন, আবার যুদ্ধক্ষেত্রেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ বছিলেন। তাঁর জনপ্রিয়তারও অভাব ছিল না। বারাণী, ইসামী ও ইবনবতুতা উল্লেখ করেছেন যে, হাজার হাজার মানুষ মহম্মদের আচরণে ক্ষুব্ধ ছিলেন এবং প্রতিশোধ গ্রহণে উন্মুখ ছিলেন। অথচ আশ্চর্যের বিষয় যে, মহম্মদের প্রাণনাশের জন্য কোনো ষড়যন্ত্র করা হয়নি। মহম্মদ মৃত্যুকালে নিজ উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যাননি। তথাপি সেনাবাহিনী বা প্রাদেশিক শাসনকর্তাগণ তুঘলকবংশকে উচ্ছেদ করে ক্ষমতাদখলের বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কোনো চেষ্টা করেননি। মহম্মদের রাজত্বকালে বিদ্রোহের দাবানল দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল উত্তর থেকে দক্ষিণে, পূর্ব থেকে পশ্চিম ভারতে। সুলতান দক্ষিণের বিদ্রোহ দমনে ব্যর্থ হলেও, উত্তরের ও অন্যান্য অংশের সমস্ত বিদ্রোহ, কেবল বাংলা ছাড়া, দমন করেছিলেন দক্ষতার সাথেই। শিক্ষাদীক্ষা এবং সাংস্কৃতিক মনস্কতার দিক থেকেও মহম্মদ দিলেন অতুলনীয়।
তথাপি মহম্মদের রাজত্বকালেই দিল্লি-সুলতানির অবক্ষয়ের সূচনা হয়েছিল বলে পণ্ডিতদের অনুমান। এবং এজন্য কিছুটা দায়ী ছিল মহম্মদ তুঘলকের ব্যক্তিগত ভুলভ্রান্তি এবং কিছুটা দায়ী ছিল সমসাময়িক আর্থসামাজিক পরিস্থিতি। সুলতানি শাসনব্যবস্থা প্রকৃতিগতভাবে ধর্মাশ্রয়ী না-হলেও প্রশাসনের স্থায়িত্ব ও শক্তিবিধানে উলেমা, খাতিব প্রমুখ ধর্মীয় নেতাদের বিশেষ ভূমিকা ছিল। কিন্তু মহম্মদ তুঘলক দর্শন ও যুক্তিবাদ দ্বারা চালিত হবার ফলে ধর্মগুরুদের যুক্তিহীন কর্তৃত্বে আস্থাহীন হয়ে পড়েছিলেন। ফলে এই শ্রেণি মহম্মদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। ‘ফুতুহ-উস্-সালাতিন’ গ্রন্থে পরিষ্কার লেখা হয়েছে যে, “সমস্ত মানুষ ঐক্যবদ্ধ হলে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করা সম্ভব। তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ আইনানুগ, শরয়িত অনুমোদিত।” এইভাবে একজন উদারপন্থী শাসকের বিরুদ্ধে গোঁড়াপন্থী ও স্বার্থান্বেষীদের জেহাদ ঘোষিত হয়েছে। অন্যদিকে উদারপন্থী অতিন্দ্রীয়বাদী সুফিসাধকরাও মহম্মদের প্রতি বিদ্বিষ্ট ছিলেন। দিল্লি থেকে তাঁদের জোরপূর্বক দৌলতাবাদে স্থানান্তরের নির্দেশ এই সর্বত্যাগী এবং জনপ্রিয় ধর্মগোষ্ঠীকেও বিরোধী শক্তিতে পরিণত করেছিল। নিজ সম্প্রদায়ের প্রভাবশালী গোষ্ঠীর বিরূপতা নিঃসন্দেহে সাম্রাজ্যের ভিতকে দুর্বল করেছিল।
মহম্মদ তুঘলকের শাসনতান্ত্রিক পরীক্ষানিরীক্ষাগুলি সাম্রাজ্যের সংহতির পক্ষে ক্ষতিকারক হয়েছিল। রাজধানী স্থানান্তর, প্রতীক-মুদ্রার প্রচলন, দোয়াবে করবৃদ্ধি—সবই ছিল প্রয়োজনভিত্তিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু প্রকল্পগুলির রূপায়ণে ভুল পদ্ধতির প্রয়োগ এবং ব্যর্থতা নিঃসন্দেহে সুলতানি শাসনকে দুর্বল করেছিল। সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল নানাভাবে। প্রকল্পগুলি তাদের দৈহিক ও আর্থিক নির্যাতনের শিকারে পরিণত করেছিল। ফলে সুলতান দ্রুত জনসমর্থন হারিয়েছিলেন এবং আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতা ইন্ধন পেয়েছিল। অথচ বাস্তববাদী এই সকল প্রকল্প রূপায়ণে প্রায়োগিক দিক সম্পর্কে একটু সচেতন হলে প্রকল্পগুলি ব্যর্থ হত না, পরস্তু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে সেগুলি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতির সূচনা করতে পারত। কিন্তু এই কাজের জন্য যে ধৈর্য্য ও স্থিরতার প্রয়োজন, তা সুলতানের ছিল না। মহম্মদ তুঘলক পরিবর্তন চেয়েছিলেন। কিন্তু কোনো বিরাট পরিবর্তন আনার জন্য যে ক্ষেত্র প্রস্তুত করা আবশ্যিক, তা তিনি মানতে রাজি ছিলেন না। তাই অষ্টাদশ শতকে অস্ট্রিয়ার সম্রাট দ্বিতীয় যোশেফ-এর মতোই সৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রকল্পগুলি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল।
মহম্মদ বিদেশিদের উচ্চপদে নিয়োগ করে সঠিক কাজ করেননি। তিনি নিম্নশ্রেণির মানুষ এবং মোঙ্গল বা আফগানদের দায়িত্বশীল পদে নিয়োগ করে তুর্কি ও খলজি অভিজাতদের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। অথচ এইসব বিদেশি অভিজাত সুলতানের প্রতি অনুগত ছিলেন না। সুলতানের বিরুদ্ধে যেসব বিদ্রোহ হয়েছিল, তাতে এদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। লাহোরে শাহু আফগান, গুজরাট ও সিন্ধুতে মালিক তাঘী, দৌলতাবাদে সদাহ আমিরগণ বিদ্রোহের আগুন প্রজ্জ্বলিত করে দিল্লির কর্তৃত্বকে দুর্বল ও পতনোন্মুখ করেছিলেন। স্বাধীন বিজয়নগর ও বাহমনী রাজ্যের প্রতিষ্ঠা এবং বাংলাদেশে ইলিয়াস শাহি বংশের উত্থান সুলতানি সাম্রাজ্যের মানচিত্রকে যথেষ্ট সংকুচিত করেছিল। মহম্মদের ব্যর্থতা সাম্রাজ্যের যে ভাঙনের সূচনা করেছিল, তা শেষ পর্যন্ত পরিণতি পেয়েছিল সাম্রাজ্যের চূড়ান্ত পতনে।
দুর্ভাগ্য মহম্মদের যে, তাঁর আমলেই প্রকৃতির বিরূপতা প্রকাশ পেয়েছিল নানাভাবে। অনাবৃষ্টির কারণে দিল্লি, দোয়াব, মালব প্রভৃতি অঞ্চলে ব্যাপক খাদ্যাভাব ও দুর্ভিক্ষ এবং দক্ষিণ ভারতের প্লেগরোগ মহম্মদের ব্যর্থতাকে প্রকট করে তোলে। সুলতানের কর নীতির সাথে প্রাকৃতিক বিপর্যয় যুক্ত হয়ে তাঁকে ঘৃণ্য খলনায়কে পরিণত করে। আর ভয়াবহ প্লেগরোগ শেষ করে দেয় সুলতানের সামরিক শক্তিকে। এর প্রতিক্রিয়া ঘটে দুভাবে। সারাদেশে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত; কিন্তু তখন তা দমনের মতো সামরিক শক্তি সুলতানের হাতে নেই। তিনি নিজে ছুটে বেড়িয়েছেন দেশের এ প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত। কিন্তু রাজ্যের ভাঙন রোধ করতে পারেননি। তাই বলা চলে, সুলতান মহম্মদ-বিন্-তুঘলক ছিলেন দারুণ প্রতিভাবান একজন ব্যক্তি কিন্তু প্রতিভার বিকাশ ঘটানোর জন্য যে ধৈর্য্য ও সহনশীলতা প্রয়োজন, তা তাঁর ছিল না। তাই তাঁর শাসন মহৎ উদ্দেশ্য পরিচালিত হলেও তিনি সাম্রাজ্যের স্থায়িত্বের পথ দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন।
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।