দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটারে রুখি সত্য বলে, আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি – ভাবসম্প্রসারণ

প্রিয় শিক্ষার্থীরা কেমন আছো আশা করি ভালো আছো, আজকে তোমাদের জন্য আমরা নিয়ে এসেছি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন ভাবসম্প্রসারণ “ দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটারে রুখি সত্য বলে, আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি ”। চলো এই ভাবসম্প্রসারণটি পড়ে নেয়।

দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটারে রুখি সত্য বলে, আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি - ভাবসম্প্রসারণ

দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটারে রুখি সত্য বলে, আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি ভাবসম্প্রসারণ

মূলভাব: মানুষের জীবনে সত্য মিথ্যা ভালো-মন্দ একত্রে জড়িয়ে আছে। একটি কে ছাড়া অপরটিকে যথাযথ উপলব্ধি করে যায় না বলে উভয়েই উভয়ের পরিপূরক। তাই জীবনের প্রয়োজনে সত্য-মিথ্যা চিরন্তন। সত্য জীবনের আরাধ্য। মিথ্যাকে পরিহার করে সত্যকে আঁকড়ে ধরেই জীবনের সার্থকতা প্রতিপন্ন করতে হয়। পৃথিবীতে যারা মিথ্যা ও ভুল-ভ্রান্তি কে বাদ দিয়ে কেবল মাত্র সত্য লাভের পথ খোঁজে তারা কখনোই সত্যের নাগাল পায় না।

সম্প্রসারিত ভাব: সত্য মিথ্যা নিয়ে এই জীবনের পথ চলা। সত্যই জীবন, সত্যই- আলো পৃথিবীতে মানুষ চায় মিথ্যার কুহকে পথভ্রান্ত না হতে, তার একান্ত কাম্য লক্ষ ‘সত্য’। সত্যই মানব জীবনের কল্যাণ বয়ে আনে। সত্য মানে কল্যান। সত্য মানে সুন্দর। কিন্তু সত্য কোন বিচ্ছিন্ন অনুষঙ্গ নয়। সত্যকে সহজে পাওয়ার ও চেনার কোন পথ নেই। কেননা সত্য এমন কোন বিশুদ্ধ ধারণা নয়, যে তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে জীবনের সকল গতিবিধি কে নিয়ন্ত্রন করতে হবে। সত্য হলো একটি আপেক্ষিক ধারণা। জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সত্য-মিথ্যা কে চিনে নেওয়া যায়। দিনকে যেমন রাতের সাথে তুলনা করেই চেনা যায়, তাপকে যেমন শত্যৈর সাথে তুলনা করে করে অনুভব করা যায়, সত্যকেও তেমনি মিথ্যার পাশাপাশি রেখেই উপলব্ধি করতে হয়। ভুল বা মিথ্যা মানবজীবনের অনিবার্য একটি ঘটনা। তাকে স্বীকার করেই তাকে অতিক্রম করতে হয় ,এড়িয়ে গিয়ে নয়। মানব জীবনের এক একটি ভুল মানুষকে এক বা একাধিক সত্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। সংসারের সত্য ও মিথ্যা, সুন্দর ও অসুন্দর একই সাথে বিরাজ করে। মিথ্যা ও অসুন্দরকে প্রত্যাখ্যানের জন্য দ্বার বন্ধ করে বসে থাকলে চলবে না। কেননা, মিথ্যা পরিহার করা মানেই সত্যানুসন্ধানী হওয়া নয়-মিথ্যা পরিহার করার সাথেসাথে সত্যকে আঁকড়ে ধরতে হবে। দ্বার বন্ধ করে সংসার বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকলে সত্য ও মিথ্যা উভয় থেকেই বিচ্ছিন্ন হতে হয়। প্রকৃতপক্ষে সংসার জীবনের সকল কাজ কর্ম করে সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য নির্ণয় পূর্বক সাধ্যমত সত্যাশ্রয়ী থাকার চেষ্টা করাই সকলের কাম্য হওয়া উচিত। পার্থিব জগতে সত্য ও মিথ্যার রয়েছে পাশাপাশি অবস্থান। সত্য-মিথ্যা পরস্পর এমন অবিচ্ছেদ্য যে, নিরবচ্ছিন্ন সত্য এবং মিথ্যাকে পৃথক পৃথকভাবে উদঘাটন করা সম্ভবপর নয়। জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতায় দুর্গম পথ চলতে চলতে এসব ভুল ভ্রান্তি ও মিথ্যাকে অপসারিত করে মানুষকে সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়। অজস্র ভুল ভ্রান্তি কে অতিক্রম করলেই যথার্থ সত্যের সন্ধান মেলে। জীবনের সকল দ্বার রুদ্ধ করে দিলে হয়তো ভ্রান্তিকে ঠেকানো যায়, কিন্তু সত্যকে পাওয়া যায় না। আকরিক ধাতু যেমন মাটির সাথে মিশে থাকে, মাটি পরিষ্কার করে তাকে পেতে হয়, জীবনের পথেও তেমনি সত্য আর মিথ্যা মিশে আছে। সত্য এবং মিথ্যা নিয়েই জীবন যাপন করতে হয়। বাস্তব জীবনের জটিল পথে সত্য ও মিথ্যা দুই-ই এসে দাঁড়াবে। মানুষকে তার বিবেক ও বুদ্ধি খাটিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয় সে কোনটাকে গ্রহণ করবে, সত্য না মিথ্যা? এই জটিল জীবন পথে ভুলভ্রান্তি আসাও স্বাভাবিক। কিন্তু ভুলকেই শেষ মনে করলে চলবে না। ভুলের বন্ধুর পথ অতিক্রম করেই সাফল্যের সোনালী দিগন্তে পৌঁছা যায়। তেমনি মিথ্যাকে মাড়িয়েই সত্যের সোনালী দিগন্তে পৌঁছা যায়। তাই মিথ্যা কে বাদ দিয়ে সত্যের কল্পনা করা বৃথা। অপরদিকে মিথ্যা না থাকলে সত্যের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব কে কিছুতেই উপলব্ধি করা যায় না।

মন্তব্য: সত্যের জন্যেই মিথ্যার প্রয়োজন। জীবনে চলতে গেলে ছোটখাট ভুল ভ্রান্তি সত্যকে পাওয়ার পথে প্রতিবন্ধক বা অন্তরায় মনে করলে চলবে না। বরং ভুল-ভ্রান্তি থেকে বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভ করে মানুষ প্রকৃত সত্যকে উদঘাটন করবে। তাই মিথ্যা গৃহবন্দি হয়ে থাকার প্রয়োজন নেই। কারণ মিথ্যা না থাকলে সত্যের গুরুত্ব ততটা বোঝা যায় না।

বিকল্প ১

মূলভাব : পৃথিবীতে সত্য ও মিথ্যা পাশাপাশি অবস্থান করে। জীবনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই মানুষ সত্য ও মিথ্যাকে চিনতে শেখে। ভুল-ভ্রান্তির ভয়ে মানুষ কর্মবিমুখ হলে জীবনে কখনও সাফল্য আসবে না।

সম্প্রসারিত ভাব : সত্য সূর্যালােকের ন্যায় স্বতঃপ্রকাশ। সত্য মানব জীবনের পরম আরাধ্য বিষয়। কিন্তু এ সত্যের নাগাল পাওয়া সহজসাধ্য নয়। সত্য অন্বেষণের জন্য প্রয়ােজন গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও কঠোর সাধনা। কেননা অগণিত ভুল আর মিথ্যায় সত্য চাপা পড়ে থাকে। সত্যকে উপলব্ধি করতে হলে অন্তরকে কলুষমুক্ত করে সত্যকে সহজভাবে গ্রহণ করতে হবে। এ ছাড়া সত্যকে পাওয়ার সহজ কোনাে পথ নেই। জীবনে বাস্তব অভিজ্ঞতার মানদণ্ডেই সত্য-মিথ্যার যাচাই হয়। এজন্য মিথ্যা ছলনার ভয়ে জগৎ ও জীবনবিমুখ হয়ে কেউ যদি কর্ম জীবনে পা না বাড়ায় তবে হয়তাে মিথ্যাকে ঠেকানাে যাবে, কিন্তু সত্যকে উপলব্ধি করা যাবে না। তাই মহামতি গ্যাটে বলেছেন, “সত্যকে ধরাে, প্রতারণায় অভ্যস্ত হয়াে না। ” ঘরের দরজা জানালা বন্ধ রাখলে যেমন ঘরের ভেতর সূর্যালােক প্রবেশ করতে পারে না, তদ্রুপ আমরা যদি আমাদের মনের দরজা খুলে না রাখি, তাহলে জ্ঞানালােক অন্তরে প্রবেশ করতে পারবে না। জীবন ও জগৎকে সত্যিকার উপলদ্ধির মাধ্যমেই আমাদের আত্মমুক্তি। রূপকে বাদ দিয়ে যেমন সত্যজ্ঞান লাভ সম্ভব নয়, তেমনি দৃশ্যমান জগৎ ও জীবনকে বাদ দিয়ে সত্যজ্ঞান থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে ইন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ করে যােগাসনের দ্বারা সত্যকে উপলব্ধি করা যায় না। কবির কথায় –

“ইন্দ্রিয়ের দ্বার-
রুদ্ধ করি যােগাসন- সে নহে আমার
যা কিছু আনন্দ আছে দৃশ্যে গন্ধে গানে,
তােমার আনন্দ রবে তার মাঝখানে।”

মন্তব্য : মানুষ ভুলের মােহে পথভ্রান্ত হবে এ ভয়ে জগৎ সংসার ও জাগতিক মােহবন্ধনকে পরিহার করলে বাস্তবেরসঙ্গে জীবনের বাস্তব যােগ ঘটবে না। ফলে শেষ পর্যন্ত জীবনের সত্য উপলদ্ধি করা সম্ভব হবে না। ভুল-ভ্রান্তির মধ্য দিয়েইমানুষ সত্য পথের সন্ধান পায়।

বিকল্প ২

দিন-রাত যেমন এক সাথে গাঁথা, ভাল-মন্দ, সত্য-মিথ্যা তেমনি একই সাথে গাঁথা। মন্দ ছাড়া ভালো অর্থঃ হীন, মিথ্যা ছাড়া সত্য অর্থঃ হীন। আমাদের সমাজে এমন অনেক মানুষ আছেন যারা, কুপথে চলে যাবার ভয়ে জীবনের পথে বের হতে চান না। তারা তাদের চারপাশে সব দ্বার রুদ্ধ করে দিয়ে শুধু সত্যের, চর্চা করতে চান। কিন্তু তারা বুঝতে পারেন না, এভাবে কখনও সত্যকে ধরা যায় না। সত্য কখনও নিজে নিজে কারও জীবনে ধরা দেয় না। যে মানুষ মিথ্যাকে চেনে না, মন্দকে চেনে না, সে কখনো সত্যের মূল্য বুঝতে পারে না। সে ভালোর মর্ম অনুধাবন করতে পারে না। সাতাঁর শিখতে হলে যেমন পানিতে নামতে হয়, তেমন জীবনে সত্য ও সুন্দরের বিকাশ ঘটাতে চাইলে সত্য-মিথ্যা, ভাল-মন্দ প্রভৃতি অভিজ্ঞতার পথে জীবনকে চালিত করতে হয়। ভালো-মন্দ, সত্য-মিথ্যা, সুন্দর-অসুন্দর, পাপ-পুণ্য সব পাশাপাশি বিচরণ করবে সেটাই স্বাভবিক। সত্যিকারে খাঁটি মানুষ যে, সেই তো মিথ্যার কুহক থেকে সত্যকে টেনে বের করে আনবে। সে জন্যে জীবনে বাস্তব অভিজ্ঞতার দরকার। মন্দের কদর্য যার অজানা, ভালোর সৌন্দর্য উপলদ্ধি করা তার পক্ষে মোটেই সম্ভব না। কুহকের ভয়ে যে জীবন দ্বার রুদ্ধ করে রাখে, বাস্তবের সাথে তার জীবনের কোনো সংযোগই ঘটে না। সুতরাং তার পক্ষে কখনই সত্য দিয়ে জীবন সুসজ্জিত করা সম্ভব নয়। তাই সত্যকে পেতে গেলে মিথ্যার অভিজ্ঞতা প্রযোজন।

শিক্ষা: জীবনকে আলোকিত করার জন্যই অন্ধকারকে জানতে হয়। তাই সত্যের পথে থাকতে গিয়ে মিথ্যার ভয়ে জীবন দ্বার রুদ্ধ করা সঠিক সিদ্ধান্ত নয়।

আশা করি তোমরা এই ভাবসম্প্রসারণটি বুঝতে পেরেছো। আমাদের সাথেই থাকো।

Leave a Comment