আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “ধর্ম আন্দোলনের কারণ ও পটভূমি” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
ধর্ম আন্দোলনের কারণ ও পটভূমি
ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও সমাজ ব্যবস্থার প্রবল প্রতাপের যুগে প্রায় নতুন তত্ত্ববিশিষ্ট এই নতুন ধর্মমতগুলির উদ্ভব কিছুটা বিস্ময়কর হলেও, অস্বাভাবিক ছিল না। এই সকল ব্যাতিক্রমী ধর্মতত্ত্ব সমকালীন সমাজ ও অর্থনীতির রূপান্তরের পটভূমিতে তাদের প্রাসঙ্গিকতা জোরালো করেছিল। এই সব ধর্মমতের বিশ্লেষণে অধিবিদ্যাগত সুক্ষ্ম স্বাতন্ত্র্যের পরিবর্তে উপজাতিক জীবনধারা ও বস্তুগত রূপান্তরের বিষয়গুলি ছিল অধিক গুরুত্বপূর্ণ। তাদের উত্থানের পশ্চাৎপটে তা খুঁজে পাওয়া সম্ভব। আদি-বৈদিক যুগের সমাজ, রাজনীতি, ধর্ম, উৎপাদন পদ্ধতি, রাষ্ট্র সম্পর্কিত ধারণা ইত্যাদি জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রই পরবর্তী-বৈদিক যুগে পরিবর্তিত হয়েছিল। এই সকল পরিবর্তন এসেছিল চেতনাগত ও বস্তুগত উভয় দিক থেকেই। ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মঙ্গল-অমঙ্গলের পরিবর্তিত ধারণা যেমন প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল, তেমনি মানুষের বস্তুগত জীবনের পরিবর্তিত রূপ এবং জীবন ও জীবিকার নতুন নতুন উপাদানের সাথে মানুষের পরিচয় তাদের প্রচলিত ধর্মীয় চিন্তা ও আচার-অনুষ্ঠানের প্রতি ক্রমে নিস্পৃহ ও বিরূপ করেছিল।
আদি-বৈদিক সমাজজীবন ছিল সহজ, সরল, অনাড়ম্বর। তখন মুখ্যত পশুচারণভিত্তিক জীবনে উপজাতীয় উপাদানগুলি বর্তমান ছিল। ব্যাপকতর অর্থে যাকে ‘সাম্যবাদী সমাজ’ নামেও অভিহিত করা হয়। জাতিভেদ বা শ্রেণীবৈষম্যের অস্তিত্ব প্রায় ছিলই না। পরবর্তী-বৈদিক যুগে কৃষির ক্রমবিকাশ ধীরে ধীরে প্রাচীন সামাজিক সম্পর্কে রূপান্তর আনে। কৃষি উৎপাদনে উদ্বৃত্ত সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে সেই উদ্বৃত্ত আত্মসাৎকরণের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। এই কাজে ব্রাহ্মণশ্রেণী ধর্মকে একটি কার্যকরী হাতিয়ার হিসেবে প্রয়োগ করতে শুরু করে। এরই পরিণামে ধর্মাচরণের প্রধান পদ্ধতিসমূহ যেমন-উপাসনা, ভক্তি, ধর্মপরায়ণতা প্রভৃতির গুরুত্ব হ্রাস পায়। ব্রাহ্মণ সাহিত্য গ্রন্থগুলি থেকে জানা যায় যে, ব্রাহ্মণদের জীবিকার সাথে যুক্ত যজ্ঞ ও বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান তখন বিশেষভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। ব্রাহ্মণদের উদ্যোগে যজ্ঞানুষ্ঠানে জটিল থেকে জটিলতর প্রক্রিয়া প্রযুক্ত হতে থাকে। অনিবার্য পরিণামস্বরূপ যজ্ঞক্রিয়ার প্রধান পরিচালক ব্রাহ্মণদের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। বৈদিক যুগের শেষদিকে যজ্ঞ পরিচালনার জন্য প্রায় সতের প্রকার পুরোহিতের উদ্ভব হয়, যার মধ্যে ব্রাহ্মণরাই ছিলেন প্রধান। ভক্তি, শ্রদ্ধা ও আন্তরিকতার পরিবর্তে কতকগুলি প্রাণহীন ও দুর্বোধ্য ক্রিয়াকাণ্ড ধর্মের মুখ্য বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়। ধর্মানুষ্ঠানের বাহ্যিক আড়ম্বর একে ব্যয়বহুল করে তোলে। ফলে ধর্মাচার সাধারণ মানুষের সাধ্যাতীত হয়ে পড়ে। অথচ ব্রাহ্মণশ্রেণীর সামাজিক কর্তৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ সাধারণ মানুষ জটিল ও ব্যয়বহুল ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান উদযাপন করতে বাধ্য হয়। এই অসহায়ত্ব থেকে মুক্তির বিকল্প পথের সন্ধানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ উন্মুখ হয়ে ওঠে এবং প্রতিবাদী ধর্মদর্শনের উত্থানের পশ্চাৎপট তৈরি করে দেয়।
ব্রাহ্মণ্যধর্মের আড়ম্বরসর্বস্বতা, যজ্ঞের জটিলতা ও ব্যয়বাহুল্য, ধর্মাচরণের কাজে সামাজিক বৈষম্যের কঠোরতা ইত্যাদি অব্রাষ্মণদের মনে যে বস্তুগত অসন্তোষ ও নৈরাশ্য সৃষ্টি করেছিল; উপনিষদের নতুন দার্শনিক চিন্তা তাকে তাত্ত্বিক ভিত্তি দেয়। প্রাচীন ভারতীয় ঋষিরা দুর্নিবার আকুতি নিয়ে জানতে চেয়েছিলেন মানুষের কল্যাণ ও মুক্তির প্রকৃত পথ কোনটি। শ্রেয়ঃ ও প্রেয়ঃ’র মধ্যে তাঁরা শ্রেয়ঃকেই বেছে নেন। উপনিষদে যজ্ঞ দ্বারা অর্জিত পূণ্যকে অস্থায়ী বলে চিহ্নিত করা হয়। বলা হয়, মানুষের প্রকৃত ও চিরস্থায়ী কল্যাণ কর্মের দ্বারা হয় না, জ্ঞানের দ্বারাই হয়। উপনিষদের ‘কর্মফলবাদ’ ও ‘জন্মান্তরবাদ’ রাষ্মণদের ধর্মীয় একাধিপত্যের ভিত্তিমূলে নাড়া দেয়। ইতিমধ্যেই ‘পরিব্রাজক ও ‘শ্রমণ’ নামে পরিচিত সন্যাসীবৃদ্ধ যে আধ্যাত্মিক অনুসন্ধিৎসায় ব্রতী হয়েছিলেন, তা উপনিষদের বক্তব্যে সমর্থন খুঁজে পায়। এই শ্রমণেরা বেদ-ভিত্তিক সমাজ ও ধর্মভাবনার বিরোধিতা করেন। এঁরা ঘোষণা করেন যে, একমাত্র সৎ আচরণ, সৎকর্ম, জ্ঞান ও ভক্তি দ্বারা মানুষ কর্ম ও জন্মান্তরের জাল থেকে মুক্তি পেতে পারে। চার্বাক, অজিত কেশকম্বলিন, মক্কাহলী প্রমুখ জীবনের লক্ষ্য ও তা অর্জনের পথ সম্পর্কে নতুন দর্শনের অবতারণা করেন। এঁদের বক্তব্যে কিছু বৈচিত্র্য থাকলেও; এঁরা সকলেই বৈদিক ব্রাহ্মণ্যবাদী প্রচলিত ধর্মাচারের বিরোধিতা করেন। গোশাল তাঁর ধর্মমত কেবল সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে আবদ্ধ না রেখে, সাধারণ গৃহী মানুষের মধ্যে তা ছড়িয়ে দেন। পুরাণকাশ্যপ নামক জনৈক ধর্মগুরুও ব্রাহ্মণ্য ধর্মাচরণ পদ্ধতির প্রতিবাদ করে অদৃষ্টবাদী দর্শন প্রচার করেন। সাধারণ মানুষের মধ্যে এঁদের দর্শন গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। কিন্তু ব্রাহ্মণধর্মের প্রবল প্রভাবকে মুছে ফেলার মত কোন ইতিবাচক দর্শন এরা উপস্থাপিত করতে পারেনি। অদৃষ্টবাদ বা শূন্যবাদী দর্শন মানুষকে ব্যাপকভাবে আকর্ষণ করতে পারেনি। এজন্য দরকার ছিল সহজ, সরল অথচ ইতিবাচক দর্শন সমৃদ্ধ কোন মতবাদ। বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের মধ্যে মানুষ সেই আশাবাদ খুঁজে পায়। এঁদের প্রাথমিক ও ক্ষীণ প্রতিবাদ মহাবীর ও গৌতমবুদ্ধের মুখ দিয়ে সোচ্চারে ধ্বনিত হয়।
চেতনাগত এই সূক্ষ্ম পরিবর্তন মানবজীবনের বস্তুগত পরিবর্তনের সাথে যুক্ত হয়ে শক্তিশালী ও সক্রিয় হয়েছিল। প্রতিবাদী ধর্ম-আন্দোলনের পটভূমিতে সহায়ক উপাদান হিসেবে বাস্তব জীবনের এই মৌলিক পরিবর্তন ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের সূচনাকালে পাঞ্জাব, হরিয়ানা-সহ পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম ভারতের অর্থনীতি পশুচারণের পর্ব অতিক্রম করে কৃষি-অর্থনীতির সাথে পরিচিত হয়েছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে এই কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি ক্রমে মধ্য-গাঙ্গেয় উপত্যকায় সরে আসে। প্রাচীন কোশল ও মগধ, উত্তরপ্রদেশের পূর্বভাগ ও বর্তমান বিহার ভূখণ্ডে এই অর্থনৈতিক রুপান্তর বস্তুগত চেতনা ও জীবনযাপন পদ্ধতির উপর বিশেষ প্রভাব ফেলে। এই পরিবর্তনের কয়েকটি অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল উৎপাদনের ক্ষেত্রে লোহার ব্যাপক ব্যবহার, বহু সংখ্যক নগরীর উদ্ভব, কারিগরি শিল্পের বৈচিত্র্য ও শিল্পী সংগঠনের (Guild), প্রতিষ্ঠা, বাণিজ্যের দ্রুত প্রসার ইত্যাদি। ‘জৈমিনি উপনিষদ, ব্রাক্ষ্মণ’ পাণিনির ‘অষ্টাধ্যায়ী’ এবং খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ থেকে ৩য় শতকের মধ্যবর্তীকালে রচিত ধর্মসূত্রগুলি থেকে এই আর্থ-সামজিক রূপান্তরের তথ্যাদি পাওয়া যায়। প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন থেকেও লৌহ আবিষ্কারের বিষয়টি প্রমাণিত হয়। কৌশাম্বী ও বিহারের সোনপুরে উৎখননের বহু সংখ্যক লোহার কুঠার পাওয়া গেছে। অধ্যাপক রামশরণ শর্মা দেখিয়েছেন যে, জঙ্গলাকীর্ণ মধ্য-গাঙ্গেয় উপত্যকায় কৃষি-অর্থনীতির বিকাশে লৌহজাত কৃষি-সরঞ্জামের বিশেষ গুরুত্ব ছিল। জঙ্গলাকীর্ণ এই অঞ্চলকে পরিষ্কার করে কৃষি-উপযোগী করে তোলার জন্য লোহার কুঠার ও লাঙ্গলের আবশ্যিকতা ছিল। ড. ভাস্কর চট্টোপাধ্যায় দেখিয়েছেন যে, আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব দশম শতকে উত্তরপ্রদেশের অত্রঞ্ঝি-খেরায় (এটা জেলা) লোহা আবিষ্কৃত হয়েছিল। ক্রমে উত্তরপ্রদেশ থেকে পূর্বদিকে লোহার কারিগরি প্রয়োগ কৌশল জ্ঞাত হয়েছিল। খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম থেকে ষষ্ঠ শতকের মধ্যে বারাণসীর রাজঘাট, গয়া জেলার শোনপুর, সরণ জেলার বৈশালী প্রভৃতি স্থানে উৎখননের ফলে প্রচুর লোহার সরঞ্জাম আবিষ্কৃত হয়েছে। লোহার প্রায়োগিক কৌশল এবং নতুন নতুন কৃষি সরঞ্জামের উদ্ভাবন মানুষের করায়ত্ত হলে কৃষিক্ষেত্রে বিপ্লব আসে। মানুষ কৃষি কাজে তামার পরিবর্তে অধিক কার্যকরী লোহার ব্যবহার শুরু করে। সম্ভবত লৌহ-কুঠারের সাহায্যে বনজঙ্গল কেটে পরিষ্কার করে কৃষিক্ষেত্রকে উপযোগী করা সম্ভব হয় এবং কৃষি-এলাকা বাড়ানো যায়। লৌহ-নির্মিত লাঙ্গল দিয়ে মটিকে গভীরভাবে খনন করা সম্ভব হয়। বৌদ্ধ সাহিত্যে কৃষিকাজে লৌহ নির্মিত লাঙ্গলের উল্লেখ আছে। সুত্তনিপাত গ্রন্থের ‘মহাভগ্ন’ অংশে লৌহ নির্মিত লাঙ্গলের ফলা ব্যবহারের আভাস আছে। বলা বাহুল্য লৌহ নির্মিত কৃষি সরঞ্জাম ব্যবহারের ফলে প্রচলিত কৃষি-ব্যবস্থা পরিবর্তিত হয়। কৃষি এলাকা ও উৎপাদন বৃদ্ধির সম্ভাবনা নতুন কৃষি অর্থনীতি ও সমাজ গড়ে তোলার সুযোগ এনে দেয়। লৌহনির্মিত লাঙ্গলের ফলা এবং লৌহ-কুঠারের ব্যবহার করে খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ ও পঞ্চম শতকের মধ্যে মধ্য গাঙ্গেয় উপত্যকা অঞ্চলে এক স্ব-নির্ভর কৃষক শ্রেণীর উত্থান সম্ভব হয়। এই স্ব-নির্ভর কৃষিজীবী সমাজ আর্থ-সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তনকে স্বাগত জানায়।
লোহার কারিগরি প্রয়োগের ফলে কৃষিক্ষেত্রে যে বিপ্লব অবশ্যম্ভাবী হয়েছিল, প্রচলিত ব্রাহ্মণ্যবাদের সাথে অনিবার্যভাবে তার সংঘাত দেখা দেয়। প্রচলিত ব্রাহ্মণ্য ধর্মাচারের প্রধান অঙ্গ ছিল যজ্ঞ ও বলিদান। এই বলিদানের প্রধান বস্তু ছিল ‘গোধন’। মৈত্রায়নী সংহিতা, তৈত্তিরিয় ব্রাহ্মণ, কাঠক সংহিতা ইত্যাদিতে ‘গো-বিতর্ক’ (গো-নিধনকারী), গোসব (গোযজ্ঞ) ইত্যাদি শব্দের উল্লেখ থেকে প্রমাণিত হয় যে, তখন যজ্ঞানুষ্ঠানের প্রচুর গোরু বলিদান করা হত। ‘শতপথ ব্রাহ্মণ’ এবং বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ ‘মঝঝিম নিকায়’, ‘সুত্তনিপাত’ ইত্যাদিতে খাদ্য হিসেবে গো-সম্পদ নষ্ট করার উল্লেখ আছে। প্রাক্-লৌহ যুগের কৃষিব্যবস্থায় গো-শক্তির প্রয়োগ ততটা আবশ্যিক ছিল না। তাই গো-সম্পদের অপচয় মানুষকে সেভাবে নাড়া দিত না। কিন্তু লৌহ-লাঙ্গল, মই ইত্যাদি ব্যবহারের জন্য গো-শক্তির প্রয়োজন অনুভূত হয়। গবাদি পশুর সংখ্যা হ্রাসের ফলে মানুষ যখন চিন্তিত, সেই সময় জৈন ও বৌদ্ধধর্মের অহিংসা নীতি স্বাভাবিক কারণেই মানুষকে আকৃষ্ট করে। বৌদ্ধগ্রন্থ ‘সুত্তনিপাতে’ বলা হয়, ‘গবাদি পশু আমাদের আত্মীয়ের মত, তাদের রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য।’ জৈন উত্তরাধ্যায়ন সূত্রে যজ্ঞানুষ্ঠানে প্রাণীহত্যাকে পাপ বলে বর্ণনা করা হয়। মানুষের বস্তুগত প্রয়োজন গৌতমবুদ্ধ ও মহাবীরের বক্তব্যে দৃঢ়ভিত্তি খুঁজে পায়। ফলে এই দুটি প্রতিবাদী ধর্মমতের উত্থান সহজতর হয়।
প্রতিবাদী আন্দোলনের পশ্চাৎপটে নগর-সভ্যতার বিকাশ ও ব্যবসাবাণিজ্যের প্রসার ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কৃষিকাজে লৌহ-প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। এই উদ্বৃত্ত অর্থ নগর সভ্যতার পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং ব্যবসাবাণিজ্যের পথ উন্মুক্ত করেছিল। রামশরণ শর্মা দেখিয়েছেন যে, খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে মধ্য-গাঙ্গেয় উপত্যকায় এই নগর-অর্থনীতির প্রথম উদ্ভব ঘটে। পূর্বে চম্পা থেকে পশ্চিমে ভূগুকচ্ছ এবং উত্তরে কপিলাবস্তু থেকে দক্ষিণে কাবেরিপত্তম্ পর্যন্ত ভূভাগে প্রায় ষাটটি সমৃদ্ধ নগরের পত্তন হয়েছিল। এদের মধ্যে অন্তত ছয়টি নগর-চম্পা, রাজগৃহ, সাকেত, কৌশাম্বী, বেনারস ও কুশীনারা’র সাথে বুদ্ধের কর্মকাণ্ড জড়িত ছিল। পালি গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, কৃষিকাজের সাথে জড়িত নয় এমন অসংখ্য উদ্যোগী মানুষ ও পরিবার নগরগুলিতে এসে বসবাস করতে শুরু করে। এদের মধ্যে প্রধান ছিল বিভিন্ন ধরনের শিল্পী ও ব্যবসায়ীর দল। কৃষিতে উদ্বৃত্ত উৎপাদনের সূত্রে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় শিল্পী ও ব্যবসায়ীদের ব্যস্ততা বৃদ্ধি পায়। কৃষি ও শিল্প-বাণিজ্য একে অপরের পরিপূরক হিসেবে পূর্ব-ভারতের অর্থনৈতিক জীবনকে একটি নতুন ও দৃঢ় ভিত্তিদান করে। এই পরিবর্তন পরোক্ষভাবে প্রতিবাদী ধর্ম-আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যায়।
কৃষি-উদ্বৃত্ত এবং বাণিজ্যের প্রসার খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে এক আর্থ-সামাজিক সংঘাতের সূচনা করে। কৃষি উৎপাদনের উদ্বৃত্ত ভোগ করার জন্য ব্রাহ্মণশ্রেণী বৃত্তিভিত্তিক বর্ণপ্রথার কঠোরতা বৃদ্ধি করে। সামাজিক সম্পদ (পশুপালন, কৃষি, শিল্প বাণিজ্য) সৃষ্টির দায়িত্ব কঠোরভাবে বৈশ্যদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। ধর্মীয় বিধান দ্বারা ব্রাহ্মণদের কায়িক শ্রম নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় এবং বৈশ্যদের সহযোগী হিসেবে শূদ্ররা ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের সেবা করার দায় বহনে বাধ্য হয়। ফলে সামাজিক দায়ভার বহন এবং বঞ্চনার দিক থেকে বৈশ্য ও শূদ্রের অবস্থান প্রায় একই রকম হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু নগরায়ণ ও বাণিজ্যের সূত্রে বৈশ্যদের হাতে যে বিপুল সম্পদ সঞ্চিত হয়েছিল, তাতে তাদের পক্ষে বৈদিক যুগের সমাজব্যবস্থাকে মেনে চলা সম্ভব ছিল না। পালি সাহিত্য থেকে এ যুগের বৈশ্যদের বিপুল ধন-সম্পদের আভাস পাওয়া যায়। এখন তারা সামাজিক মর্যাদালাভের জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠে। শ্রম-বিমুখ ব্রাহ্মণশ্রেণীর একাধিপত্য ভাঙার জন্য এরা উন্মুখ হয়ে ওঠে। এদের পাশে দাঁড়ায় কৃষক ও সাধারণ শূদ্রশ্রেণীর মানুষেরা। জৈন ও বৌদ্ধদর্শনের মধ্যে অব্রায়ণ জনগোষ্ঠী প্রচলিত সামজিক শৃঙ্খল থেকে মুক্তির পথ খুঁজে পায়। জৈন ও বৌদ্ধধর্মের আদর্শ ছিল অহিংসা ও ব্যবসাবাণিজ্যের প্রসার। বৌদ্ধদর্শনে শ্রমকে বিশেষ সামাজিক মর্যাদা দেওয়া হয়। ব্রাহ্মণ্যধর্মে সমুদ্রযাত্রা নিষিদ্ধ ছিল। বৌধায়ন সমুদ্রযাত্রাকে ‘পাপ’ বলে নিন্দা করেছেন। একইভাবে তখন সুদে ঋণদান এবং ঋণগ্রহণ দুই-ই নিষিদ্ধ ছিল। অথচ ব্যবসাবাণিজ্যের প্রসারের কাজে সমুদ্রযাত্রা এবং সুদের বিনিময়ে ঋণগ্রহণ ছিল অতি আবশ্যিক দুটি উপাদান। বৌদ্ধদর্শনে এই দুটি কাজেকেই সমর্থন ও স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এই অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট প্রতিবাদী ধর্মগুলির উত্থান ও প্রসার ত্বরান্বিত করে।
খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের রাজনৈতিক পরিস্থিতিও বৌদ্ধ, জৈন ইত্যাদি সাম্যবাদী ধর্মসমূহের উত্থানের সহায়ক ছিল। এই রাজনৈতিক পরিবর্তন দু’ভাবে প্রতিবাদী আন্দোলনের বিকাশে সহায়তা করেছিল। প্রথমত, খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে রাজ্য ও গণরাজ্যের পত্তন শুরু হলে রাজনৈতিক চেতনায় পরিবর্তন আসে। লোহার অস্ত্র আবিষ্কারের ফলে রাজতন্ত্রের ক্ষমতা আগের তুলনায় অনেক বেশি দৃঢ় ও সুরক্ষিত হয়। কিন্তু সামাজিক মর্যাদার দিক থেকে তখনও ব্রাহ্মণদের প্রথম শ্রেণী বলে চিহ্নিত করা হত। এখন শক্তিশালী ক্ষত্রিয়রা সমাজের উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত হতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। স্বভাবতই ব্রাহ্মণশ্রেণীর সাথে ক্ষত্রিয়দের সম্পর্কে ভাঙন ধরে। বিভিন্ন ধরনের রাজকীয় যজ্ঞানুষ্ঠানে ক্ষত্রিয়দের প্রচুর ব্যয় করতে হত। রাজা ও রাষ্ট্রের মঙ্গল কামনায় শাসকেরা এই ব্যয়ভার বহন করতেন। কিন্তু ইতিমধ্যে দর্শন চেতনায় যে পরিবর্তন এসেছিল, তা ক্ষত্রিয়দেরও অনুপ্রাণিত করেছিল। ফলে নতুন শক্তিতে বলীয়ান ক্ষত্রিয়রা এখন ধর্ম ও সমাজে ব্রাহ্মণদের একাধিপত্য নাশ করতে আগ্রহান্বিত বোধ করে। দ্বিতীয়ত, খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে গাঙ্গেয় সমতল ভূমিতে যেমন রাজ্য স্থাপনা শুরু হয়েছিল, তেমনি হিমালয়ের পাদদেশে ও পাঞ্জাবের উত্তর-পশ্চিম অংশে গণরাজ্যগুলির প্রতিষ্ঠা নির্দিষ্ট রূপ পেয়েছিল। অনুমান করা হয় যে, প্রধানত কোন রাজবংশজাত ব্যক্তি রাজ্য ছেড়ে এসে গণরাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছেন। ড. রোমিলা থাপারের মতে, সম্ভবত বৈদিক গোঁড়ামির প্রতিক্রিয়া হিসেবে গণরাজ্যগুলির প্রতিষ্ঠা ঘটেছে। রাজ্যগুলির ক্রমবর্ধমান রক্ষণশীলতা থেকে মুক্তিলাভের আশায় স্বাধীনচেতা আর্যদের একাংশ পাহাড়ে উঠে এসে প্রাচীন উপজাতীয় রীতি-নীতি অনুযায়ী নতুন সমাজ গড়ে তোলেন। একটি ব্রাহ্মণসূত্রে গণরাজ্যের উপজাতিকে শ্রেণীচ্যুত ক্ষত্রিয় ও শূদ্ররূপে বর্ণনা করা হয়েছে। এর কারণ গণরাজ্যগুলিতে ব্রাহ্মণদের রাজনৈতিক ধারণা অনুসরণ করা হত না। এই সকল রাজ্যে ব্রাহ্মণদের প্রতি সম্মান দেখানো ও বৈদিক অনুষ্ঠানাদি পালন করার আদৌ বাধ্যবাধকতা ছিল না। ড. থাপার লিখেছেন, “গণরাজ্যগুলি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীন মতপ্রকাশের ব্যাপারে রাজতন্ত্রের চেয়ে বেশি উদার ছিল।” প্রচলিত মতের বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গিকে সহ্য করা হত।। এইরূপ গণরাজ্য থেকে প্রতিবাদী ধর্ম-আন্দোলনের দুই নেতা গৌতমবুদ্ধ ও মহাবীরের আবির্ভাব ঘটেছিল।
এইভাবে দেখা যায় যে, লোহার ব্যবহারের ফলে কৃষি-উৎপাদনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন, নগরায়ণ, ব্যবসাবাণিজ্যের প্রসার, শিল্পী-সংঘের প্রতিষ্ঠা, গণরাজ্যের উত্থান ইত্যাদির ফলে যে নতুন আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটেছিল, তা প্রতিবাদী ধর্মগোষ্ঠীগুলির উত্থান ও বিকাশের অনুকূল প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল।
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।