আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “নন্দবংশ, শিশুনাগ বংশ, বিম্বিসার, অজাতশত্রু, অজাতশত্রুর বংশধরগণ” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
বিম্বিসার (আনুঃ ৫৪৫-৪৯৪ খ্রিষ্টপূর্ব) :
বৌদ্ধ মহাবংশ ও বুদ্ধচরিত থেকে জানা যায় হর্ষঙ্ক বংশের বিম্বিসার-এর রাজত্বকালেই মগধের সাম্রাজ্যবিস্তারের সূচনা হয়েছিল। বিম্বিসার ঠিক কত সালে মগধের সিংহাসনে বসেছিলেন তা সঠিকভাবে বলা যায় না। তবে সিংহলী ঐতিহ্য অনুসারে বুদ্ধের নির্বাণ লাভের ষাট বছর পূর্বে বিম্বিসারের রাজ্যভিষেক সম্পন্ন হয়েছিল। বুদ্ধদেব যদি ৪৮৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মারা যান তাহলে বিম্বিসার তার ষাট বছর আগে অর্থাৎ ৫৪৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মগধের সিংহাসনে বসেন। বিম্বিসারের নামের আগে শ্রেণিক (সেনিয়) উপাধি যুক্ত থাকার জন্য ড. ভাণ্ডারকর এই অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, বিম্বিসার প্রথমে সেনাপতি ছিলেন ও পরে সিংহাসন অধিকার করেন। কিন্তু মহাবংশ থেকে জানা যায় যে, মাত্র পনেরো বছর বয়সে বিম্বিসার রাজপদে অভিষিক্ত হন। তাঁর পিতা ভট্টিয় বা মহাপদ্ম তাঁকে অভিষিক্ত করেন। সুতরাং বিম্বিসার কোন নতুন রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেননি। তবে মগধের প্রথম শক্তিশালী সাম্রাজ্যবাদী শাসক হিসেবে তাঁর নাম অবশ্যই উল্লেখযোগ্য। তিনি সম্ভবত ৪৯৪ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন।
বিম্বিসার যখন মগধের সিংহাসনে বসেন তখন দক্ষিণ-বিহারের পাটনা ও গয়া জেলার মধ্যে মগধ রাজ্য সীমাবদ্ধ ছিল। বিম্বিসার ছিলেন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন শাসক। মগধের সুবিধাজনক ভৌগোলিক অবস্থান, প্রাকৃতিক সম্পদ ইত্যাদি বিবেচনা করে তিনি নিশ্চিত হন যে, মগধকে কেন্দ্র করে একটি বৃহৎ সাম্রাজ্য গড়ে তোলা সম্ভব। তাই তিনি সিংহাসন লাভ করে সাম্রাজ্য বিস্তারের নীতি গ্রহণ করেন। সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি সঠিকভাবে অনুধাবন করতে তিনি সক্ষম হন। বৃজি, কোশল, অবন্তী প্রভৃতি প্রতিবেশী দেশগুলি ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল এবং তাদের শাসকগণ উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়ে উঠেছিলেন, তা তাঁর প্রখর দৃষ্টি এড়ায়নি। তাই সাম্রাজ্য বিস্তারের ক্ষেত্রে তিনি কয়েকটি নীতি নেন। যেমন—বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন, যুদ্ধ দ্বারা রাজ্যজয়, দূরবর্তী শাসকদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা ইত্যাদি। সাম্রাজ্য বিস্তারের ক্ষেত্রে বিম্বিসার কর্তৃক গৃহীত বৈবাহিক নীতির বিশেষ ভূমিকা ছিল। কোশল, বৈশালী, বিদেহ ও মদ্র-সমকালীন এই চারটি বৃহৎ শক্তির সাথে বিম্বিসার বিবাহ সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। ‘ধৰ্ম্মপাদ সুক্ত’ থেকে জানা যায় কোশলরাজ প্রসেনজিতের ভগিনী কোশলদেবীকে বিবাহ করে তিনি যৌতুক হিসেবে কাশীগ্রাম লাভ করেন। কাশী লাভের ফলে তাঁর বার্ষিক ১ লক্ষ মুদ্রা রাজস্ব আদায় হতে থাকে। এরপর তিনি লিচ্ছবি-প্রধান চেতকের কন্যা চেল্লানাকে বিবাহ করেন। শক্তিশালী লিচ্ছবিগণ মিত্রে পরিণত হওয়ায় মগধের ক্ষমতা ও মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। বিম্বিসারের তৃতীয় স্ত্রী ছিলেন বিদেহ-রাজকন্যা বাসবী। এছাড়া মদ্র-রাজকন্যা ক্ষেমারও পাণিগ্রহণ করেন তিনি। মদ্র রাজ্য মধ্য পাঞ্জাবে অবস্থিত ছিল। এই সকল বিবাহ সম্পর্ক স্থাপনের ফলে পশ্চিম ও উত্তরদিকে মগধ সাম্রাজ্য বিস্তারের পথ প্রশস্ত হয়।
বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে নিজ সাম্রাজ্যের ভিত্তি সূদৃঢ়করণের পর বিম্বিসার অঙ্গ রাজ্যজয়ের উদ্যোগ নেন। শোনা যায়, বিম্বিসারের পিতাকে অঙ্গরাজ ব্রহ্মদত্ত পরাজিত করেছিলেন। তাই বিম্বিসার প্রতিশোধ গ্রহণকল্পে অঙ্গ রাজ্যজয়ের পরিকল্পনা করেন। এর প্রস্তুতি হিসেবে তিনি ইতিপূর্বেই সেনাবাহিনীকে সুগঠিত করে তোলেন। সেনানিয়োগের পদ্ধতির তিনি আমূল পরিবর্তন সাধন করেন। এতদিন বিভিন্ন গোষ্ঠী থেকে সেনাবাহিনী সংগ্রহ করা হত। স্বভাবতই নিজ নিজ বাহিনীর উপর গোষ্ঠীপতিদের নিয়ন্ত্রণ থাকত। গোষ্ঠীপতিগণ রাজার উপরেও প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হত। বিম্বিসার ঐরূপ সেনাবাহিনী ভেঙে দিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্য থেকে সৈনিক সংগ্রহ করেন। এদের আনুগত্য ছিল একমাত্র রাজার প্রতি। বংশানুক্রমিক কর্তৃত্ব বজায় রাখার লক্ষ্যে ‘সেনাপতি’ বা ‘সেনাধ্যক্ষ’ নামক একটি নতুন পদ সৃষ্টি করা হয় এবং মূলত যুবরাজদের ঐপদে নিয়োগ করা হয়। এইভাবে বিম্বিসার বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের উপযুক্ত করে সেনাবাহিনীকে গড়ে তোলেন ও তারপর অঙ্গ রাজ্য আক্রমণ করেন। অঙ্গরাজ ব্রম্মদত্তকে পরাজিত ও নিহত করে বিম্বিসার অঙ্গ রাজ্যকে মগধ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। ড. রায়চৌধুরীর মতে, “বিম্বিসারের অঙ্গ রাজ্যজয়ের দ্বারা মগধ সাম্রাজ্যবাদের যে সূচনা হয়, অশোকের কলিঙ্গজয়ে তার সমাপ্তি ঘটে।” বিম্বিসার তাঁর রাজ্যকালে এই একটি মাত্র রাজ্যই জয় করেন। কিন্তু এর গুরুত্ব ছিল অসীম। অঙ্গের রাজধানী চম্পা সেই সময়ে বৌদ্ধধর্মের একটি অন্যতম কেন্দ্র ছিল। তাছাড়া বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবেও চম্পার গুরুত্ব ছিল সমধিক। কারণ চম্পা ছিল একটি নদীবন্দর। এই বন্দরের মাধ্যমে একদিকে যেমন অন্তর্বাণিজ্য চলত, অন্যদিকে তেমনি গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের সমুদ্র-বন্দরগুলিকেও নিয়ন্ত্রণে রাখা যেত। যেহেতু ঐ সামুদ্রিক বন্দরগুলির মাধ্যমে ব্রষ্মদেশের সঙ্গে বাণিজ্য চলত, সেহেতু চম্পা অধিকারের আশায় মগধ এই সক্রিয় বহির্বাণিজ্যেও অংশ নিতে সক্ষম হয়েছিল। এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি স্বরূপ মগধের আর্থিক স্বচ্ছলতা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছিল। জৈনগ্রন্থ ভগবতী সূত্র থেকে জানা যায় যে, অঙ্গকে একটি পৃথক প্রদেশের মর্যাদাদান করা হয়েছিল। প্রদেশটি শাসন করতেন যুবরাজ অজাতশত্রু।
বেশ কয়েকটি দূরবর্তী রাজ্যের সাথে রাজনৈতিক কারণেই বিম্বিসার সুসম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। গান্ধাররাজ পুককুশতি বিম্বিসারের কাছে দূত প্রেরণ করেন। আবার রোগাক্রান্ত অবন্তীরাজাকে সুস্থ করে তোলার জন্য তিনি নিজ চিকিৎসক জীবককে রাজ্যে প্রেরণ করেন। এইভাবে তিনি নিজ সাম্রাজ্যের ভিতকে শক্তিশালী করে তোলেন।
কেবল সাম্রাজ্য সংগঠক হিসেবে নয়, সুশাসক হিসেবেও বিম্বিসারের দক্ষতা প্রশংসার দাবি রাখে। তাঁর সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল ৩০০ লিগ। এই বিস্তৃত সাম্রাজ্যের সুশাসনের উপযুক্ত ব্যবস্থা তিনি করেন। বৌদ্ধগ্রন্থাদি থেকে তাঁর শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে তথ্যাদি পাওয়া যায়। বিম্বিসারের সাম্রাজ্যে প্রায় ৮০,০০০ সমৃদ্ধ গ্রাম ছিল। গ্রামগুলি ছিল স্বায়ত্তশাসিত। গ্রামপ্রধান বা গ্রামক-এর উপর গ্রাম-শাসনের ভার ছিল। গ্রামক সভার মাধ্যমে গ্রামের শাসন পরিচালনা করতেন। প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থাও ছিল স্বায়ত্তশাসিত। কেন্দ্রীয় স্তরের শাসন ছিল সরাসরি বিম্বিসারের নিয়ন্ত্রণাধীন। এক্ষেত্রে যেমন যোগ্যতার প্রকৃত মর্যাদা দেওয়া হত, তেমনি অযোগ্য লোকেদের অপসারণের মাধ্যমে শাস্তিদানও করা হত। কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থায় তিনটি বিভাগ ছিল। যথা— শাসনবিভাগ, বিচারবিভাগ ও সামরিক বিভাগ। এই তিন বিভাগে কর্মরত ব্যক্তিরা যথাক্রমে সর্বার্থক, ভোহারিক ও সেনানায়ক নামে অভিহিত হতেন। অপরাধীদের কারাদণ্ড দেওয়ার রীতি চালু ছিল। কৃষিজমির উপর রাজার অধিকার স্বীকৃত ছিল। তাই উৎপন্ন ফসলের একাংশ শুল্ক হিসেবে রাজকোষে জমা হত। বিম্বিসার কোন্ ধর্মাবলম্বী ছিলেন যে সম্পর্কে বৌদ্ধ ও জৈন গ্রন্থগুলি ভিন্ন মত পোষণ করে। জৈন উত্তরাধ্যয়ন সূত্র অনুযায়ী তিনি জৈন ধর্মাবলম্বী ছিলেন ও মহাবীরের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎও হয়। অন্যদিকে বৌদ্ধগ্রন্থাদি থেকে বুদ্ধদেবের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎকারের বর্ণনা পাওয়া যায় ও তিনি বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন বলে দাবি করা হয়। সম্ভবত, বিম্বিসার বৌদ্ধ ও জৈন উভয় ধর্মমতের প্রতিই শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতেন এবং গৌতম ও মহাবীর উভয়েই তাঁর সমসাময়িক ছিলেন। তবে তিনি বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন—এই মতই সত্য বলে মনে হয়। তিনি বৌদ্ধ সংঘকে বেনুবন উদ্যান দান করেন ও নিজ চিকিৎসক জীবকের উপর বুদ্ধদেবের চিকিৎসার দায়িত্ব অর্পণ করেন। প্রচলিত মতানুযায়ী পুত্র অজাতশত্রু কর্তৃক তিনি নিহত হন। এ বিষয়েও জৈন ও বৌদ্ধ গ্রন্থে ভিন্ন মতের অবতারণা করা হয়েছে। বৌদ্ধগ্রন্থ অনুযায়ী দেবদত্তের কুপরামর্শে অজাতশত্রু পিতাকে বন্দী করেন এবং অভুক্ত রেখে প্রাণনাশ করেছিলেন। জৈনগ্রন্থ অনুযায়ী অজাতশত্রু পিতাকে বন্দী করেন ঠিকই কিন্তু হত্যা করেননি। বিম্বিসার নিজেই অজাতশত্রুর আগমন সংবাদে ভীত হয়ে বিষপানে মৃত্যুবরণ করেন। যে মতই সঠিক হোক্, বিম্বিসারের মৃত্যুর জন্য অজাতশত্ৰু কিছুটা দায়ী অবশ্যই ছিলেন। বিম্বিসারের এহেন শোচনীয় পরিণতিতে শোকাহত হয়ে মহিষী কোশল দেবীরও মৃত্যু ঘটে।
অজাতশত্রু (আনুঃ ৪৯৪-৪৬২ খ্রিষ্টপূর্ব) :
বিম্বিসারের দ্বিতীয়া পত্নী লিচ্ছবী রাজকন্যা চেল্পনার গর্ভজাত সন্তান ছিলেন অজাতশত্রু। পিতাকে বন্দী বা হত্যা করে সিংহাসনে আরোহণ করলেও, পিতার সাম্রাজ্য বিস্তার নীতি থেকে তিনি বিচ্যুত হননি। তিন দশকের কিছু বেশী সময়কাল (খ্রিষ্টপূর্ব ৪৯৪-৪৬২ অব্দ) ব্যাপী শাসনকালে তিনি মগধের ভৌমিক বিস্তৃতি এবং শক্তি বৃদ্ধির কাজে যথেষ্ট সাফল্য দেখান। এই কারণে তাঁকে হর্ষবংশের ‘শ্রেষ্ঠ শাসক’ বলা হয়। সমকালীন উত্তর ভারতের দুই বৃহৎ শক্তি কোশল ও বৃজি (বজ্জি)র বিরুদ্ধে তিনি অস্ত্র ধরেন এবং অতি দক্ষতার সাথে তাদের পরাস্ত করেন।
রাজতান্ত্রিক শক্তি কোশল রাজ্যের বিরুদ্ধে তিনি প্রথমে সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। বিম্বিসারের শোচনীয় মৃত্যুতে মর্মাহতা কোশলদেবীও প্রাণত্যাগ করলে কোশলরাজ প্রসেনজিৎ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন ও এই ঘটনার জন্য অজাতশত্রুকেই দায়ী করেন। ভগিনী হত্যার সমুচিত দণ্ডদানের জন্য তিনি কাশীগ্রাম ফিরিয়ে নিতে মনস্থ করেন। এই কাশীগ্রাম বিম্বিসার লাভ করেছিলেন কোশলদেবীকে বিবাহের সূত্রে। কাশীগ্রাম ফিরিয়ে নেওয়ার ঘটনায় অজাতশত্রুও অপমানিত হন এবং উভয়ের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ হিসেবে উপরোক্ত ঘটনাকে উপস্থাপিত করা হলেও এর পরোক্ষ বা প্রকৃত কারণ ছিল আরো গভীর। সমকালীন রাজনীতিতে কোশল যথেষ্ট ক্ষমতাশালী রাজ্য বলেই পরিগণিত হত। তাই দুই সাম্রাজ্যবাদী শক্তি, মগধ ও কোশলের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল, তীব্র। বিচক্ষণ বিম্বিসার বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের দ্বারা এই শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীকে বশীভূত করেছিলেন। কিন্তু অজাতশত্রুর সময়ে অবস্থার পরিবর্তন ঘটে এবং প্রসেনজিৎ ও অজাতশত্রু সরাসরি সংঘর্ষে লিপ্ত হন। যুদ্ধের প্রথমদিকে অজাতশত্রুর জয়ী হবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। প্রসেনজিৎ রাজধানী শ্রাবস্তীতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে অজাতশত্রু সেনাবাহিনী-সহ আত্মসমর্পণে বাধ্য হন। অবশেষে উভয়ের মধ্যে শান্তি স্থাপতি হয়। প্রসেনজিৎ নিজ কন্যা বজিরার সাথে অজাতশত্রুর বিবাহ দিয়ে পুনরায় কাশী প্রদান করেন। এইভাবে কাশী বরাবরের মত মগধের অধিকারভুক্ত হয়। তবে এই শাস্তি ছিল নিতান্তই সাময়িক, পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ থেকে তা প্রমাণিত হয়।
বৈশালীর লিচ্ছবি-প্রধান চেতকের নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ এক শক্তিজোটের সঙ্গে অজাতশত্রু দীর্ঘকালীন সংঘর্ষে লিপ্ত ছিলেন। ৩৬টি গণরাজ্য এই শক্তিজোটের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এর মধ্যে ৯টি মল্ল উপজাতি, ৯টি লিচ্ছবি উপজাতি ও ১৮টি কাশী-কোশলের উপজাতি ছিল। মল্ল ও লিচ্ছবিগণের পরিচয় নিশ্চিত। কিন্তু ১৮টি কাশী-কোশলের উপজাতীয় প্রধান কারা ছিলেন, তাঁরা কেনই বা ঐ শক্তিজোটে যোগ দিয়েছিলেন, সে সম্পর্কে প্রশ্ন থেকে যায়। সম্ভবত প্রসেনজিতের পরবর্তী কোশলরাজ বীবাহ কর্তৃক গণরাজ্যটি অধিকৃত হলে কোশলরাজকে কর প্রদানকারী অন্যান্য উপজাতিদের মধ্যে আশঙ্কার সৃষ্টি হয়েছিল। ফলে তারা চেতকের আহ্বানে অরাজতান্ত্রিক শক্তিজোটে যোগ দিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় সচেষ্ট হন। এমনও হতে পারে, এই সকল উপজাতিদের দমন করতে গিয়ে বীরূবাহর মৃত্যু হয় ও উপজাতিগুলি লিচ্ছবি গণরাজ্যের স্বপক্ষে যুদ্ধে যোগ দিয়ে মগধ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে। অর্থাৎ আলোচ্য সংঘাত বৃহত্তর পটভূমিতে রাজতন্ত্র বনাম প্রজাতন্ত্রের সংঘাতে রূপান্তরিত হয়। অজাতশত্রুর পক্ষেও এই যুদ্ধ ছিল তাঁর সাম্রাজ্যবাদী নীতির অবশ্যম্ভাবী ফলাশ্রুতি। কারণ গঙ্গার দুই তীর নিজ অধিকারভুক্ত করে নদীপথে সম্পাদিত বাণিজ্যকে নিয়ন্ত্রিত করাই ছিল তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য। সমৃদ্ধ বাণিজ্য যে-কোন সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক বুনিয়াদকে দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করে, তা তিনি উপলব্ধি করেন। বিম্বিসারের ‘চম্পা’ দখলের মধ্য দিয়েই এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল বলা চলে। তারপর অজাতশত্রু প্রথমে কাশী অধিকার করে ও পরে লিচ্ছবিদের পরাজিত করে গঙ্গার উত্তর তীরেও নিজ অধিকারভুক্ত করেন। অবশ্য এজন্য দীর্ঘ ১৬ বছরকাল তাঁকে শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কঠিন সংগ্রামে রত থাকতে হয়েছিল। ৩৬টি গণরাজ্য এই যুদ্ধে অজাতশত্রুর বিরোধিতা করলেও লিচ্ছবি-প্রধান চেতকের সঙ্গে মতবিরোধকে কেন্দ্র করেই যুদ্ধের সুত্রপাত হয়। যুদ্ধের কারণ সম্পর্কে বৌদ্ধ ও জৈন গ্রন্থে ভিন্ন ভিন্ন মতপ্রকাশ করা হয়েছে। বৌদ্ধগ্রন্থ অনুযায়ী গঙ্গার তীরে আবিষ্কৃত একটি রত্নখনিকে কেন্দ্র করে বিরোধের সূত্রপাত হয়। এই চুক্তি দ্বারা স্থির হয়েছিল যে, ঐ খনি থেকে উত্থিত রত্ন মগধ ও বৈশালী, উভয় রাজ্যের মধ্যে সমানভাগে বণ্টিত হবে। কিন্তু লিচ্ছবিগণ চুক্তিভঙ্গ করলে অজাতশত্রু যুদ্ধ ঘোষণা করেন। জৈনগ্রন্থ অনুযায়ী বিম্বিসার তাঁর দুই পুত্র হল্ল ও বেহল্লকে হস্তী এবং কিছু রত্ন দান করেছিলেন। অজাতশত্রু তাদের কাছ থেকে ঐগুলি নিজ অধিকারভুক্ত করতে চাইলে তারা মাতামহ চেতকের কাছে আশ্রয় নেয়। অজাতশত্রু তাদের প্রত্যর্পণ দাবি করলে চেতক তাতে অস্বীকৃত হন ও যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধ শুরুর উপরেই উভয় পক্ষের অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নটি নির্ভরশীল ছিল। তাই উভয়েই ব্যাপকভাবে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছিল। অজাতশত্রু গঙ্গার তীরে পাটলগ্রামে একটি দুর্গ নির্মাণ করান। কারণ তাঁর রাজধানী রাজগৃহ ছিল দেশের অভ্যন্তরে, গঙ্গার থেকে দূরবর্তী স্থানে অবস্থিত। তাই সেখান থেকে গঙ্গার অপর তীরস্থ লিচ্ছবীদের সঙ্গে সংগ্রামে লিপ্ত হওয়া সুবিধাজনক ছিল না। অন্যদিকে চেতকও বৎস এবং অবন্তীর রাজাদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের মধ্যেমে তাঁদের নিজপক্ষে এনে শক্তিজোটকে শক্তিশালী করে তোলেন। এ সত্ত্বেও যুদ্ধে শেষপর্যন্ত অজাতশত্রুই জয়ী হন, কারণ অস্ত্রবল ও লোকবলের অভাব তিনি পূরণ করেন কুটনীতির প্রয়োগের মাধ্যমে। এ ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা নেন অজাতশত্রুর মন্ত্রী বস্সাকর। তাঁর নির্দেশে গুপ্তচরেরা দক্ষতার সাথে গণরাজ্যগুলির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। ফলে দীর্ঘ যুদ্ধের পর গণরাজ্যগুলির পতন ঘটে। এই যুদ্ধে অজাতশত্রু মহাশিলীকণ্টক ও রথম্শল নামক দুটি নতুন অস্ত্র ব্যবহার করেছিলেন। প্রথমটি ছিল পাথরছোঁড়ার যন্ত্র ও দ্বিতীয়টি ছিল তীরের মত ফলাযুক্ত একটি দুর্ভেদ্য রথ। এই যুদ্ধে জয়লাভের ফলে সমগ্র উত্তর বিহার মগধের অধিকারভুক্ত হয়। গঙ্গার উভয় তীরের উপর মগধের কর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। ও মগধ ভারতের একটি অবিসংবাদী শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। কাশী থেকে বাংলার সীমান্ত অবধি গঙ্গার দুই তীরস্থ অঞ্চল অজাতশত্রুর নিয়ন্ত্রণে আসে। ব্যাসামের মতে, বিম্বিসার ও অজাতশত্রু উভয়েরই সাম্রাজ্যবিস্তারের একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল, তা হল যতদূর পর্যন্ত সম্ভব গঙ্গার গতিপথের উপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করা এবং অজাতশত্রু সেই লক্ষ্যপূরণের বহুদূর পর্যন্তই সাফল্য অর্জন করেছিলেন।
সমকালীন ভারতের চারটি বৃহৎ শক্তির অন্যতম ছিল অবন্তী। পশ্চিম ভারতের এই অগ্রণী শক্তির সাথে অজাতশত্রুর সংঘাত ছিল একটি রাজনৈতিক অনিবার্য ঘটনা। কোশল রাজ্যের অন্তর্গত কাশী ও বৈশালী জনপদ দুটি মগধের হস্তগত হলে অবন্তীরাজ প্রদ্যোত শঙ্কিত হন এবং মগধ রাজ্য আক্রমণ করে অজাতশত্রুর ক্ষমতা নাশ করার সিদ্ধান্ত নেন। মঝঝিমনিকায় গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, অবন্তী রাজ্যের সম্ভাব্য আক্রমণের আশঙ্কায় অজাতশত্রু আগে ভাগেই রাজধানীর সুরক্ষার বন্দোবস্ত করেন। তবে উভয় রাজ্যের মধ্যে বাস্তবে কোন সংঘর্ষ হয়েছিল কিনা, কিংবা সেই সংঘর্ষের ফলাফল কি হয়েছিল, এ বিষয়ে সমকালীন গ্রন্থে কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না। অনুমান করা হয় যে, অজাতশত্রু সুকৌশলে অবন্তীরাজ্যের সাথে সংঘর্ষ এড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন। অজাতশত্রুর ধর্মভাবনা সম্পর্কে কিছু অস্পষ্টতা আছে। বৌদ্ধ ও জৈন উভয় ধর্মের গ্রন্থাবলীতে অজাতশত্রুকে নিজ নিজ ধর্মমতের অনুগামী বলে দাবি করা হয়েছে। বৌদ্ধধর্ম তথা বুদ্ধদেবের সাথে অজাতশত্রুর সম্পর্ক প্রাথমিক পর্বে যে মধুর ছিল না, এমন প্রমাণ আছে। অন্যদিকে জৈনধর্মের প্রচারক মহাবীরের সাথে তাঁর সুসম্পর্কের কথা জৈনগ্রন্থ ‘উপপাটিক সূত্তে’ উল্লেখ আছে। জৈন ধর্মমতের প্রতি যে তিনি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, এ কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। তবে পরবর্তী পর্যায়ে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিও তিনি অনুরক্ত হয়েছিলেন। সম্ভবত পিতৃহত্যার জন্য তাঁর মনে অনুতাপ দেখা দেয় ও শান্তিলাভের আশায় তিনি বুদ্ধদেবের কাছে আশ্রয় নেন। ভারহুতে বুদ্ধদেবের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎকারের দৃশ্য খোদিত রয়েছে। শিলালেখতে এও বলা হয়েছে যে, মগধরাজ অজাতশত্রু বুদ্ধের চরণতলে মাথা নত করেন। তিনি যে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, তার আরো প্রমাণ পাওয়া যায়। রাজধানী রাজগৃহের চারিদিকে তাঁর প্রতিষ্ঠিত চৈত্যগুলি তাঁর বৌদ্ধধর্ম গ্রহণের স্বপক্ষে সাক্ষ্য দেয়। রাজগৃহের ১৮টি বৌদ্ধবিহারের সংস্কার কার্যত তাঁর নির্দেশে সম্পন্ন হয়। সর্বোপরি, তাঁর রাজত্বকালে রাজগৃহে আহুত প্রথম বৌদ্ধসঙ্গীতিতে তিনি বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন। এই সঙ্গীতিতে যোগদানকারী ভিক্ষুদের যাবতীয় প্রয়োজনীয় দ্রব্য যোগান দেবার ভার নেন তিনি। আবার জৈনগ্রন্থাদিতে অজাতশত্রুকে জৈনধর্ম গ্রহণকারী বলে বর্ণনা করা হয়েছে। সম্ভবত অজাতশত্ৰু জৈনধর্মের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল ছিলেন।
অজাতশত্রুর বংশধরগণ :
আনুমানিক ৪৬২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে অজাতশত্রুর মৃত্যু হয়। বৌদ্ধ ও জৈন ঐতিহ্য অনুযায়ী এর পরে সিংহাসনে বসেন তাঁর পুত্র উদয়ভদ্র বা উদায়িন। পুরাণ অনুযায়ী অজাতশত্রুর পরবর্তী শাসক ছিলেন দর্শক। কিন্তু পণ্ডিতগণ এই মত সঠিক বলে মনে করেন না। সিংহলী ঐতিহ্য থেকে জানা যায় উদায়িন ১৬ বছর (৪৬২-৪৪৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে) রাজত্ব করেন। পরিশিষ্টপার্বণ অনুযায়ী গঙ্গাতীরস্থ পাটলিপুত্র নগরী তাঁর নির্দেশে নির্মিত হয়। অজাতশত্রু ইতিপূর্বেই এখানে একটি দুর্গের নির্মাণকার্য সম্পন্ন করেছিলেন, তা আমরা জানি। গঙ্গা ও শোন নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত পাটলিপুত্রর বাণিজ্যিক ও সামরিক গুরুত্ব উদায়িন উপলব্ধি করেন ও একে রাজধানীতে পরিণত করে বিচক্ষণতার পরিচয় রাখেন। অজাতশত্রুর রাজত্বকালে অবন্তীরাজ্যের সাথে মগধের যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সূত্রপাত হয়েছিল উদায়িনের সময়ে তা আরো প্রকট রূপ নেয়। ইতিমধ্যে অবন্তী পূর্ব ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্য জয় করে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ফলে দুই সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হয়। কথাসরিৎসাগর থেকে জানা যায় যে, উদায়িন অবন্তীরাজ পালকের প্রতিপত্তি কিছুটা কমিয়ে দেন। তবে এ বিষয়ে চূড়ান্ত মীমাংসা উদায়িনের সময়ে হয়নি। উদায়িন জৈনধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। উদায়িনের পর যথাক্রমে অনিরুদ্ধ, মুণ্ড ও নাগদসক মগধের সিংহাসনে বসেন। সিংহলী ইতিবৃত্ত অনুযায়ী এঁরা সকলেই ছিলেন পিতৃঘাতী ও অযোগ্য শাসক। ফলে সাধারণ মানুষ এঁদের প্রতি ক্ষুব্ধ ছিল। এই সুযোগে অমাত্য শিশুনাগ এই বংশের শেষ রাজা নাগদাসককে হত্যা করে মগধের সিংহাসন দখল করে নেন (৪৩০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)।
শিশুনাগ বংশ (আনুঃ খ্রিষ্টপূর্ব ৪৩০-৩৬৪ অব্দ) :
হর্ষঙ্ক বংশের উচ্ছেদ ঘটিয়ে শিশুনাগ মগধের সিংহাসন দখল করলে (খ্রিঃপূঃ ৪৩০ অব্দ) শিশুনাগবংশের শাসন শুরু হয়। সিংহলীয় বিবরণ অনুসারে তিনি খ্রিষ্টপূর্ব ৪১২ অব্দ পর্যন্ত ক্ষমতাসীন ছিলেন। মগধ সাম্রাজ্যবাদের গৌরব বৃদ্ধির কাজে তাঁর অবদান কম নয়। অবন্তীর বিরুদ্ধে তাঁর সাফল্য উল্লেখ্য। অজাতশত্রুর আমল থেকে অবন্তীর প্রদ্যোত বংশ মগধের একাধিপত্যের পথে বড় বাধা তৈরী করেছিল। অজাতশত্রু বা উদায়িন অবন্তীর ক্ষমতা নাশ করতে পারেন নি। রাজা প্রদ্যোত যে দক্ষতার অধিকারী ছিলেন তাঁর বংশধরদের তা ছিল না। প্রদ্যোতের পরবর্তী শাসক পালকের আমলে অবন্তী তার অতীত দক্ষতা ধরে রাখতে সক্ষম ছিল। কিন্তু পরবর্তী দুই অবন্তীরাজ বিশাখ ও আর্যক যথেষ্ট সবল ও দক্ষ শাসক ছিলেন না। এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেন শিশুনাগ অবন্তীর বিরুদ্ধে অভিযানের শক্তি বাড়ানোর জন্য তিনি পাটলিপুত্র থেকে মগধের পূর্বতন রাজধানী গিরিব্রজতে রাজধানী সরিয়ে আনেন। দুর্বল অবস্তী রাজ্যকে পরাজিত করে শিশুনাগ ঐ রাজ্যকে মগধের সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। পরে তিনি বৈশালীতে স্থায়ীভাবে রাজধানী স্থানান্তর করেন। এর কারণ সম্ভবত এটি ছিল শিশুনাগের পৈত্রিক বাসভূমি। তা ছাড়া ষোড়শ মহাজনপদের অন্যতম বৃহত্তর রাজ্য বৎস তাঁর আমলেই মগধের সাম্রাজ্যভুক্ত হয়েছিল।
শিশুনাগের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র মগধের সিংহাসনে বসেছিলেন। বৌদ্ধসাহিত্য অনুসারে সেই রাজার নাম ছিল কালাশোক। অন্যদিকে পুরাণে শিশুনাগের পরবর্তী শাসক রূপে কাকবর্ণ-এর নাম করা হয়েছে। ডি. আর, ভাণ্ডরকার-এর মতে, কালাশোক ও কাকবর্ণ এক ও অভিন্ন ব্যক্তি। কালাশোক পুনরায় বৈশালী থেকে রাজধানী পাটলিপুত্র নগরে স্থানান্তর করেন। তাঁর রাজত্বকালের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল বৈশালীতে দ্বিতীয় বৌদ্ধ মহাসংগীতির আয়োজন। বানভট্টের হর্ষচরিত থেকে জানা যায় যে, করুন হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তাঁর রাজত্বের অবসান ঘটেছিল। বহুকাল আগে রচিত গ্রীক লেখক কার্ঘিয়াস-এর লেখাতেও এই হত্যাকাণ্ডের সমর্থন মেলে। এই বিবরণ মতে, জনৈক শুদ্র কালাশোক ও তাঁর দশ পুত্রকে হত্যা করে সিংহাসন দখল করেছিলেন (আনুঃ ৩৬৪ খ্রিষ্টপূর্ব) বৌদ্ধগ্রন্থ ‘মহাবোধিবংশ’ থেকে কালাশোকের দশ পুত্রের নাম জানা যায়। এঁরা হলেন ভদ্রসেন, কোরণ্ডবর্ণ, মনগুর, সর্বগ্রহ, জালিক, উডক, সঞ্জয়, কোরব্য, নন্দী বর্ধন ও পঞ্চমক। ‘মহাবোধিবংশ অনুসারে ধরে নেওয়া যায় যে, কোনরূপ গোপন ষড়যন্ত্র কিংবা বিশ্বাসঘাতকতা দ্বারা কালাশোক বা তাঁর পুত্রদের হত্যা করা হয়নি। যথারীতি সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমেই উক্ত শূদ্র মগধের ক্ষমতা দখল করেছিল। নন্দবংশের প্রতিষ্ঠাতা মহাপদ্ম নন্দ (মহাপদ্মপতি)কে কালাশোকের হত্যাকারী শূদ্র সেনানায়ক বলে চিহ্নিত করা হয়।
নন্দবংশ (খ্রিষ্টপূর্ব ৩৬৪-৩২৪ অব্দ) :
নন্দবংশের ইতিহাস জানার জন্য আমাদের কলিঙ্গরাজ খারবেলের হাতিগুম্ফা লিপি, বৌদ্ধগ্রন্থ মিলিন্দপাঞহো, বৃহৎকথা, মহাবংশ, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, মুদ্রারাক্ষস নাটক ইত্যাদির উপর নির্ভর করতে হয়। এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মহাপদ্মনন্দ নামটিই সমধিক পরিচিত। যদিও মহাবোধিবংশতে নন্দবংশের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে উগ্রসেন নামটি পাওয়া যায়। সম্ভবত বিশাল সেনাদলের অধিপতি হওয়ার কারণে মহাপদ্মকেই ‘উগ্রসেন’ নামে অভিহিত করা হত। এই ‘উগ্রসেন নামটি থেকেই তাঁর বংশধরগণ উগ্রসৈন্য নামে পরিচিত হয়েছেন যেটি আবার গ্রীক উচ্চারণে ‘আগ্রাসেন’-এ এসে দাঁড়িয়েছে। নন্দবংশের প্রতিষ্ঠাতা মহাপদ্ম বা উগ্রসেন যিনিই হোন না কেন, তিনি উচ্চবংশোদ্ভূত ছিলেন না বলেই মনে হয়। জৈনগ্রন্থ অনুযায়ী তিনি ছিলেন নাপিতের পুত্র। কার্টিয়াসও এই মত সমর্থন করেছেন। পুরাণেও নন্দবংশের প্রতিষ্ঠাতাকে শুদ্রার গর্ভজাত বলে বলা হয়েছে। বৌদ্ধগ্রন্থ অনুযায়ী নন্দ শাসকগণ ছিলেন ‘অন্নাটকুল’ বা ‘অজ্ঞাতকুলশীল’। সুতরাং কোন ঐতিহ্যেই তাঁকে উচ্চ বংশমর্যাদার অধিকারী হিসেবে বর্ণনা করা হয়নি। তাই নন্দবংশকেই ভারতের প্রথম শূদ্র রাজবংশ বলা চলে। এটি বিশেষ অর্থবহ ঘটনা। কারণ এতদিন পর্যন্ত রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ক্ষত্রিয়দের প্রাধান্যই ছিল সুপ্রতিষ্ঠিত। মহাপদ্মনন্দ কর্তৃক মগধের সিংহাসন দখল সেই ঐতিহ্যে চরম আঘাত হেনেছিল।
মহাপদ্মনন্দ সম্পর্কে পুরাণে প্রদত্ত তথ্যাদি যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য। এখানে তাকে সর্বক্ষত্রান্তক (সকল ক্ষত্রিয়ের ধ্বংসকারী), একরাট ইত্যাদি অভিধায় ভূষিত করা হয়েছে। তিনি ছিলেন একজন শক্তিশালী শাসক। পুরাণ অনুযায়ী মহাপদ্মনন্দ ইক্ষ্বাকু, পাঞ্চাল, কাশী, অস্মক, সুরসেন, কলিঙ্গ, মৈথিল, কুরু, বিতিহোত্র প্রভৃতি রাজ্যের ক্ষত্রিয় রাজাদের উচ্ছেদ করেন। এর মধ্যে ইক্ষ্বাকুগণ রাজত্ব করত কোশলে। মহাপদ্ম যে ঐ অঞ্চল জয় করেন, কথাসরিৎসাগরের বর্ণনা থেকেও তা জানা যায়। হাতিগুম্ফা লিপিতে একজন নন্দরাজার নাম পাওয়া যায়। এ থেকে মনে হয় মহাপদ্মনন্দ কলিঙ্গ জয় করেছিলেন। দক্ষিণ-ভারতের কিছু অংশেও তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল। কারণ গোদাবরী নদীর তীরে ‘নবনন্দ ডেহরা’ নামক একটি নগর আবিষ্কৃত হয়েছে। মহীশূরে প্রাপ্ত লেখ থেকেও অনুমান করা যায় কুন্তল তাঁর অধিকারভুক্ত ছিল। ড. রায়চৌধুরীর মতে, কলিঙ্গ জয়ের পরবর্তী পর্যায় হিসেবে দাক্ষিণাত্য জয়ের সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। গ্রীক লেখক কার্টিয়াসের লেখা থেকেও জানা যায়, বিপাশা নদীর পূর্ব তীর থেকে মহাপদ্মনন্দের রাজ্য বিস্তৃত ছিল। মহাপদ্মই ছিলেন উত্তর ভারতের প্রথম সম্রাট। R. K. Mukherjee-র ভাষায়, “Mahapadma is the first great historical emperor of Northern India.” তাঁর আমলেই মগধ প্রকৃত অর্থেই একটি সাম্রাজ্যের চরিত্র লাভ করেছিল।
মহাপদ্মনন্দের পরে আরো আটজন ‘নন্দ’ রাজা মগধের সিংহাসনে বসেছিলেন। তবে তাঁদের সম্পর্ক বিষয়ে দ্বিমত আছে। পুরাণ গ্রন্থের মতানুসারে প্রথম জন অর্থাৎ মহাপদ্ম ছিলেন পিতা এবং অবশিষ্ট আটজন ছিলেন তাঁর পুত্র। আবার বৌদ্ধ ঐতিহ্য অনুসারে নয়জন নন্দরাজ বা ‘নবনন্দ’ ছিলেন পরস্পরের ভ্রাতা। ‘মহাবোধিবংশ’তে নয়জন রাজার নাম উল্লেখ আছে। এঁরা হলেন মহাপদ্ম, পণ্ডুক, পন্ডুগতি, ভূতপাল, রাষ্ট্রপাল, গোবিন্দসনক, দেশশিল্পক, কৈবর্ত ও ধন। এই শেষ রাজা ধননন্দ ছিলেন গ্রীক বীর আলেকজাণ্ডারের সমসাময়িক। ধননন্দের রাজত্বকালেই আলেকজাণ্ডার ভারতবর্ষ আক্রমণ করেন। এই কারণেই গ্রীক লেখকদের রচনা থেকে ধননন্দ সম্পর্কে তথ্যাদি জানা যায়। গ্রীক রচনায় অবশ্য ধননন্দ নামটি নেই। কাটিয়াসের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, গঙ্গারিডই বা গঙ্গাহুদি এবং প্রাশই বা প্রাচ্য ছিল উপনন্দের শাসনাধীন অঞ্চল। মেগাস্থেনিসের ইণ্ডিকা অনুযায়ী গঙ্গাহৃদি ছিল গঙ্গার বদ্বীপ অঞ্চল। আর প্রাচ্য বলতে পাঞ্জাল, সুরসেন, কোশল ও বিদেহর অধিবাসীগণকে বোঝাত। এ থেকেই ধননন্দের সাম্রাজ্যের বিপুল বিস্তৃতি সম্পর্কে ধারণা করা যায়। গ্রীক লেখকদের বিবরণ থেকে আরো জানা যায় যে, ধননন্দ এক বিশাল সেনাবাহিনী গঠন করেছিলেন। দু’লক্ষ পদাতিক, কুড়ি হাজার অশ্বারোহী, দু’হাজার রথ ও তিন হাজার হাতি এই বাহিনীর অন্তর্গত ছিল। আলেকজাণ্ডার সম্ভবত এই কারণেই ধননন্দের রাজ্য আক্রমণে সাহস করেননি। বিশাল বাহিনীর ব্যয়নির্বাহের জন্য ধননন্দ প্রজাদের উপর করের বোঝা ভীষণভাবে বাড়িয়ে দেন। কর আদায়ের জন্য কর্মচারীদের অত্যাচারও কম ছিল না। ফলে তাঁর বিরুদ্ধে জন-অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছিল। শূদ্র হবার জন্য প্রতাপশালী ব্রাহ্মণদের ক্ষোভ ত ছিলই; এই অবস্থায় কৌটিল্য (চাণক্য) নামক জনৈক প্রতিশোধকামী ব্রাহ্মণের সহায়তায় চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য নামক এক ক্ষত্রিয় যুবক নন্দবংশের উচ্ছেদ সাধন করে মগধের সিংহাসন দখল করেন (৩২৪ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)। অতঃপর মৌর্যবংশের নেতৃত্বে মগধের সাম্রাজ্যবাদ এগিয়ে চলে।
মগধে নন্দবংশের প্রতিষ্ঠা ভারতের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে বিশিষ্টতার দাবি রাখে। ঐতিহ্য অনুসারে রাজনীতি এবং রাজ্য শাসনের কাজে কেবল ক্ষত্রিয়দের অধিকার স্বীকৃত ছিল। বর্ণাশ্রম প্রথায় শূদ্রদের ভূমিকা ছিল শ্রমদাতার। তাই মহাপদ্মনন্দের ক্ষমতালাভ প্রচলিত রীতির অবসান ঘটায় এবং সিংহাসনে জাতিবর্ণ নির্বিশেষে যে কোন উদ্যমী, দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তির অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়। মধ্যযুগের ভারতে (ত্রয়োদশ শতক) তুর্কীদের বিরুদ্ধে খলজিদের বিদ্রোহ ও ক্ষমতালাভের সাথে প্রাচীন ভারতে নন্দবংশের উত্থানের একটা সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া সম্ভব। মহাপদ্ম কর্তৃক সিংহাসন দখলের ঘটনা রাজনীতিতে তথাকথিত নীচবর্ণভুক্তদের প্রতিষ্ঠার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলন এবং বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের ব্যাপক জনপ্রিয়তা যেমন ধর্মক্ষেত্রে উদারতাবাদ এর প্রতিষ্ঠা এবং বৈদিক ধর্মাচারের কঠোর কর্তৃত্ববাদী অস্তিত্ব ভ্রান্ত প্রমাণ করেছিল, তেমনি নন্দবংশের ক্ষমতা দখল ভারতীয় রাজনীতিতে অক্ষত্রিয়দের উত্থানের সম্ভাবনা উজ্জ্বল করেছিল।
নন্দরাজগণ কেবল বিশাল সাম্রাজ্যের অধিকারী ছিলেন তাই নয়, সেই সাম্রাজ্যের সুশাসনের ব্যবস্থা করা ও তাকে দৃঢ় আর্থিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্বও তাঁরা সঠিকভাবে পালন করেছিলেন। মহাপদ্মনন্দ এক বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডকে নিজ অধিকারভুক্ত করে কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা প্রচলন করেন। সমগ্র সাম্রাজ্য সম্ভবত কতকগুলি প্রদেশে বিভক্ত ছিল। গ্রীক লেখকগণ নোমার্ক, হাইপার্ক প্রমুখ রাজকর্মচারীদের উল্লেখ করেছেন। সম্ভবত তারা মহামাত্র, প্রাদেশিক, প্রমুখ রাজকর্মচারীদের বোঝাতে চেয়েছেন। রাষ্ট্রের ক্ষুদ্রতম একক গ্রামের শাসনভার ‘গ্রামিক’ নাম কর্মচারীদের উপর ন্যস্ত ছিল। এ যুগের অর্থনীতিও ছিল যথেষ্ট সমৃদ্ধ ও প্রধানত কৃষিভিত্তিক। গাঙ্গেয় বদ্বীপের উর্বর জমিতে প্রচুর ফসল ফলত। উপরন্তু নন্দরাজাগণ খাল খননের মাধ্যমে জলসেচের ব্যবস্থা করায় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছিল। ফলে উচ্চহারে কর ধার্য করা সম্ভব হয়েছিল। কর সংগ্রহের জন্য উপযুক্ত পরিকাঠামো এবং কর্মীমন্ডলী গড়ে তোলা হয়। এইভাবে নন্দরাজারা একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তি রচনা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও নন্দবংশের সমকালীন মগধ যথেষ্ট অগ্রণী ছিল। এ যুগেই বিশিষ্ট পণ্ডিত বর্ষ, উপবর্ষ, পানিনি, কাত্যায়ন প্রমুখ আবির্ভূত হয়েছিলেন। ব্যাকরণ-সাহিত্য প্রণয়ন দ্বারা ভাষা-সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে তোলার প্রয়াস এই সময় যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছিল। এইভাবে নন্দবংশের নেতৃত্বে ভারতে শক্তিশালী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নন্দদের রাজত্ব দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। জনৈক চন্দ্রগুপ্ত ধননন্দকে সরিয়ে মগধ দখল করেন। মৌর্যদের নেতৃত্বেই ভারতে বৃহত্তর সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা ঘটে।
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।