নানান দেশের নানান ভাষা, বিনা স্বদেশী ভাষা মিটে কি আশা? – ভাবসম্প্রসারণ

প্রিয় শিক্ষার্থীরা কেমন আছো আশা করি ভালো আছো, আজকে তোমাদের জন্য আমরা নিয়ে এসেছি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন ভাবসম্প্রসারণ “নানান দেশের নানান ভাষা, বিনা স্বদেশী ভাষা মিটে কি আশা? ”। চলো এই ভাবসম্প্রসারণটি পড়ে নেয়।

নানান দেশের নানান ভাষা, বিনা স্বদেশী ভাষা মিটে কি আশা? - ভাবসম্প্রসারণ

নানান দেশের নানান ভাষা, বিনা স্বদেশী ভাষা মিটে কি আশা? ভাবসম্প্রসারণ

মূলভাব: মানুষ জন্মের পরে মায়ের কাছ থেকে যে ভাষায় কথা বলতে শিখে সে ভাষাই তার মাতৃভাষা বা স্বদেশি ভাষা। স্বদেশি ভাষায় মনের ভাব যত সহজে প্রকাশ করা যায়, অন্য কোন ভাষায় তা সম্ভব নয়।

সম্প্রসারিত ভাব: বর্তমান পৃথিবীতে বিভিন্ন জাতি-গুষ্ঠির লোকের বসবাস করে। এদের কথাবার্তা, চালচলন, আচার-ব্যবহার একেক রকম। ভাষার ক্ষেত্রেও বিভিন্ন দেশের লোক বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে। আমরা বাঙালি, বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন দেশে আমাদের বসবাস। এদেশের প্রতিটি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। সুতরাং বাংলা এদেশের স্বদেশি ভাষা। বাংলা ভাষায় কথা বলে এদেশের মানুষ সবচেয়ে বেশি তৃপ্তি পায়। পৃথিবীর এক দেশের মানুষের সাথে অন্য দেশের মানুষের চেহারার যেমন পার্থক্য রয়েছে, তেমনই ভাষারও অনেক পার্থক্য রয়েছে।

চেহারার বৈচিত্র্যের মতো পৃথিবীতে রয়েছে নানা জাতির মানুষের নানা ভাষা। একেক দেশের মানুষ একেক ভাষায় কথা বলে। মানুষ যে দেশে জন্মগ্রহণ করে এবং মাতাপিতা যে ভাষা ব্যবহার করে, সেটাই তার স্বদেশি ভাষা। স্বদেশি ভাষার মাধ্যমেই মানুষ জ্ঞানের যাবতীয় বিষয় সবচেয়ে বেশি উপলব্ধি করতে এবং প্রকাশে সক্ষম। এমন অনেকে আছেন যারা স্বদেশি ভাষার সাথে অন্য ভাষাও আয়ত্ত করে থাকে। কিন্তু অন্য ভাষার কোন কিছু বুঝতে হলেও তা কেবল স্বদেশি ভাষার মাধ্যমেই বুঝতে হয়। কাজকর্মের সুবিধার্থে ক্ষেত্রবিশেষে স্বদেশি ভাষার বাইরে অন্য একাধিক ভাষায় কথা বললেও স্বদেশি ভাষায় কথা বলে মানুষ যত আত্মতৃপ্তি লাভ করে অন্য ভাষায় কথা বলে তা পায় না। তাছাড়া স্বদেশি ভাষাকে উপেক্ষা করে কেউ কোনােদিন তার প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে পারে না। মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। মূলত স্বদেশি ভাষা ভিন্ন অন্য ভাষায় কোন আত্মতৃপ্তি পাওয়া যায় না। যারা দেশ ছেড়ে বিদেশে থাকে, বিদেশি ভাষায় কথা বলতে বাধ্য হলেও তাদের আত্মতৃপ্তি ঘটে স্বদেশি ভাষাভাষী মানুষের সাথে কথা বলেই। তাছাড়া। আত্মবিকাশে স্বদেশি ভাষার কোন বিকল্প নেই। মিল্টন পাহাড়ি ঝরনার কলধ্বনিতে স্বদেশি ভাষার সুর শুনতে পেতেন। স্বদেশি ভাষা মানবজীবনে, জাতীয় জীবনে অতি গুরুত্বপূর্ণ বলেই বাঙালিরা স্বদেশি ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছে।

মন্তব্য: স্বদেশি ভাষা পরিহার করে কোন ব্যক্তি বা জাতির পক্ষে সাফল্য অর্জন করা সম্ভব নয়। তাই প্রত্যেকেরই উচিত, স্বদেশি ভাষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া।

বিকল্প ১

ভাবসম্প্রসারণ: পৃথিবীতে বিভিন্ন ধরনের ভাষা প্রচলিত। তারপরও মাতৃভাষা ছাড়া অন্য কোনাে ভাষায় মনের ভাব প্রকাশে মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যবােধ করে না। মনের ভাব সুন্দরভাবে সহজে প্রকাশ করতে পারে না। একমাত্র মাতৃভাষা দ্বারাই মনের সূক্ষাতিসূক্ষ্ম ও গভীর ভাবগুলাে সুন্দর, সাবলীল ও যথাযথভাবে প্রকাশ করা যায়। মাতৃভাষার সংযােগ মানুষের হৃদয়ের সাথে।

মানবমনের বিচিত্র অনুভূতি ও আবেগ প্রকাশ পায় ভাষারই মাধ্যমে। এক এক দেশের এক এক জাতি বিভিন্ন ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করে। মানুষ প্রয়ােজনে বিদেশি ভাষা শিখলেও সেই ভাষাকে সে অন্তরের গভীরে লালন করতে পারে না। কারণ ছােটবেলা থেকে সে মায়ের মুখে যে বুলি শেখে সেটাই তার মাতৃভাষা বা স্বদেশি ভাষা। এ মাতৃভাষার মাধ্যমে মানুষ তার মনের আশা-আকাঙ্ক্ষা, সুখ-দুঃখ, আবেগ-অনুভূতি যেভাবে অন্যের কাছে প্রকাশ করতে পারে অন্য ভাষার সাহায্যে সে তা পারে না। মাতৃভাষা মানুষের প্রাণের ভাষা, এ ভাষা জড়িয়ে আছে রক্তের সাথে । মানুষ বিদেশি ভাষায়ও মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে। তবে এক্ষেত্রে প্রথমে মাতৃভাষায় অনুধাবন করে নিয়ে তারপর প্রকাশ করতে হয়। কিন্তু মাতৃভাষার মাধ্যমে মানুষ তার অন্তরের একান্ত অনুভূতিগুলাে যেভাবে অন্যের কাছে প্রকাশ করতে পারে অন্য কোনাে ভাষা দ্বারা তা সম্ভব নয়। তাই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেজ দাদা বলেছেন, “আগে চাই মাতৃভাষার গাঁথুনি, তারপর ইংরেজি শেখার পত্তন। মাতৃভাষার মাধ্যমে শিশুর বিকাশ সহজ হয়। শিশুর কচি মনে মায়ের ভাষার প্রভাব বেশি থাকে। যার কারণে তার উপলব্ধি জ্ঞান ও প্রকাশ ক্ষমতা দ্রুত বৃদ্ধি লাভ করে। বিদেশি ভাষাতে মনের ভাব প্রকাশ করা যায় না, এমন নয়। তবে মাতৃভাষার মতাে সাবলীল সুন্দর ও আনন্দের সঙ্গে করা যায় না। মা, মাটি ও মাতৃভাষা এক সূত্রে গাঁথা। মাতৃভাষা রক্ষা করার জন্যে বীর বাঙালিরা রক্ত দিতেও দ্বিধা করেনি। তাদের রক্তের বিনিময়ে আমরা আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি।

মাতৃভাষা মানবমনের সম্পূর্ণ আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করার সবচেয়ে উপযুক্ত বাহন। তা মনের সকল আবেগ, অনুভূতি, উপলদ্ধিকে সবচেয়ে ভালােভাবে প্রকাশের ক্ষমতা রাখে।

বিকল্প ২

মূলভাব : পৃথিবীতে যত ভাষা প্রচলিত আছে তার মধ্যে সকল মানুষের জন্য নিজ নিজ মাতৃভাষাই উত্তম। মাতৃভাষায়মনের ভাব যত সহজে প্রকাশ করা যায়, অন্য ভাষায় তা সম্ভব হয় না।

সম্প্রসারিত ভাব : মাতৃভাষা মানুষের সবচেয়ে প্রিয় এবং মনােভাব প্রকাশের জন্য সবচেয়ে বেশি উপযােগী। নিজেরভাষায় মনােভাব প্রকাশে মানুষ যত বেশি আনন্দ পায়, অন্য কোনাে ভাষায় তা মােটেই সম্ভব নয়। প্রত্যেক জাতিরমাতৃভাষার একটা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে এবং মাতৃভাষার সঙ্গে এমন একটা আত্মিক সম্পর্ক থাকে যে, সেই ভাষায় তারমনােভাব প্রকাশের সর্বোত্তম বাহন হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রতিভাশালী লােকেরা নানান ভাষা শিখে পণ্ডিত খ্যাতি পান। কিন্তু তাঁরা মনের ভাব প্রকাশের জন্য মাতৃভাষারই সহায়তা নিয়ে থাকেন। নিজের ভাষার সাথে মানুষের পরিচয় শিশুকাল থেকে।সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা ইত্যাদি প্রকাশের জন্য মানুষ মাতৃভাষাকে খুব সহজেই ব্যবহার করতে পারে। মাতৃভাষা ভিন্ন অন্যকোনাে ভাষায় কোনাে কবি বা সাহিত্যিকের সাহিত্যচর্চাও স্বতঃস্ফূর্ততা পায় না। উদাহরণস্বরূপ বলা চলে বাঙালি কবি মধুসূদনদত্তের কথা। তিনি দীর্ঘ প্রবাস জীবনে বিদেশি ভাষা আয়ত্ত করে সাহিত্যচর্চায় মনােনিবেশ করেন। কিন্তু তাঁর রচনা সমাদৃতহয়নি ইংরেজি সাহিত্যে তথা ইংরেজ ভাষাভাষীর হৃদয়ে। যখন বােধােদয় হয় তখন তিনি ভ্রান্ত ধারণা পরিত্যাগপূর্বক লেখেন-

“পালিলাম আজ্ঞা সুখে; পাইলাম কালেমাতৃভাষা রূপখনি, পূর্ণ মণিজালে।”

তাই পৃথিবীর অন্যান্য ভাষার মধ্যে মাতৃভাষাই আপন এবং মনােভাব প্রকাশের শ্রেষ্ঠ পন্থা।

মন্তব্য : মাতৃভাষা পরিহার করে কোনাে ব্যক্তি বা জাতির পক্ষে সাফল্য অর্জন সম্ভব নয়। তাই প্রত্যেকেরই উচিতমাতৃভাষার প্রতি সর্বাধিক গুরুত্বারােপ করা।

বিকল্প ৩

মূলভাব : মাতৃভাষার মাধ্যমেই মানুষ যেকোনো কিছুর প্রকৃত রস আস্বাদন করতে পারে এবং এই ভাষাতেই তার প্রাণের স্ফূর্তি ঘটে।

সম্প্রসারিত ভাব : পৃথিবীর প্রায় সব জাতিরই নিজস্ব ভাষা আছে এবং এক ভাষা থেকে অন্য ভাষা আলাদা। ভাষার মাধ্যমে আমরা শুধু নিজের মনের ভাবই অন্যের কাছে প্রকাশ করি না, মাতৃভাষার সাহায্যে অন্যের মনের কথা, সাহিত্য-শিল্পের বক্তব্যও নিজের মধ্যে অনুভব করি। নিজের ভাষার কিছু বোঝা যত সহজ, অন্য ভাষায় তা সম্ভব নয়। বিদেশে গেলে নিজের ভাষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা যায় আরও প্রবলভাবে। তখন নিজের ভাষাভাষী মানুষের সান্নিধ্য পেতে ভেতরে ভেতরে মরম্নভূমির মতো তৃষিত হয়ে থাকে মানুষ। আমরা বাঙালি, বাংলা আমাদের ভাষা। বাংলা ভাষায় আমরা কথা বলি, পড়ালেখা করি, গান গাই, ছবি আঁকি, সাহিত্য রচনা করি, হাসি-খেলি, আনন্দ-বেদনা প্রকাশ করি। অন্য ভাষায় আমাদের সব অনুভূতি স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরম্নল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ এই ভাষায় সাহিত্য রচনা করে যশস্বী হয়েছেন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত জীবনের শুরম্নতে অন্য ভাষায় সাহিত্য রচনা করে পরে আড়্গপে করেছেন এবং মাতৃভাষায় সাহিত্যচর্চা করে বিশ্বখ্যাতি লাভ করেছেন। মায়ের মুখের বুলি থেকে শিশু তার নিজের ভাষা আয়ত্ত করা শুরম্ন করে এবং এই ভাষাতেই তার স্বপ্নগুলোকে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করে, এই ভাষাতেই লেখাপড়া করে এবং জগৎ ও জীবনকে চিনতে শুরম্ন করে। ভিন্ন ভাষাভাষীদের মধ্যে আšত্মঃসম্পর্ক রড়্গার জন্য, দেশ-বিদেশের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে নিজেদের সংযুক্ত রাখার জন্য আমাদের অন্যান্য ভাষাও শিখতে হয়। কিন্তু কোনো বিষয় বোঝার জন্য মাতৃভাষার মতো সহায়ক আর কিছু নেই। অন্য ভাষা শেখার জন্যও মাতৃভাষার বুনিয়াদ শক্ত হওয়া জরম্নরি।

মন্তব্য : স্বদেশের ভাষাকে ভালোবাসতে হবে, এর বিকাশ ও সমৃদ্ধিকে অবাধ করতে হবে এবং বিকৃতিকে রোধ করতে হবে। সুপেয় জল যেমন আকর্ষণীয়, তেমনি স্বদেশের ভাষা সুমিষ্ট।

আরো পড়ুন: দুঃখেৱ মত এত বড় পরশ পাথর আৱ নেই

আশা করি তোমরা এই ভাবসম্প্রসারণটি বুঝতে পেরেছো। আমাদের সাথেই থাকো।

Leave a Comment