নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের-এর ‘টোপ’ গল্পটি আলোচনা করো

আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের-এর ‘টোপ’ গল্পটি আলোচনা করো” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।

নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের-এর ‘টোপ’ গল্পটি আলোচনা করো

‘টোপ’ গল্প সম্পর্কে সমালোচক বলেছেন—“নিজের অহংকে চরিতার্থ করার জন্য মানুষ কত নিষ্ঠুর হতে পারে তারই উদাহরণ হল ‘টোপ’ গল্পটি।…..প্রকৃতপক্ষে টোপ গল্পে উচ্চ ও মধ্যবিত্তের মানসিক দ্বন্দ্ব মূল্যবোধের সমস্যা নিপুণভাবে ধরা পড়েছে।” ‘টোপ’ গল্পটি নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের সব থেকে বেশি জনপ্রিয় গল্প। টোপের বিষয় ভাবনার রোমাঞ্চকর চমৎকারিত্ব আমাদের তীব্র আকর্ষণ করে। ‘টোপ’ গল্পের একটা কাহিনি আছে, গল্পের মূল বিষয় শিকার বিলাসী রাজাবাহাদুর ও তার পার্শ্বচরগণ এবং অরণ্যের গভীর গম্ভীর ভয়াল পরিবেশ। আসলে কাহিনি অংশ বিস্তারিত নয়, ঘটনার উজ্জ্বল রঙেও দীপ্ত নয়, তবে লেখক ঘন পরিবেশ বর্ণনার মাধ্যমে কাহিনিকে একটা বৃত্তে রাখতে সচেষ্ট হয়েছেন।

লেখক প্রথমেই স্বীকার করেছেন ‘টোপ’ গল্পটি হল ‘এক আরণ্যক ইতিহাস’। একটি বিচিত্র শিকার কাহিনি। আর এর সঙ্গে বিলাসী রাজাবাহাদুরের শিকার কাহিনি বর্ণিত হওয়ায় যথার্থ ছোটোগল্পের বাঁধুনীও গল্পে অনুপস্থিত। গল্পের লেখকের কাছে একদিন সকালে একটা পার্সেল আসে। পার্সেলটি হল একজোড়া বাঘের চামড়ার জুতোর এবং প্রেরক হলেন রামগঙ্গা এস্টেটের রাজাবাহাদুর এন. আর. চৌধুরী। রাজাবাহাদুর তাঁর এস্টেটের একটি অরণ্যে বাস করেন এবং তিনি অত্যন্ত শিকার বিলাশী। কথক রাজাবাহাদুরের সঙ্গে একবার শিকারের সহযাত্রী হয়। কলকাতা থেকে এসে অরণ্যের সৌন্দর্যের মধ্যে লেখকের ভালো লেগে যায়। তরাই অঞ্চল চারশো ফুট নীচে হিংস্র জন্তুর বাস। রাজাবাহাদুরের পক্ষে ওপর থেকে সোজাসুজি শিকার করা সম্ভব নয়। তাই নানা উপায় অবলম্বন করেন তিনি। রাজাবাহাদুর একরাতে পাহাড়ের পাড় থেকে সামনে লোহার মজবুত সাঁকোর মতো খানিকটা বাড়িয়ে সেখান থেকে টোপ ঝুলিয়ে চারশো ফুট নীচে নামান; সঙ্গে কথকের রুদ্ধশ্বাস প্রতীক্ষা—কখন বড়ো জাতের বাঘ সেই টোপ গিলতে আসবে। আসেও একসময় এবং বাঘ ও রাজাবাহাদুরে রাইফেলের অব্যর্থগুলিতে শেষ হয়ে পড়ে থাকে টোপের পাশে। আর গল্পের কথক শোনে টোপের ঝুলি থেকে ছোটো শিশুর স্পষ্ট গোঙানি। বোঝা যায় শিশুটিকে টোপ হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে; আর আটমাস বাদে পার্সেলে যে জুতো জোড়া আসে তা নিহত বাঘেরই দামি চামড়ার উপহার। গল্পটি এখানেই শেষ।

‘টোপ গল্পের কাহিনির শেষে চমক। যেখানে ছাগশিশু বা অন্যকোনো জন্তুর মাংসকেই বাঘধরার টোপ করা যায়, সেখানে মানব শিশুকে টোপ করে বাঘ ধরার বিলাসেই গল্পের চমক এবং রাজাবাহাদুরের সামন্ততান্ত্রিক আচরণের চরম রূপেই গল্পের সামগ্রিক ব্যঞ্জনা নিহিত আছে।

গল্পের প্রধান চরিত্র রামগঙ্গা এস্টেটের রাজাবাহাদুর এন. আর. চৌধুরী আর কথক প্রধান পার্শ্বচরিত্র। রাজাবাহাদুর নিজের প্রশংসা শুনে খুব খুশি হন। নিজের বিলাসের অভিনবত্ব কথকের কাছে প্রকাশ করাই তাঁর একান্ত বাসনা। দামি মদ্যপানের চরম অবস্থায় না এলে শিকারের হাত ঠিক হয় না। মানুষ মারতেও তাঁর হাত কাঁপে না। শিকারের গোপনতম কৌশল বিশেষ কয়েকজন কাছের মানুষ ছাড়া এ সব কাজের সাক্ষী থাকে না। শিকারের নামে ছোটোশিশুকে বাঘ ধরার টোপ করা এবং উল্লাসের জীবন-যাপন এও এক সামন্ততান্ত্রিক অধিকার।

কোনো হীন কৌশল সফল ও ব্যর্থ হলে তার প্রত্যক্ষদর্শীকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া ছিল রাজাবাহাদুরের মতো জমিদারের জীবনযাপন পদ্ধতি। – “চুপ একটা রাইফেলের নল আমার বুকে ঠেকালেন রাজাবাহাদুর। তার পরেই আমার চারিদিকে পৃথিবীটা পালটে যেতে যেতে হাওয়ায় গড়া একটা বুদ্বুদের মতো শূন্যে মিলিয়া গেল। রাজাবাহাদুর জাপটে না ধরলে চারশো ফুট নীচেই পড়ে যেতাম হয়তো।” রাজাবাহাদুরের চরিত্র সুন্দরভাবে আঁকা হয়েছে গল্পের মধ্যে। দ্বিতীয় চরিত্র কথক। রাজাবাহাদুরের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার ফলে যে গর্ব বোধ করেন তা তাঁর কথার মধ্য ধিয়েই পাওয়া যায়—“আমার সৌভাগ্য ওদের ঈর্ষা, তা আমি পরোয়া করি না, নৌকা বাঁধতে হলে বড়ো গাছ দেখেই বাঁধা ভালো, অন্তত ছোটোখাটো ঝড় ঝাপটার আঘাতে সম্পূর্ণ নিরাপদ।” এ জাতীয় মানসিকতায়, তার সহজ অর্থে সুবিধাবাদী মধ্যবিত্ত স্বভাবের প্রচ্ছন্ন পরিচয় মেলে।

‘টোপ’ গল্পের নামে মূল গল্পের কেন্দ্রবিন্দু স্পষ্ট হয়ে যায়। টোপ শব্দটির ব্যঞ্জনাগত একটি অর্থ হল ‘লোভ’ বা ‘সুযোগ’। মাছ ধরার যেমন টোপ থাকে তেমনি কোনো হিংস্র জন্তুকে খাঁচার মধ্যে পুরতে হলে তাকে কোনো লোভের বস্তুর দিকে আকৃষ্ট করতে হয়, তবে সেই চেষ্টা সফল হবে। শিকারি এবং শিকার উভয়েরই দৃষ্টি টোপের দিকে। এই ব্যাখ্যায় টোপ রাজাবাহাদুর ও রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার দূতরফেরই টোপটি মুখ্য স্থান পাওয়ায় নামটি সার্থক।‘টোপ’ গল্পের ক্লাইম্যাক্স রচিত হয়েছে একেবারে শেষে। রাজাবাহাদুর শিকার ধরার জন্য যে টোপটি চারশো ফুট নীচে নামিয়ে দেয় চকিত আলোয় সেই টোপের উপর নিবদ্ধ দৃষ্টিতেই আছে গল্পের কম্পিত চরমক্ষণ—“পুঁটলিটা যেন জীবন্ত অথচ কী জিনিস কিছু বুঝতে পারছি না। এ নাকি মাছের টোপ। কিন্তু কী এ মাছ, এ কীসের টোপ। টোপের দিকে তাকিয়ে থাকে কথক। রাজাবাহাদুরের ‘টোপ’ গল্পের মূল ভাববস্তু হল সভ্যজগতে থেকেও একদল অর্থের বিলাসে মগ্ন, প্রভুত্বে অহংকারী মানুষের আদিম প্রবৃত্তি চরিতার্থতার জন্য শিকার বিলাশের আবরণে অমানবিক আচরণ। কিন্তু এই ভাবটিকে লেখক যে সমগ্র গল্পে উপস্থাপিত করেছেন তাতে তাঁর ‘টোপ’ গল্পটি সামগ্রিকভাবে শিল্প সার্থক হয়ে উঠেছে।

আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।

Leave a Comment