আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “‘নিভে যাওয়া দীপগুলি আজ জ্বালিয়ে যাব’ কবিতাটির মধ্যে রবীন্দ্রপ্রভাব কতখানি কাজ করেছে আলোচনা করো” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
‘নিভে যাওয়া দীপগুলি আজ জ্বালিয়ে যাব’ কবিতাটির মধ্যে রবীন্দ্রপ্রভাব কতখানি কাজ করেছে আলোচনা করো
হিন্দি সাহিত্যের ছায়াবাদী যুগের বেশ কিছু কবি সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথের রোমান্টিক চেতনার দ্বারা প্রভাবিত। এই রবীন্দ্র প্রভাব বেশ সর্বাত্মক রূপ নিয়েছিল সূর্যকান্ত ত্রিপাঠী নিরালা ও মহাদেবী বর্মার কাব্যে। তবে মহাদেবী বর্মার ব্যক্তিগত জীবনচেতনা, কাব্যভাবনায় রবীন্দ্রনাথের মানবতাবাদ, ভক্তিতত্ত্ব, প্রেমতত্ত্ব ও জীবনদেবতা ভাবনা এতখানি কাজ করেছে যে তা অন্য কোনো কবির রচনায় এতখানি সুলভ নয়। নিজের জীবনাদর্শ ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে মহাদেবী নিজেই বলেছিলেন, “আমি কিছুতে বিশ্বাস করি বা না করি, কিন্তু মানুষে তো বিশ্বাস করি। আমি কোন কর্মকান্ডে বিশ্বাস করি না……. আমি মুক্তিকে নয়, এই ধূলিকেই বেশি করে চাই।” মহাদেবীর এই জীবনবানী ও রবীন্দ্রনাথের ধ্যান ধারণা এই জায়গাটিতেই একাত্ম হয়ে যায়, যখন দেখি দুজনেরই বিশ্বাসের তার বাঁধা মানুষের ধর্মে। কাব্যকলাগত প্রকাশভঙ্গি, চিত্রকল্প নির্মাণ, কবিমানসের বৈশিষ্ট্যে মহাদেবী যেন সার্বিকভাবেই রবীন্দ্রনাথের দ্বারা অনুপ্রাণিত।
১৯০২ খ্রিস্টাব্দে মহাদেবীর ‘দীপশিখা’ কাব্যটি প্রকাশিত হয়েছিল। এই ‘দীপশিখা’ কাব্যের অন্তর্গত ৫ সংখ্যক কবিতা ‘নিভে যাওয়া দীপগুলি আজ জ্বালিয়ে যাব’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রবল অভিঘাত, সাম্প্রদায়িক হানাহানি, মন্বন্তর অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের প্রবল মন্দা, রাজনৈতিক নানা পালাবদল, এক ঘোর দুর্বিপাককে ঘনিয়ে এনেছিল সেইসময়। সময়ের কালো ছায়া বিংশ শতাব্দীর ভাঙন ধরা পরিবেশের রূপ নিয়েই মহাদেবীর এই কবিতায় প্রতীকায়িত। পৃথিবীর অন্ধকারাগার ভেঙে ঘূর্ণিঝড় যেন উন্মত্তের মতো ধেয়ে আসছে। তিনি বিশ্বাস করেন, কালো মেঘের প্রবল ঘনঘটা লাস্যময় তড়িৎকে আর ঢেকে রাখতে পারবে না। নক্ষত্রপুঞ্জও যেন ভয়ে নিভে গেছে। বাতাসের আকুলতা প্রবল বিভ্রান্তিতে আর পথ খুঁজে পাচ্ছে না। আকাশে আকাশে অশুভ উল্কার প্রতিভাস যেন সভ্যতার ধ্বংসাত্মক দিকটিকেই স্পষ্ট করে তুলছে। তবে এই বিধ্বস্ত সময়ে মহাদেবী কিন্তু ভয়ে মুখ লুকিয়ে থাকেননি, নৈরাশ্যের অন্ধকূপে। মানবের ভয়ঙ্কর লাঞ্ছনা আর অপমান, হাহাকার-হতাশা আর বেদনায় আশার প্রদীপরূপী অমরতার বানীকে নিভিয়ে ফেলেননি তিনি মন থেকে। দীপক রাগিনীতে উদ্দীপনার গাঢ় সুর সঞ্চার করে মানবকে তিনি এই দুঃসময় থেকে মুক্ত করতে চেয়েছেন। অবক্ষয়িত এই সময়েই তিনি নিভে আসা আশার প্রদীপগুলি জ্বালতে চেয়েছেন। সর্বব্যপ্ত অবক্ষয় ও ধ্বংসের মাঝখানেই কবি জীবনের সুন্দর ও সুকুমার প্রবৃত্তিগুলিকে বাঁচিয়ে রাখতে চান। প্রবল দুর্যোগের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ বাতাসেও তিনি প্রদীপের মৃদু শিখাটি জ্বালিয়ে রাখতে চান। দীপাবলীর প্রবল আলোকমালার মতো তিনি প্রতিটি স্বরকে সাজিয়ে তুলতে চান।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ের কালো রাত্রি রবীন্দ্রনাথের ভাবনায় যেমন ‘বলাকা’ কাব্যে স্থান পেয়েছে। বলাকা কাব্যের ‘সর্বনেশে’ কবিতায় সেইসময়ের কালো ছায়া পড়েছিল। কবি মহাকালের অট্টহাসি রূপে বেদনার কালকে গ্রহণ করতেও চেয়েছেন এবং সেই গ্রহণ যথার্থই প্রসন্ন মনের পরিচয় দেয়।
“এবার যে ঐ এল সর্বনেশে গো
বেদনায় যে বান ডেকেছে, / রোদনে যায় ভেসে গো!
রক্তমেঘে ঝিলিক ঝরে,/বজ্র বাজে গহন-পরে,
কোন পাগল ঐ বারে বারে উঠছে অট্ট হেসে গো?”
এই প্রবল দুর্যোগময় ঝঞ্ঝারাত্রিকে ভয় না করে তাকে পরম প্রিয়জন হিসাবে কাছে টেনে নেওয়ার কথা বলেছেন কবি। ‘বলাকা’ কাব্যের এমন অনেক কবিতাতেই কবির এজাতীয় মনোভাব ছায়া ফেলেছে। ‘আহ্বান’, ‘পাড়ি’, ‘ঝড়ের খেয়া’ এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য কবিতা। মানব সমাজের এই ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে কবি ভয়হীন চিত্তে মানবের যথার্থ পরিবর্তন বা মুক্তিকেই বরণ করে নেবার কথা বলেছেন। কেননা ক্রান্তিকালে এই মুক্তির পথ দুঃসহ সাধনার আঙ্গিকেই আসতে পারে। দুর্যোগময় রাত্রি ও সেইপথে অভিসারের অনিমেষ সংকল্পই ‘ঝড়ের খেয়া’ কবিতাটিতে বর্ণিত।
“বহ্নি বন্যাতরঙ্গের বেগ,
বিষশ্বাস ঝটিকার মেঘ,
ভূতল গগন/মূর্ছিত বিহ্বল-করা মরণে মরণে আলিঙ্গন
ওরই মাঝে পথ চিরে চিরে
নূতন সমুদ্রতীরে/তরী নিয়ে দিতে হবে পাড়ি…”
রবীন্দ্রভাবনার দুর্যোগময় কালো রাত্রির ইতিবৃত্ত মহাদেবী বর্মার কবিতা প্রসঙ্গে কেন আলোচিত হয়ে উঠছে—এ প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে রয়েছে উভয় কবির কবিতার প্রেক্ষিত জুড়ে। রবীন্দ্র ভাবনায় এসময়ের কবিতাগুলিতে এসেছে নাবিকের সহজ চিত্রকল্প। মহাদেবীও কালের ভয়ংকর রাত্রিকে জীবনের ক্রম উত্তরনের বাধা হিসাবেই দেখেছেন। আর সেই বাধা পেরিয়ে জীবনের মাটি ছুঁতে পাবার প্রতীক হিসাবে তাঁর কবিতাতেও এসেছে নাবিকের চিত্রকল্প। দুর্যোগময় রাত্রিতে রবীন্দ্র অনুধ্যানকে মর্মে ও চিন্তায় স্থাপিত করেই মহাদেবী তার জীবনদেবতার কাছে প্রার্থনা করেছেন তাকে যেন তিনি তাঁর তরীতে তুলে নেন। এ প্রসঙ্গে খুব স্বাভাবিকভাবেই রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার তরী’ কবিতাটির কথা মনে আসে। যদিও ‘সোনার তরী’ কবিতার তত্ত্ব বা রূপকচিন্তার সঙ্গে মহাদেবী বর্মার কবিতার কোনো মিল নেই। তবে কবি যখন বলেন,
“অবতরী পতয়ার লা কর
তুম দিখা যত পার দেনা
আজ গর্জন মে মুঝে বস
একবার পুকার লেনা!”
তখন প্রায় রবীন্দ্রকাব্যের সুর লয় এবং চিত্রকল্পগত সংলগ্নতাটিই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কানে ভেসে আসে রাবীন্দ্রিক শব্দচিত্রের প্রতিভাস।
“এতকাল নদীকূলে
যাহা লয়ে ছিনু ভুলে
সকলই দিলাম তুলে
থরে বিথরে।”
কবিতা দুটির বহিরঙ্গিক মিল বিন্যাসটি খুব স্পষ্ট হলেও পরিণতিতে উভয় কবির বিশ্বাস একেবারেই সমতাবিধান করেনি। কারণ সোনার তরীর নাবিক রবীন্দ্রনাথকে চির প্রত্যাখ্যানের বেদনাতেই অভিষিক্ত করেছিলেন। কবিকে ফেলে রেখে গিয়েছিলেন উপেক্ষা আর অবহেলায়। কিন্তু মহাদেবীর বিশ্বাস তাঁর নাবিক ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ তরঙ্গস্রোতে ভাসমান তরীতে কবিকে নিশ্চিন্ত সঙ্গী করে নেবেই।
রবীন্দ্র প্রভাব এ কবিতার চিত্রকল্প, শব্দ বা প্রতীকায়নের বিভিন্ন ব্যঞ্জনায় শুধু নয়, কবিতাটিতে প্রকাশিত দীপ বা দীপাবলীর রূপক অর্থেও বারবার ছায়ার মত রয়ে গেছে। প্রজ্জ্বলিত দীপশিখার সঙ্গে জীবনের চির বিশ্বাসের প্রতীকায়ন মহাদেবীর কাব্যের একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। আসলে প্রাচীন ভারতের উপনিষদীয় মন্ত্র ‘তমসো মা জ্যোতির্গময় কবিচেতনাকে বারবারই আলোড়িত করে তুলেছে। মানুষের অমর আত্মাকে প্রজ্জ্বলিত দীপশিখায় পরিণত করে অন্ধকার থেকে আলোর পথে তার ক্রম উত্তরনের ভাবনাটিই মহাদেবীকে প্রাণীত করেছিল বেশী। এ প্রসঙ্গে ‘হিন্দি কবিতাকাশের দশ নক্ষত্র’ গ্রন্থের ড. সত্রাজিৎ গোস্বামীর উক্তি মনে পড়ে। মহাদেবী বর্মার ‘দীপশিখা’ কাব্যগ্রন্থটি সম্পর্কে তিনি বলেছেন, “মহাদেবী দীপশিখাকে এ কাব্যে ব্যবহার করেছেন অবিচলিত, আস্থার প্রতীক হিসাবে। তাঁর মতে ভারত সংস্কৃতিতে আত্মচৈতন্যকে প্রদীপ শিখার মতো উজ্জ্বল আলোকময় করে তোলার আহ্বান মন্ত্র উচ্চারিত হয়েছে। ‘তমসো মা জ্যোতির্গময়’ মন্ত্ৰ ভারতের ধর্ম, দর্শন, সাহিত্য, শিল্প ও জীবনচেতনায় নিরন্তর গুঞ্জরিত।” বিশ্বযুদ্ধ বা তৎপরবর্তী নৈরাশ্যপীড়িত অবক্ষয়ের কালো অন্ধকারে উপনিষদীয় ঋষির মহিমাময় বাণীতেই আস্থা রেখেছিলেন মহাদেবী। তপোবনাশ্রিত জীবন, ভগবান বুদ্ধের বিশ্বব্যাপী করুণা ও মানবতার বাণী, প্রজ্বলিত দীপশিখার অনুষঙ্গ রবীন্দ্রনাথেরও অত্যন্ত প্রিয় বিষয় ছিল। মানবের জীবনকে প্রদীপের আলোক শিখায় রূপান্তরিত করে সভ্যতার বিধ্বংসী অবক্ষয়কে রোধ করবার প্রয়াসে চেতনার ক্রমমুক্তি রাবীন্দ্রিক ভাবনাকে আত্মস্থ করেই সম্ভব করেছিলেন কবি মহাদেবী। এই রবীন্দ্র দীক্ষাই তাঁর কবিতাকে করে তুলেছিল রবীন্দ্র অনুষঙ্গযুক্ত। কিন্তু মহাদেবীর মৌলিক কাব্যকলা এ ভাবনায় বিনষ্ট হয়নি একথা বলা যায়।
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।