প্রবন্ধের সংজ্ঞা নির্ণয় করো। প্রবন্ধের শ্রেণিবিভাগ করে তা উদাহরণ ও বৈশিষ্ট্যসহ বুঝিয়ে দাও

আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “প্রবন্ধের সংজ্ঞা নির্ণয় করো। প্রবন্ধের শ্রেণিবিভাগ করে তা উদাহরণ ও বৈশিষ্ট্যসহ বুঝিয়ে দাও” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।

প্রবন্ধের সংজ্ঞা নির্ণয় করো। প্রবন্ধের শ্রেণিবিভাগ করে তা উদাহরণ ও বৈশিষ্ট্যসহ বুঝিয়ে দাও

প্রবন্ধ সাহিত্যের সংজ্ঞা নির্ণয়ে স্বাধীন মতামত প্রকাশের পূর্বে কয়েকজন বিশিষ্ট সমালোচকের বক্তব্যগুলিকে গভীরভাবে অনুধাবন করা যাক। প্রখ্যাত সমালোচক শ্রীশচন্দ্র দাস তাঁর ‘সাহিত্যে সন্দর্শন’ গ্রন্থে প্রবন্ধ সাহিত্য সম্পর্কে বলেছেন “কল্পনা ও বুদ্ধি বৃত্তিকে আশ্রয় করিয়া লেখক কোনো বিষয়বস্তু সম্বন্ধে যে আত্মসচেতন নাতিদীর্ঘ সাহিত্যরূপ সৃষ্টি করেন, তাহাকেই প্রবন্ধ বলা হয়। আবার ড. উজ্জ্বলকুমার মজুমদার তাঁর সাহিত্যের রূপ ও রীতি গ্রন্থে প্রবন্ধ সম্পর্কে আরও একটু সতর্কতার সঙ্গে বলেছেন—“যে-কোনো সংক্ষিপ্ত গদ্য রচনা বা বিষয়বস্তুকে আলোচনার মাধ্যমে উপস্থাপিত করে, কিংবা কোনো বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রকাশ করে কিংবা কোনো বিষয়ের অন্তর্গত বক্তব্যকে নিষ্কাশিত করে যুক্তির মাধ্যমে পাঠককে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সাহায্য করে তাকেই সাধারণ ভাবে প্রবন্ধ বলা হয়। উভয় সমালোচক প্রদত্ত প্রবন্ধের সম্পর্কিত তথ্য থেকে আমরা মোটামুটি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি—’প্রবন্ধ এমন এক গদ্য রচনা যা কোনো বিষয়বস্তুকে বিশ্লেষণের মাধ্যমে উপস্থিত করে, অথবা একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দেয় কিংবা কোনো বিতর্কিত বিষয়ে পাঠককে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সাহায্য করে।

বাংলায় যাকে আমরা প্রবন্ধ বলি ইংরেজিতে তাকে মূলত Essay বলা হয়। Essay-র মধ্যে যেসব গুরুগম্ভীর বিষয় লুকিয়ে আছে তা ইংরেজিতে-treatise, disciarse বা dissertation, এবং Monograph নামে পরিচিত। কিন্তু সঠিক বিশ্লেষণের দ্বারা ইংরেজিতে এই সমস্ত Essay জাতীয় বিষয়গুলির স্বরূপ উদ্ঘাটিত করলে দেখা যাবে বাংলায় প্রবন্ধ রূপে যে রচনাকে আমরা চিনি, তার সঙ্গে এদের কোনো মিল নেই। এ সম্পর্কে উজ্জ্বলবাবু জানিয়েছেন—“treatise বা dissertation জাতীয় রচনার একটি ‘সীমাবদ্ধ’ পাঠকগোষ্ঠী থাকে। প্রবন্ধের ক্ষেত্রে এই সীমাবদ্ধ পাঠকগোষ্ঠী থাকে না। সাধারণ পাঠকের প্রতি লক্ষ্য রেখেই প্রবন্ধ লেখা। ফলে স্বভাবতই প্রবন্ধে বিশেষ বিষয় নীতিও পারিভাষিক নীতি ও সব সময়ে মেনে চলা হয় না। বরং অনেক সময়েই গল্পচ্ছলে, উপযোগী উদাহরণ সহযোগে, এমনকি কিছুটা রসিকতার মাধ্যমেও, বিষয়বস্তুকে পাঠকের যুক্তি ও বুদ্ধির কাছে উপস্থাপিত করা হয়।” এছাড়া তিনি আরও দেখিয়েছেন ইংরেজিতে Essay-র যেমন বিভিন্ন বিভাগ আছে, বাংলা প্রবন্ধেও আছে তেমনি বিভিন্ন বিভাগ। যেমন—নিবন্ধ, সন্দর্ভ, প্রস্তাব, বিবিধ সমালোচনা ইত্যাদি আছে। তবে রচনা গৌরবে শ্রেষ্ঠ হল প্রবন্ধ যার মধ্যে নিহিত থাকে প্রকৃষ্ট বন্ধন।

ইংরেজিতে Essay-কে মূলত দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়।

১। Formal Essay বা বিষয় গৌরবী কিংবা বস্তুগত প্রবন্ধ।

২। Informal বা Familiar essay কিংবা Intimat essay বাংলায় যাকে বলা হয়-আত্মগৌরবী বা ব্যক্তিগত প্রবন্ধ।

এ দুটিকে আবার তন্ময় ও মন্ময় প্রবন্ধ রূপে আখ্যাত করা যেতে পারে। বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধ সম্পর্কে শ্রীশচন্দ্র দাস বলেছেন—“বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধ আমাদের বুদ্ধিকে তীক্ষ্ণতর, দৃষ্টিকে সমুজ্জ্বল ও জ্ঞানের পরিধিকে প্রশস্ত করিয়া তোলে।” আর ব্যক্তিগত প্রবন্ধ সম্পর্কে বলেছেন ‘মন্ময় বা ব্যক্তিগত প্রবন্ধে জ্ঞানের বিষয়কে হাস্যরস মণ্ডিত পুষ্প পেলবতা দান করিয়া আমাদিগকে মুগ্ধ করে।” অর্থাৎ বস্তুগত প্রবন্ধে কেবলমাত্র বিষয়ের প্রাধান্য স্বীকৃত হয় যেখানে মানবমনের বা প্রাবন্ধিকের কোনো স্থান নেই, কিন্তু ব্যক্তিগত প্রবন্ধে লেখকই প্রাধান্য পায়। কোনো বিষয় সেখানে অনুপ্রবেশ করে লেখকের উদ্দেশ্যকে বিপথে চালিত করতে পারে না।

বিষয় গৌরবী প্রবন্ধ :

যে প্রবন্ধে বিষয়বস্তু প্রাধান্য লাভ করে বা মুখ্য রূপে বস্তু বা বিষয় স্বীকৃত পায় তাকে বিষয় গৌরবী প্রবন্ধ (Formal Essay) বলা হয়। রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ পুস্তককে এই শ্রেণির শ্রেষ্ঠ উদাহরণরূপে নির্ণয় করা যায়। এছাড়া অক্ষয় কুমার দত্ত, রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী প্রমুখ প্রাবন্ধিকের বহু রচনা এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। এখানে লেখক আপন জ্ঞানের দ্বারা যুক্তিসহযোগে নিজ মত প্রতিষ্ঠা করেন। পাঠকের তোয়াক্কা না করে তিনি আপন সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। সমালোচকের ভাষায় লেখক এখানে যেন—“বেদীর উপর সমাসীন আচার্য্য বা গুরুদেবের মতো পাঠককে নেহাত অপোগণ্ড শিশু মনে করিয়া জ্ঞানের আলো-কণিকা বিতরণ করেন। বিভিন্ন পত্র পত্রিকা, জীবন চরিত, বৈজ্ঞানিক বা ঐতিহাসিক—আলোচনা মূলক রচনা বা সম্পাদকীয় প্রবন্ধ এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত।

ব্যক্তিগত প্রবন্ধ :

যে প্রবন্ধে বিষয় চিন্তা অপেক্ষা ব্যক্তি হৃদয়ই প্রাধান্য পায় তাকে মন্ময় বা ব্যক্তিগত বা আত্মগৌরবী প্রবন্ধ নামে অভিহিত করা হয়। এই প্রবন্ধে কোনো বস্তুনিষ্ঠ নয়, ভাবপ্রধান বিষয় আত্মপ্রকাশ করে। বস্তুগত প্রবন্ধে জ্ঞানের পিপাসা মেটায়, আর ব্যক্তিগত প্রবন্ধে হাস্যোচ্ছ্বলে জীবনের গভীরতম বিষয়কে প্রকাশ করে। বস্তুগত প্রবন্ধে গুরুগম্ভীর বিষয় মুখ্য হয়ে ওঠে বলে পাঠক চিত্তের উপর তেমন গভীর প্রভাব ফেলতে পারে না, কিন্তু ব্যক্তিগত প্রবন্ধের বিষয়বস্তু আকাশের তারকা থেকে মাটির প্রদীপ পর্যন্ত বিস্তৃত। এ সম্পর্কে Robert Lynd-এর বক্তব্য আমাদের চমৎকৃত করে “Sometimes it is nearly a sermon. Sometimes it is nearly a short story. It may be a fragment of auto biography, or a piece of nonsense. It may be satirical or vituperalive or sentimental. It may deal with any subject from the day of Judgement to a pair of scissors. বলতে দ্বিধা নেই ইংরেজি সাহিত্যে যেমন এই মন্ময় প্রবন্ধে প্রাচুর্য পরিলক্ষিত হয় বাংলায় তেমন সম্ভার নেই বললেই চলে। কেবলমাত্র বঙ্কিমচন্দ্রের কমলাকান্তের দপ্তর ধ্রুবতারকার ন্যায় একক ক্ষমতায় আসীন। এছাড়া আরও কয়েকজন যেমন রায়গত ন্যায়রত্ন, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কালীপ্রসন্ন ঘোষ, চন্দ্রনাথ বসু, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রমুখ লেখকগণ এই রচনায় হস্তক্ষেপ করলেও বঙ্কিমের প্রতিভাকে কেউ ম্লান করতে পারেনি।

এছাড়া সমালোচক শ্রীশচন্দ্র দাস আরও একখানি প্রবন্ধ রচনার সন্ধান দিয়েছেন, তা তাঁর ভাষায় ব্যক্ত করা যেতে পারে “Belles-Letters শব্দটি খুব সম্ভব Swift ইংরাজি সাহিত্যে (রম্য রচনা) প্রথম ব্যবহার করেন (১৭৩০)। প্রাচীনকালে ব্যাকরণ শাস্ত্র, বাগ্মিতা ও কাব্যকলাকেই রম্যরচনা বলা হইত। পরবর্তীকালে Belles Letters বলতে কল্পনাকান্ত ও শিল্পসঙ্গত যে-কোনো সাহিত্যকেই বুঝানো হইত।” তবে আপাতদৃষ্টিতে রম্য রচনাকে প্রবন্ধের সমজাতীয় বলে মনে হলেও বিশেষ করে ব্যক্তিগত প্রবন্ধের সঙ্গে হুবহু মিল থাকলেও উভয়ের মধ্যেকার পার্থক্য খুব সুস্পষ্ট। এ প্রসঙ্গে জনৈক বিখ্যাত সমালোচক বলেছেন-Modern usage applies the word more often to the little hills than to the mountain peaks of literature and denotes the essay and the critical study rather than the epics of homer or the plays of Shakespeare.” কেবলমাত্র ব্যক্তিগত রমণীয়তা খেয়ালি কল্পনার অবাধ বিস্তার এই জাতীয় রচনার বিশেষ গুণ। আধুনিককালে যাঁরা রম্যরচনার বিশেষ কৃতিত্ব অর্জন করেছেন তাঁদের মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বীরবল, যাযাবর, বিরূপাক্ষ, সৈয়দ মুজতবা আলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।

Leave a Comment