আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “প্রাচীন ভারতের ইতিহাস পুনর্গঠনে মহাকাব্যদ্বয়” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
প্রাচীন ভারতের ইতিহাস পুনর্গঠনে মহাকাব্যদ্বয়
প্রাচীন ভারতের দুটি মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারত বিশেষ মর্যাদার স্থান অধিকার করে আছে। বৈদিক সূত্র সাহিত্যকে যদি ‘ব্রাহ্মণ্য সাহিত্য’ বলে অভিহিত করা হয় তাহলে মহাকাব্য দুটিকে নিঃসন্দেহে ‘ক্ষত্রিয়দের সাহিত্য’ বলা চলে। তবে পুরাণ যেমন সূত জাতির সাহিত্য হয়েও পরবর্তীকালে ব্রাহ্মণদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল, এই দুই মহাকাব্যের ক্ষেত্রেও তার প্রত্যয় ছিল না। মহাকাব্যের পূর্বেকার সাহিত্যে ব্রাহ্মণদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল। তাতে ক্ষত্রিয় বা ব্রাহ্মণেতর জাতির কথা ছিল না। জনগণের সাথে তাদের কোন যোগ ছিল না। রামায়ণ ও মহাভারতের উপরেও তেমনি ব্রাহ্মণদের প্রভাব পড়েছে অনিবার্যভাবে। ড. বিমানচন্দ্র ভট্টাচার্যের মতে, এই দুই মহাকাব্যের জনপ্রিয়তা দেখে ব্রাহ্মণগণ এদের কবলিত করেন এবং ব্রাহ্মণধর্মের প্রচার ও প্রচারের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেন। এই নিয়ন্ত্রণকারী ব্রাহ্মণদের অধিকাংশই ছিলেন অশিক্ষিত। ধর্ম বিষয়ে তাঁদের জ্ঞান ছিল খুবই কম এবং অসম্পূর্ণ। তাই এদের সংস্পর্শে এসে মহাকাব্য দুটি নীতি, ধর্ম ও ধর্মবিধির পুস্তকে পরিণত হয়েছে। ড. ভট্টাচার্যের মতে, বৌদ্ধ ইত্যাদি অন্যান্য ধর্ম সম্প্রদায়ও তাঁদের ধর্মনীতি প্রচারের জন্য এই দুই মহাকাব্যকে বাহন হিসেবে ব্যবহার করেছেন। ত্যাগ, মৈত্রী, অহিংসা-সংক্রান্ত কাহিনীগুলি এদের প্রভাব চিহ্নিত করে। এই বিচারে রামায়ণ বা মহাভারতের কোনটিই একজন কবির দ্বারা বা একই সময়ে রচিত হয়নি। নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, মহাকাব্য দুটি বিশেষত মহাভারত বহু পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছিল ও খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতকের আগে এটি তার বর্তমান রূপ লাভ করেনি। এগুলির রচনার কাজ শুরু হয়েছিল সম্ভবত আরো ছয় থেকে আটশো বছর পূর্বে। রচনাকালের দিক থেকে রামায়ণ খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় বা দ্বিতীয় শতক থেকে খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় বা তৃতীয় শতকে সম্পূর্ণ হয়েছিল। অন্যদিকে মহাভারত রচনা শুরু হয়েছিল সম্ভবত খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম বা চতুর্থ শতকে এবং শেষ হয়েছে খ্রিষ্টীয় চতুর্থ বা পঞ্চম শতকে। অর্থাৎ রামায়ণ পরে শুরু হয়ে আগে শেষ হয়েছে এবং মহাভারত আগে শুরু হয়ে পরে শেষ হয়েছে। বাল্মিকী আদি কবি এবং রামায়ণ প্রাচীনতর গ্রন্থ—এমন প্রবাদ বা বিশ্বাস ভারতবর্ষে প্রচলিত। প্রবাদ বহুক্ষেত্রেই সত্যের ওপর গড়ে ওঠে, তাছাড়া মহাভারতে রামায়ণের বহু চরিত্র ও ঘটনার উল্লেখ আছে, কিন্তু রামায়ণে মহাভারতের কোন চরিত্রের উল্লেখ নেই। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, রামায়ণের আখ্যান মহাভারতের আখ্যানের থেকে প্রাচীনতর।
উইন্টারনিজের (M. Winternitz) মতে, মহাকাব্যের বীজ বৈদিক সাহিত্যের মধ্যে নিহিত ছিল। ঋগ্বেদের দানস্তুতি, অথর্ববেদের কুত্তাপ সুক্তগুলি, ব্রাহ্মণ সাহিত্যে যাগযজ্ঞ উপলক্ষে যেসব গাথা (গাথা নারাশংসী) আবৃত্তি করা হত, সেগুলি থেকে মহাকাব্যের গাথা রচনার প্রেরণা আসতে পারে। গাথা রচনার উদ্দেশ্য ছিল বীরপূজা। সূত বা চারণরা এই গাথা রচনা করতেন। এঁরা ছিলেন রথ চালক। যুদ্ধক্ষেত্রে মহারথীদের যে সামরিক কীর্তি প্রত্যক্ষ করতেন, তাকে কেন্দ্র করেই রচনা করতেন বীরগাথা। প্রকৃতিগতভাবে এই সকল গাথার সাথে ধর্মকর্ম, যাগযজ্ঞের কোন যোগ ছিল না। এগুলি মূলত বীর রসাত্মক, মনোরঞ্জনমূলক সামরিক সাহিত্য। রামায়ণে দেখা যায় যে, লব-কুশ বাল্মিকীর নিকট রাম-গীত শিক্ষা করে গ্রাম-গ্রামান্তরে পরিভ্রমণ করে মানুষকে শোনাতেন। মহাভারতে সঞ্জয় নামক সূত রাজা ধৃতরাষ্ট্রের কাছে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ কুরু-পাণ্ডবের যুদ্ধের কাহিনী শুনিয়েছেন। যুগ যুগ ধরে সূতদের মুখে মুখে বংশ পরম্পরায় যেমন মহাকাব্যের কাহিনী বেঁচে ছিল, তেমনি চারণদের মুখে মুখে সেই কাহিনী কাব্যছন্দে যুগের পর যুগ গীত হয়েছে। তাই রামায়ণ ও মহাভারতের যে সংকলন আমরা পেয়েছি, তা গড়ে উঠতে লেগেছে কয়েক শতক। তাতে স্পর্শ লেগেছে নানা কবি, গীতিকারের। এইভাবে মূল সামরিক বীরগাথার সাথে যুক্ত হয়েছে ধর্ম, দর্শন, নীতিকথা ইত্যাদি।
রামায়ণ ও মহাভারত দুটিই মহাকাব্য, কিন্তু আকৃতি ও প্রকৃতিতে উভয়ের মধ্যে পার্থক্য দেখা যায়। রামায়ণ তুলনায় প্রাচীন রচনা, কিন্তু মহাভারতের বিষয় বৈচিত্র্য, তেজস্বীতা রামায়ণের থেকে বেশী। উভয় কাব্যের ছন্দ বিন্যাসে অনেক মিল আছে, কিন্তু রামায়ণে তা অধিকতর মার্জিত। মহাভারতের চরিত্রগুলির সামাজিক আবেদন এখন প্রায় নিঃশেষিত, কিন্তু রামায়ণের মুখ্য চরিত্রের সামাজিক আবেদন এখনো যথেষ্ট। মূল মহাভারতের চরিত্রগুলি সবই মানবিক। পশু-পাখির কথা এসেছে দৃষ্টান্ত বা reference হিসেবে। কিন্তু রামায়ণে তৃতীয় কাণ্ড থেকে দৈত্য, বানর ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে স্থান পাওয়ায় সেখানে বাস্তব ও কল্পনার সংমিশ্রণ দেখা যায়। দুটি মহাকাব্যই ভারতবাসীর কাছে পবিত্র গ্রন্থ। কিন্তু পবিত্রতার উৎস এক নয়। রামায়ণে পবিত্রতার উৎস রাম-সীতার চরিত্রভাতি। রাম এখানে অবতার। অন্যদিকে মহাভারতে বর্ণিত নীতিমূলক অংশগুলি, যা পরবর্তীকালে সংযোজিত, কাব্যটিকে পবিত্রতা দিয়েছে।
মহাকাব্য হিসেবে লিখিত রূপ গ্রহণের পূর্বে দীর্ঘকাল রামায়ণের কাহিনী মুখে মুখে প্রচলিত ছিল। চারণকবিরা রামায়ণ গান পরিবেশন করতেন। রামায়ণ প্রথমে গীত হত ঋষিদের তপোবনে। সর্বশেষ অযোধ্যায় রামচন্দ্রের প্রাসাদে অশ্বমেধ অনুষ্ঠানে রামায়ণ গান পরিবেশিত হয়। অঞ্চলভেদে শ্রোতাদের মনোরঞ্জনের প্রয়োজনে রামগানের বিষয়বস্তু পরিবর্তিত ও সংযোজিত হত। চারণকবিরা আপন দক্ষতায় সেই রূপান্তরের কাজ সম্পন্ন করতেন। বাল্মিকী রামায়ণের লিখিত রূপ দেন। তবে তিনি একক প্রচেষ্টায় একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে রামায়ণ রচনা করেছিলেন—এমন ধারণা যুক্তিসিদ্ধ নয় বলেই পণ্ডিতদের অনুমান। রামায়ণের মূল কাহিনীর বিন্যাস ঘটেছে অযোধ্যাকাণ্ড ও যুদ্ধকাণ্ডের মধ্যে। প্রাথমিক পর্বে মূল রামায়ণের নায়ক রামচন্দ্র ছিলেন একজন আদর্শ মানব। উত্তরকাণ্ড ও বালকাণ্ড পরবর্তীকালের সংযোজন। এখানে রামচন্দ্র বিষ্ণুর অবতাররূপে চিত্রিত হয়েছেন। এইভাবে রাজপুত্র থেকে জাতীয়নেতা এবং শেষে বিষ্ণুর অবতার হিসেবে রামচন্দ্রের ক্রম রূপাত্তর রামায়ণে দেখা যায়।
রামায়ণ মহাকাব্য হলেও এর কাহিনী সমকালীন সমাজ ব্যবস্থার আভাস দেয়। দক্ষিণভারতে আর্য সংস্কৃতির বিস্তার এবং আর্য-অনার্য সংঘর্ষের ঐতিহ্য রামায়ণে আভাসিত। দাক্ষিণাত্য ও দক্ষিণ ভারতে আর্যসংস্কৃতির প্রসারের উদ্ভাবিত পদ্ধতি হিসেবে রামায়ণের দু’টি বৈশিষ্ট্য স্মরণ করা যায়। আর্য ঋষিরা গোদাবরী নদীর তীরে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে ধর্মপ্রচারের মাধ্যমে আর্য সংস্কৃতির প্রসার ঘটাতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। অন্যদিকে অনার্যদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে অনার্যদের দুর্বল করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। বালি-সুগ্রীবের সংঘাত এবং রামচন্দ্রের ভূমিকা, এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়। অনার্য সংস্কৃতির প্রতীক হিসেবে লঙ্কেশ্বর রাবণের উপস্থাপনা এবং রাজা রাবণের বিলাস ও সামরিক শক্তি থেকে বোঝা যায় যে, অনার্যরাও যথেষ্ট শক্তি ও বৈভবের অধিকারী ছিলেন।
ডা. প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ তাঁর ‘প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাস’ গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন যে, দু’টি মহাকাব্যের মধ্যে রামায়ণ অধিক জনপ্রিয়। কারণ বাল্মিকী তাঁর কাব্যে সহজ, সরল, প্রাণ্ডুলভাবে মানুষের মনের কথা ব্যক্ত করেছেন। তাঁর মতে, উত্তরকাণ্ডের অংশ মূল বাল্মিকী রামায়ণের অংশ নয়। রামচন্দ্রের অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তনের পরই বাল্মিকী রামায়ণ সমাপ্ত হয়েছে। তাছাড়া রামায়ণের নানা আঞ্চলিক সংস্করণে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মনোরঞ্জনের জন্য মূল কাহিনীর পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংযোজন করা হয়েছে। বাল্মিকী রামচন্দ্রকে ‘অবতার’ রূপে উপস্থাপন করেননি। তাঁর রামচন্দ্র নরচন্দ্রমা। উপনিষদের সেই চিরন্তন বাণী ‘আনন্দ হতেই জীবের জন্ম, আনন্দেই জীবনযাপন এবং অবশেষে আনন্দেই লয়’, (‘আনন্দাদ্ব্যোর খল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে, আনন্দেন জাতানি জীবত্তি, আনন্দং প্রয়ন্ত্যভিসং বিশত্তি’) এ-সত্য বাল্মিকী বিস্মৃত হন নি। তাই সীতার পাতাল প্রবেশ মূল রামায়ণে স্থান পায়নি। কৃত্তিবাসী রামায়ণে সীতার জীবন কেবল দুঃখময়। কিন্তু বাল্মিকী দশরথ, রামচন্দ্র, সীতা ও লক্ষ্মণ, ভরত প্রমুখের মাধ্যমে আদর্শপিতা, আদর্শ পুত্র, পতিব্রতা স্ত্রী ও আদর্শবান ভায়েদের ছবি আঁকতে চেয়েছেন। এ-জন্য রামায়ণের মূল কাহিনীর মধ্যে ভারতবাসী তাঁর নিজের দৈনন্দিন জীবনের স্পর্শ খুঁজে পান। প্রক্ষিপ্ত অংশে রামচন্দ্র অবতাররূপে প্রতিভাত হলে তাঁর স্থান মানুষের হৃদয়ের পরিবর্তে মন্দিরের কোণে পরিবর্তিত হয়ে যায়।
মহাভারত রামায়ণের চেয়ে বৃহৎ কাব্য এবং বিশ্বসাহিত্যে এত বড় মহাকাব্য আর নেই। সম্পূর্ণ মহাভারত একসাথে রচিত হয়নি। পর্যায়ক্রমে এই মহাগ্রন্থের সংযোজন ও পরিবর্ধন ঘটেছে। প্রথমে মহাভারতে শ্লোকের সংখ্যা ছিল চব্বিশ হাজার। পরিণত পর্বে শ্লোকের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে এক লক্ষ। ব্যাসদেব প্রথমে এই মহাকাব্য শুনিয়েছিলেন তাঁর শিষ্য বৈশাম্পায়নকে। জন্মেজয়ের সর্পযজ্ঞে তিনি সেই কাব্যকথা আবৃত্তি করেন। সূত উগ্রশ্রবন সেই কাহিনী শ্রবণ করে শৌনিক মুনির যজ্ঞানুষ্ঠানে আবৃত্তি করেন। অর্থাৎ মহাভারতের তিনটি সংস্করণের কথা মহাকাব্যেই উল্লেখ করা হয়েছে। খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকে পাণিনির আমল থেকে কয়েক শতক এটি ‘পাণ্ডবকাব্য’ নামে পরিচিত ছিল। আনুমানিক খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতকে কৃষ্ণের ক্রমবর্ধমান সক্রিয়তা বর্ণনা প্রসঙ্গে মহাভারতের কলেবর বৃদ্ধি পেয়েছে। দ্বিতীয় ও চতুর্থ খ্রিস্টাব্দের অন্তবর্তী দুশো বছরে শিক্ষামূলক অংশগুলি যুক্ত হওয়ার ফলে এর আয়তন আরো বৃদ্ধি পায়।
মহাভারতে আখ্যানের মধ্যে আখ্যানের সৃষ্টি হলে এর আয়তন বৃদ্ধি পায়। শকুন্তলা-দুষ্মন্ত (আদিপর্ব), নল-দময়ন্তী (বন পর্ব), রামচন্দ্রের কাহিনী, সাবিত্রী-সত্যবান, বিশ্বামিত্র বশিষ্ট (বন পর্ব) ইত্যাদি বিচিত্র ঘটনাবলী আখ্যানের মধ্যে স্থান পেয়েছে। শান্তি ও অনুশাসন পর্ব মহাভারতের গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। এখানে মহামতি ভীষ্মের মুখ দিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষামূলক উপদেশাবলী বিবৃত হয়েছে। বিষ্ণুসহস্রনাম এবং ভগবদ্গীতা মহাভারতের অতি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্রাক্কালে অর্জুনের বিষাদ এবং তা নিবারণের জন্য কৃষ্ণের উপদেশাবলী ভগবদ্গীতার বিষয়বস্তু, যা সাধারণভাবে ‘গীতা’ আকারে লিপিবদ্ধ হয়েছে। অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত মনে করেন, গীতা মহাভারতের আগেই রচিত হয়েছিল, পরে মহাভারতের সাথে যুক্ত করা হয়েছে। আর. কে. ভাণ্ডারকর, তিলক প্রমুখের মতে, গীতা খ্রিষ্টপূর্ব নবম ও চতুর্থ শতকের অন্তর্বর্তীকালে রচিত হয়েছে এবং যোগ্য কারণেই মহাভারতের যোগ্যস্থানে যুক্ত হয়েছে। প্রাচীনকালে গীতা হয়তো একান্তী বৈষ্ণবদের কিংবা ভাগবত ধর্মাবলম্বীদের সাম্প্রদায়িক গ্রন্থ বলে বিবেচিত হত। কিন্তু বর্তমানে গীতা হিন্দুসমাজের সার্বজনীন গ্রন্থ। অদ্বৈতবাণী শংকর (৮ম শতক), বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী রামানুজ (১১শ শতক) কিংবা দ্বৈতবাদী মাধ্বাচার্য (১৩শ শতক) সকলেই নিজ নিজ মতবাদ সমর্থন করার জন্য গীতার ভাষ্যকেই ব্যবহার করেছেন। রচনাশৈলী, ভাষার মাধুর্য ইত্যাদির বিচারে গীতা কাব্য হিসেবেও উচ্চ স্থান পেতে পারে। কিন্তু গীতা প্রথমে ধর্মগ্রন্থ, পরে কাব্য। মহাভারতের পরিশিষ্ট (খিল) হিসেবে পরিচিত ‘হরিবংশ’ মহাভারতের মত একাধিক পর্যায়ের মধ্য দিয়ে পরিণত রূপ পেয়েছে। হরিবংশের দু’টি ভাগ : হরিবংশ পর্ব ও বিষ্ণুপর্ব।
মহাভারতের মূল বিষয়বস্তু কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ, যেখানে দুই আত্মীয়-প্রতিপক্ষ কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যে সংঘর্ষের বিস্তারিত কাহিনী ও বিচিত্র ঘটনাবলী স্থান পেয়েছে। কাহিনী বিন্যাসের মধ্যে প্রাসঙ্গিকভাবে উঠে এসেছে কূটনীতি, রাষ্ট্রনীতি, ন্যায়পরায়ণতা, শৌর্য-বীর্য ইত্যাদির পাশাপাশি সমকালীন সমাজব্যবস্থা, আচার-অনুষ্ঠান ইত্যাদির বিবরণ। এ্যানি বেশান্তের মতে, ‘নীতিগ্রস্থ হিসেবে দর্শনশাস্ত্র হিসেবে এবং ইতিহাস হিসেবে মহাভারত সত্যই মহান ভারতের পরিচয় বহন করিতেছে।’ বিশিষ্ট সাধক আনন্দতীর্থ তাঁর ‘মহাভারতের তাৎপর্য নির্ণয়’ গ্রন্থে লিখেছেন যে, মহাভারতের বীরগণের জীবনকাহিনীর মধ্য দিয়ে ভারতীয় দর্শনের মৌলিক আদর্শ ব্যক্ত হয়েছে। সমকালীন ভারতবর্ষে একাধিক স্বতন্ত্র ও স্বাধীন রাজ্যের অস্তিত্ব এই মহাকাব্য থেকে জানা যায়। পাণ্ডব ও কৌরবদের পক্ষে যোগদানকারী বিভিন্ন রাজ্যের অস্তিত্ব সমকালীন ভারতে আঞ্চলিক রাজ্য গঠন প্রক্রিয়ার আভাস দেয়। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে পাণ্ডবদের জয়লাভের পর হস্তিনাপুরকে কেন্দ্র করে শক্তিশালী কুরু রাজ্যের প্রতিষ্ঠা ভারতীয় রাজনীতিতে কেন্দ্রীকরণ প্রবণতার আভাস দেয়। কৃষ্ণ রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার কাজে মুখ্য সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সামাজিক জীবনের আভাসও এই মহাগ্রন্থ থেকে চয়ন করা সম্ভব। সত্যের জয় এবং অন্যায়ের বিনাশ অবশ্যম্ভাবী এই শাশ্বত বার্তা মহাভারত থেকে পাওয়া যায়। যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন প্রমুখ যথাক্রমে সত্যবাদিতা, শৌর্য ও নেতৃত্বের প্রতীকরূপে প্রতিভাত হয়েছেন। ভীষ্ম শুনিয়েছেন জগত সংসারের অনিবার্যতার কাহিনী। দ্রৌপদী আদর্শ পত্নী হিসেবে একইসাথে সংসার ও রাজনীতির অঙ্গণে পদচারণা করেছেন। দ্রৌপদীর পঞ্চস্বামী তত্ত্বের মধ্য দিয়ে অনার্য সভ্যতার বৈশিষ্ট্য প্রকাশের চেষ্টা দেখা যায়।
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।