আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “প্রাচীন ভারতে সাহিত্য” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
প্রাচীন ভারতে সাহিত্য
প্রাচীন ভারতে প্রায় সকল কাজের উৎস ও পরিচালক ছিল ধর্ম। তাই সাহিত্যচর্চার কাজেও ধর্মের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। মূলত ধর্মভাবনার নানা দিককে কেন্দ্র করে সাহিত্যচর্চার কাজ শুরু হয়েছিল। তবে ধর্মীয় বিষয়বস্তুকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা প্রাচীন সাহিত্যকর্মের মধ্যে সমসাময়িক সমাজভাবনা, শাসনধারা ইত্যাদিরও প্রকাশ দেখা যায়। প্রাচীন ভারতে সাহিত্যচর্চার অগ্রগতির ইতিহাসকে দুটি পর্বে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগের পরিধি মৌর্য যুগের সূচনা থেকে গুপ্তশাসন প্রতিষ্ঠার আগে পর্যন্ত। অর্থাৎ খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ থেকে খ্রিষ্টীয় ৩০০ শতক। এবং দ্বিতীয় পর্ব খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতক থেকে অষ্টম শতক পর্যন্ত। এই পর্বে সাহিত্যচর্চার প্রধান মাধ্যম ছিল সংস্কৃত ভাষা। এছাড়া পালি, অর্ধ-মাগধী ও প্রাকৃত ভাষাতেও বহু সাহিত্য চর্চা হয়েছিল। দক্ষিণ ভারতে সাহিত্যচর্চার প্রধান মাধ্যম ছিল তামিল ভাষা। অন্যান্য ভাষার মধ্যে কন্নড়, তেলেগু ও মালায়ালম ভাষাতেও বহু জনপ্রিয় সাহিত্য সৃষ্টি সম্ভব হয়েছিল। আমাদের বর্তমান আলোচনার মূল বিষয় হল ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্য। তবে আনুসাঙ্গিক ভাবে ধর্মীয় সাহিত্যের উল্লেখ থাকা অপ্রাসঙ্গিক হবে না।
প্রাচীন ভারতের সংস্কৃত সাহিত্য: প্রাক্-গুপ্তযুগ
সাধারণ বিচারে সংস্কৃত ভাষা-সাহিত্য গুপ্তযুগে খ্যাতির চূড়ায় আরোহণ করেছিল। কালিদাসের সমসাময়িক অমর সিংহ প্রণীত ‘নামলিঙ্গানুশাসন’ গ্ৰন্থকে প্রাচীন সংস্কৃত ভাষার শ্রেষ্ঠ অভিধান বলা হয়। সাধারণভাবে এটি ‘অমর কোষ’ নামে বেশি পরিচিত। তবে এই কাজে প্রথম কৃতিত্ব দেখান খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকের বৈয়াকরণিক পাণিনি। তাঁর ব্যাকরণের নাম ‘শব্দানুশাসন’। আট অধ্যায়ে বিভক্ত বলে একে ‘অষ্টাধ্যায়ী’বলা হয়। পাণিনি তাঁর গ্রন্থে সংস্কৃত ভাষার সংজ্ঞা এমনভাবে নির্দেশ করেছিলেন, যা একটি ‘ভাষা’ বা ভাবপ্রকাশের মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে উত্তর-পশ্চিম ভারতে প্রধান বিদ্যাচর্চার কেন্দ্র তক্ষশিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্র ছিলেন পাণিনি। তিনি পূর্ববর্তী চৌষট্টি জন বৈয়াকরণিকের নাম উল্লেখ করেছেন, যদিও তাঁদের কোন পুস্তক উদ্ধার করা যায়নি। পাণিনি সেই সংস্কৃত ভাষার প্রধান রূপকার বলা যায়। এই ভাষাকে তিনি ধাতুরূপ, শব্দ সম্পদ, স্বর সংঘাতের দিক থেকে সহজ-সরল করে ভাব প্রকাশের যথাযোগ্য বাহন করেছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, বর্তমানে সংস্কৃত ভাষা দেবনাগরী অক্ষরে লেখা হয়। পণ্ডিতদের অনুমান প্রাচীনকালে ভারতে ব্রাহ্মী লিপির ব্যাপক প্রচলন ছিল। ক্রমপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে প্রাচীন ব্রাহ্মী লিপিই বর্তমান দেবনাগরী অক্ষরে পরিণত হয়েছে। ডি. ডি. ভান্ডারকরের মতে, ব্রাহ্মী লিপি ভারতবর্ষেই উদ্ভূত হয়েছে। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারও এই মত সমর্থন করেন।
মৌর্য ও শুঙ্গদের শাসনকালে সংস্কৃত ভাষার পরিশুদ্ধিকরণ ঘটে। এই কাজে পাণিনির গ্রন্থের দুই ভাষ্যকার ব্যাদি ও পতঞ্জলি বিশেষ কৃতিত্ব দেখান। ব্যাদি পাণিনির সূত্র ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে লক্ষাধিক শ্লোক রচনা করেছিলেন এবং প্রায় চৌদ্দ হাজার বিষয় সেখানে আলোচিত হয়েছে। পাণিনির সংস্কৃতের পরিভাষাগুলি ব্যাদির সৃষ্টি বলেই মনে করা হয়। এমনকি, পতঞ্জলির ‘মহাভাষ্য’-র ভিত্তিও ছিলেন ব্যাদি। পাণিনির রচনার উপর অন্য দুজন ব্যাখ্যাকার ছিলেন কাত্য এবং কাত্যায়ন। পতঞ্জলি কাত্যকে ‘ভগবান কাত্য’ নামে উল্লেখ করে সংস্কৃত সাহিত্যের আধুনিকীকরণে তাঁর গুরুত্ব বুঝিয়েছেন। কাত্যর টিকাভাষ্য ‘মহাবর্তিকা’ নামে পরিচিত। মৌর্যযুগের বিশিষ্ট রচনাকার ছিলেন কাত্যায়ন। তিনি সরাসরি পাণিনির সূত্রের সমালোচনা ও সংশোধন করেছিলেন। এজন্য কাত্যায়নকে পাণিনির ব্যাকরণের শ্রেষ্ঠ ভাষ্যকার বলা হয়। তবে পাণিনির সূত্রের সমালোচনা, সংশোধন বা পরিমার্জনার কাজে সর্বোচ্চ কৃতিত্বের দাবিদার পতঞ্জলি। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের প্রথম দিকে তাঁর আবির্ভাব ঘটেছিল। সম্ভবত তিনি রাজা পুষ্যমিত্র শুঙ্গের রাজসভা অলংকৃত করেছিলেন। পতঞ্জলি মনে করতেন যে, শব্দ চিরন্তন। তাকে খেয়াল খুশিমত পাল্টে ফেলা যায় না, তবে শোধণ করা যায়। তিনি পাণিনির অবদানকে স্থায়ী ভিত্তি দিতে আন্তরিক চেষ্টা করেন। কোন কোন ক্ষেত্রে পাণিনির সূত্রকে তিনি সমালোচনা করেছেন। তবে সম্পূর্ণরূপে বর্জনীয় বলেন নি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃত ভাষার যে সব পরিবর্তন জরুরী হয়েছিল, সেগুলির দিকে তাকিয়ে তিনি ‘মহাভাষ্য’ গ্রন্থে পাণিনির রচনার সাথে সামঞ্জস্য রেখে কিছু পরিপূরক শব্দগুচ্ছ (বিধি) যুক্ত করেছিলেন। পতঞ্জলির মহাভাষ্যে সংস্কৃত গদ্যের যে গঠন রীতি প্রয়োগ করা হয়েছিল, তা পরবর্তী বহুকাল অপরিবর্তিত ছিল। এই গ্রন্থকে কেবল ব্যাকরণের টিকা ভাষ্য না বলে সমাজ, সাহিত্য ও দর্শনের প্রতীক বলা যায়।
পতঞ্জলির আন্তরিক প্রয়াস সত্ত্বেও পাণিনির সংস্কৃত-সূত্র ক্রমশ গুরুত্বহীন প্রতিপন্ন হয়েছিল। খ্রিষ্টীয় তৃতীয়-চতুর্থ শতকে বৈজ, সৌভব প্রমুখ নতুন ধারায় সংস্কৃত ভাষাচর্চা শুরু করেছিলেন। পাণিনির সূত্র ও পতঞ্জলির ভাষ্য দক্ষিণ ভারতে কোনক্রমে টিকেছিল। এই কাজে কৃতিত্ব দেখান চন্দ্রাচার্য। সাতবাহন বংশীয় রাজা হালের উদ্যোগে সংস্কৃত ভাষা চর্চায় এক নতুন ধারার সংযোজন ঘটে। রাজা হালের নির্দেশে তাঁর জনৈক ব্রাহ্মণ অনুচর সর্ববর্মন সংস্কৃতের একটি সংক্ষিপ্ত (কাতন্ত্র) ব্যাকরণ রচনা করেন। এই ‘কাতন্ত্র’ ব্যাকরণে পাণিনির সূত্রাবলীর সামান্য অংশ গৃহীত হয়েছিল। সংস্কৃত ভাষাকে জনপ্রিয় করার জন্য এই ব্যাকরণের সৃষ্টি বলে মনে করা হয়। এক্ষেত্রে সংস্কৃত ব্যাকরণ কার্যত পাণিনির আগের রূপে ফিরে গিয়েছিল। তবে কাতন্ত্র ব্যাকরণ তিব্বত সহ দেশের বিভিন্ন অংশে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। কাচ্ছায়নের পালি ব্যাকরণ বা প্রাচীন তামিল ব্যাকরণের উপর ‘কাতন্ত্র’ ব্যাকরণের বিশেষ প্রভাব ছিল।
কাব্য সাহিত্যের মৃদু আভাস পতঞ্জলির মহাভাষ্যে খুঁজে পাওয়া যায়। তবে ভারতবর্ষের প্রাচীনতম কাব্য হিসেবে মহাকাব্যদ্বয় রামায়ণ ও মহাভারতের নাম উচ্চারিত হয়। এই দুটি মহাকাব্যকে বিশুদ্ধ ধর্মগ্রন্থ বলা সঙ্গত নয়। তবে ধর্মকে আশ্রয় করে এই দুটি গ্রন্থে ভারতবর্ষের প্রাণের নির্যাস তুলে ধরার প্রয়াস আছে। এখানে ধর্ম মানে সদাচার, সৎ বিশ্বাস ও সৎ কর্ম। তাই মহাকাব্য দুটিকে ‘ভারতবর্ষের প্রাণের মূর্তিবিগ্রহ’ বলে ড. প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ উল্লেখ করেছেন।
প্রাচীন ভারতের মহাকাব্যদ্বয় :
প্রাচীন ভারতের দুটি মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারত বিশেষ মর্যাদার স্থান অধিকার করে আছে। বৈদিক সূত্র সাহিত্যকে যদি ‘ব্রাক্ষ্মণ্য সাহিত্য’ বলে অভিহিত করা হয় তাহলে মহাকাব্য দুটিকে নিঃসন্দেহে ‘ক্ষত্রিয়দের সাহিত্য’ বলা চলে। তবে পুরাণ যেমন সূত জাতির সাহিত্য হয়েও পরবর্তীকালে ব্রাহ্মণদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল, এই দুই মহাকাব্যের ক্ষেত্রেও তার প্রত্যয় ছিল না। মহাকাব্যের পূর্বেকার সাহিত্যে ব্রাহ্মণদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল। তাতে ক্ষত্রিয় বা ব্রাহ্মণেতর জাতির কথা ছিল না। জনগণের সাথে তাদের কোন যোগ ছিল না। রামায়ণ ও মহাভারতের উপরেও তেমনি ব্রাহ্মণদের প্রভাব পড়েছে অনিবার্যভাবে। ড. বিমানচন্দ্র ভট্টাচার্যের মতে, এই দুই মহাকাব্যের জনপ্রিয়তা দেখে ব্রাহ্মণগণ এদের কবলিত করেন এবং ব্রাহ্মণধর্মের প্রচার ও প্রচারের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেন। এই নিয়ন্ত্রণকারী ব্রাহ্মণদের অধিকাংশই ছিলেন অশিক্ষিত। ধর্ম বিষয়ে তাঁদের জ্ঞান ছিল খুবই কম এবং অসম্পূর্ণ। তাই এদের সংস্পর্শে এসে মহাকাব্য দুটি নীতি, ধর্ম ও ধর্মবিধির পুস্তকে পরিণত হয়েছে। ড. ভট্টাচার্যের মতে, বৌদ্ধ ইত্যাদি অন্যান্য ধর্ম সম্প্রদায়ও তাঁদের ধর্মনীতি প্রচারের জন্য এই দুই মহাকাব্যকে বাহন হিসেবে ব্যবহার করেছেন। ত্যাগ, মৈত্রী, অহিংসা সংক্রান্ত কাহিনীগুলি এদের প্রভাব চিহ্নিত করে। এই বিচারে রামায়ণ বা মহাভারতের কোনটিই একজন কবির দ্বারা বা একই সময়ে রচিত হয়নি। নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, মহাকাব্য দুটি বিশেষত মহাভারত বহু পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছিল ও খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতকের আগে এটি তার বর্তমান রূপ লাভ করেনি। এগুলির রচনার কাজ শুরু হয়েছিল সম্ভবত আরো ছয় থেকে আটশো বছর পূর্বে। রচনাকালের দিক থেকে রামায়ণ খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় বা দ্বিতীয় শতক থেকে খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় বা তৃতীয় শতকে সম্পূর্ণ হয়েছিল। অন্যদিকে মহাভারত রচনা শুরু হয়েছিল সম্ভবত খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম বা চতুর্থ শতকে এবং শেষ হয়েছে খ্রিষ্টীয় চতুর্থ বা পঞ্চম শতকে। অর্থাৎ রামায়ণ পরে শুরু হয়ে আগে শেষ হয়েছে এবং মহাভারত আগে শুরু হয়ে পরে শেষ হয়েছে। বাল্মিকী আদি কবি এবং রামায়ণ প্রাচীনতর গ্রন্থ—এমন প্রবাদ বা বিশ্বাস ভারতবর্ষে প্রচলিত। প্রবাদ বহুক্ষেত্রেই সত্যের ওপর গড়ে ওঠে, তাছাড়া মহাভারতে রামায়ণের বহু চরিত্র ও ঘটনার উল্লেখ আছে, কিন্তু রামায়ণে মহাভারতের কোন চরিত্রের উল্লেখ নেই। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, রামায়ণের আখ্যান মহাভারতের আখ্যানের থেকে প্রাচীনতর।
উইন্টারনিজের (M. Winternitz) মতে, মহাকাব্যের বীজ বৈদিক সাহিত্যের মধ্যে নিহিত ছিল। ঋগ্বেদের দানস্তুতি, অথর্ববেদের কুত্তাপ সুক্তগুলি, ব্রাক্ষ্মণ সাহিত্যে যাগযজ্ঞ উপলক্ষে যেসব গাথা (গাথা নারাশংসী) আবৃত্তি করা হত, সেগুলি থেকে মহাকাব্যের গাথা রচনার প্রেরণা আসতে পারে। গাথা রচনার উদ্দেশ্য ছিল বীরপূজা। সূত বা চারণরা এই গাথা রচনা করতেন। এঁরা ছিলেন রথ চালক। যুদ্ধক্ষেত্রে মহারথীদের যে সামরিক কীর্তি প্রত্যক্ষ করতেন, তাকে কেন্দ্র করেই রচনা করতেন বীরগাথা। প্রকৃতিগতভাবে এই সকল গাথার সাথে ধর্মকর্ম, যাগযজ্ঞের কোন যোগ ছিল না। এগুলি মূলত বীর রসাত্মক, মনোরঞ্জনমূলক সামরিক সাহিত্য। রামায়ণে দেখা যায় যে, লব-কুশ বাল্মিকীর নিকট রাম-গীত শিক্ষা করে গ্রাম-গ্রামান্তরে পরিভ্রমণ করে মানুষকে শোনাতেন। মহাভারতে সঞ্জয় নামক সূত রাজা ধৃতরাষ্ট্রের কাছে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ কুরু-পাণ্ডবের যুদ্ধের কাহিনী শুনিয়েছেন। যুগ যুগ ধরে সূতদের মুখে মুখে বংশ পরম্পরায় যেমন মহাকাব্যের কাহিনী বেঁচে ছিল, তেমনি চারণদের মুখে মুখে সেই কাহিনী কাব্যছন্দে যুগের পর যুগ গীত হয়েছে। তাই রামায়ণ ও মহাভারতের “যে সংকলন আমরা পেয়েছি, তা গড়ে উঠতে লেগেছে কয়েক শতক। তাতে স্পর্শ লেগেছে নানা কবি, গীতিকারের। এইভাবে মূল সামরিক বীরগাথার সাথে যুক্ত হয়েছে ধর্ম, দর্শন, নীতিকথা ইত্যাদি।
রামায়ণ ও মহাভারত দুটিই মহাকাব্য, কিন্তু আকৃতি ও প্রকৃতিতে উভয়ের মধ্যে পার্থক্য দেখা যায়। রামায়ণ তুলনায় প্রাচীন রচনা, কিন্তু মহাভারতের বিষয় বৈচিত্র্য, তেজস্বীতা রামায়ণের থেকে বেশী। উভয় কাব্যের ছন্দ বিন্যাসে অনেক মিল আছে, কিন্তু রামায়ণে তা অধিকতর মার্জিত। মহাভারতের চরিত্রগুলির সামাজিক আবেদন এখন প্রায় নিঃশেষিত, কিন্তু রামায়ণের মুখ্য চরিত্রের সামাজিক আবেদন এখনো যথেষ্ট। মূল মহাভারতের চরিত্রগুলি সবই মানবিক। পশু-পাখির কথা এসেছে দৃষ্টান্ত বা reference হিসেবে। কিন্তু রামায়ণে তৃতীয় কাণ্ড থেকে দৈত্য, বানর ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে স্থান পাওয়ায় সেখানে বাস্তব ও কল্পনার সংমিশ্রণ দেখা যায়। দুটি মহাকাব্যই ভারতবাসীর কাছে পবিত্র গ্রন্থ। কিন্তু পবিত্রতার উৎস এক নয়। রামায়ণে পবিত্রতার উৎস রাম-সীতার চরিত্রভাতি। রাম এখানে অবতার। অন্যদিকে মহাভারতে বর্ণিত নীতিমূলক অংশগুলি, যা পরবর্তীকালে সংযোজিত, কাব্যটিকে পবিত্রতা দিয়েছে।
মহাকাব্য হিসেবে লিখিত রূপ গ্রহণের পূর্বে দীর্ঘকাল রামায়ণের কাহিনী মুখে মুখে প্রচলিত ছিল। চারণকবিরা রামায়ণ গান পরিবেশন করতেন। রামায়ণ প্রথমে গীত হত ঋষিদের তপোবনে। সর্বশেষ অযোধ্যায় রামচন্দ্রের প্রাসাদে অশ্বমেধ অনুষ্ঠানে রামায়ণ গান পরিবেশিত হয়। অঞ্চলভেদে শ্রোতাদের মনোরঞ্জনের প্রয়োজনে রামগানের বিষয়বস্তু পরিবর্তিত ও সংযোজিত হত। চারণকবিরা আপন দক্ষতায় সেই রূপান্তরের কাজ সম্পন্ন করতেন। বাল্মিকী রামায়ণের লিখিত রূপ দেন। তবে তিনি একক প্রচেষ্টায় একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে রামায়ণ রচনা করেছিলেন—এমন ধারণা যুক্তিসিদ্ধ নয় বলেই পণ্ডিতদের অনুমান। রামায়ণের মূল কাহিনীর বিন্যাস ঘটেছে অযোধ্যাকাণ্ড ও যুদ্ধকাণ্ডের মধ্যে। প্রাথমিক পর্বে মূল রামায়ণের নায়ক রামচন্দ্র ছিলেন একজন আদর্শ মানব। উত্তরকাণ্ড ও বালকাণ্ড পরবর্তীকালের সংযোজন। এখানে রামচন্দ্র বিন্নুর অবতাররূপে চিত্রিত হয়েছেন। এইভাবে রাজপুত্র থেকে জাতীয়নেতা এবং শেষে বিষ্ণুর অবতার হিসেবে রামচন্দ্রের ক্রম রূপান্তর রামায়ণে দেখা যায়।
রামায়ণ মহাকাব্য হলেও এর কাহিনী সমকালীন সমাজ ব্যবস্থার আভাস দেয়। দক্ষিণভারতে আর্য সংস্কৃতির বিস্তার এবং আর্য-অনার্য সংঘর্ষের ঐতিহ্য রামায়ণে আভাসিত। দাক্ষিণাত্য ও দক্ষিণ ভারতে আর্যসংস্কৃতির প্রসারের উদ্ভাবিত পদ্ধতি হিসেবে রামায়ণের দু’টি বৈশিষ্ট্য স্মরণ করা যায়। আর্য ঋষিরা গোদাবরী নদীর তীরে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে ধর্মপ্রচারের মাধ্যমে আর্য সংস্কৃতির প্রসার ঘটাতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। অন্যদিকে অনার্যদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে অনার্যদের দুর্বল করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। বালি-সুগ্রীবের সংঘাত এবং রামচন্দ্রের ভূমিকা, এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়। অনার্য সংস্কৃতির প্রতীক হিসেবে লঙ্কেশ্বর রাবণের উপস্থাপনা এবং রাজা রাবণের বিলাস ও সামরিক শক্তি থেকে বোঝা যায় যে, অনার্যরাও যথেষ্ট শক্তি ও বৈভবের অধিকারী ছিলেন।
ডা. প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ তাঁর ‘প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাস’ গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন যে, দু’টি মহাকাব্যের মধ্যে রামায়ণ অধিক জনপ্রিয়। কারণ বাল্মিকী তাঁর কাব্যে সহজ, সরল, প্রাঞ্জলভাবে মানুষের মনের কথা ব্যক্ত করেছেন। তাঁর মতে, উত্তরকাণ্ডের অংশ মূল বাল্মিকী রামায়ণের অংশ নয়। রামচন্দ্রের অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তনের পরই বাল্মিকী রামায়ণ সমাপ্ত হয়েছে। তাছাড়া রামায়ণের নানা আঞ্চলিক সংস্করণে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মনোরঞ্জনের জন্য মূল কাহিনীর পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংযোজন করা হয়েছে। বাল্মিকী রামচন্দ্রকে ‘অবতার’ রূপে উপস্থাপন করেননি। তাঁর রামচন্দ্র নরচন্দ্রমা। উপনিষদের সেই চিরন্তন বাণী ‘আনন্দ হতেই জীবের জন্ম, আনন্দেই জীবনযাপন এবং অবশেষে আনন্দেই লয়’, (‘আনন্দাদ্ব্যোর খল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে, আনন্দেন জাতানি জীবন্তি, আনন্দং প্রয়ন্ত্যভিসং বিশন্তি’) এ-সত্য বাল্মিকী বিস্মৃত হন নি। তাই সীতার পাতাল প্রবেশ মূল রামায়ণে স্থান পায়নি। কৃত্তিবাসী রামায়ণে সীতার জীবন কেবল দুঃখময়। কিন্তু বাল্মিকী দশরথ, রামচন্দ্র, সীতা ও লক্ষ্মণ, ভরত প্রমুখের মাধ্যমে আদর্শপিতা, আদর্শ পুত্র, পতিব্রতা স্ত্রী ও আদর্শবান ভায়েদের ছবি আঁকতে চেয়েছেন। এ-জন্য রামায়ণের মূল কাহিনীর মধ্যে ভারতবাসী তাঁর নিজের দৈনন্দিন জীবনের স্পর্শ খুঁজে পান। প্রক্ষিপ্ত অংশে রামচন্দ্র অবতাররূপে প্রতিভাত হলে তাঁর স্থান মানুষের হৃদয়ের পরিবর্তে মন্দিরের কোণে পরিবর্তিত হয়ে যায়।
মহাভারত রামায়ণের চেয়ে বৃহৎ কাব্য এবং বিশ্বসাহিত্যে এত বড় মহাকাব্য আর নেই। সম্পূর্ণ মহাভারত একসাথে রচিত হয়নি। পর্যায়ক্রমে এই মহাগ্রন্থের সংযোজন ও পরিবর্ধন ঘটেছে। প্রথমে মহাভারতে শ্লোকের সংখ্যা ছিল চব্বিশ হাজার। পরিণত পর্বে শ্লোকের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে এক লক্ষ। ব্যাসদেব প্রথমে এই মহাকাব্য শুনিয়েছিলেন তাঁর শিষ্য বৈশাম্পায়নকে। জন্মেজয়ের সর্পযজ্ঞে তিনি সেই কাব্যকথা আবৃত্তি করেন। সূত উগ্রশ্রবন সেই কাহিনী শ্রবণ করে শৌনিক মুনির যজ্ঞানুষ্ঠানে আবৃত্তি করেন। অর্থাৎ মহাভারতের তিনটি সংস্করণের কথা মহাকাব্যেই উল্লেখ করা হয়েছে। খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকে পাণিনির আমল থেকে কয়েক শতক এটি ‘পাণ্ডবকাব্য’ নামে পরিচিত ছিল। আনুমানিক খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতকে কৃষ্ণের ক্রমবর্ধমান সক্রিয়তা বর্ণনা প্রসঙ্গে মহাভারতের কলেবর বৃদ্ধি পেয়েছে। দ্বিতীয় ও চতুর্থ খ্রিস্টাব্দের অন্তবর্তী দুশো বছরে শিক্ষামূলক অংশগুলি যুক্ত হওয়ার ফলে এর আয়তন আরো বৃদ্ধি পায়।
মহাভারতে আখ্যানের মধ্যে আখ্যানের সৃষ্টি হলে এর আয়তন বৃদ্ধি পায়। শকুন্তলা-দুষ্মন্ত (আদিপর্ব), নল-দময়ন্তী (বন পর্ব), রামচন্দ্রের কাহিনী, সাবিত্রী-সত্যবান, বিশ্বামিত্র-বশিষ্ট (বন পর্ব) ইত্যাদি বিচিত্র ঘটনাবলী আখ্যানের মধ্যে স্থান পেয়েছে। শান্তি ও অনুশাসন পর্ব মহাভারতের গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। এখানে মহামতি ভীষ্মের মুখ দিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষামূলক উপদেশাবলী বিবৃত হয়েছে। বিষুসহস্রনাম এবং ভগবদ্গীতা মহাভারতের অতি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্রাক্কালে অর্জুনের বিষাদ এবং তা নিবারণের জন্য কৃষ্ণের উপদেশাবলী ভগবদ্গীতার বিষয়বস্তু, যা সাধারণভাবে ‘গীতা’ আকারে লিপিবদ্ধ হয়েছে। অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত মনে করেন, গীতা মহাভারতের আগেই রচিত হয়েছিল, পরে মহাভারতের সাথে যুক্ত করা হয়েছে। আর. কে. ভাণ্ডারকর, তিলক প্রমুখের মতে, গীতা খ্রিষ্টপূর্ব নবম ও চতুর্থ শতকের অন্তর্বর্তীকালে রচিত হয়েছে এবং যোগ্য কারণেই মহাভারতের যোগ্যস্থানে যুক্ত হয়েছে। প্রাচীনকালে গীতা হয়তো একান্তভাবে বৈষুবদের কিংবা ভাগবত ধর্মাবলম্বীদের সাম্প্রদায়িক গ্রন্থ বলে বিবেচিত হত। কিন্তু বর্তমানে গীতা হিন্দুসমাজের সার্বজনীন গ্রন্থ। অদ্বৈতবাদী শংকর (৮ম শতক), বিশিষ্টাদৈতবাদী রামানুজ (১১শ শতক) কিংবা দ্বৈতবাদী মাধ্বাচার্য (১৩শ শতক) সকলেই নিজ নিজ মতবাদ সমর্থন করার জন্য গীতার ভাষ্যকেই ব্যবহার করেছেন। রচনাশৈলী, ভাষার মাধুর্য ইত্যাদির বিচারে গীতা কাব্য হিসেবেও উচ্চ স্থান পেতে পারে। কিন্তু গীতা প্রথমে ধর্মগ্রন্থ, পরে কাব্য। মহাভারতের পরিশিষ্ট (খিল) হিসেবে পরিচিত ‘হরিবংশ’ মহাভারতের মত একাধিক পর্যায়ের মধ্য দিয়ে পরিণত রূপ পেয়েছে। হরিবংশের দু’টি ভাগ : হরিবংশ পর্ব ও বিষ্ণুপর্ব।
মহাভারতের মূল বিষয়বস্তু কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ, যেখানে দুই আত্মীয়-প্রতিপক্ষ কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যে সংঘর্ষের বিস্তারিত কাহিনী ও বিচিত্র ঘটনাবলী স্থান পেয়েছে। কাহিনী বিন্যাসের মধ্যে প্রাসঙ্গিকভাবে উঠে এসেছে কূটনীতি, রাষ্ট্রনীতি, ন্যায়পরায়ণতা, শৌর্য-বীর্য ইত্যাদির পাশাপাশি সমকালীন সমাজব্যবস্থা, আচার-অনুষ্ঠান ইত্যাদির বিবরণ। এ্যানি বেশান্তের মতে, ‘নীতিগ্রন্থ হিসেবে দর্শনশাস্ত্র হিসেবে এবং ইতিহাস হিসেবে মহাভারত সত্যই মহান ভারতের পরিচয় বহন করিতেছে।” বিশিষ্ট সাধক আনন্দতীর্থ তাঁর ‘মহাভারতের তাৎপর্য নির্ণয়’ গ্রন্থে লিখেছেন যে, মহাভারতের বীরগণের জীবনকাহিনীর মধ্য দিয়ে ভারতীয় দর্শনের মৌলিক আদর্শ ব্যক্ত হয়েছে। সমকালীন ভারতবর্ষে একাধিক স্বতন্ত্র ও স্বাধীন রাজ্যের অস্তিত্ব এই মহাকাব্য থেকে জানা যায়। পাণ্ডব ও কৌরবদের পক্ষে যোগদানকারী বিভিন্ন রাজ্যের অস্তিত্ব সমকালীন ভারতে আঞ্চলিক রাজ্য গঠন। প্রক্রিয়ার আভাস দেয়। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে পাণ্ডবদের জয়লাভের পর হস্তিনাপুরকে কেন্দ্র করে শক্তিশালী কুরু রাজ্যের প্রতিষ্ঠা ভারতীয় রাজনীতিতে কেন্দ্রীকরণ প্রবণতার আভাস দেয়। কৃষ্ণ রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার কাজে মুখ্য সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সামাজিক জীবনের আভাসও এই মহাগ্রন্থ থেকে চয়ন করা সম্ভব। সত্যের জয় এবং অন্যায়ের বিনাশ অবশ্যম্ভাবী এই শাশ্বত বার্তা। মহাভারত থেকে পাওয়া যায়। যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন প্রমুখ যথাক্রমে সত্যবাদিতা, শৌর্য ও নেতৃত্বের প্রতীকরূপে প্রতিভাত হয়েছেন। ভীষ্ম শুনিয়েছেন জগত সংসারের অনিবার্যতার কাহিনী। দ্রৌপদী আদর্শ পত্নী হিসেবে একইসাথে সংসার ও রাজনীতির অঙ্গনে পদচারণা করেছেন। দ্রৌপদীর পঞ্চস্বামী তত্বের মধ্য দিয়ে অনার্য সভ্যতার বৈশিষ্ট্য প্রকাশের চেষ্টা দেখা যায়।
প্রাচীন ভারতের অন্যান্য সাহিত্য :
ব্রাহ্মণদের পাশাপাশি বৌদ্ধ পণ্ডিতরাও সংস্কৃত ভাষায় সাহিত্যচর্চা করেছিলেন। সংস্কৃত কাব্যের জনপ্রিয়তা উপলব্ধি করে তাঁরাও বৌদ্ধধর্ম প্রচারের মাধ্যম হিসেবে সংস্কৃত ভাষায় কাব্য-সাহিত্য চর্চায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। বৌদ্ধ সংস্কৃত চর্চার দুটি মূল্যবান উপহার হল ‘মহাবস্তু’ ও ‘ললিতবিস্তার। খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে মহাসঙ্ঘিক সম্প্রদায়ের উপ-শাখা লোকোত্তর গোষ্ঠী ‘মহাবস্তু’ রচনা করেন। খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকে সর্বাস্তিবাদীগণ রচনা করেন ‘ললিত বিস্তার’। বহু ব্রাহ্মণ বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করার ফলে সংস্কৃত ভাষায় বৌদ্ধ সাহিত্য সৃষ্টি ও চর্চার কাজ নতুন গতি পেয়েছিল। নাট্যকার অশ্ব ঘোষ কাব্য রচনার কাজেও সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তাঁর দুটি বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘সৌন্দ্রানন্দ’ ও ‘বুদ্ধচরিত’যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিল। বুদ্ধচরিত কাব্যে রামায়ণের রাম ও সীতার অনুকরণে শুদ্ধোধন ও সুন্দরী চরিত্রদ্বয়ের অবতারণা তাঁর অসাধারণ কবি প্রতিষ্ঠার সাক্ষ্য দেয়। তাঁর বুদ্ধচরিত গ্রন্থ একদিকে আদি কবি বাল্মিকী, অন্যদিকে কবিশ্রেষ্ঠ কালিদাসের মধ্যে যোগসূত্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। অশ্ব ঘোষ অলঙ্কার প্রয়োগের ক্ষেত্রে ছিলেন খুব সচেতন। তাঁর ভাষা, ভাবপ্রকাশের ভঙ্গী খুবই সংযত, মিষ্ট এবং প্রশান্ত। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর চিন্তাধারা কোথাও তাঁর কবি-প্রতিভাকে খর্ব করেনি। খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকে অশ্ব ঘোষের সমসাময়িক কবি ছিলেন মাতৃচেত। মধ্য এশিয়া ও তিব্বতে তাঁর বৌদ্ধ স্তোত্রগুলি খুবই জনপ্রিয় ছিল বলে ইৎ-সিং মন্তব্য করেছেন। সংস্কৃত ভাষায় কাব্যচর্চার দৃষ্টান্ত বৌদ্ধ সাহিত্যেও পাওয়া যায়। এপ্রসঙ্গে খ্রিষ্টীয় প্রথম বা দ্বিতীয় শতকে রচিত ‘অবদানশতক’ ও ‘দিব্যবদান’ গ্রন্থ দুটির নাম উল্লেখ্য। মূলত ধর্মপ্রচারের জন্য কাব্যছন্দে এই দুটি বৌদ্ধ অবদান সাহিত্য রচিত হয়েছিল। তাই এগুলিতে কাব্য মাধুর্যের অভাব দেখা যায়।
প্রাক্-গুপ্তযুগের সংস্কৃত কাব্যের প্রকাশে কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল বলে কেউ কেউ মনে করেন। ড. সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের মতে, সেকালের কবিরা রাজানুকূল্যে কাব্যচর্চা করতেন। তাঁদের কাব্যসৃষ্টির মূল প্রেরণা ছিল রাজকীয় মাহাত্ম্য প্রচার করা। তাই স্বাধীন কাব্যপ্রতিভা প্রকাশের সুযোগ তাঁদের ছিল না। এই স্বতঃস্ফূর্ততার অভাব তাঁদের সৃষ্টিগুলিকে কৃত্রিম রূপ দিয়েছিল। ড. এ. এল. ব্যাসামের মতে, সেকালের কাব্যগুলি রাজসভায় পাঠ করার জন্য লেখার রেওয়াজ ছিল। রাজানুগত সভাষদ ও জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিদের কাছে জটিল, অলঙ্কার বহুল বিবরণ বা তত্ত্ব তুলে ধরার তাগিদে এই রচনাগুলিতে যথার্থ আবেগ ও অনুভূতির প্রকাশ বাধা প্রাপ্ত হয়েছিল। তবে সীমাবদ্ধতা থাকলেও সেকালের সংস্কৃত কাব্যগুলিকে সমাজ ও মানুষের দর্শন হিসেবে কৃতিত্ব দিতে হয়।
প্রাচীন ভারতে সংস্কৃত সাহিত্যচর্চার অঙ্গ হিসেবে নাট্য সাহিত্যের অবদানও গুরুত্বপূর্ণ। খ্রিষ্টীয় শতকের আগে মঞ্চে অভিনয়যোগ্য নাটক রচনা হয়েছিল কিনা বলা কঠিন। তবে নাট্যশাস্ত্র সম্পর্কে আলোচনা এবং অভিনয়ের রীতিনীতি, পদ্ধতি ইত্যাদি বিষয়ে গ্রন্থ রচনার কাজ যে শুরু হয়েছিল, তা সত্য। কৌটিল্য নটনবী ও নাট্যমঞ্চের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন। অভিনেতার (নট) উল্লেখ পতঞ্জলির রচনাতেও পাওয়া যায়। তিনি অভিনয়কে রস বিতরণের মাধ্যম বলে উল্লেখ করেছেন। নাট্যশিল্প বিষয়ক উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল ভরত রচিত ‘নাট্যশাস্ত্র’ গ্রন্থ। কাব্যছন্দে লেখা এই গ্রন্থটি খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের রচনা বলে অনেকে মনে করেন। আবার ‘নাট্যশাস্ত্র’ গ্রন্থে ভাষার ব্যবহার এবং সমসাময়িক রচনাগুলিতে এর উল্লেখ ইত্যাদি বিশ্লেষণ করে কেউ কেউ মনে করেন এটি বহু পরবর্তীকালের রচনা। যেমন, ভরত ব্যবহৃত অর্ধ-মাগধী ভাষার ব্যবহার অশ্ব ঘোষ ও ভাসের নাটক ছাড়া অন্যত্র পাওয়া যায় নি। এমনকি, পরবর্তীকালের নাট্যচর্চার ব্যবহৃত মহারাষ্ট্রী প্রাকৃত ভাষার প্রয়োগ নাট্যশাস্ত্রে নেই। তাই অনুমিত হয় যে খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক এবং খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতকের মধ্যবর্তীকালে নাট্যশাস্ত্র রচিত হয়েছিল। নাট্যশিল্প বিষয়ে এই গ্রন্থকে একটি পূর্ণাঙ্গ রচনা বলা যায়। এখানে নাটক উপস্থাপনার প্রতিটি খুঁটিনাটি যেমন নাটকের চরিত্র, অভিনেতাদের অঙ্গ সঞ্চালন, বাচনভঙ্গি, পোষাক, মঞ্চসজ্জা ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তিনি নাটককে ‘পঞমবেদ’ আখ্যা দিয়ে নাট্যশিল্পকে সম্মানিত করেছেন। সমকালীন ও পরবর্তীকালের নাট্যচর্চার ‘নাট্যশাস্ত্র’ গ্রন্থের বিশেষ প্রভাব ছিল।
মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর কিছুকাল ভারতীয় রাজনীতিতে বিদেশী শক্তির প্রতিপত্তি স্থাপিত হয়েছিল। এদের অন্যতম ছিল ব্যাকট্রিয় গ্রীকগন। অনেকের মতে, ভারতীয় নাট্যশিল্প গ্রীক নাটক দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। নাট্যসাহিত্যেও তার প্রভাব দেখা যায়। সম্ভবত গ্রিক প্রভাবের ফলেই নাটকে ‘পর্দা’ অর্থে ‘যবনিকা’ শব্দটি প্রয়োগ করা হয়। তবে এই বিষয়টিকে অনেকেই বেশি গুরুত্ব দিতে অস্বীকার করেছেন। এঁদের যুক্তি হল যে, গ্রীক নাটকের নানা বৈশিষ্ট্য ভারতীয় নাটকে অনুপস্থিত ছিল। যেমন বিয়োগান্ত নাটকের প্রাধান্য, কোরাসের উপস্থিতি গ্রীক নাটকের বিশেষত্ব। কিন্তু ভারতীয় নাটকে এগুলি গুরুত্ব পায়নি। সিলভা লেভী মনে করেন, ভারতের গ্রিকদের উত্তরসূরী ছিলেন শক্ শাসকরা। উজ্জয়িনীর শক্ ক্ষত্রপরা সংস্কৃত নাটকের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। হয়তো তাঁদের মাধ্যমে গ্রীক নাটক ভারতীয় নাট্যচর্চাকে প্রভাবিত করেছিল। এক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার যে, অশ্ব ঘোষের নাটকে যে পরিণত রূপ প্রকাশ পেয়েছে, তাতে নিশ্চিত দীর্ঘ অনুশীলন, পরিমার্জন ও পরিবর্ধনের দ্বারা সংস্কৃত নাটক এই কৃতিত্ব অর্জন করেছে। শক্দের আগমনের পর এত অল্প সময়ের মধ্যে সংস্কৃত নাটকের এহেন পরিণত রূপ প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তাছাড়া শক্দের শব্দার্থ এবং সংস্কৃত নাটকের শব্দার্থ অনুরূপ ছিল না। যেমন রুদ্রদামনের রাজপদ ‘রাষ্ট্রীয়’ এবং শূদ্রক বা কালিদাসের নাটকের চরিত্র ‘রাষ্ট্রীয়’ ছিল স্বতন্ত্র।
প্রাগুপ্ত যুগের সংস্কৃত ভাষার নাট্যকারদের মধ্যে অগ্রণী ছিলেন ভাস। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে গণপতি শাস্ত্রী ভাসের তেরটি নাটক আবিষ্কার করেন। গণপতি শাস্ত্রীর মতে, ভাস কৌটিল্যের পূর্ববর্তী। কিন্তু তিলকের মতে, খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় বা তৃতীয় শতকের পরে নয়। আবার ফণিভূষণ তর্কবাগীশ তাঁকে খ্রিষ্টপূর্ব কালের শেষ পর্বের লেখক বলেছেন। ভাসের নাটকের ভাষা খুব সহজ ও প্রাঞ্জল। সাধারণ মানুষের পক্ষে সহজবোধ্য হওয়ায় ভাসের নাটকগুলি জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। স্বয়ং কালিদাস ভাসকে দক্ষ নাট্যকার বলেছেন। বস্তুত কালিদাসের কল্পনার গভীরতা না থাকলেও বহিঃপ্রকৃতির সাথে মানুষের যোগাযোগ ফুটিয়ে তুলতে তিনি সক্ষম হয়েছিলেন। ভাসের তেরটি নাটকের মধ্যে কেবল ‘চারুদত্ত’ নাটকটি অসম্পূর্ণ অবস্থায় পাওয়া গেছে। অবশিষ্ট বারোটি নাটক সম্পূর্ণ অবস্থায় আছে। তাঁর ছয়টি নাটকের বিষয়বস্তু মহাভারত থেকে নেওয়া। দুটি নাটকের কাহিনী রামায়ণের এবং একটির বিষয়বস্তু কৃষ্ণের কাহিনী। অবশিষ্ট চারটি নাটকের কাহিনী প্রচলিত লোককথা থেকে নেওয়া। ভাসের নাটকগুলির মধ্যে ‘স্বপ্নবাসবদত্তা’ শ্রেষ্ঠ বিবেচিত হয়। বৎসরাজ উদয়ন ও তাঁর স্ত্রী অবন্তীর রাজকন্যা বাসবদত্তা এই নাটকের নায়ক-নায়িকা। গোটা নাটকে তিনি দুজনের পারস্পরিক গভীর ভালবাসাকে নানাভাবে রূপ দিয়েছেন। কাব্যিক উচ্ছাস তাঁর নাট্য চেতনাকে আচ্ছন্ন করতে পারেনি। নাটকীয় ভাব প্রকাশে তিনি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তবে কিছু সীমাবদ্ধতা ভাসের রচনাতেও আছে। যেমন তিনি একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি বার বার করেছেন। তাঁর নাটকে দৈব মহিমা ও জাদুশক্তির প্রভাব গুরুত্ব পেয়েছে। ফলে নাটকের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়েছে। তাঁর অন্যান্য নাটকগুলি হল ‘মধ্যম-ব্যায়োস’, ‘দূত ঘটোৎকচ’, ‘কর্ণভার’, ‘উরুভঙ্গ’, ‘বালচরিত’ ইত্যাদি।
ভাসের পর সংস্কৃত নাট্যকার হিসেবে অশ্ব ঘোষের নাম গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ছিলেন কুষাণ রাজ কণিষ্কের সমসাময়িক। খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকের শেষভাগ বা দ্বিতীয় শতকের প্রথম ভাগে তিনি জীবিত ছিলেন। একদলের মতে, অশ্ব ঘোষ অযোধ্যার মানুষ। আবার কারো মতে কাশী বা পাটনার অধিবাসী ছিলেন। তাঁর পিতার নাম সৌম্যগুহ্য এবং মাতার নাম সুবর্ণাক্ষী। ব্রাষ্মণ সন্তান অশ্ব ঘোষ সুগায়ক ছিলেন। পরে আর্যদেবের কাছে (মতান্তরে পার্শ্ব) বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা নেন। কাব্য রচনার পাশাপাশি নাটক রচনাতেও তিনি সিদ্ধ হস্ত ছিলেন। তাঁর বিভিন্ন নাটকের অংশ বিশেষ মধ্য এশিয়ার তুরফানে পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে বিশেষ জনপ্রিয় নাটকটি ছিল ‘সারিপুত্রপ্রকরণ’। সারিপুত্তল মৌদগল্লায়নের বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণের কাহিনী-ভিত্তিক এই নাটকটি সংস্কৃত সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ বলে বিবেচিত হয়, নাটক রচনার ক্ষেত্রে অশ্বঘোষ ভরত বর্ণিত নাট্যশাস্ত্র অনুসরণের চেষ্টা করেছেন। আন্তরিকভাবে। অন্যান্য নাটক রূপক বা প্রহসন ধর্মী। ফরাসি পণ্ডিত সিলভা লেভী অশ্বঘোষের সাহিত্য প্রতিভাকে ভাব ও বৈচিত্র্যের দিক থেকে মিল্টন, গ্যেটে বা কান্টের সমতূল্য বলে মন্তব্য করেছেন।
এ যুগের অন্যতম বিশিষ্ট নাট্যকার ছিলেন শূদ্রক। অনেকের মতে তিনি সাতবাহন রাজবংশের সাথে সম্পর্কিত ছিলেন। তাঁর বিখ্যাত সৃষ্টি ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটক। শূদ্রক এই নাটকটি কালিদাসের আগে নাকি পরে লিখেছিলেন, তা স্পষ্ট নয়। কথাসরিৎ, দশকুমারচরিত, রাজতরঙ্গিনী প্রভৃতি গ্রন্থে এই নাটকের উল্লেখ আছে। তবে শূদ্রক তাঁর নাটকের মূল ঘটনাটি নিয়েছিলেন ভাসের ‘চারুদত্ত’ থেকে। এই নাটকে বসন্ত সেনা ও চারুদত্তের প্রণয় কাহিনীর সাথে যুক্ত হয়েছে একটি রাজনৈতিক ঘটনা। নাটকটি দশ অঙ্কে বিভক্ত একটি প্রকরণ। নাটকে তৎকালীন জীবনের বিশ্বস্ত ছবি তুলে ধরা হয়েছে। নাটকে চরিত্রগুলি সমাজের সাধারণ মানুষ। তাদের মুখে কঠিন সংস্কৃতের পরিবর্তে নানা প্রাকৃত ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। নায়িকা বসন্তসেনা কিছু কিছু কথা সংস্কৃত ভাষায় বললেও, মূলত প্রাকৃত ভাষায় কথা বলেছেন। তাই মৃচ্ছকটিক যতটা সংস্কৃত নাটক, ততোধিক প্রাকৃত নাটক। তবে কথ্য ভাষা অর্থাৎ প্রাকৃত ভাষা স্থান বিশেষে ভিন্ন রূপ হয়। কালিদাসের সমসাময়িক বররুচি তাঁর প্রাকৃত ব্যাকরণে প্রাকৃতের চারটি বৈচিত্র্যর উল্লেখ করেছেন-সৌরসেনী, মহারাষ্ট্রী, মাগধী ও পৈশাচী। এ ছাড়াও অবন্তী, অভিরী, অপভ্রংশ ইত্যাদি প্রাকৃতের আরো বিভাগ আছে। নাটকের বিভিন্ন চরিত্র তাদের অবস্থান অনুসারে প্রাকৃতের নানা রূপের ব্যবহার করেছেন।
আলোচ্য কালে সংস্কৃত সাহিত্যের অন্যান্য শাখাগুলিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এক্ষেত্রে স্মরণীয় সৃষ্টি হল ‘পুরাণ সমগ্র’। পুরাণ সমূহের রচনাকাল খুব স্পষ্ট নয়। তবে পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে পণ্ডিতদের অনুমান যে, অষ্টাদশ পুরাণ একই সময়ের রচনা নয়। এদের অনেকগুলিই প্রাক্-গুপ্ত যুগে লেখা হয়েছিল। গুপ্তযুগে পুরাণের সংশোধন, পরিবর্ধন অব্যাহত ছিল। অর্থাৎ খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ শতক থেকে ৭৫০ খ্রিস্টাব্দের অর্ন্তবর্তী কালে আঠারোটি পুরাণ পরিণত রূপ পেয়েছিল। বেদ, উপনিষদের জটিল ধর্মতত্ত্ব সাধারণ মানুষের পক্ষে সহজবোধ্য ছিল না। তাই সর্ব সাধারণের ধর্ম শিক্ষার জন্য পুরাণ সৃষ্টি করা হয়েছে। ইতিহাস-পুরাণ ‘পঞ্চম বেদ’ নামে অভিহিত হয়। জনশিক্ষার বাহন হিসেবে এই গ্রন্থের গুরুত্ব অসীম। তবে ইতিহাস-পুরাণকে ‘ইতিহাস’ বলে গ্রহণ করা যায়। না কারণ ঠাকুরমার ঝুলির গল্পের মতো বহু অতিরঞ্জিত গল্প পুরাণে আছে। আঠারোটি পুরাণই ব্যাসদেবের শুনা বলে সাধারণের বিশ্বাস। বিয়ু, পদ্ম, বায়ু, ভাগবত, ব্রহ্মবৈবর্ত ও মার্কণ্ডেয় পুরাণ অধিক জনপ্রিয়। পুরাণের উল্লেখ অথর্ববেদে পাওয়া যায়। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের পুরাণের উল্লেখ আছে। কৌটিল্য ও পতঞ্জলির রচনা থেকে জানা যায় যে মৌর্য ও শুঙ্গ যুগে পুরাণ থেকে আবৃত্তি করা হত। অর্থাৎ পুরাণ অতি প্রাচীন কালের সাহিত্য, তবে সেই সব পুরাণ হয়তো পরিবর্তিত হয়ে বর্তমান আকার পেয়েছে। বর্তমান অষ্টাদশ পুরাণ একাদশ শতকের আগেই রচিত হয়েছিল। কারণ সুলতান মামুদের ভারত অভিযানের সময় তাঁর সাথে আগত পণ্ডিত অলবেরুণী অষ্টাদশ পুরাণের উল্লেখ করেছেন। সপ্তম শতকে কবি বানভট্ট তাঁর গ্রামে বায়ুপুরাণের পাঠ শুনেছেন বলে দাবি করেন। বিষ্ণুপুরাণে মৌর্য বংশীয় রাজাদের (খ্রিঃপূঃ ৩২১-১৮৭ অব্দ), মৎসপুরাণে অন্ধ্র রাজাদের (দ্বিতীয় শতক), বায়ুপুরাণে গুপ্তরাজা প্রথম চন্দ্রগুপ্তের (৩২০-৩৪০ খ্রিঃ) রাজত্বের বর্ণনা আছে। উইনটারনিজের মতে প্রাচীন পুরাণগুলি সপ্তম শতকের আগেই রচিত হয়েছিল।
ব্রাহ্মণ্যবাদ প্রতিষ্ঠার কাজে ধর্মসূত্রগুলির অবদান অনস্বীকার্য। বর্ণ ও জাতির বৈচিত্র্যের মধ্যে সমন্বয় বিধানের জন্য ধর্মসূত্র রচনার প্রয়োজন অনুভূত হয়। বস্তুত প্রধান তিনটি ধর্মসূত্র গৌতম ধর্মসূত্র, বৌধায়ন ধর্মসূত্র এবং আপস্তম্ভ ধর্মসূত্রগুলি খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ শতকের মধ্যেই রচনা সম্পন্ন হয়েছিল। ধর্মসূত্রের উপর ভিত্তি করেই স্মৃতিশাস্ত্রগুলি লেখা হয়। স্মৃতি পর্যায়ের প্রাচীনতম গ্রন্থের লেখক মনু। সাধারণভাবে মনে করা হয় যে খ্রিষ্টপূর্ব ২০০ থেকে খ্রিষ্টীয় ২০০ অব্দের মধ্যে এই গ্রন্থ রচনা সম্পূর্ণ হয়েছিল। মনুস্মৃতি লেখা হয় বিভিন্ন পর্যায়ে। মনুস্মৃতির বিষয়বস্তু ধর্ম ও দৈনন্দিন বাস্তব জীবনের মধ্যে সমন্বয় সাধনের নিয়মাবলি। মনুস্মৃতির বাস্তববাদী বৈশিষ্ট্যটি গুরুত্বপূর্ণ। মনু জীবনকে অস্বীকার করতে বলেননি। বরং তাকে গ্রহণ ও উন্নত করার বিধান দিয়েছেন। ভারতের আদি দেওয়ানি আইনবিধি হিসেবে মনুস্মৃতি গুরুত্বপূর্ণ। এখানে প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে চলার কথা বলা হয়েছে। মনুস্মৃতি একাধারে বর্ণাশ্রম ধর্ম, রাজধর্ম, স্বামী-স্ত্রীর কর্তব্য, দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইন, প্রায়শ্চিত্ত ব্যবস্থা এবং দার্শনিক তত্ত্ব।
মনুস্মৃতির আদর্শে আরো স্মৃতিশাস্ত্র রচিত হয়েছিল। এদের মধ্যে যাজ্ঞবল্ক স্মৃতি, নারদ স্মৃতি, বৃহস্পতি স্মৃতি, কাত্যায়ন স্মৃতি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। বিভিন্ন স্মৃতির রচনাকাল নিয়ে মতভেদ আছে। সাধারণভাবে মনে করা হয় যাজ্ঞবল্কস্মৃতি চতুর্থ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে লেখা হয়েছিল। নারদস্মৃতি পঞ্চম খ্রিস্টাব্দে, বৃহস্পতিস্মৃতি পঞ্চম বা ষষ্ঠ শতকে এবং কাত্যায়নস্মৃতি ষষ্ঠ শতকের মধ্যে সম্পূর্ণ হয়েছিল। প্রতিটির ক্ষেত্রেই দীর্ঘসময় ধরে সংকলনের কাজ হয়েছিল। এই কালপর্বে রচিত হয় রাজনীতি বিষয়ক গ্রন্থ অর্থশাস্ত্র, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যর প্রধান পরামর্শদাতা ও মন্ত্রি চাণক্য ‘কৌটিল্য’ ছদ্মনামে এই গ্রন্থ লেখেন। আনুমানিক ৪০০ খ্রিস্টাব্দে এটি রচিত হয়েছিল। কারো কারো মতে কৌটিল্যের মতামতকে ভিত্তি করে পরবর্তীকালে অর্থশাস্ত্র সংকলিত হয়েছিল। যাইহোক, প্রশাসনের স্বরূপ, রাজার কর্তব্য, আইনবিধি ও দণ্ডবিধি, সমাজ, অর্থনীতি ইত্যাদি প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয়ে অর্থশাস্ত্র গ্রন্থে আলোচনা আছে। এমনকি, চিকিৎসাশাস্ত্রের নানা দিক যেমন শিশুর যত্ন, বিষক্রিয়ার প্রতিষেধক, গর্ভবতী নারীর শুশ্রুষা ইত্যাদি বিষয়েও কৌটিল্য আলোচনা করেছেন। চিকিৎসাশাস্ত্রের উপর লেখা এই যুগের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হল ‘চরক সংহিতা”। বৌদ্ধ ঐতিহ্য অনুসারে চরক প্রথম কনিষ্কের চিকিৎসক ছিলেন। তবে চরকের মূল গ্রন্থটি পাওয়া যায়নি। নবম শতকে কাশ্মীরের দৃঢ়বল কর্তৃক সংকলিত ‘চরক সংহিতার’ একটি পরিবর্তিত সংস্করণ পাওয়া গেছে। এমনই আর একটি গ্রন্থ ‘শুশ্ৰুত সংহিতা”। সম্ভবত চরকের কিছু আগের শুশ্রুত এটি রচনা করেছিলেন। এতে নানা রোগ ও তার প্রতিকার, ঔষধ ইত্যাদির পাশাপাশি অস্ত্রোপচারের পদ্ধতি বিষয়েও আলোচনা আছে। খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতকে লেখা একটি চিকিৎসা বিষয়ক গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি কাসগড়ে পাওয়া গেছে (১৮৯০ খ্রিঃ)। এতে চিকিৎসা বিষয়ক আলোচনার সাথে সাথে পূর্বসূরী চিকিৎসক ও লেখকদের নামের তালিকা আছে। এখান থেকেই আত্রেয়, ক্ষারপানি, পরাশর, হারীত, শুশ্রুত প্রমুখের নাম জানা যায়। খ্রিষ্টীয় ২০০ শতকের লেখা আরো একটি চিকিৎসাগ্রন্থের পাণ্ডুলিপি পূর্ব তুর্কীস্থানে পাওয়া গেছে। সাহিত্যগুণ বা কাব্য মাধুর্য কম হলেও সংস্কৃত ভাষায় লেখা চিকিৎসাশাস্ত্রগুলি সংস্কৃত ভাষা সাহিত্যের অমূল্য নিদর্শন ছিল।
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।