প্রাচীন ভারত-ইতিহাস পুনর্গঠন

আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “প্রাচীন ভারত-ইতিহাস পুনর্গঠন” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।

প্রাচীন ভারত ও ইতিহাস চর্চা :

প্রাচীন ভারতে যথার্থ ইতিহাসচর্চার রেওয়াজ ছিল না, এ বিষয়ে প্রায় সকলে সহমত। তবে কালানুক্রমিক বা ধারাবাহিক সভ্যতার বিবরণ লিপিবদ্ধ না করা হলেও, ভারতীয় ঐতিহ্যকে মহাকাব্য, পুরাণ বা সাহিত্যকর্মের (ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ) মধ্যে ধরে রাখার একাধিক দৃষ্টান্ত আছে। তাই বিশিষ্ট ইংরেজ ভারতবিদ এ. এল. ব্যাসাম স্বীকার করেছেন যে, ভারতের প্রাচীন সভ্যতার ধারা অবিচ্ছিন্নভাবে প্রবহমান এবং এখানকার মানুষ তার প্রাচীন ঐতিহ্য সম্পর্কে পূর্ণভাবে সচেতন। তিনি লিখেছেন, ‘সভ্যতার উদয় পৃথিবীর একাধিক দেশেই প্রাচীনকালে ঘটেছে। কিন্তু ভারত ও চিনের সভ্যতা যেমন ছেদহীন ও প্রবহমান, তেমনটি আর কোথাও নয়।’ এটি পরম্পরাগত জ্ঞান বিস্তারের ফল। যদিও প্রাচীন ভারতের ইতিহাসচর্চার কাজ শুরু হয়েছে অনেক পরে, অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে এবং সেই কাজে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন ইউরোপীয়গণ।

উপনিবেশবাদী ইতিহাস চর্চা :

প্রাথমিকভাবে গ্রীক্ ও ল্যাটিন রচনাবলীতে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত উল্লেখ ভারত ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞান লাভের প্রধান অবলম্বন ছিল। কলহনের ‘রাজতরঙ্গিনী’র মত কিছু ব্যতিক্রমী রচনা এই কাজে সহায়ক ছিল। এ ছাড়া বেদ, পুরাণ, মহাকাব্য, জৈন ও বৌদ্ধ শাস্ত্র ইত্যাদি থেকে সভ্য, অর্ধসভ্য, কল্পনা, বিশ্বাস, সম্ভাবতাবোধ ইত্যাদির সমন্বয়ে সৃষ্ট একধরনের জীবনকথা উদ্ধার করা যেত, যাকে যথার্থ ইতিহাস বলা যায় না। খ্রিস্টান মিশনারীদের কিছু দরদী সদস্য নিষ্ঠার সাথে তাঁদের সমসাময়িক ভারতকে উপলব্ধি করার প্রথম চেষ্টা করেন। কিন্তু ভারতবর্ষের আদি সংস্কৃতি বা জীবনধারার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট উদ্ধার করার প্রয়াস তাঁদের ছিল না। তাঁরা সমকালকেই ভারতীয় জীবনচর্চার আদি-অন্ত বলে ধরে নিয়েছিলেন। ফলে তা ইতিহাসের উপজীব্য হতে পারেনি।

অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয় পর্বে মূলত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের প্রয়োজনে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস পুনর্গঠনের আধুনিক প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা সুবার ‘দেওয়ানি’ অধিকার অর্জনের ফলে ভারতের প্রাচীন আইনকানুন সম্পর্কে কোম্পানির কর্মচারীদের অবহিত করার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে প্রাচীন ভারতের সামাজিক -আইনপুস্তকরূপে স্বীকৃত ‘মনুস্মৃতি’র ইংরেজি অনুবাদ সম্পন্ন করা হয়। প্রাচীন কালে ভারতে প্রচলিত আইনকানুন ও রীতিনীতি অনুধাবনের কাজে নতুন গতিবেগ আসে ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে ‘এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গল’ প্রতিষ্ঠার পর। কোম্পানির পদস্থ কর্মচারী ও প্রাচ্যবাদী পণ্ডিত স্যার উইলিয়াম জোনস (১৭৪৬-৯৪ খ্রিঃ)-এর উদ্যোগে ও সভাপতিত্বে গঠিত এই সংস্থা সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্যের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। জোনস্ কালিদাসের ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলা’ ইংরেজিতে অনুবাদ করেন (১৭৮৯ খ্রিঃ)। এরপর তিনি অনুবাদ করেন ‘গীতগোবিন্দ’ এবং ‘মনুর অনুশাসন’। তাঁর মৃত্যুর পর মনুর অনুশাসনটি ‘ইন্সটিটিউটস্ অফ হিন্দু ল’ নামে প্রকাশিত হয় (১৭৯৪ খ্রিঃ)। ইতিমধ্যে বিশিষ্ট সংস্কৃতজ্ঞ ও ইংরেজ কর্মচারী তথা প্রাচ্যবিদ চার্লস উইলকিন্‌স (১৭৪৯-১৮৩৬ খ্রিঃ) ‘ভগবদ্গীতা’ (১৭৮৪ খ্রিঃ) এবং ‘হিতোপদেশ’ (১৭৮৭ খ্রিঃ) সংস্কৃত থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে ভারতচর্চার কাজ অনেকটা এগিয়ে দিয়েছিলেন। ভারততত্ত্ব বিদ্যার পথিকৃৎ জোনস্ ও উইলকিনস্-এর কাজে উৎসাহিত হয়ে প্রাচ্য সংস্কৃতি চর্চার কাজকে এগিয়ে নিয়ে যান হেনরী কোলব্রুক (১৭৬৫-১৮৩৭ খ্রিঃ), হোরেস হেম্যান উইলসন (১৭৮৯-১৮৬০ খ্রিঃ) প্রমুখ।

প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃত সাহিত্যের অনুবাদ পাঠ করে ইউরোপীয়দের মধ্যে সংস্কৃত সাহিত্য বিষয়ে আগ্রহ বাড়তে থাকে। উইলিয়াম জোন্‌স প্রচার করেন যে, ইউরোপীয় ভাষাগুলির সাথে সংস্কৃত ও ইরানীয় ভাষার প্রভূত মিল আছে। এর ফলে জার্মানি, ফ্রান্স, রাশিয়া প্রভৃতি দেশে ভারততত্ত্ব সম্পর্কে জ্ঞানান্বেষনের আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দে ‘কলেজ দ্য ফ্রান্স’-এ সংস্কৃত অধ্যাপনার চেয়ার প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮১৮ থেকে জার্মানির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত অধ্যাপনার পদ সৃষ্টি হতে থাকে। ১৮২১ ও ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে যথাক্রমে প্যারিস ও লন্ডনে দু’টি এশিয়াটিক সোসাইটি স্থাপিত হলে ইউরোপে প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যের অনুবাদ, সম্পাদনা ও ভারততত্ত্ব সম্পর্কে পঠনপাঠন জনপ্রিয় হতে থাকে।

প্রাচীন ভারততত্ত্ব চর্চার ক্ষেত্রে একটি স্মরণীয় নাম হল জার্মান পণ্ডিত ফ্রেডরিখ ম্যাক্সমূলার (১৮২৩-১৯০২ খ্রিঃ)। সংস্কৃতজ্ঞ এই পণ্ডিতের কর্মজীবনের বেশিরভাগটাই অতিবাহিত হয়েছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের প্রধান অধ্যাপকরূপে। ফলে ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকে একটা দৃঢ় তাত্ত্বিক ভিত্তি দেওয়ার তাগিদও তাঁর মধ্যে সক্রিয় ছিল। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহ ও গণজাগরণের প্রেক্ষিতে ইংরেজ সরকার উপলব্ধি করেছিল যে, শাসিত জনগোষ্ঠীর সামাজিক বৈশিষ্ট্য, রীতিনীতি, উপজাতীয় প্রথাসমূহ ইত্যাদি বিষয়ে শাসকদের পরিচিতি আবশ্যিক। অন্যদিকে খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকরা মনে করতেন যে, ভারতীয় সমাজজীবনের শ্রেণীবৈষম্য, শোষণ, অনাচার ইত্যাদি প্রকাশ্যে উদ্ঘাটন করে খ্রিষ্টধর্ম ও ইউরোপীয় সভ্যতার মানবিক বৈশিষ্ট্যগুলি প্রচার করতে পারলে ব্রিটিশ শাসন ও খ্রিষ্টধর্মের প্রতি ভারতীয়দের আস্থা ও আনুগত্য বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে। এই লক্ষ্যে প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যের ব্যাপক অনুবাদের কাজে জোর দেওয়া হয়। ম্যাক্সমুলারের সম্পাদনায় ঋগ্বেদের একটি সংস্করণ প্রকাশ করা হয়। ‘সেক্রেড বুকস অফ দ্য ইস্ট’ নামক গ্রন্থমালার প্রায় পঞ্চাশটি খণ্ডে বিভিন্ন সংস্কৃত সাহিত্য প্রামাণ্য টিকাসহ প্রকাশ করা হয়। অবশ্য চিন ও ইরানের সামান্য কিছু সাহিত্যও এখানে স্থান পেয়েছিল।

পশ্চিমী প্রাচ্যবিদদের রচনাবলীতে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস ও সমাজব্যবস্থাকে নেতিবাচকরূপে সাধারণীকরনের (Negative generalization) প্রবণতা স্পষ্ট। এমনকি, বিংশ শতকে ভিনসেন্ট আর্থার স্মিথ (V. A. Smith 1843-1920 A. D.) রচিত ‘Early History of India’ গ্রন্থেও (১৯০৪ খ্রিঃ) সেই ধারা লক্ষ্য করা যায়। তিনি ভারতবর্ষকে স্বৈরাচারী শাসকের অধীন এবং জাতীয় ঐক্য চেতনাবর্জিত একটি দেশ হিসেবে তুলে ধরেছেন। পশ্চিমী সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত, মিশনারী বা ইতিহাসবিদ, প্রায় সকলেই প্রাচীন ভারতকে একটি জড়তা ও নৈরাশ্যের অন্ধকারে ঢাকা দেশ হিসেবে চিত্রায়িত করেছেন। এঁদের দৃষ্টিতে প্রাচীন ভারত ছিল জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন মুনিঋষিদের আবাসস্থল যাঁরা ভারতবাসীর ওপর তাঁদের বন্ধ্যা ও বিষাদগ্রস্ত দৃষ্টিভঙ্গীকে চাপিয়ে দিয়ে গেছেন। এঁদের মতে, ভারতীয়গণ স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থাতেই বেশী স্বচ্ছন্দ্য এবং অধ্যাত্মবাদ ও পরলোক সম্পর্কে এতটাই আকৃষ্ট যে, ইহলৌকিক জীবনের সুখদুঃখ সম্পর্কে তারা খুবই নিস্পৃহ। বস্তুত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকে যুক্তিগ্রাহ্যতা প্রদানের এবং গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির জন্যই প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির এহেন নেতিবাচক ইতিহাসচর্চা পশ্চিমী পণ্ডিতদের রচনায় দেখা যায়।

জাতীয়তাবাদী ইতিহাস চর্চা :

প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির উপনিবেশবাদী ব্যাখ্যা ভারতের পাশ্চাত্য শিক্ষিত পণ্ডিতদের বিব্রত করে। পাশ্চাত্যের যুক্তিবাদের সাথে পরিচিত একদল মানবতাবাদী ভারতীয় পণ্ডিত তৎকালীন সমাজকে কুসংস্কার মুক্ত করার উদ্যোগ নেন। একই সাথে এঁরা প্রাচীন ভারতীয় জীবনধারা সম্পর্কে পশ্চিমীদের প্রচারিত কাল্পনিক ও উদ্দেশ্যমূলক ইতিহাস চর্চার বিরোধীতা শুরু করেন। এঁদের কেউ কেউ হিন্দু পুনর্জাগরণবাদের আদর্শ দ্বারা চালিত হয়েছিলেন। অবশ্য অনেকেই যুক্তিসিদ্ধ ও নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গীসহ প্রাচীন ভারতের ইতিহাসচর্চা করতে সচেষ্ট ছিলেন। উনিশ শতকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের অস্ফুট আলোকের মধ্যেই এঁরা জাতীয়তাবাদী ইতিহাসচর্চার গুরুত্ব উপলব্ধি করেন। প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাস, শিল্প, সংস্কৃতি, সভ্যতা সম্পর্কে পশ্চিমী লেখকদের ‘নেই-রাজ্য’ ধর্মী ইতিহাস চর্চার কলঙ্ক থেকে এঁরা প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্যকে উদ্ধারের কাজে ব্রতী হন।

প্রাচীন ভারতের জাতীয়তাবাদী ইতিহাসচর্চার পথিকৃৎ ছিলেন রাজেন্দ্রলাল মিত্র (১৮২২-১৮৯১ খ্রিঃ)। ইতিহাস দর্শনের বিশিষ্ট প্রবক্তা র‍্যাঙ্কে ও নেবুর-এর বৈজ্ঞানিক ইতিহাসচর্চার সম্পর্কে রাজেন্দ্রলাল অবহিত ছিলেন। এশিয়াটিক সোসাইটির সহ-সম্পাদক পদে কর্মরত থাকার সুবাদে প্রাচীন পুঁথি, পাণ্ডুলিপি ও পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনের সাথে তাঁর পরিচয় সমৃদ্ধ হয়। তিনি প্রথমে ধারাবাহিক ইতিহাস রচনার পরিবর্তে মহাফেজখানার দলিলপত্র এবং পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন ভিত্তিক প্রাচীন ভারতের সমাজ, সংস্কৃতির খণ্ড চিত্র তুলে ধরতে উদ্যোগী হন। প্রাচীন ভারতীয় রাজনীতি ও সমাজ জীবন সম্পর্কে তিনি অসংখ্য গবেষণামূলক প্রবন্ধ রচনা করেন। এগুলি ‘দ্য ইন্ডো-অ্যারিয়ানস’ নামে প্রকাশিত হয়। তিনি তথ্যসহ প্রমাণ করেন যে প্রাচীন ভারতে হিন্দুরা সোমরস পান এবং গোমাংস ভক্ষণে অভ্যস্ত ছিলেন। এছাড়াও অসংখ্য প্রবন্ধ ও প্রাচীন পুঁথির টিকাভাষ্য রচনা করে রাজেন্দ্রলাল প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রটিকে সমৃদ্ধ করেছেন।

উনিশ শতকে প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির ইতিহাসচর্চার একটি উজ্জ্বল নাম পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (১৮৫৩-১৯৩১ খ্রিঃ)। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রাজেন্দ্রলাল ও হরপ্রসাদকে একই স্তরের পণ্ডিত বলে মনে করতেন। রাজেন্দ্রলালের কাছেই তিনি পুঁথি সংগ্রহের কাজে দীক্ষিত হন। ‘অবদানশতক’, =‘বোধিস্বত্ত্ব অবদান’, ‘মহাবস্তু অবদান’ ইত্যাদি বহু বৌদ্ধ গ্রন্থ তিনি ইংরাজীতে অনুবাদ করেন। দেশের নানা স্থানে ছড়িয়ে থাকা ‘লেখ’র পাঠোদ্ধারের কাজেও তিনি কৃতিত্ব দেখান। হরপ্রসাদের পাঠোদ্ধার করা তিনটি গুরুত্বপূর্ণ লেখ হল দিল্লির চন্দ্ররাজার ‘মেহরৌলি লেখ’, নর বর্মণের ‘মান্দাসোর লেখ’ এবং শুসুনিয়া পাহাড়ে (অযোধ্যা) প্রাপ্ত ‘চন্দ্র বর্মণের লেখ’। হরপ্রসাদ হাজার বছরেরও বেশী প্রাচীন আদি বাংলা ভাষায় লেখা বৌদ্ধ গান ও দোঁহা আবিষ্কার করে বাংলা ভাষার উৎপত্তি ও বিকাশ সম্পর্কে আলোড়ন তুলে দেন। মৌর্য সাম্রাজ্যের পত্তন সম্পর্কেও তিনি নতুন কথা শোনান। তাঁর মতে, অশোকের অহিংসনীতি ব্রাহ্মণ শ্রেণীর আর্থ-সামাজিক স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করেছিল। তাই ব্রাক্ষ্মণ্যবাদী প্রতিক্রিয়া মৌর্য শাসনের পত্তন ডেকে আনে। অবশ্য এক্ষেত্রে তিনি কিছুটা আবেগতাড়িত ছিলেন বলে অন্যান্য ঐতিহাসিকেরা মনে করেন।

মহারাষ্ট্রের প্রাচীন ইতিহাসচর্চার কাজে অগ্রণী ভূমিকা নেন রামকৃষ্ণ গোপাল ভাণ্ডারকর (১৮৩৭-১৯২৫ খ্রিঃ), তাঁর পুত্র দেবদত্ত রামকৃয় ভাণ্ডারকর (১৮৭৫-১৯৫০ খ্রিঃ), বিশ্বনাথ কাশীনাথ রাজওয়াড়ে (১৮৬৯-১৯২৬ খ্রিঃ) প্রমুখ। রামকৃয়ের ইতিহাসমূলক দুটি বিখ্যাত গ্রন্থ হল, ‘আর্লি হিস্ট্রি অব ডেকান’ (১৮৮৪ খ্রিঃ) এবং ‘এ পিপ ইন্টু দ্য আর্লি হিস্ট্রি অফ ইণ্ডিয়া” (১৮৯০ খ্রিঃ)। প্রাচীনকাল থেকে মুসলমান বিজয় পর্যন্ত তিনি দাক্ষিণাত্যের ধারাবাহিক বিবরণ তুলে ধরেন। রাজনৈতিক ইতিহাসের সাথে সাথে প্রাচীনকালে দক্ষিণ ভারতের সমাজ, অর্থনীতি, ধর্মীয় জীবন সম্পর্কেও তিনি যথাযথ আলোকপাত করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর প্রথম গ্রন্থটি থেকে সাতবাহন, চালুক্য, রাষ্ট্রকূট, কল চুরি প্রভৃতি রাজবংশের কালানুক্রমিক ইতিহাস জানা যায়। দ্বিতীয় গ্রন্থের পরিধি মৌর্যযুগ থেকে গুপ্তবংশের শাসনের শেষ পর্যন্ত। গুপ্তযুগের সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণের বিষয়টির ওপর তিনি বিশেষ আলোকপাত করেছেন। রামকৃষ্ণের পুত্র দেবদত্ত ভাণ্ডারকর ছিলেন মূলত লেখ বিশারদ (epigraphist )। প্রথম জীবনে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভের পশ্চিমাঞ্চলের সুপারিন্টেনডেন্ট এবং পরে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির কারমাইকেল অধ্যাপক হিসেবে ইতিহাস চর্চার বিশেষ সুযোগ পান। তিনি একাধিক বক্তৃতামালার মাধ্যমে প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির ইতিহাস পুনর্গঠনের চেষ্টা করেছেন। প্রাচীন হিন্দু রাজতন্ত্রের ধারণা এবং গণরাজ্য গঠনের ভারতীয় উদ্যোগ সম্পর্কে তিনি বহু নতুন তথ্য উপস্থাপন করেন। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট অশোকের জীবন ও কর্মধারা বিষয়ে তিনি আটটি বক্তৃতা দেন। অশোকের বিভিন্ন লেখ’র বক্তব্য এবং অন্যান্য সাহিত্যসূত্র পর্যালোচনা করে দেবদত্ত ভাণ্ডারকর অশোকের রাষ্ট্র দর্শন, মানবতাবাদ ও প্রজা কল্যাণের আদর্শ সম্পর্কে তথ্যনিষ্ঠ বিবরণ তুলে ধরেছেন। বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত বক্তৃতামালায় তিনি হিন্দু রাজনীতির প্রকৃতি, রাষ্ট্র সম্পর্কে প্রাচীন ভারতীয়দের ধারণা, রাষ্ট্রের উৎপতি, রাষ্ট্রের লক্ষ্য ইত্যাদি বিষয়ে তথ্যনিষ্ট ইতিহাস উপস্থাপন করেন। বিশিষ্ট জাতীয়তাবাদী লেখক কাশীপ্রসাদ জয়সোয়াল (১৮৮১-১৯৩৭ খ্রিঃ) পশ্চিমী ঐতিহাসিকদের প্রাচীন ভারত ইতিহাসের মনগড়া মূল্যায়ন মিথ্যা প্রমাণিত করেন। ভি. স্মিথ প্রমুখের প্রাচীন স্বৈরতান্ত্রিক ভারত রাষ্ট্রের ধারণার বিরুদ্ধে গিয়ে তথ্য সহ প্রমাণ করেন যে, খ্রিষ্টপূর্ব কালেও ভারতবর্ষে গণরাজ্য ও নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের অস্তিত্ব ছিল।

প্রাচীন ভারতের ইতিহাসচর্চায় বিশেষ অবদান রেখেছেন হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী (১৮৯২-১৯৫৭ খ্রিঃ)। প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিষয়ক তাঁর দু’টি অমরগ্রন্থ হল ‘পলিটিক্যাল হিস্ট্রি অব এনসিয়েন্ট ইন্ডিয়া’ (১৯২৬ খ্রিঃ) এবং ‘স্টাডিজ ইন ইন্ডিয়ান অ্যান্টিকুইটিস্’ (১৯৩২ খ্রিঃ)। প্রথম গ্রন্থে তিনি খ্রিষ্টপূর্ব নবম শতক থেকে গুপ্ত শাসনের শেষ পর্যন্ত (খ্রিষ্টীয় ৬ষ্ঠ শতক) আলোচনা করেছেন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময় থেকে বৌদ্ধধর্মের উদ্ভবের মধ্যবর্তীকালের ইতিহাসচর্চার অভাব তাঁর এই গ্রন্থ পূরণ করে। ‘অ্যান্টিকুইটিস্’ গ্রন্থটি তাঁর মৌলিক গবেষণার ফল। এখানে বিভিন্ন প্রবন্ধে তিনি ইতিহাসের কিছু রহস্য দূর করতে প্রয়াসী হয়েছেন। ঋগ্বেদের প্রাচীনত্ব, রামায়ণ ও মহাভারতের মধ্যে সম্পর্ক, বঙ্গদেশের অবস্থান ও বিশেষত্ব ইত্যাদি বিষয়ে তিনি যুক্তিনিষ্ট তথ্য দ্বারা বিভ্রান্তি মোচনের চেষ্টা করেছেন। অনুরূপভাবে প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক অবস্থা, হিন্দু জাতীয়তাবাদের ধারণা, ভারতবর্ষের ঐক্য, প্রাচীন শিল্পভাবনা, নৌ-বাণিজ্য ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে একাধিক তথ্যনিষ্ঠ ইতিহাস রচনা করেছেন রাধাকুমুদ মুখার্জি (১৮৮০-১৯৬৩ খ্রিঃ)। তাঁর বহুল প্রশংসিত বিষয় হল প্রাচীন ভারতের স্বায়ত্ত শাসনের ইতিহাস।

প্রাচীন ভারতের ইতিহাসচর্চায় উত্তর ভারতের সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, যতটা গুরুত্ব পেয়েছে, দক্ষিণ ভারতের ক্ষেত্রে তা হয়নি। এই ফাকটি পূরণ করেছেন কে. এ. নীলকণ্ঠ শাস্ত্রী (১৮৯২-১৯৭৫খ্রিঃ)। তাঁর দু’টি বিখ্যাত গ্রন্থ হল ‘এ হিস্ট্রি অব সাউথ ইন্ডিয়া’। চোল, পাণ্ড্য সহ দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলি সম্পর্কেও তিনি তথ্যনিষ্ঠ আলোচনা করেছেন। ইতিহাস দর্শন (Historical method) সম্পর্কেও তিনি একাধিক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন। দক্ষিণ ভারতের সংস্কৃতির ধারা প্রসঙ্গে কিছু প্রচলিত ধারণাকে তিনি দৃঢ়তার সাথে বাতিল করে নিরপেক্ষ ইতিহাসচর্চার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। যেমন, হরপ্পা সভ্যতার স্রষ্টা দক্ষিণ ভারতের মানুষ কিংবা তামিল ভাষীরাই ভারতের আদিম অধিবাসী ইত্যাদি সংকীর্ণ জাতিবাদভিত্তিক ইতিহাসচর্চাকে তিনি যুক্তিতথ্য দ্বারা বাতিল করে দেন। অবশ্য তাঁর ইতিহাসচর্চাও সীমাবদ্ধতা-মুক্ত নয়। কারও কারও মতে, অধ্যাপক শাস্ত্রী ব্রাহ্মণ শ্রেণীর সাংস্কৃতিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন। দক্ষিণের জাতিগত বিরোধ, বৈষম্য, বর্ণপ্রথার শোষণমূলক বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি বিষয়ে তিনি নীরব থেকেছেন।

ইতিহাসচর্চায় নবদিগন্ত :

ইতিহাসের উপজীব্য মানুষ ও মানব সভ্যতার বিবর্তন। আবার পরবর্তী প্রজন্মের ভবিষ্যত দিশা প্রদর্শনের জন্য নৈর্ব্যক্তিক ইতিহাসচর্চা আবশ্যিক। আবেগ, জাত্যাভিমান ইত্যাদি আত্মসন্তুষ্টি বিধান করতে হয়তো সক্ষম হয়, কিন্তু ভবিষ্যতের সঠিক দিশা দেখাতে পারে না। পশ্চিমী লেখকরা উপনিবেশবাদী দৃষ্টিভঙ্গী থেকে এবং ঔপনিবেশিক শাসন কর্তৃত্বকে একটা তাত্ত্বিক ভিত্তি দেবার লক্ষ্যে প্রাচীন ভারতের ইতিহাসচর্চায় যথার্থ নিরপেক্ষতা দেখাতে পারেননি বা চাননি। অন্যদিকে জাতীয়তাবাদী লেখকেরা অতীত অন্ধকার থেকে সুপ্রাচীন সংস্কৃতির গতিপ্রকৃতি উদ্ধারের আন্তরিক চেষ্টা করেছেন ঠিকই। এ কাজে তাঁরা তুলনামূলকভাবে অধিক তথ্যনিষ্ট ও যুক্তিবাদী, একথাও ঠিক। কিন্তু তাঁরাও সম্পূর্ণরূপে জাতিগত আবেগমুক্ত হয়ে যথার্থ নৈর্ব্যক্তিক ইতিহাসচর্চা সর্বদা করতে পারেন নি। প্রাচীন ভারতের ইতিহাসচর্চার সেই সীমাবদ্ধতা অনেকটাই দূর হয়েছে বস্তুবাদী ইতিহাসচর্চায়। এক্ষেত্রে একটি স্মরণীয় নাম দামোদর ধর্মানন্দ কোশাম্বি (১৯০৭-৬৬ খ্রিঃ)। তিনি সমাজবিজ্ঞানী কার্ল মার্কস-এর সাম্যবাদতত্ত্বের ভিত্তিতে ইতিহাসের বস্তুগত ব্যাখ্যা দেন। তাঁর দুটি বিখ্যাত গ্রন্থ হল ‘অ্যান ইনট্রোডাকশন টু দ্য স্টাডি অফ ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি’ (১৯৫৬ খ্রিঃ) এবং ‘দ্য সিভিলাইজেশন অফ এনসিয়েন্ট ইন্ডিয়া ইন হিস্টোরিক্যাল আউটলাইন’ (১৯৬৫ খ্রিঃ)। কোশান্বি মনে করতেন যে, উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের ধারাবাহিক পরিবর্তন ইতিহাসের গতি-প্রকৃতি নির্ধারণ করে। প্রাচীন ভারতের সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ইত্যাদি বস্তুগত পরিবর্তন অর্থাৎ উৎপাদন সম্পর্কের পরিবর্তনের সাথে সাথে রূপান্তরিত হয়েছে। দশটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত তাঁর প্রথম গ্রন্থে কোশাম্বি আদিম সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থা থেকে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব পর্যন্ত প্রাচীন ভারতের ইতিহাস উপস্থাপন করেছেন। এখানে প্রথাগত রাজনৈতিক ইতিহাস আলোচিত হয়নি। তিনি মূলত প্রাচীন ভারতের উপজাতি জীবন থেকে সমাজ গড়ে ওঠার কথা এবং উৎপাদন পদ্ধতি, উৎপাদনভিত্তিক সামাজিক সম্পর্ক ও প্রতিষ্ঠান সমূহের কথা লিখেছেন। দ্বিতীয় খণ্ডটি সাতটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত। এখানে হরপ্পা সভ্যতার আমলের উৎপাদন পদ্ধতি, আর্যদের পূর্বমুখী সম্প্রসারণ ও ব্যাপক কৃষি-অর্থনীতির উদ্ভব, মগধের উত্থানের পশ্চাদপটে তার সমৃদ্ধ অর্থ-ভিত্তির অবদান, প্রতিবাদী ধর্মমতের উত্থানের অনুসঙ্গ হিসেবে লৌহ-কৃষি সরঞ্জাম ভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থার রূপান্তর, সম্রাট অশোকের ‘ধৰ্ম্ম’ ব্যবস্থার সাথে সমাজের বস্তুগত পরিবর্তনের সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। রামশরণ শর্মা, রোমিলা থাপার প্রমুখ অনুরূপভাবে নৈর্ব্যক্তিক ও বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গী থেকে প্রাচীন ভারতের সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতির কালেরযাত্রা ব্যাখ্যা করেছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য একটি ব্যতিক্রমী নাম এ. এল. ব্যাসাম (১৯১৪-‘৮৬ খ্রিঃ)। ইংরেজ ভারততত্ত্ববিদ পণ্ডিত ব্যাসাম তাঁর পূর্বসূরীদের জাত্যাভিমান ত্যাগ করে প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে উপস্থাপন করতে চেষ্টা করেছেন। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘দ্য ওয়ান্ডার দ্যাট ওয়াজ ইন্ডিয়া’ (১৯৫১ খ্রিঃ)-তে ব্যাসাম প্রাচীন যুগ থেকে ভারতীয় ঐতিহ্যের মহান বৈশিষ্ট্যগুলির প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তিনি ভারতের বিবর্তনশীল সমাজব্যবস্থায় প্রতিটি মানুষের নিজস্ব স্থান ও অবদানের অস্তিত্ব প্রত্যক্ষ করেছেন। প্রাচীন ভারতে জাতিভেদের কঠোরতা এবং নিচুতলার মানুষদের কষ্টকর জীবনের কথা বলেও তিনি দেখিয়েছেন যে, সমকালীন বিশ্বের অপর যে-কোন সভ্যতার তুলনায় ভারতের পরিস্থিতি ছিল উন্নত ও সহনশীল।

সাম্প্রতিক কোন কোন ঐতিহাসিক সাম্প্রদায়িকতাবাদী ইতিহাসচর্চায় রত হয়েছেন। এঁদের সংখ্যা কম হলেও, এঁদের বক্তব্য সমাজ-সংহতির পক্ষে যথেষ্ট বিপজ্জনক। এঁরা প্রাচীন ভারতের বর্ণ ও জাতি ব্যবস্থার মধ্যেও মহত্তর অবদান খোঁজার চেষ্টা করেন। ফলে সাম্প্রদায়িকতাবাদী যুক্তিহীন ইতিহাসচর্চার সাথে যুক্তিসঙ্গত নৈর্ব্যক্তিক ইতিহাসচর্চার একটা টানাপোড়েন লক্ষ্য করা যায়। আর্যদের ভারতীয় উদ্ভবতত্ত্ব কিংবা বাবরি মসজিদ-রামজন্মভূমি তত্ত্বের মধ্যে প্রাচীন ভারতের ইতিহাসচর্চার সেই অনাকাঙ্খিত অনৈতিহাসিকতার সন্ধান পাওয়া যায়।

আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।

Leave a Comment