ফসিল গল্পের বিষয়বস্তু এবং রচনারীতি বাংলাসাহিত্যে অভিনব— এই অভিনবত্বের পরিচয় দাও

আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “ফসিল গল্পের বিষয়বস্তু এবং রচনারীতি বাংলাসাহিত্যে অভিনব— এই অভিনবত্বের পরিচয় দাও” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।

ফসিল গল্পের বিষয়বস্তু এবং রচনারীতি বাংলাসাহিত্যে অভিনব— এই অভিনবত্বের পরিচয় দাও

চল্লিশের দশকে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর কিছু আগে থেকে বাংলা সাহিত্যে পরিবর্তনের ছোঁয়া স্পষ্ট হয়ে আসছিল। ১৯৪০-৪১ সালে একদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন হিংস্র নখরাঘাতে বিশ্বমানবতাকে ক্ষতবিক্ষত করে তুলছে অন্যদিকে তখন রোগশয্যায় শায়িত রবীন্দ্রপ্রতিভা প্রায় অস্তাচলগামী—এই বিনষ্টির অভিঘাতে বাংলাসাহিত্যের প্রায় সমস্ত ধারাতেই পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে উঠলো। পুরোনো মূল্যবোধের পতন, প্রাচীন চিন্তা-চেতনার উপর অবিশ্বাস থেকেই একালের সাহিত্যিক-রা নতুন করে বিশ্লেষণের তাগিদ অনুভব করলেন। ফলত অভিনব বিষয়বস্তু, প্রকাশভঙ্গি নিয়ে বাংলা সাহিত্যে নব্য আধুনিকতার সূচনা হল। সুবোধ ঘোষ সেই আধুনিকতার বাণীবাহক।

১৯৪০-এ লেখা প্রথম দুটি গল্প ‘অযান্ত্রিক’ ও ‘ফসিল’ বাংলা ছোটোগল্পে সুবোধ ঘোষের স্বতন্ত্র স্থানটিকে নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চরম অভিঘাত বাংলা সমাজ ও বাঙালির সামাজিক অবস্থানে যে পালাবদল সূচিত করেছিল ‘ফসিল’ গল্পটি সেই পালাবদলের পটভূমিকায় রচিত। শোষণজীবী সামন্ততন্ত্র ও অমানবিক ধনতন্ত্রের যুগপৎ নির্মমতা, তাদের অশুভ আঁতাত ও মিলিত চক্রান্ত, শ্রেণিদ্বন্দ্বের চরম সংকট, মধ্যবিত্তের বিবেকহীন আপোষকামীতা সর্বোপরি শোষণের যাঁতাকালে পিষ্ট কৃষিজীবী ও শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর নির্মম পরিণতি ‘ফসিল’ গল্পে আশ্চর্য কুশলতায় চিত্রিত হয়েছে। সমালোচকের ভাষায় “গল্পের বিশেষত্ব আঙ্গিকে নয় বক্তব্যের বলিষ্ঠতায়, নির্মোহ চক্রদৃষ্টিভঙ্গিতে। এই গল্পের মধ্যে সব আছে-শাসন-শোষণ, সংগ্রাম-সংহতি, নিষ্ঠুরতার উল্লাস, নৃশংসতায় আত্মশ্লাঘা—ইতিহাসের অমোঘ সত্য, কালের বিচার অথচ তা পল্লবিত নয়, অহেতুক বর্ণনা বা সংলাপ নেই, কলেবর বৃদ্ধি নেই। শানিত ছুরির মতো তীব্র তীক্ষ্ণ এবং সহজ।”

ফসিল গল্পটির কাহিনি বেশি দীর্ঘ না হলেও এ-গল্পের থীম অত্যন্ত জটিল। সামন্ততন্ত্রের অবসান ও ধনতন্ত্রের সমৃদ্ধির এক সংকটময় মুহূর্তকে এ গল্পের প্রেক্ষাপটে স্থাপন করে লেখক গল্পটিকে বিস্তৃতকালের পটভূমিতে মুক্তি দিয়েছেন। সমালোচকের ভাষায়—“এক বিশেষ সংকটের মুহূর্তে শ্রেণিদ্বন্দ্বের চিত্র ধরা দিয়েছে এ-গল্পে—এটুকু বললে বোঝানো যাবে না থীমটিকে। ধনতান্ত্রিক সমান্ততান্ত্রিক, মধ্যবিত্ত, কৃষিজীবী, শ্রমজীবী, —এতগুলি শ্রেণিকে একসঙ্গে ধরেছেন তা-ই নয়—শ্রেণিদ্বন্দ্বের কারণ, পরিণতি এমনকি সভ্যতার ভবিষ্যৎ মানুষের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা, অন্তসার শূন্যতা—এমনি বিবিধ ডিটেলে থীমটিকে অর্থবহ করে তুলেছেন। ছোটোগল্পের আয়তনে ও কর্মে এই থীমটিকে ধরা দুঃসাধ্য বললেও অত্যুক্তি হয় না।”

ফসিল গল্পে দেখানো হয়েছে অবক্ষয়িত সামন্ততন্ত্রে রূপ। ‘নেটিভ স্টেট অঞ্জনগড়’কে কাহিনির স্থান রূপে উপস্থাপিত করে সামন্ত রাজাদের অবক্ষয় ও শোষণকে গল্পকার রূপ দিয়েছেন। পাশাপাশি সদ্য গড়ে ওঠা ধনতান্ত্রিক শাসনের নির্মমতাও গল্পের প্রতিপাদ্য হয়ে উঠেছে। এই দুই বিশাল প্রতিপক্ষকে ছোটোগল্পের সংক্ষিপ্ত পরিসরে স্থাপন করে গল্পকার আদ্যন্ত ব্যাঙ্গাত্মক দৃষ্টিকোণ থেকে গল্পটি বলেছেন। যেমন অবক্ষয়িত দাপটহীন সামন্ততন্ত্র সম্বন্ধে লেখকের ভাষ্যে পাই—“বারো পুরুষ আগে এ রাজ্যে বিশুদ্ধ শাস্ত্রীয় প্রথায় অপরাধীকে শূলে চড়ানো হত, এখন সেটা আর সম্ভব নয়। তার বদলে অপরাধীকে শুধু উলঙ্গ করে নিয়ে মৌমাছি লেলিয়ে দেওয়া হয়।” কিংবা রাজপ্রাসাদ সম্পর্কে লেখকের বর্ণনা—“কেল্লার ফটকে বুনো হাতির জীর্ণ কঙ্কালের মতো দুটো মরচে পড়া কামান। তার নলের ভেতরে পায়রার দল স্বচ্ছন্দে ডিম পাড়ে, তার ছায়ায় বসে ক্লান্ত কুকুরেরা ঝিমোয়।”

ধনতান্ত্রিক শোষণের নির্মমতাও লেখকের তির্যক ব্যঙ্গের থেকে রেহাই পায়নি। শ্রমিক শোষণে হৃদয়হীনতাকে তুলে ধরে চিনিকলের শ্রমিক দুলাল মাহাতোর অবসর জীবন প্রসঙ্গে লেখকের বর্ণনায় পাই—দীর্ঘদিন চিনিকলে কাজ করে মাহাতো গ্রামে ফিরেছে কিন্তু বাঁচার রসদ হিসেবে তার অবশিষ্ট আছে নগদ সাতটি টাকা আর বুক ভরা হাঁপানি।

ফসিল গল্পে সামন্ততন্ত্র ও ধনতন্ত্রের বিরোধ উপস্থাপিত করেই গল্পকার যবনিকা টানেননি। সমালোচকের ভাষায়—“শক্তিমান কলমের অধিকারী সুবোধ ঘোষ ‘ফসিল’ গল্পটির মাধ্যমে মানব ইতিহাসের রাজনৈতিক বিবর্তনের প্রেক্ষাপট ও পরিণাম সংকেতিত করেছেন। আবার অন্যদিকে এই একই গল্পের মাধ্যমে সামন্ততন্ত্র ও ধনতন্ত্রের বিরোধ, সেই বিরোধের পটভূমিকাতেও শোষিত শ্রেণির অধিকার কেড়ে নেওয়া শোষণ করার প্রশ্নে পরস্পরের নির্লজ্জ সহমত পোষণের মতো ঘটনাও যথাযথ বাস্তবানুগ দৃষ্টিভঙ্গিতে উপস্থাপিত করা হয়েছে। উৎপাদনের উপাদান হিসেবে শ্রমিক শ্রেণির শ্রমকে যেন তেন প্রকারেণ কব্জা করার অকুণ্ঠ প্রয়াসই যে অন্য দুই আপাত যুযুধান শ্রেণির মূল চাহিদা—সেটাও পরিস্ফুট হয়েছে। সমাজ ইতিহাসের এই ব্যাখ্যা সম্পূর্ণতই মার্কসীয় দৃষ্টি সম্মত।”

গল্পের সূচনায় আছে অবক্ষয়িত সামন্ততন্ত্রের রূপ। পরবর্তী পর্যায়ে সামন্ততন্ত্রের অবক্ষয়ের সুযোগে ধনতন্ত্রের আগ্রাসনের বিষয়টিও যথাযথ রূপ পেয়েছে। ফলত উভয়ের সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠেছে এবং গল্পকার সেই সংঘাতের পটভূমিটিও রচনা করেছেন সুকৌশলে। আকস্মিক দুটি দুর্ঘটনা এই উভয় শাসক ও শোষককে একই মানদণ্ডে স্থাপন করে দিয়েছে। লেখক দেখিয়েছেন নিজস্ব স্বার্থরক্ষার তাগিদে শোষক শ্রেণির মধ্যে কোনও ভিন্নতা থাকে না। নির্মমতাই তখন একমাত্র উপজীব্য বিষয়। যে নির্মমতার অগ্নিদাহে দগ্ধ হয়ে গেছে হতভাগ্য কুৰ্মী সমাজ। ১৪নং পীটের আকস্মিক খনি দুর্ঘটনায় মাইনিং সিন্ডিকেটের গাফিলতি প্রমাণ করার জন্য এবং ধনতন্ত্রকে বিপর্যস্ত করতে যখন সামন্ত প্রভু অঞ্জনগড়ের মহারাজ উদগ্রীব হয়ে উঠেছে ঠিক সেই সময়ই তিনি খবর পেয়েছেন ঘোড়ানিমের জঙ্গলে লকড়ি কাটতে গিয়ে তারই ফৌজদারের গুলিতে নিহত হয়েছে বেশ কয়েকজন প্রজা। এই নরহত্যার কলঙ্ক চাপা দিতেই সিন্ডিকেট ও মহারাজা বসে গেছেন একই টেবিলে। আর হতভাগ্য লাশগুলো এবং উভয় ঘটনার একমাত্র সাক্ষী ও এই গল্পের বলিষ্ঠ প্রতিবাদী চরিত্র দুলাল মাহাতোর লাশটিকেও খনির গর্ভে ফেলে দেওয়া হয়েছে। সমাজ শাসকদের পাপের একমাত্র সাক্ষী দুলালকে তুলে এনে খুন করা হয়েছে। তারপর দামী পানীয়ের পাত্রে ঠোঁট ছুইয়ে শাসক মহারাজা আর বণিক গিবসন, উভয় শ্রেণির প্রতিনিধিদের মুখে ফুটে উঠেছে হাসি। গিবসন মহারাজার কথায় সায় দিয়ে বলেছে—“অনেক ক্লামজি ঝঞ্ঝাট থেকে বাঁচা গেল। আমাদের উভয়ের ভাগ্য বলতে হবে।”

সামন্ততন্ত্রের অবক্ষয় ও অস্তিত্ব রক্ষার তীব্র প্রয়াস, ধনতন্ত্রের শ্রীবৃদ্ধি ও নির্মম আগ্রাসন, শ্রেণিদ্বন্দ্বের নিষ্ঠুর চিত্র, কৃষিজীবীর শ্রমজীবীতে রূপান্তর, শ্রমজীবী মানুষের মর্মান্তিক পরিণতি, মধ্যবিত্তের স্বপ্নভঙ্গ ও বিবেক বর্জিত আপোষ—ইত্যাদি নানা চিত্র গল্পে অতি সু-কৌশলে অঙ্কিত করে লেখক গল্পটিকে স্থাপন করেছেন বৃহত্তর ইতিহাসের পটে। ফলত শোষক আর শোষিতের লড়াইয়ে মানুষের যে পরাভব এ গল্পে খণ্ডচিত্ররূপে আভাসিত ছিল তা অন্তহীন চিরন্তনতায় ব্যাপ্ত হয়েছে। ভবিষ্যতের সমাজ বদলে গেলেও শাসকের শোষণের যে কোনো সমাপ্তি নেই—এই নির্মম সত্যটি গল্পের অন্তিমে পরস্ফুিট হয়েছে। মানুষের সভ্যতার নিরক্ত অর্থহীনতাকে প্রকট করেছে মুখার্জির ছলছল চোখ আর দূরগামী ভাবনা। মুখার্জির ভবিষ্যৎ চিন্তা ও নামকরণের মধ্যে দিয়ে লেখক এ গল্পে সঞ্চারিত করেছেন মানবসভ্যতার লক্ষ বছরের বিস্তৃতি ও ফসিলের নিরক্ত সাদা রঙের গভীরে নিহিত রক্তাক্ত তাৎপর্য।

আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।

Leave a Comment