আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “বলভীর মৈত্রক বংশ এবং কনৌজ : মৌখরী বংশ, থানেশ্বর-এর পুষ্যভূতি বংশ” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
বলভীর মৈত্রক বংশ:
গুপ্ত সাম্রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যে সকল ছোটো ছোটো আঞ্চলিক রাজ্য গড়ে উঠেছিল, তাদের অন্যতম ছিল বলভীর মৈত্রক বংশ। কাথিয়াবাড়ে ভাবনগরের ১৮ মাইল উত্তর-পশ্চিমের বর্তমান ‘ওয়ালা’ শহরটি ছিল তৎকালীন বলভী।
বলভীর মৈত্রক বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জনৈক ভট্টারক। মৈত্রকদের উদ্যোগে প্রচারিত বিভিন্ন শিলালেখ থেকে এই বংশের ইতিহাস সম্পর্কে আভাস পাওয়া যায়। মৈত্রকদের উৎকীর্ণ প্রাচীনতম লেখটি হল দ্রোণসিংহ’র ভূমোদারা-মাহাতা তাম্রশাসন। ৫০২ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ এই লেখ থেকে অনুমান করা হয় যে, খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতকের শেষদিকে শাসক বংশ হিসেবে মৈত্রকদের উত্থান শুরু হয়েছিল।
এ ছাড়া, প্রথম ধ্রুবসেনের পলিতন তাম্রশাসন (৫০৫ খ্রিঃ), খড়গ্রহের ভিরদি তাম্রশাসন (৬১৬ খ্রিঃ), তৃতীয় ধরসেনের ভাবনগর তাম্রশাসন (৬২৩ খ্রিঃ), দ্বিতীয় ধ্রুবসেনের নোগাভা তাম্রশাসন (৬৪০ খ্রিঃ), চতুর্থ ধরসেনের খেড়া তাম্রশাসন (৬৪৯ খ্রিঃ) ইত্যাদি লেখ থেকে মৈত্রক বংশের শাসনকাল সম্পর্কে জানা যায়। এ ছাড়া চৈনিক পর্যটক হিউয়েন সাঙ-এর ভ্রমণ বৃত্তান্ত সি-ইউ-কি থেকেও মৈত্রক বংশ-বিষয়ক কিছু তথ্য পাওয়া যায়।
মৈত্রক বংশের প্রতিষ্ঠাতা ভট্টারক সম্ভবত গুপ্তদের অধীনে সৌরাষ্ট্রের গভর্নর ছিলেন। তিনি বলভীকে কেন্দ্র করে স্বাধীন শাসন প্রতিষ্ঠার প্রথম উদ্যোগ নেন। তবে তাঁর রাজ্যসীমা সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই। ধরে নেওয়া যায় যে, পূর্বতন সৌরাষ্ট্র প্রদেশের ওপর তাঁর শাসন স্থাপিত হয়েছিল। একইভাবে বলভী রাজ্যের সঠিক প্রতিষ্ঠাকালও ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। যাইহোক, বলভীর মৈত্রক বংশ-সম্পর্কিত প্রাথমিক তথ্য পাওয়া যায় ভট্টারকের তৃতীয় পুত্র ধ্রুবসেনের তাম্রশাসন থেকে। এটি উৎকীর্ণ হওয়ার আনুমানিক সময় ৫২৫ থেকে ৫৪৫ খ্রিস্টাব্দ। যদি ধরে নেওয়া যায় যে, এই সময়ে ভট্টারকের দুই পুত্র ক্ষতাসীন ছিলেন, তাহলে তাঁদের সম্মিলিত শাসনকাল চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ বছর চলেছিল। সেক্ষেত্রে মৈত্রক বংশের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ৪৮০ খ্রিস্টাব্দে। লক্ষণীয় যে, ভট্টারক মৈত্রক শাসনের সূচনা করলেও কোনো রাজকীয় উপাধি নেননি। তিনি সেনাপতি ভট্টারক নামেই পরিচিত ছিলেন। তাঁর পুত্র ও উত্তরাধিকারী ধরসেনও পিতার মতো সেনাপতি অভিধাতেই সন্তুষ্ট ছিলেন। প্রথম দুই শাসকের রাজকীয় উপাধি গ্রহণ না করা থেকে অনুমান করা সম্ভব যে, এঁরা দুজন অন্য কোনো শাসকের অধীন সামন্ত-সেনাপতি ছিলেন। তবে কোন শাসকের অধীন এঁরা ছিলেন, তা স্পষ্ট নয়।
ভট্টারকের অপর তিন পুত্র ছিলেন দ্রোণসিংহ, প্রথম ধ্রুবসেন এবং ধরপট্ট। ভূমোদরা-মাহাতা তাম্রশাসন থেকে জানা যায় যে, দ্রোণসিংহ ‘মহারাজা’ অভিধা গ্রহণ করেছিলেন। তবে পরবর্তীকালে ৫২৫ খ্রিস্টাব্দের পলিতন তাম্রশাসনে বলা হয়েছে যে, জনৈক সার্বভৌম শাসক (পরম স্বামিন) দ্রোণসিংহকে শাসকপদে অভিষিক্ত করেছিলেন। দ্রোণসিংহের পরবর্তী শাসক তথা তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা প্রথম ধ্রুবসেনও মহাসামন্ত-মহারাজ অভিধা নিয়েছিলেন। এ থেকে অনুমান করা যায় যে, ষষ্ঠ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ পর্যন্ত মৈত্রকবংশীয় শাসকেরা স্বাধীন আঞ্চলিক শাসক রূপেই কাজ করেছিলেন। অবশ্য তাঁদের আনুগত্য হয়তো ছিল নামেমাত্র। ভট্টারকের কনিষ্ঠ পুত্র ধরপট্ট অবশ্য ‘মহারাজ’ উপাধি নিয়েছিলেন। পরবর্তী শাসক গৃহসেনের বহু তাম্রলেখ পাওয়া গেছে। ৫৫৯ থেকে ৫৬৭ খ্রিস্টাব্দের অন্তর্বর্তীকালে পাওয়া লেখগুলিতে তিনি নিজেকে ‘মহারাজ’ বলেই অভিহিত করেছেন। উপরন্তু সেগুলিতে আনুগত্য-জ্ঞাপনমূলক অভিধা, যেমন পরম ভট্টারক গ্রহণের কোনো উল্লেখ নেই। তাই বলা যায়, গুহসেন অন্য কোনো শাসকের প্রতি আনুগত্য ছাড়াই রাজত্ব করেছিলেন। সম্ভবত এই কারণে পরবর্তীকালের ক্ষমতাবান মৈত্রক শাসক শিলাদিত্যের (৬০৬-৬১২ খ্রিঃ) আমলে উৎকীর্ণ শিলালেখগুলিতে যে বংশতালিকা পাওয়া যায়, তাতে গৃহসেনের আমল থেকে মৈত্রক রাজাদের নাম স্থান পেয়েছে। বলভী রাজ্যের সীমানা কতদূর বিস্তৃত ছিল, তা সঠিক বলা যায় না। তবে হিউয়েন সাঙের বিবরণ থেকে এ সম্পর্কে একটা ধারণা লাভ করা যায়। হিউয়েন সাঙ বলেছেন যে, তাঁর ভারত ভ্রমণের প্রায় ষাট বৎসর পূর্বে মো-ল-পো অর্থাৎ মালব শাসন করতেন শিলাদিত্য এবং বর্তমানে ওই অঞ্চলের রাজা হচ্ছেন শিলাদিত্যের ভ্রাতুষ্পুত্র। হিউয়েন সাঙ-এর আগমনের ষাট বছর পূর্ববর্তী সময় হল ৫৮০ খ্রিস্টাব্দ। শিলাদিত্য রাজত্ব করেন ৬০৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে। এক্ষেত্রে এই ২০-২৫ বছরের গরমিল সত্ত্বেও মনে করা অসঙ্গত নয় যে, হিউয়েন সাঙ মৈত্রকবংশীয় প্রথম শিলাদিত্যই উল্লেখ করেছেন। কারণ হিউয়েন সাঙ-এর সমকালীন পরবর্তী রাজা দ্বিতীয় ধ্রুবসেন ছিলেন সম্পর্কে শিলাদিত্যের ভ্রাতুষ্পুত্র। তাই বলা যায় যে, মালব অন্ততপক্ষে পশ্চিম মালব ষষ্ঠ শতকের শেষদিকে বলভী সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং সেই সময়ে পশ্চিম ভারতে বলভী একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল।
প্রথম শিলাদিত্যের পরবর্তী রাজা ছিলেন যথাক্রমে তৃতীয় ধরসেন ও দ্বিতীয় ধ্রুবসেন বালাদিত্য। হিউয়েন সাঙ-এর বিবরণ থেকে জানা যায় যে, এই দ্বিতীয় ধ্রুবসেন সমকালীন বিখ্যাত নৃপতি হর্ষবর্ধনের কাছে পরাজিত হন। এরপর অবশ্য উভয়ের মধ্যে মৈত্রী স্থাপিত হয়, হর্ষ ধ্রুবসেনের সাথে নিজকন্যার বিবাহ দেন। তা ছাড়া হর্ষের প্রয়াগ-মেলাতেও ধ্রুবসেন যোগ দেন।
পরবর্তী রাজা চতুর্থ ধরসেন ছিলেন মৈত্রক বংশের শ্রেষ্ঠ নৃপতি। (৬৪৬-৬৫০ খ্রিঃ) তিনি ‘মহারাজাধিরাজ’ উপাধি নেন। তাঁর সাম্রাজ্য ব্রোচ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এর পরে যথাক্রমে তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শিলাদিত্য বলভী রাজ্যের রাজা হন। এঁদের সামগ্রিক শাসনকাল মোটামুটি ৬৯০ থেকে ৭৭০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সীমিত ছিল। পঞ্চম শিলাদিত্যের রাজত্বকালে বলভী আরবদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। এই ঘটনা ঘটে সম্ভবত অষ্টম শতকের প্রথম ভাগে। যদিও চালুক্য ও প্রতিহারগণ আরবদের বিতাড়িত করতে সক্ষম হয়, তবুও এরপর থেকেই মৈত্রকগণ দুর্বল হয়ে পড়ে। মৈত্ৰক বংশের শেষ নরপতি ছিলেন সপ্তম শিলাদিত্য। এরপর মৈত্রকদের পতন ঘটে। সম্ভবত ওই চালুক্য প্রতিহারদের উত্থান বলভী রাজ্যকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়।
বাণিজ্য ও সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসেবে বলভী রাজ্যের বিশেষ কৃতিত্ব ছিল। সপ্তম-অষ্টম শতকে বলভী নগরী ব্যস্ত বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে সুপরিচিত ছিল। অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের পাশাপাশি বৈদেশিক বাণিজ্যেও বলভীর খ্যাতি ছিল। ভৃগুচ্ছ (ব্রোচ) ও কাথিয়াবাড় ছিল বলভীর দুটি প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র। সারাদেশ থেকে বণিকেরা পণ্যদ্রব্য এনে এখানে জড়ো করতেন এবং সমুদ্রপথে পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন দেশ ও ভূমধ্যসাগরীয় বন্দরগুলিতে সেই পণ্য চালান যেত। চৈনিক পর্যটক হিউয়েন সাঙ এবং ই-সিং ‘বলভীকে আদি-মধ্যযুগের ভারতের অগ্রণী সংস্কৃতির কেন্দ্র’ বলে উল্লেখ করেছেন।
বিশ্বখ্যাত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই বলভীর শিক্ষাকেন্দ্র প্রশংসনীয় ছিল। দেশের নানাপ্রান্তের শিক্ষার্থীরা বলভীতে এসে শিক্ষা নিতেন। বলভীর শিক্ষাকেন্দ্র থেকে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা প্রশাসনের উচ্চপদে নিয়োগের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পেতেন। বলভী নগরীতে বহু খ্যাতনামা পণ্ডিত বসবাস করতেন। বলভীতে অবস্থানকারী সেকালের দুজন প্রখ্যাত পণ্ডিত ছিলেন গুণমতি ও স্থিরমতি। সম্ভবত রাবণবধ মহাকাব্যের রচয়িতা বিশিষ্ট কবি ও ব্যাকরণবিদ ‘ভট্টি’ বলভীতে বসবাস করতেন।
মৈত্রক রাজারা ছিলেন শিক্ষাসংস্কৃতির অনুরাগী। মূলত এঁদের অর্থানুকূল্যে বিভিন্ন শিক্ষাকেন্দ্র পরিচালিত হত। অধ্যাপক আলতেকর (A. S. Altekar) তাঁর ‘Education in ancient India’ গ্রন্থে বলেছেন যে, বলভীর ধনীবণিকরাও শিক্ষাসংস্কৃতি চর্চার জন্য বহু অর্থ ব্যয় করতেন। আঞ্চলিক স্তরের একটি রাজ্য এবং স্বল্প স্থায়িত্বের অধিকারী হলেও বলভী রাজ্য শান্তি ও প্রগতির কেন্দ্র হিসেবে সমকালীন লেখক-পর্যটকদের প্রশংসা পেয়েছে।
কনৌজ : মৌখরী বংশ
ভারতের অন্যতম প্রাচীন উপজাতি গোষ্ঠী হিসেবে মৌখরীদের উল্লেখ বহু প্রাচীন সাহিত্যে পাওয়া যায়। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের টীকাকার পতঞ্জলী এবং খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের বৈয়াকরণিক পাণিনির রচনাতে ‘মৌখরী’ উপজাতির উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে মৌখরী বংশের কার্যকলাপের সূচনা হয় গুপ্ত সাম্রাজ্যের অবক্ষয়ের দিনগুলিতে এবং খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতকে একটি রাজ্যের সংগঠক হিসেবে মৌখরীদের আত্মপ্রকাশ ঘটে। উত্তর ভারতের ভিন্ন ভিন্ন অংশে মৌখরীদের তিনটি শাখা প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিল, যেমন—কনৌজ, বিহারের অন্তর্ভুক্ত গয়া অঞ্চল এবং রাজস্থানের কোটা অঞ্চল। অবশ্য কনৌজের মৌখরীবংশই গুপ্তদের পরবর্তীকালে উত্তর ভারতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। গয়া শাখার অন্তর্ভুক্ত মৌখরী বংশের তিনজন শাসকের নাম জানা যায়, যথা- যজ্ঞবর্মন, শার্দুলবর্মন ও অনন্তবর্মন। গয়া জেলার বরাবর ও নাগার্জুনি পর্বতে প্রাপ্ত তিনটি প্রস্তরলেখ থেকে এঁদের সম্পর্কে জানা যায়। এরা সকলেই সম্ভবত গুপ্তদের অধীনে সামন্ত শাসক হিসেবে সক্রিয় ছিলেন এবং খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতকের প্রথমার্ধের পরে এদের সক্রিয়তা ছিল না।
মৌখরীবংশের নেতৃত্বে কনৌজে একটি শক্তিশালী রাজ্যের প্রতিষ্ঠা ঘটেছিল। মৌখরীরা কীভাবে কনৌজে ক্ষমতাসীন হয়েছিল, সে তথ্য স্পষ্ট নয়। তবে এই বংশের কয়েকজন প্রতিভাবান শাসক কনৌজে ক্ষমতাসীন হয়েছিলেন।
বাণভট্টের হর্ষচরিত গ্রন্থ এবং অসিরগড়, জুনাগড় প্রভৃতি স্থানে প্রাপ্ত কিছু লিপি ও মুদ্রা থেকে কনৌজের মৌখরীবংশ সম্পর্কে নানা তথ্য পাওয়া যায়। বিভিন্ন লেখ ও রাজকীয় সিল বা অভিজ্ঞানপত্র থেকে প্রথমদিকের ছয় জন শাসকের নাম ও বিবরণ জানা যায়। সপ্তম বংশধরের পূর্ণ নাম পাওয়া যায় না। প্রাপ্ত তথ্যাদির ভিত্তিতে অনুমান করা হয় যে, হরিবর্মন কনৌজে মৌখরীবংশের স্বাধীন শাসনের সূচনা করেছিলেন। তবে সার্বভৌমত্ব পেয়েছিলেন কিনা সন্দেহ আছে। হরিবর্মন ‘মহারাজ’ উপাধি নেন, যা তাঁর স্বাধীন কর্তৃত্বের পরিচয় দেয়।
তাঁর পরবর্তী দুই শাসক যথাক্রমে আদিত্যবর্মন ও ঈশ্বরবর্মন ‘মহারাজ’ উপাধিতে ভূষিত ছিলেন। চতুর্থ শাসক ঈশানবর্মন ‘মহারাজাধিরাজ’ উপাধি নেন। এ থেকে অনুমিত হয় যে, প্রথম তিনজন মৌখরী শাসক কনৌজে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করলেও, তাঁরা পরবর্তী গুপ্তশাসকদের প্রতি আনুগত্য বজায় রেখেছিলেন। যাইহোক, হরিবর্মন প্রথমদিকে বিহার ও পরে উত্তরপ্রদেশের সামন্ত প্রধান হিসেবে শাসন পরিচালনা করেছিলেন। হর্ষচরিত গ্রন্থ ও বিভিন্ন শিলালেখ থেকে জানা যায় যে, পরবর্তী গুপ্তরাজাদের সাথে মৌখরীদের সম্পর্কে মাঝে মাঝে উত্তেজনা সৃষ্টি হত। উভয়ের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে সেই উত্তেজনা প্রশমিত করা হত। মহারাজা আদিত্যবর্মনের সাথে গুপ্তরাজা কৃষ্ণগুপ্তের কন্যার বিবাহ সম্পর্কে সেই কূটনীতির পরিণতি ছিল বলে মনে করা হয়।
আদিত্যবর্মনের পুত্র ঈশ্বরবর্মনের আমলে মৌখরীবংশের রাজনৈতিক প্রতিপত্তি অনেকটাই বৃদ্ধি পায়। জৌনপুর প্রস্তরলেখ থেকে জানা যায় যে, ঈশ্বরবর্মন মালবের শাসক যশোধর্মনকে পরাজিত করেছিলেন। বিন্ধ্য পর্বত অতিক্রম করে আগত অস্ত্র-অভিযানকারীদেরও তিনি পরাস্ত করেন। আরও একজন স্থানীয় নৃপতিকে তিনি পরাজিত করে রৈবতক পাহাড়ের ওপারে বিতাড়িত করেছিলেন বলে জানা যায়। অসিরগড় প্রত্নলেখ থেকে জানা যায়, ঈশ্বরবর্মন মগধের গুপ্তবংশীয় রাজকন্যা দেবী উপগুপ্তকে বিবাহ করে নিজের মর্যাদা ও ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছিলেন। হর্ষবর্ধনের লেখতে ঈশ্বরবর্মনকে পরদদুঃখকাতর, ধর্মপ্রাণ, উচ্চাকাঙ্ক্ষী, আত্মবিশ্বাসী এবং সত্যানুসারী শাসক (Compassionate, pious, ambitious, self reliant and truthful ruler) বলা হয়েছে।
ঈশ্বরবর্মনের পুত্র ঈশানবর্মন সর্বপ্রথম ‘মহারাজাধিরাজ’ উপাধি গ্রহণ করেন। এই উপাধি থেকে অনুমিত হয় যে, তিনিই প্রথম মৌখরী শাসক যিনি স্বাধীন ও সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। হরহ শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, তিনি অন্ধ্র, শূলিক ও গৌড়দের পরাজিত করেছিলেন। সম্ভবত পরবর্তী গুপ্তদের সাথে তিনি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছিলেন এবং দামোদর গুপ্ত’র হাতে পরাজিত হয়েছিলেন। তাঁর আমলে মৌখরী রাজ্যের সীমানা সম্পর্কে কিছুটা অস্পষ্টতা আছে। বিভিন্ন মুদ্রা ও লিপির ভিত্তিতে অনুমান করা হয় যে, বর্তমান উত্তরপ্রদেশ এবং মগধের একাংশের ওপর তাঁর শাসন বলবৎ ছিল। দক্ষিণদিকে অসিরগড় পর্যন্ত ঈশানবর্মনের রাজ্যসীমা সম্প্রসারিত ছিল। কেউ কেউ মনে করেন, শতদ্রু পর্যন্ত তাঁর রাজ্য প্রসারিত ছিল। তবে এমন ধারণা যথেষ্ট তথ্য দ্বারা প্রমাণিত নয়।
ঈশানবর্মনের পুত্র ও উত্তরাধিকারী সর্ববর্মন পিতার মতোই ক্ষমতাশালী শাসক ছিলেন। আনুমানিক ৫৭৬-৫৮০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি রাজত্ব করেছিলেন। পরবর্তী শাসক অবন্তীবর্মন দত্ত (৫৮০-৬০০ খ্রিঃ) মৌখরী বংশের সুনাম অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন বলে রমেশচন্দ্র মজুমদার মনে করেন। অবন্তীবর্মনের পরবর্তী শাসক সম্পর্কে কিছুটা অস্পষ্টতা আছে। বাণভট্টের ‘হর্ষচরিত’ গ্রন্থের একটি উদ্ধৃতি থেকে জানা যায় যে, পরবর্তী শাসক ছিলেন অবন্তীবর্মনের জ্যেষ্ঠপুত্র গ্রহবর্মন। এই গ্রন্থের এক জায়গায় পুষ্যভৃতি বংশের রাজা প্রভাকরবর্ধনের কন্যা রাজ্যশ্রীর সাথে অবম্ভীবর্মনের জ্যেষ্ঠ পুত্র গ্রহবর্মনের বিবাহের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু নালন্দা লিপিতে বলা হয়েছে যে, গ্রহবর্মন অবস্তীবর্মনের পুত্র বা উত্তরাধিকারী ছিলেন না। যদিও এখানেও প্রভাকরবর্ধনের কথা রাজ্যশ্রীর সাথে গ্রহবর্মনের বিবাহের কথা স্বীকার করা হয়েছে। তাই গ্রহবর্মনকে অবন্তীবর্মনের উত্তরাধিকারী হিসেবে ধরে নেওয়া যেতে পারে। এই বৈবাহিক সম্পর্ক পুষ্যভূতিবংশ ও মৌখরীবংশের মধ্যে রাজনৈতিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করেছিল। গ্রহবর্মন আনুমানিক ৬০০-৬১০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। গৌড়রাজ শশাঙ্কের মিত্র তথা মালবের শাসক দেবগুপ্তের আকস্মিক আক্রমণে গ্রহবর্মন নিহত হন। গ্রহবর্মনের মৃত্যুর পর কনৌজের শাসনভার প্রভাকরবর্ধনের পুত্র হর্ষবর্ধনের ওপর বর্তেছিল। সম্ভবত হর্ষবর্ধনের প্রতি আনুগত্য জ্ঞাপন করে ছোটো রাজ্যখণ্ডের ওপর কয়েকজন মৌখরীবংশীয় রাজত্ব করতেন। ৭৫৯ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় জয়দেবের একটি প্রত্নলেখতে মৌখরী রাজপুত্র ভোগবর্বনের নামোল্লেখ পাওয়া যায়। অর্থাৎ হর্ষের পরবর্তীকালেও মৌখরীদের অনুজ্জ্বল অস্তিত্ব ছিল, ধরে নেওয়া যায়।
থানেশ্বর-এর পুষ্যভূতি বংশ :
গুপ্ত সাম্রাজ্যের ভাঙনের যুগে ভারতে যে আঞ্চলিক রাজ্যগঠনের উদ্যোগ শুরু হয়েছিল, তাদের অন্যতম ছিল পুষ্যভূতি বংশের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা থানেশ্বর রাজ্য। সমকালীন গড়ে ওঠা অন্যান্য আঞ্চলিক রাজ্যগুলির তুলনায় থানেশ্বরের ইতিহাস কিছুটা স্বতন্ত্র। পুষ্যভৃতি বংশের নেতৃত্বে থানেশ্বর রাজ্য তুলনামুলকভাবে ছিল অধিক প্রসারিত, স্থায়ী এবং শক্তিশালী। বিশেষত এই বংশের অন্যতম শাসক হর্ষবর্ধনের আমলে থানেশ্বরকে কেন্দ্র করে একটি বৃহত্তর সাম্রাজ্য গড়ে ওঠার সম্ভাবনাও দেখা দিয়েছিল। বর্তমান হরিয়ানার আম্বালা জেলায় জনৈক পুষ্পভূতি বা পুষ্যভূতি এই বংশের শাসনের সূচনা করেন। প্রতিষ্ঠাতার নামানুসারে এই রাজবংশ পুষ্যভূতি বংশ নামে পরিচিত হয়। হনরাজ্য ও মগধের মধ্যবর্তী ভূখণ্ডে গড়ে ওঠা থানেশ্বরের শাসকেরা নামের শেষে ‘বর্ধন’ শব্দটি ব্যবহার করতেন।
উপাদান :
পুষ্যভূতি বংশ এবং বিশেষভাবে হর্ষবর্ধনের রাজত্বকাল সম্পর্কে উপাদানের অভাব নেই। সাহিত্যিক ও প্রত্নলেখ উপাদানের প্রাচুর্য এই বংশের ইতিহাস পুনর্গঠনে বিশেষভাবে সাহায্য করে। ভিনসেন্ট স্মিথ (V. A. Smith) বলেছেন যে, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য এবং সম্রাট অশোককে বাদ দিয়ে এত সমৃদ্ধ উপাদান প্রাচীন ভারতীয় অন্য কোনো রাজার ক্ষেত্রে পাওয়া যায়নি। সাহিত্যিক উপাদানসমূহের মধ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হল বাণভট্ট বিরচিত হর্ষচরিত এবং হিউয়েন সাঙ (Yuan chwang)-এর বিবরণমূলক গ্রন্থ সি-ইউ-কি।
৬৩০ থেকে ৬৪৪ খ্রিস্টাব্দে ভারতে অবস্থান ও বিভিন্ন অঞ্চল পরিভ্রমণের অভিজ্ঞতা এই গ্রন্থের বিষয়বস্তু। ড. রাধাকুমুদ মুখার্জীর মতে, “এই গ্রন্থের বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা সরকারি নথির মতোই নির্ভরযোগ্য” (“reads like a Gazetteer in scope of enquiry and its wealth of details. “)। এই বিবরণ থেকে সপ্তম শতকের প্রথমার্ধের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও প্রশাসনিক অবস্থার বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়। হর্ষের জীবনধারা এবং কনৌজের সিংহাসনে আরোহণের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে এই গ্রন্থে বিস্তারিত উল্লেখ আছে, যা হর্ষচরিত গ্রন্থেও নেই। নিজের চোখে দেখা ঘটনাবলির উল্লেখ এই গ্রন্থটিকে অতিরিক্ত মর্যাদা দিয়েছে।
হর্ষবর্ধনের রাজত্বকাল সম্পর্কে আর একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হল তাঁর সভাকবি বাণভট্ট রচিত হর্ষচরিত গ্রন্থ। এই গ্রন্থ থেকে হর্ষের বাল্যকাল, রাজনৈতিক কার্যাবলি, হর্ষের পরিবারের উদারতা এবং সাধারণ মানুষের সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনের নানা তথ্য পাওয়া যায়। পাশাপাশি বাণভট্টের কাদম্বরী গ্রন্থ থেকেও সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতির ধারণা পাওয়া যায়। তবে হর্ষচরিত ও সি-ইউ-কি গ্রন্থের ইতিহাসমূলক তথ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। কারণ বাণভট্ট এবং হিউয়েন সাঙ দুজনেই ছিলেন হর্ষের অনুগ্রহপুষ্ট। স্বভাবতই তাঁদের রচনায় পৃষ্ঠপোষকর প্রতি বীর-পূজা (hero worship) জাতীয় মনোভাব থাকা অসম্ভব নয়। ধর্মীয় কারণেও শশাঙ্কের প্রতি এঁদের অনাস্থা ছিল। হিউয়েন সাঙ-এর ক্ষেত্রে ভারতের ভাষাগত ও কৃষ্টিগত অজ্ঞতাও সত্যানুসন্ধানের পক্ষে একটা বাধাস্বরূপ ছিল। অবশ্য গ্রন্থ দুটির বক্তব্যের মধ্য থেকে সত্য ও কল্পনাকে পৃথক করে নেওয়া খুব কষ্টকর নয়।
সাহিত্য-উপাদান হিসেবে দণ্ডিন-এর দশকুমারচরিত নাটকটিও গুরুত্বপূর্ণ। হর্ষের কিছু আগে রচিত এই গ্রন্থ থেকে সমকালীন আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতির ধারণা পাওয়া যায়। হর্ষবর্ধন নিজেও ছিলেন সাহিত্যানুরাগী। হর্ষ রচিত তিনটি নাটক রত্নাবলী, প্রিয়দর্শিকা ও নাগানন্দ সমকালীন সমাজ, ধর্ম ও আর্থিক জীবনের আভাস দেয়।
প্রত্নতাত্ত্বিক লেখমালা থেকেও হর্যের রাজত্বকালের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি পাওয়া যায়। হর্ষবর্ধন তাঁর সিংহাসনারোহণ উপলক্ষ্যে ৬০৬ খ্রিস্টাব্দে হর্ষাব্দ নামক অব্দের প্রবর্তন করেছিলেন। হর্ষাব্দ গণনার ভিত্তিতে তিনি ২২-তম রাজ্যবর্ষে বাঁশঘেরা (৬২৮ খ্রিঃ) এবং ২৫-তম রাজ্যবর্ষে মধুবন তাম্রশাসন (৬৩১ খ্রিঃ) উৎকীর্ণ করেছিলেন।
এই দুটি লেখ থেকে তাঁর কর্মধারার বহু তথ্য পাওয়া যায়। হর্ষবর্ধনের দাক্ষিণাত্য অভিযানের উল্লেখ পাওয়া যায় চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশীর ‘আইহোল প্রশস্তি’ (৬৩৪ খ্রিঃ) থেকে। অন্যান্য চালুক্য রাজাদের উৎকীর্ণ করনুল, টোগরচেডু প্রভৃতি তাম্রশাসন থেকেও পুষ্যভূতি বংশের ইতিহাসমূলক তথ্যাদি পাওয়া যায়।
হর্ষবর্ধনের বহু মুদ্রা পাওয়া গেছে। এগুলিও তাঁর রাজত্বকালের আর্থিক অবস্থা এবং বিশেষ করে কালানুক্রম সম্পর্কে নানা তথ্য সরবরাহ করে।
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।