আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “বাহমনী রাজ্য— উত্থান ও পতন” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
বাহমনী রাজ্য— উত্থান ও পতন
দিল্লির সুলতানি-সাম্রাজ্যের অবক্ষয়ের কালে গড়ে ওঠা রাজ্যগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল বাহমনী রাজ্য। দক্ষিণ ভারতের এই মুসলমান-শাসিত রাজ্যটি ছিল দক্ষিণের আর একটি সমসাময়িক হিন্দুরাজ্য বিজয়নগরের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী। মহম্মদ-বিন-তুঘলকের রাজত্বকালে দক্ষিণ ভারতে সুলতানিতে নানা গোলযোগ দেখা দিয়েছিল। এজন্য বিশেষভাবে দায়ী ছিলেন ‘সাদাহ’ আমিরগণ। একশোটি করে গ্রামের দায়িত্বপ্রাপ্ত আমিরদের ‘সাদাহ’ বলা হত। উচ্চশ্রেণিভুক্ত ও প্রতিপত্তিশালী সাদাহ-আমিরদের বিশেষ কর্তৃত্ব ছিল দক্ষিণ ভারতের প্রশাসন ও সাধারণ মানুষের ওপর। সুলতান মহম্মদ-বিন-তুঘলক সাদাহ আমিরদের ক্ষমতা খর্ব করার পরিকল্পনা করলে এরা প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন এবং বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। নানা সমস্যায় বিব্রত সুলতান এদের দমন করার উদ্দেশ্যে স্বয়ং দৌলতাবাদে উপস্থিত হলেও, কাজ অসমাপ্ত রেখে গুজরাটে ছুটে যেতে বাধ্য হন। বিদ্রোহীরা দৌলতাবাদ দখল করে ইসমাইল মুখ নামক জনৈক আমিরকে ‘স্বাধীন সুলতান’ বলে ঘোষণা করেন। কিন্তু ইসমাইল স্বেচ্ছায় আলাউদ্দিন হাসান নামক আর এক আমিরের পক্ষে সিংহাসন ত্যাগ করেন। এই আফগান প্রথম জীবনে ‘গঙ্গু’ নামক জনৈক ব্রাহ্মণের অধীনে কাজ করতেন। তাই তিনি হাসান গঙ্গু নামে বেশি পরিচিত ছিলেন। যাই হোক্, তিনি ‘আলাউদ্দিন হাসান বাহমন শাহ’ উপাধি নিয়ে সিংহাসনে বসেন (১৩৪৭ খ্রিঃ)। হাসান নিজেকে ইরানের পৌরাণিক বীর বাহমনের বংশধর বলে দাবি করতেন, সম্ভবত এই কারণে তাঁর রাজ্য বাহমনী রাজ্য নামে পরিচিত হয়।
বাহমন শাহ নিঃসন্দেহে একজন দক্ষ শাসক ছিলেন। সুযোদ্ধা ও প্রশাসক হিসেবে তিনি যথেষ্ট খ্যাতি পান। তিনি নবগঠিত রাজ্যের সীমানা উত্তরে ওয়াইনগঙ্গা নদী থেকে দক্ষিণে কৃষ্ণা নদী পর্যন্ত এবং পূর্বে ভেঙ্গীর পশ্চিমে দৌলতাবাদ পর্যন্ত সম্প্রসারিত করেছিলেন। প্রশাসনের সুবিধার্থে তিনি গুলবর্গায় রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। সারারাজ্যকে চারটি তরফ বা প্রদেশে বিভক্ত করা হয়। এগুলি হল গুলবর্গা, দৌলতাবাদ, বেরার এবং বিদর। প্রতি অংশের দায়িত্ব একজন গভর্নরের হাতে ন্যস্ত ছিল। প্রাদেশিক শাসকেরা সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসন চালনার ক্ষেত্রে যথেষ্ট স্বাধীনতা ভোগ করতেন। ‘বুরহান-ই-মাসির’ গ্রন্থে বাহমান শাহকে একজন ন্যায়পরায়ণ ও প্রজাদরদী শাসক বলে অভিহিত করা হয়েছে। সমকালীন লেখক ইসামীও তাঁর প্রশংসা করে লিখেছেন : “একজন সফল শাসকের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় তিনটি গুণই বাহমন শাহের মধ্যে ছিল; তিনি সর্বদাই অত্যাচারিতের পাশে থাকতেন, দীনদরিদ্রের প্রতি ছিল তাঁর গভীর দয়া এবং ধর্মে স্থির থাকার জন্য তিনি চূড়ান্ত কষ্টস্বীকারেও রাজি ছিলেন।”
বাহমন শাহর মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসেন তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র প্রথম মহম্মদ শাহ (১৩৫-‘৭৩ খ্রিঃ)। ইনিও সুযোদ্ধা ও সুদক্ষ শাসক ছিলেন। মহম্মদ শাহ বাহমনী রাজ্যের দক্ষিণ-পূর্ব ও দক্ষিণ পশ্চিমে প্রতিষ্ঠিত হিন্দু-রাজ্যদ্বয় যথাক্রমে বরঙ্গল ও বিজয়নগরের বিরুদ্ধে দীর্ঘসংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন। তিনি কঠোর হাতে অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহও দমন করেন। যোদ্ধা ও সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি তাঁর আগ্রহের প্রশংসা করে অধ্যাপক শেরওয়ানী (H. K. Sherwani) লিখেছেন: “Mahammad Shah (1) was one of the greatest rulers of the Bahamani Dynasty. By his campaign in the East and the South, he demonstrated to his neighbours the power of the new Sultanate. He sought the company of the learned and made the Deccan the centre of the learned.”
পরবর্তী শাসক আলাউদ্দিন মুজাহিদ (১৩৭৩-‘৭৭ খ্রিঃ) ছিলেন ব্যর্থ শাসক। তিনি বিজয়নগর রাজ্যের দুটি যুদ্ধেই পরাজিত হন। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে তিনি পারসিক ও তুর্কি মুসলমানদের অধিক গুরুত্ব ও মর্যাদা প্রদান করে মহাভুল করেন। এর ফলে ভারতীয় মুসলমানদের সাথে বহিরাগত মুসলমানদের দ্বন্দ্বের সূচনা হয়— যা পরিণামে রাজ্যের প্রচণ্ড ক্ষতি করে। জনৈক আত্মীয় দাউদের হাতে মুজাহিদ নিহত হলে সাময়িক বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। অবশেষে দ্বিতীয় মহম্মদ শাহ (১৩৭৮ *৯৭ খ্রিঃ) সিংহাসনে বসেন। তবে ইনি ছিলেন একান্তভাবে যুদ্ধবিরোধী ও শান্তিপ্রিয় মানুষ। তাই কোনো যুদ্ধ তিনি করেননি। তবে সাধারণ মানুষের সুখসুবিধা বৃদ্ধি ও শিক্ষা-সাহিত্যের প্রসারে তাঁর উদ্যোগের অভাব ছিল না। অতঃপর তাঁর দুই পুত্র যথাক্রমে গিয়াসউদ্দিন ও সামসউদ্দিন কয়েক মাসের জন্য সিংহাসনে বসেন। ১৩৯৭ খ্রিস্টাব্দে বাহমন শাহর জনৈক পৌত্র ফিরোজ সিংহাসন দখল করেন এবং ‘তাজউদ্দিন ফিরোজ শাহ’ উপাধি নিয়ে শাসন শুরু করেন।
বাহমনী রাজ্যের অন্যতম কৃতি সুলতান ছিলেন ফিরোজ শাহ বাহমন (১৩৯৭-১৪২২ খ্রিঃ)। খেরলার গণ্ডরাজা নরসিংহ রায়কে পরাজিত করে তিনি বেরারের দিকে রাজ্যবিস্তার করেন। এখান থেকে তিনি প্রচুর সোনা-রূপা ও হাতি উপঢৌকন হিসেবে লাভ করেন। বিজয়নগররাজ প্রথম দেব রায়কে পরাজিত করে তিনি রাজ্যের মর্যাদা বৃদ্ধি করেন। অবশ্য ১৪১৯ খ্রিস্টাব্দে প্রথম দেবরায়ের কাছে তিনি পরাজিত হন। এই পরাজয়ের ফলে ফিরোজের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব হ্রাস পায়। তাঁর বয়োবৃদ্ধি ও মতিভ্রমের সুযোগে তাঁর দুইজন প্রিয় ক্রীতদাস ক্ষমতা কুক্ষিগত করে নেয়। সুলতানের ভ্রাতা আহম্মদের বিরুদ্ধে এরা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এই সূত্রে শুরু হয় গৃহযুদ্ধের। এই গৃহযুদ্ধে দাক্ষিণাত্যের জনপ্রিয় সুফিসন্ত গেসুদরাজ আহম্মদকে সমর্থন করেন। শেষ পর্যন্ত ফিরোজ ভায়ের অনুকূলে সিংহাসন ত্যাগ করতে বাধ্য হন। এর কয়েকদিন মধ্যেই তিনি মারা যান।
ফিরোজ শাহের রাজত্বকালের অন্যতম গুরুত্ব এই যে, তিনি বাহমনী রাজ্যকে ভারতের সংস্কৃতির প্রধান কেন্দ্রে পরিণত করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। ধর্মশাস্ত্র ও প্রকৃতিবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তাঁর যথেষ্ট জ্ঞান ছিল। কবিতা রচনায় তিনি ছিলেন পারদর্শী। ফেরিস্তার মতে, ফিরোজ কেবল ফারসি, আরবি বা তুর্কি ভাষাতেই নয়, তেলেগু, কানাড়ি, মারাঠি প্রভৃতি দক্ষিণ ভারতীয় ভাষাতেও পারদর্শী ছিলেন। তাঁর রাজসভায় দেশি-বিদেশি গুণীর সমাবেশ ঘটেছিল। দিল্লি-সুলতানির অস্থিরতার ফলে সেখান থেকে বহু পণ্ডিত দক্ষিণ ভারতের ফিরোজের সভায় আশ্রয় পান। ফিরোজ মনে করতেন যে, রাজার কাছে নানা দেশের জ্ঞানীগুণী ব্যক্তির সমাবেশ হওয়া উচিত; কেননা তাঁর কাছ থেকে দেশবিদেশের খবর সংগ্রহ করে রাজা নিজের জ্ঞানভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করতে পারবেন। গভীর রাত পর্যন্ত তিনি কবি, দার্শনিক ধর্মবিদদের সঙ্গে আলোচনা করতেন। খ্রিস্টান ধর্মগ্রন্থ ‘বাইবেল’ সম্পর্কেও তাঁর জ্ঞান ছিল যথেষ্ট। বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্ট ও নিউ টেস্টামেন্ট তিনি আগ্রহের সাথে আদ্যোপান্ত পাঠ করেন। জ্যোতির্বিদ্যাচর্চার জন্য ফিরোজ দৌলতাবাদে একটি ‘মানমন্দির’ নির্মাণের ব্যবস্থা করেছিলেন। ফিরোজ শাহের আর একটি উল্লেখযোগ্য কাজ হল শাসনকার্যে হিন্দুদের নিয়োগ। শোনা যায়, তিনি রাজস্ববিভাগে বহু দক্ষিণী ব্রাহ্মণকে নিযুক্ত করেছিলেন। তাঁর উদ্যোগে চাউল ও দাভোল বন্দর দুটির সংস্কার করা হয়। ফলে পারস্য উপসাগর ও লোহিত সাগরের পথে ভারতের সাথে বহির্বাণিজ্য সম্প্রসারিত হয়। ‘বুরহান-ই-মাসির’ গ্রন্থে ফিরোজ শাহকে একজন ন্যায়পরায়ণ ও অতুলনীয় শাসক বলে প্রশংসা করা হয়েছে। তবে ফেরিস্তার মতে, নানা মানবিক গুণের অধিকারী ফিরোজের চরিত্রের সীমাবদ্ধতাও ছিল। তিনি ছিলেন ঘোর মদ্যপ, তাঁর হারেমটি ছিল খুবই বৃহৎ, সেখানে নানা জাতির নারী থাকতেন, সংগীতের প্রতিও তাঁর গভীর আসক্তি ছিল। এই সকল দুর্বলতা তাঁর পতনের অন্যতম কারণ ছিল।
আহম্মদ শাহ (১৪২২-৩৫ খ্রিঃ) বাহমনী রাজ্যের হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেন। বিজয়নগর রাজ্যকে পরাজিত করে তিনি বহু অর্থ সংগ্রহ করেন এবং পূর্ব-পরাজয়ের গ্লানি দূর করেন। বিজয়নগরের মিত্রদেশ বরঙ্গলের রাজাকে পরাস্ত করে বহু ভূখণ্ড তিনি দখল করেন। বরঙ্গলের অধিকাংশ অঞ্চল দখল করার ফলে বাহমনী রাজ্য প্রভূত শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং দক্ষিণ ভারতের শক্তিসাম্য বিঘ্নিত হয়। মালব ও কোঙ্কনের শাসকদেরও তিনি পরাস্ত করেন। নিরাপত্তার কারণে তিনি গুলবর্গা থেকে বিদরে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন (১৪২৫ খ্রিঃ)। আহম্মদ শাহ ধর্মান্ধ ছিলেন, তবে বিদ্বান ব্যক্তির প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল।
আহম্মদ শাহের রাজত্বকালে তাঁর দরবারে অভিজাতদের মধ্যে পরস্পরবিরোধী দুটি দলের সৃষ্টি হয়েছিল। একদিকে ছিল সুন্নিপন্থী স্থানীয় মুসলমানগণ, অন্যদিকে ছিল তুর্কি, পারসিক, আরবীয় প্রভৃতি বহিরাগত মুসলমানগণ। এই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ফলে বাহমনী শাসন দুর্বল হয়ে পড়েছিল।
আহম্মদ শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দ্বিতীয় আলাউদ্দিন শাহ সিংহাসনে আরোহণ করেন (১৪৩৫-৫৭ খ্রিঃ)। সিংহাসনে বসেই তিনি খান্দেশ ও কোঙ্কনের বিদ্রোহ দমন করেন। তাঁর সময়ে বিজয়নগরের রাজা দ্বিতীয় দেবরায় রায়চুর-দোয়ার আক্রমণ করেন। কিন্তু দেবরায় পরাজিত হন এবং করদানে প্রতিশ্রুত হন। তিনি বেশকিছু প্রজাকল্যাণমূলক কাজ করেন। শিক্ষা ও শিক্ষিতের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধাবোধ ছিল।
পরবর্তী শাসক হুমায়ুন শাহ (১৪৫৭-‘৬১ খ্রিঃ) ছিলেন অকর্মণ্য ও অত্যাচারী। এজন্য জনগণ তাঁকে ‘জালিম’ (oppressor) নামে অভিহিত করেন। হুমায়ুনের মৃত্যুর পর তাঁর নাবালক পুত্র নিজাম শাহ সিংহাসনে বসেন (১৪৬১-৬৩ খ্রিঃ)। তাঁর নাবালকত্বের সুযোগে উড়িষ্যা ও তেলেঙ্গানার রাজারা বাহমনী রাজ্য আক্রমণ করেন। তিনি অকালে মারা গেলে সিংহাসনে বসেন তাঁর ভ্রাতা তৃতীয় মহম্মদ শাহ। তিনিও ছিলেন বিলাসপ্রিয়, নৈতিক চরিত্রহীন ও অযোগ্য শাসক ; কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে সেই সময়ে মামুদ গাওয়ান নামক জনৈক দক্ষ ও দেশপ্রেমিক মন্ত্রীর উত্থান ঘটে।
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।