“বাহিরের দিক হইতে কমলাকান্তের দপ্তর কয়েকটি হালকা ব্যঙ্গ-হাস্য-দুঃখ বেদনামূলক প্রবন্ধের সমষ্টি কিন্তু একটু তালাইয়া দেখিলে বুঝা যাইবে, এই বিচ্ছিন্নতার মধ্যে একটা মূলতত্ত্ব ওতপ্রোত হইয়া আছে, ইহাই কমলাকান্তের দর্শন।” এই উক্তিটি সম্বন্ধে সবিস্তারে আলোচনা করো

‘কমলাকান্তের দপ্তর’ বঙ্কিমচন্দ্রের নিভৃত মনের দুঃখাভিভূত চিন্তার যোগফল। তাঁহার স্বদেশ এবং স্বজাতির নানারকমের ত্রুটি-বিচ্যুতি অন্ধ গোড়ামি এবং কুসংস্কারাচ্ছন্নতা আত্মবিস্মরণের নির্বিকারত্ব লক্ষ্য করিয়া তাঁহার হৃদয়সমুদ্রে বিক্ষোভের উত্তাল তরঙ্গ উৎক্ষিপ্ত হইয়া উঠিয়াছিল। বঙ্কিমের সেই বিক্ষুব্ধ হৃদয়ের প্রকাশ তাঁহার উপন্যাসে লক্ষিত হয়। কিন্তু তাহাতে তাঁহার ক্ষোভ বিরাম লাভ করে নাই। আর তাছাড়া উপন্যাসে বঙ্কিম নৈর্ব্যক্তিকতার আশ্রয় লইয়াছেন। যাই হোক, সমাজ সংসার সম্বন্ধে কিন্তু বলিতে গেলে নৈর্ব্যক্তিক হইলে চলে না। তবে যে সমাজ এবং সংসার সম্পর্কে কছু বলিতে হইবে,তাহা হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া না আসিলে বক্তব্য পরিস্ফুট হয় না। অথচ বঙ্কিম এই সমাজ সংসার হইতে বিচ্ছিন্ন নিরাসক্ত না হইয়াও উপযুক্ত একটি পন্থা অবলম্বন করিলেন। সে পন্থাটি কমলাকান্ত নামক কোনও নেশাখোর ভবঘুরে, ছন্নছাড়া, নিরাসক্ত, নিরভিমান চরিত্রের পরিকল্পনা। আমরা শ্রীভীষ্মদেব খোশনবীশের নিকট হইতে জানিতে পারি, কমলাকান্তের অর্থেরও বেশি প্রয়োজন ছিল না। কমলাকান্ত কখনও দারপরিগ্রহ করেন নাই। যেখানে হয় দুইটি অন্ন এবং আধ ভরি আফিম পাইলেই হইত। যেখানে সেখানে পড়িয়া থাকিত। “অনেক দিন আমার বাড়ীতে ছিল। আমি তাহাকে পাগল বলিয়া যত্ন করিতাম। কিন্তু আমিও তাহাকে রাখিতে পারিলাম না সে কোথাও স্থায়ী হইত না। একদিন প্রাতে উঠিয়া ব্রহ্মচারীর মতো গেরুয়া বস্ত্র পরিয়া কোথায় চলিয়া গেল। কোথায় চলিয়া গেল? আর তাহাকে পাইলাম না, সে এ পর্যন্ত আর ফিরে নাই।”

কমলাকান্ত আর প্রত্যাবর্তন করে নাই। না করুক ক্ষতি নাই, তাহার অগস্ত্য যাত্রাকালে সে তাহার দপ্তরটি শ্রীভীষ্মদেব খোশনবীশের নিকট গচ্ছিত রাখিয়া গিয়াছিল। কমলাকান্ত আর ফিরিয়া না আসাতে তিনি সেই দপ্তরটি জনসমাজে প্রচার করিলেন। তিনি বলিলেন, “এই দপ্তরটিতে সুনিদ্রার অভ্যুৎকৃষ্ট ঔষধ আছে—যিনি পড়িবেন, তাঁহারই নিদ্রা আসিবে। যাঁহারা অনিদ্রা রোগে পীড়িত তাঁহাদিগের উপকারার্থে আমি কমলাকান্তের রচনাগুলি প্রচারে প্রবৃত্ত হইলাম।”

শ্রীভীষ্মদেব খোশনবীশ যাই বলুন, আমরা যখন এই দপ্তরগুলি পাঠ করি, তখন আমাদের নিদ্রাকর্ষণ তো দূরের কথা, মস্তিষ্ক এবং হৃদয় দুই-ই গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়। আমরা আমাদের অসঙ্গতি দুর্বলতা ত্রুটি বিচ্যুতি সম্বন্ধে সচেতন হইয়া উঠি। অতএব দেখা যাইতেছে শ্রীভীষ্মদের খোশনবীশের উক্তির ভিতর শ্লেষ রহিয়াছে।

কমলাকান্ত পাগল বটে। আমরা জানি, এই জগৎ ও জীবন সম্পর্কে সে চরমভাবে উদাসীন। তাহার উক্তিতেও নির্বিকার ঔদাসীন্য। কিন্তু সেই প্রলাপ উক্তির পশ্চাতে যে বৃহত্তর অর্থ আত্মগোপন করিয়া আছে, তাহার প্রতি সচেতন সজ্ঞান মানুষের সজাগ দৃষ্টি পরিবেই।

কমলাকান্ত লেখাপড়া জানিত। সংস্কৃত এবং ইংরাজী তাহার জানা ছিল। ইহার দ্বারা তাহার বেশি মাহিনায় চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু চাকরি পাইতে গেলে যে পদলেহনের ক্ষমতা থাকা দরকার কমলাকান্তের তাহা ছিল না। চাকরি অবশ্য সে পাইয়াছিল, তবে চাকরিতে তাহার মন ছিল না। সরকারি খাতায় সে কবিতা লিখিত। কমলাকান্তের চাকরি টিকিল না। চাকরির প্রয়োজনও ছিল না তাহার। কারণ অর্থের প্রতি তাহার আকর্ষণ নাই। আকর্ষণ শুধু অহিফেন এবং দুগ্ধে। প্রসন্ন গোয়ালিনী তাহার দুগ্ধ যোগানোর ভার লইয়াছিল।

কমলাকান্তের চরিত্র-রূপায়ণে আমরা লক্ষ্য করি বঙ্কিম তাঁহার একটি বিশেষ উদ্দেশ্য এবং অভিলাষ পূরণ করিয়াছেন। সমাজ-বিচ্ছিন্ন মানুষই সমাজের ত্রুটি বিচ্যুতি সম্বন্ধে মন্তব্য করিবার অধিকারী। তাহার মন্তব্য শুনিয়া মনে হয়, সে যেন এই জগৎ, সমাজ সংসার সম্পর্কে বহুদর্শী। তাহার এই দর্শন সে যখন অপরকে শোনায় তখন তাহা আপাতদৃষ্টিতে প্রলাপোত্তি বলিয়া বোধ হয় কিন্তু সে প্রলাপোক্তির মূল্যবান ব্যঞ্জনাময় অর্থকে কোনক্রমেই অস্বীকার করা যায় না।

বস্তুত বঙ্কিমের উদ্দেশ্যও তাহাই। তিনি একনিষ্টচিত্তে অনুধাবন করিয়াছেন সমাজ ও সংসারকে। দেখিয়াছেন এই সমাজ সংসার অসঙ্গতিতে পরিপূর্ণ। অথচ কেহই এই অসঙ্গতির বিরুদ্ধে একটি বাক্যও উচ্চারণ করিতেছে না। করিবার কথাও নয়। কেননা এই জগৎ ও জীবন একটি অখণ্ড মায়ায় আচ্ছন্ন। উক্ত মায়ায় মানুষ আপন অভিমান, অহঙ্কার স্বার্থপরতা ভালোমন্দ লইয়া ব্যতিব্যস্ত। এই মায়ায় মানুষ পতঙ্গের মতো যশ, ধন, রূপ ও ইন্দ্রিয় বিদ্যা প্রভৃতি উত্তপ্ত বহ্নিসদৃশ বস্তুতে আত্মাহুতি দিয়া জীবনের একটি বৃহত্তর সূক্ষ্ম ব্যঞ্জনা বিস্মৃত হইতেছে। শুধু তাহাই সব নয়, আপন মঙ্গল চিন্তায় মানুষ এত বেশি মশগুল যে, পরহিতের শুভ চিন্তাও বিসৰ্জ্জন দিয়া বসিয়া আছে। মানুষ তো বসন্তের কোকিল মাত্র। এই জগৎ জুড়িয়া আছে একটি বড়বাজার যেখানে বিদ্যা, রূপ ও যশ লইয়া এক বিরাট ফাঁক এবং ফাঁকির কারবার চলিতেছে। অথচ ফাঁক এবং ফাঁকির কোনও প্রতিকার হইবার অবকাশ মিলিতেছে না। বঙ্কিম লক্ষ্য করিয়াছেন, এই পৃথিবী একটি বৃহত্তর ঢেঁকিশালা বিশেষ। ঢেঁকির কাজ ধান্য পেষা। এই ঢেঁকি আর কেহ নয়, জমিদার, আইনবিদ, শিক্ষক যাহাদের একমাত্র কাজ দরিদ্র নিঃসহায় নির্জীব মানুষ-ধান্যকে পিষিয়া নির্মমভাবে নিপীড়ন এবং শোষণ করা। এই নিপীড়ণের এবং শোষণের কোনও বিচার হয় না। সে বিচারের দাবী নীরবে নিভৃতে কাঁদে। এই কান্নার সুর বঙ্কিম শুনিয়াছিলেন বিড়ালরূপ শোষিত জনসমাজের ম্লান মূক মুখে। মানব প্রেমিক বঙ্কিম এই অবিচার অন্যায় কোনক্রমেই সহ্য করিতে পারেন না। অথচ ইহার বিরুদ্ধেই বঙ্কিমের প্রচণ্ড বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহের বাণী প্রচার করিতে গেলে যে সমাজে বসবাস করা হয়, সে সমাজ হইতে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন নিরাসক্ত নির্বিকার হইতে হইবে। বিক্ষুব্ধ বঙ্কিমের সেই নির্বিকার সমাজ-বিচ্ছিন্ন নিরাসক্ত আত্মার প্রতীক স্বয়ং কমলাকান্ত। যাহারা সমাজ-বিচ্ছিন্ন তাহারা যে বৈরাগী ও উন্মাদকল্প হইবে, ইহাতে আর বৈচিত্র্য কি।

কমলাকান্তের দপ্তরের ইহাই হইতেছে প্রাক্-ভূমিকা। বঙ্কিমের একটি বিশিষ্ট দর্শন এবং মানসচিন্তা কমলাকান্তের চরিত্রের মধ্যে প্রতিফলিত। ‘কমলাকান্তের দপ্তর-এ কমলাকান্তের নানা অসংলগ্ন প্রলাপোক্তি ব্যঙ্গ বিদ্রূপ হাস্যকৌতুকের মাধ্যমে পরিবেশিত হইয়াছে। কিন্তু আপাত-অসংলগ্ন হইলেও কমলাকান্তের চৌদ্দটি দপ্তরের বক্তব্যবিষয়ের মধ্যে একটি অখণ্ড ঐক্য পরম নীরবতায় কাজ করিয়া গিয়াছে। সে ঐক্য হইতেছে, মানুষকে মায়ার রঙীন পর্দা ছিঁড়িয়া ফেলিয়া নিরাসক্ত মনের অধিকারী হওয়ার প্রেরণা দেওয়া। অবশ্য কয়েকটি দপ্তরে সে ঐক্য রক্ষিত হয় নাই। কিন্তু তাহা বুঝি আংশিক সত্য। ‘একটি গীত’ ‘আমার দুর্গোৎসব’ প্রভৃতি রচনাগুলির কথা এই প্রসঙ্গে বলা যাইতে পারে। কিন্তু একটু তলাইয়া দেখিলে বুঝিতে পারিবে, সেখানেও বঙ্কিমের উদ্দেশ্যে পুর্বোল্লিখিত ঐক্য বর্তমান। বাঙালির পক্ষে আত্মবিস্মরণ ভুলিয়া মুক্তমনের পরিচয় দেওয়ার ভিতরই সেই পরম ঐক্য বর্তমান। কমলাকান্তের দপ্তরের প্রথম দপ্তরটি পাঠ করিলেই আমরা দেখিতে পাইব, কমলাকান্তরূপী বঙ্কিমের উদ্দেশ্য উদগাটিত হইয়াছে। কমলাকান্ত সমাজ-বিচ্ছিন্ন জীব হইলেও সমাজের সামগ্রিক ভবিষ্যৎ শুভচিন্তায় নিযুক্ত। কমলাকান্ত বলিয়াছে, ‘আমি একা। কিন্তু ইহাও বলিয়াছে, ‘কেহ একা থাকিও না। কারণ কমলাকান্ত মনুষ্যপ্রীতি ছাড়া আর কিছুই জানে না। কমলাকান্ত সংসারত্যাগী বৈরাগী উন্মাদসদৃশ হইয়াও বলিয়াছে, ‘প্রীতিই আমার কর্ণে এখনকার সংসার সঙ্গীত। এই প্রীতিরূপ মহাসঙ্গীতই কমলাকান্তের চৌদ্দটি দপ্তরে মধুগুঞ্জন তুলিয়াছে। বলা বাহুল্য, ওই মহাসঙ্গীত পরিবেশন করাই বঙ্কিমের উদ্দেশ্য। কমলাকান্তের দর্শন, সেই দর্শন পরিবেশন করিতে সে যত রসিকতা ব্যঙ্গ বিদ্রূপ হাস্যরসের শর্করা মিশ্রিত করুক না কেন, সে দর্শন অবিসংবাদিতভাবে মনুষ্যপ্রেমের। মনুষ্যপ্রেম বঙ্কিমের একমাত্র অনুষ্ঠেয় কর্ম। সেই কর্ম-সম্পাদনকালে মনুষ্যের নানা ত্রুটি বিচ্যুতিকে নিরঙ্কুশভাবে দূর না করিলে মনুষ্যপ্রেমে খাদ মিশিয়া থাকিবে। কমলাকান্তের দপ্তর রচনা করিয়া বঙ্কিম সেই নিখাদ মনুষ্যপ্রেমের পরাকাষ্ঠা দেখাইয়াছেন, যাহা কমলাকান্তের দপ্তরের একমাত্র কেন্দ্রবস্তু।

আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।

Leave a Comment