আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে ““বিড়াল” রচনায় নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে য়ুরোপীয় শিক্ষা ও সভ্যতার প্রতি কীভাবে ব্যঙ্গ প্রকাশিত হয়েছে আলোচনা করো। এই প্রসঙ্গে ধনতন্ত্র সমাজতন্ত্রের মধ্যে দ্বন্দ্বের উদ্ঘাটন করো” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
“বিড়াল” রচনায় নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে য়ুরোপীয় শিক্ষা ও সভ্যতার প্রতি কীভাবে ব্যঙ্গ প্রকাশিত হয়েছে আলোচনা করো। এই প্রসঙ্গে ধনতন্ত্র সমাজতন্ত্রের মধ্যে দ্বন্দ্বের উদ্ঘাটন করো
কমলাকান্তের দপ্তর এর অন্যতম বিশিষ্ট রচনা “বিড়াল”। এটি “বঙ্গদর্শন” পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় চৈত্র ১২৮১ বঙ্গাব্দে। কমলাকান্তীয় রচনারীতির অন্যতম প্রধান এই রচনাটিতে ভাবগত কিছু স্বাতন্ত্র্য রয়েছে অন্যান্য রচনা করে। এই একই মানসিকতায় অন্য উল্লেখযোগ্য রচনা হল ‘সাম্য’। সম্ভবত ফরাসি বিপ্লবের ভাবধারা এই রচনাগুলির সৃষ্টির ক্ষেত্রে আংশিক প্রভাব ফেলেছিল। অবশ্য পরবর্তীকালে অনুশীলন তত্ত্বে বঙ্কিমচন্দ্র এই বিশেষ অগ্রগামী চিন্তার জগৎ থেকে কিছুটা সরে এসেছিলেন।
“কমলাকান্তের দপ্তর” আঙ্গিকের দিক থেকে এটি একটি পরীক্ষামূলক রচনা।
সাহিত্যের বহু সার্থক স্রষ্টাই আত্মপ্রকাশের মাধ্যমে হিসাবে স্বতন্ত্র কিছু সৃষ্টির প্রেরণা অন্তরে অনুভব করেন। যেমন রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন “লিপিকা”, “গল্পস্বল্প’-এর মতো রচনা। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রধান পরিচয় ঔপন্যাসিক হিসাবে; কিন্তু প্রাবন্ধিক হিসাবেও তাঁর কীর্তি উপন্যাস সৃষ্টির চেয়ে কিছু কম নয়। অথচ কবিতা দিয়ে শুরু হয়েছিল তাঁর জীবন। আর কমলাকান্তের এই রচনাগুলিতে পাওয়া যায় নাটকীয়তার স্বাদ। কয়েকটি নির্ধারিত চরিত্রের কথোপকথনের মধ্য দিয়ে ও কাহিনির অংশ বিন্যস্ত হয়েছে। ঘটনাগুলির মধ্যে একটা ধারাবাহিকতার সুরও খুব প্রচ্ছন্ন হয়। ভীষ্মদেব খাশনবীশ (যিনি কমলকান্ত চক্রবর্তীর সমগ্র রচনাবলীর রক্ষক এবং প্রকাশক), কমলাকান্ত স্বয়ং, প্রসন্ন গোয়ালিনী—এই তিনটি প্রধান চরিত্র ছাড়া বিভিন্ন রচনায় সংলাপগুলি ভাষা পেয়েছে নসীরামবাবু ও তার কন্যা, বিড়াল, দেবরাজ, বড়ো বাজারের ক্রেতা-বিক্রেতা ইত্যাদিদের কণ্ঠে। কলমাকান্তের জোবানবন্দি, রচনাটি সম্পূর্ণ তাই নাটকীয়তায় গুনে সমৃদ্ধ। এখানে সাক্ষী কমলাকান্ত ফরিয়াদি প্রসন্ন গোয়ালিনী, উকিলদ্বয়, কাহিনি, চাপরাসী, মুহুরী সকলে মিলে উৎকৃষ্ট নাটকীয় বাতাবরণে সৃষ্টি করেছেন। নাটক রচনা করলে বঙ্কিম যে অনায়াসেই সাফল্যের দ্বারা প্রান্তে পৌঁছে যেতেন, তার প্রমাণ রয়েছে কমলাকান্তের এইসব নাটকীয় রস সমৃদ্ধ সংলাপে।
মূলত সংলাপই নাটকের প্রাণ। ছটি নাট্য-উপাদানের মধ্যে সংলাপ আত্মপ্রকাশ করে Character এবং diction— এই দু’টি উপাদানের মধ্য দিয়ে। বাংলা নাটকের প্রথম যুগে নাটকীয় চরিত্রগুলির কণ্ঠে উচ্চারিত হত দীর্ঘ সংলাপ। ‘শমিষ্ঠা’, ‘পদ্মাবতী’ এমন কি ‘নীলদর্পণে’ও তার উদাহরণ আছে। ‘বিড়াল’ রচনার প্রথমার্ধে বক্তৃতার ঢং-এ বিড়ালের কণ্ঠে এইরকম দীর্ঘ সংলাপই উচ্চারিত হয়েছে। যুক্তি, তর্ক, ন্যায়নীতির জাল বিস্তার ক’রে বিড়াল নিজ মতো প্রতিষ্ঠার প্রতি এক যত্নশীল হয়েছে যে, কমলাকান্তের বক্তব্য সেখানে নিষ্প্রভ। নাটকীয় রীতিতে সেই সংলাপ অনায়াসে বিন্যস্ত করা যেতে পারে—
বিড়াল। সমাজের ধন বৃদ্ধির অর্থ ধনীর ধন বৃদ্ধি। ধনীর ধন বৃদ্ধি না হইলে দরিদ্রের কী ক্ষতি?
কমলাকান্ত। সামাজিক ধন বৃদ্ধি ব্যতীত সমাজের উন্নতি নাই।
বিড়াল। আমি যদি খাইতে না পাইলাম, তবে সমাজের উন্নতি লইয়া কি করিব।
এই উক্তি-প্রত্যুক্তিগুলির মধ্যেই নিহিত রয়েছে ধনতন্ত্র সমাজতন্ত্রের দ্বন্দ্বের বীজ। ধনতন্ত্র চায় সামগ্রিক ধনসম্পদে ক্ষমতাশালীর ধনসম্পদে পরিণত করতে; আর সমাজতন্ত্র চায় সমগ্র সমাজের মধ্যে ধনের বন্টন। শত শত দরিদ্রকে শোষণ ক’রে একজন কি দু’জন লোক অর্থে-সম্পদে স্ফীত হয়ে উঠবে এবং ধন সঞ্চয় ও ধন বৃদ্ধির দ্বারা সামাজিক উন্নতি ঘটাবে— সমাজতন্ত্রীদের কাছে এটা অলীক কল্পনা। কেননা, এখানে রয়েছে সামাজিক শোষণ। তার চাপে দরিদ্র ক্রমশ মৃত্যুর দিকে অনিবার্যভাবে এগিয়ে যাবে। কিন্তু অনাহারে মৃত্যুবরণ করার জন্য কেউ পৃথিবীতে আসেনি। এই পৃথিবীর চেতনা বিড়ালের কণ্ঠে শেষ পর্যন্ত যেভাবে উচ্চারিত হয়েছে—তার কেড়ে নেবার বা প্রচ্ছন্ন বিপ্লব পন্থার পূর্বসূচনা গোপন করেনি। কেননা বঙ্কিম বৃষজাতীয় পলিটিকস-এ বিশ্বাসী ছিলেন।
এই রচনায় একই সঙ্গে শাসক ও শোষক ইংরেজ, ধর্মপ্রচারক ইংরেজ এবং আধুনিক সভ্যতার ধ্বজাধারী ইংরেজের প্রতি বঙ্কিমচন্দ্র অত্যন্ত সূক্ষ্ম ব্যঙ্গ প্রদর্শন করেছেন। ওয়াটার্লুর যুদ্ধজয়ী ইংরেজ সেনাপতি ডিউক অব্ ওয়েলিংটনকে বিড়াল করে কমলাকান্ত ইংরেজের যুদ্ধপ্রিয়তাকে ব্যঙ্গ করেছেন। বিড়াল যখন বিজ্ঞ চতুষ্পদের কাছে শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে আমাদের জ্ঞানোন্নতির প্রসঙ্গে আধুনিক বিদ্যালয়ের কথা বলেছে—তখন বিলাতের অনুকরণে চেয়ার টেবিল-ডেকস্-বেঞ্চ দিয়ে স্কুল সাজানোর প্রতি বঙ্কিমের কটাক্ষের পরিচয় পাওয়া যায়। উপকরণের বাহুল্য প্রকৃত শিক্ষার অন্তরায়—চতুষ্পদ চেয়ার-টেবিলই যেন এখন আমাদের শিক্ষক। নিউম্যান ও পার্কারের ধর্মতন্ত্রের গ্রন্থের কথা উল্লেখ করে লেখক এখানে ব্যঙ্গ করেছেন মানব-নিরপেক্ষ পলায়নবাদী জ্ঞানপিপাসুদের প্রতি। চূড়ান্ত ও শেষ ব্যঙ্গটি খ্রিস্টান পাদ্রীদের প্রতি—পতিত আত্মাকে অন্ধকার থেকে আলোকে আনবার “মহান” দায়িত্ব নিয়ে ভারতে এসেছিলেন তাঁরা। তাঁদের থেকে অ-খ্রিস্টান মানেই পতিত আত্মা। স্ব-জাতি, ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতির প্রতি প্রবল অনুরাগী বঙ্কিমচন্দ্র এইভাবে আমাদের চেতনার প্রহরী হয়েছিলেন সেই প্রতিকূল সময়ে।
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।