আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “বিদেশি পর্যটকদের দৃষ্টিতে বিজয়নগরের অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতি” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
বিদেশি পর্যটকদের দৃষ্টিতে বিজয়নগরের অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতি
পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে একাধিক পর্যটক ও দূত ভারতে এসেছিলেন। এঁদের অনেকেই বিজয়নগর রাজ্যে অবস্থান করে সমকালীন অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেন এবং তা লিপিবদ্ধ করেন। বিজয়নগরের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে এইসব বিবরণীর গুরুত্ব অপরিসীম। পঞ্চদশ শতকের প্রথমদিকে বিজয়নগরের রাজা দ্বিতীয় দেবরায়-এর রাজত্বকালে (১৪২২-‘৪৬ খ্রিঃ) দুজন পর্যটক এদেশে এসেছিলেন। ইতালিদেশীয় পর্যটক নিকোলো কন্টি (Nicolo Conti) ১৪২২ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ বিজয়নগরে আসেন। তাঁর অভিজ্ঞতার বিবরণ পোপের সচিব প্রথমে ল্যাটিন ভাষায় লিপিবদ্ধ করেন। পরে এটি পোর্তুগীজ ভাষায় অনূদিত হয়। আরও পরে রামুসিও (Ramusio) এটিকে ইতালি ভাষায় অনুবাদ করেন। পারসিক দূত ও পর্যটক আব্দুর রজ্জাক ১৪৪২ খ্রিস্টাব্দে ‘কালিকট বন্দরে উপস্থিত হন। এক বছর পর তিনি বিজয়নগরে এসে উপস্থিত হন। ষোড়শ শতকের প্রথমদিকে পোর্তুগীজদের সঙ্গে বিজয়নগরের বাণিজ্যিক সম্পর্কের দ্রুত উন্নতি ঘটতে থাকে। বাণিজ্যিক সূত্রে বহু পোর্তুগীজ বণিক বিজয়নগরে এসে উপস্থিত হন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দুজন হলেন ডোমিনগোস পায়েজ (Domingos Paes) এবং ফার্নাও নুনিজ (Fernao Nuniz) । বিজয়নগর রাজ্যের স্বর্ণময় যুগে পায়েজ এই রাজ্যে আসেন (১৫২২ খ্রিঃ)। তাঁর প্রায় দশ-পনেরো বছর পরে আসেন নুনিজ। এঁদের আগমনকালে বিজয়নগরের রাজা ছিলেন নৃপতিতিলক কৃষ্ণদেব রায়। পায়েজ-এর ভ্রমণকাহিনিতে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে রাজ্যের চিত্রাকর্ষক প্রকৃতি ও পরিবেশ, নগর-শহর, স্থাপত্য-ভাস্কর্য ইত্যাদি। অন্যদিকে নুনিজ গুরুত্ব দিয়েছেন ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর ওপর।
বিজয়নগরের আর্থিক চিত্র :
বিদেশি পর্যটকদের বিবরণী থেকে বিজয়নগরের ঐশ্বর্য, চাকচিক্য এবং জনসাধারণের আর্থিক প্রাচুর্যের আভাস পাওয়া যায়। এঁদের বর্ণনায় রাজধানী-নগরী বিজয়নগরের এক মনোরম চিত্র ফুটে উঠেছে। বিজয়নগর ছিল সমকালীন বিশ্বের অন্যতম সম্পদশালী রাজ্য। বিজয়নগরের বর্ণনা প্রসঙ্গে নিকোলো কন্টি লিখেছেন : “শহরের পরিধি ছিল ৬০ মাইল; এর দেওয়ালগুলি দূরের পাহাড়ঘেরা উপত্যকা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এই শহরে প্রায় ৯০ হাজার অস্ত্রধারণে সক্ষম পুরুষ বাস করত। ভারতের যে-কোনো রাজার থেকে এখানকার রাজা ছিলেন অধিক শক্তিশালী।” পারসিক দুত আব্দুর রজ্জাক লিখেছেন: “দেশটি এতই জনবহুল যে, তার প্রকৃত চিত্র লিখে বোঝানো কষ্টকর। রাজার কোষাগারে একাধিক প্রকোষ্ঠ আছে, যার প্রতিটি তরল সোনায় পরিপূর্ণ। রাজ্যের সমস্ত উচ্চ-নীচ, এমনকি বাজারের কারিগররাও দেহের নানা অঙ্গে অলংকারাদি পরিধান করত।” পোর্তুগীজ পর্যটক পায়েজ বিজয়নগরকে বিশ্বের সেরা শহর হিসেবে চিহ্নিত করে এখানকার সমৃদ্ধ বাণিজ্যের উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেনঃ “এখানকার উন্নত বহির্বাণিজ্যের কারণে বিশ্বের নানা দেশের লোকের সন্ধান পাওয়া যায়। বাজারগুলিতে নানা ধরনের সামগ্রী, ধান, চাল, ডাল, গম, বার্লি প্রভৃতি মজুত থাকত। খাদ্যদ্রব্যের দাম খুবই সম্ভা।” পায়েজ বিজয়নগরের রাজার অপরিময়ে ঐশ্বর্য ও হাতি, ঘোড়া-সহ বিশাল সেনাবাহিনীর কথাও উল্লেখ করেছেন। এডোয়ার্ডো বারবোসা (Edoardo Barbosa) নামক জনৈক পর্যটক ১৫১৬ খ্রিস্টাব্দে এদেশে আসেন। তিনিও বিজয়নগর রাজ্যের আর্থিক প্রাচুর্য ও বাণিজ্যিক সমৃদ্ধির কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেনঃ “নগরটি ছিল সুবিস্তৃত, জনবহুল এবং বাণিজ্যে অগ্রণী। পেগুর সাথে হীরা, রুবি, চিন ও আলেকজান্দ্রিয়ার সাথে সিল্ক এবং মালাবারের সাথে চন্দনকাঠ, কর্পূর ও নানা ধরনের মশলার বাণিজ্য চলত।”
বিদেশি পর্যটকদের সকলেই প্রায় একমত যে, বিজয়নগর রাজ্যে লক্ষণীয় আর্থিক সচ্ছলতা ছিল। সমস্ত মানুষের আয়ব্যয় হয়তো সমান ছিল না; উচ্চবিত্তের পাশে নিম্নবিত্ত মানুষ অনেক ছিল; কিন্তু সাধারণভাবে যাকে দারিদ্র্যের যন্ত্রণা বলে, তা বিজয়নগরের কোনো মানুষকেই ভোগ করতে হত না। দেশের এই সমৃদ্ধির প্রধান উৎস ছিল কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের অগ্রগতি। কৃষিক্ষেত্রে বিজয়নগর ছিল খুবই উন্নত। পায়েজ লিখেছেনঃ “এদেশে প্রচুর ধান ও অন্যান্য শস্য, শিম-জাতীয় ফসল এবং আমাদের দেশে হয় না এমন সব শস্য উৎপন্ন হয় ; কার্পাসের প্রচুর চাষ হয়। এদেশে অসংখ্য গ্রাম, শহর ও বড়ো বড়ো নগর আছে। কৃষি-উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে রাজাদের সজাগ দৃষ্টি ছিল। বেশিসংখ্যক জমিকে সেচের আওতায় আনার জন্য এবং অনাবাদী জমিকে চাষযোগ্য করে তোলার জন্য সরকারের তরফে নানা ব্যবস্থা গৃহীত হয়। সরকারি আয়ের প্রধান উৎস ছিল ভূমিরাজস্ব। সাধারণভাবে উৎপন্ন ফসলের এক-ষষ্ঠাংশ ভূমিরাজস্ব হিসেবে আদায় করা হত। তবে দেশের প্রয়োজনে রাজস্বের হার বৃদ্ধি করা হত। অবশ্য শস্যভেদে, মৃত্তিকাভেদে এবং সেচভুক্ত ও অসেচভুক্ত এলাকায় রাজস্বের হারে তারতম্য ছিল। যেমন—একটি শিলালিপি থেকে জানা যায়, ‘শীতকালে কুরুভয়ি (ধান) উৎপন্নের এক তৃতীয়াংশ; তিল, রাগী, ছোলা ইত্যাদির এক-চতুর্থাংশ; জোয়ার ও শুকনো জমির উৎপন্নের এক ষষ্ঠাংশ’ রাজস্ব দিতে হত। ভূমিরাজস্ব ছাড়াও প্রজাদের সম্পদ-কর, বিক্রয় কর, যুদ্ধ কর, বিবাহ কর ইত্যাদি নানা ধরনের অতিরিক্ত কর দিতে হত।”ষোড়শ শতকে আগত পর্যটক নিতিন লিখেছেনঃ “রাজ্যে বহু লোকের বাস ছিল। পল্লী অঞ্চলের লোকদের অবস্থা ছিল শোচনীয়; কিন্তু অভিজাতরা ছিলেন অতি সমৃদ্ধিশালী এবং বিলাসব্যসনে মত্ত।” ড. সতীশ চন্দ্র মনে করেন যে, বিদেশি পর্যটকগণ বিজয়নগরের কৃষকদের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে এক ধরনের কথা বলেননি। তার প্রধান কারণ হল অধিকাংশ পর্যটক গ্রামীণ জীবনযাত্রা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না। শিল্প উৎপাদনের ক্ষেত্রে বস্ত্র শিল্প, খনি-শিল্প ও ধাতু ছিল প্রধান। এ ছাড়া সুগন্ধ দ্রব্য উৎপাদনে বিজয়নগরের খ্যাতি ছিল।
বিজয়নগরের আর্থিক সমৃদ্ধির মূলে কৃষির পরেই ছিল বাণিজ্যের স্থান। অভ্যন্তরীণ ও বহির্বাণিজ্য উভয় ক্ষেত্রেই বিজয়নগর ছিল অগ্রণী একটি দেশ। সারাদেশে একাধিক ব্যস্ত বন্দর ছিল। আব্দুর রজ্জাক এখানে তিনশো বন্দরের উল্লেখ করেছেন। মালাবার উপকূলে এ যুগের ব্যস্ততম বন্দর ছিল কালিকট। পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ, ব্রহ্মদেশ, মালয় উপদ্বীপ, চিন, আরব, পারস্য, দক্ষিণ আফ্রিকা, আবিসিনিয়া, পোর্তুগাল প্রভৃতি দেশের সাথে বিজয়নগরের বাহির্বাণিজ্য চলত। প্রধান রপ্তানি দ্রব্যাদির মধ্যে ছিল নানা ধরনের বস্ত্র, সুগন্ধি মশলা, চাল, চিনি, সোরা, লোহা ইত্যাদি। বিদেশ থেকে আমদানি হত প্রধানত ঘোড়া, হাতি, তামা, কয়লা, পারদ, প্রবাল, ভেলভেট ইত্যাদি। অন্তর্দেশীয় বাণিজ্যও যথেষ্ট সমৃদ্ধ ছিল। স্থলপথে ও জলপথে অন্তর্দেশীয় বাণিজ্য চলত। স্থলপথে ঘোড়া বলদ ও গো-শকটে মাল পরিবহণ হত। সমুদ্রের উপকূলবর্তী বন্দরগুলিকেও অন্তর্দেশীয় বাণিজ্যে ব্যবহার করা হত। উপকূলের বাণিজ্যে ছোটো ছোটা জলযান ব্যবহৃত হত। তবে বিজয়নগরে বড়ো জাহাজও তৈরি হত। বারবোসা দক্ষিণ ভারতের মালদ্বীপে বড়ো জাহাজ তৈরির কারখানা ছিল বলে উল্লেখ করেছেন। তা ছাড়া, রাজাদের উৎকীর্ণ কিছু কিছু লিপি থেকেও অনুমান করা হয় যে, জাহাজ-নির্মাণশিল্প সেকালে আজানা ছিল না। পোর্তুগীজ বণিকদের সাথে বিজয়নগরের সুসম্পর্কের প্রেক্ষিতে ধারণা করা যায় যে, জাহাজ শিল্প ও জাহাজের ব্যবহার সম্পর্কে বিজয়নগরের অধিবাসীরা যথেষ্ট অভিজ্ঞ ছিল। অবশ্য অনেকের অভিযোগ এই যে, প্রতিরক্ষার প্রয়োজনে দক্ষ নৌবাহিনী গড়ার ব্যাপারে বিজয়নগরের শাসকেরা যথেষ্ট উদাসীন ছিলেন।
এ যুগে শিল্প ও বাণিজ্যে ‘গিল্ড’ বা বণিকসংঘের বিশেষ গুরুত্ব ছিল। একই ধরনের শিল্প বা ব্যবসা শহরের নির্দিষ্ট স্থানে গড়ে ওঠার প্রবণতা ছিল। আব্দুর রজ্জাক লিখেছেন : এক-এক ধরনের শিল্প বা ব্যবসার জন্য এক-একটি স্বতন্ত্র গিল্ড বা সংঘ গড়ে উঠত। গিল্ডের তত্ত্বাবধানে এই ব্যবসা শহরের নির্দিষ্ট অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত হত। পায়েজের বর্ণনাতেও ব্যবসায়ী সংঘ এবং কেন্দ্রীভূত বাণিজ্যকেন্দ্র গড়ে ওঠার কথা পাওয়া যায়।
বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে বিজয়নগরে মুদ্রার প্রচলন ছিল। সোনা ও তামার মুদ্রার প্রচলন ছিল বেশি। সামান্য পরিমাণ রৌপ্যমুদ্রাও প্রচলিত ছিল। মুদ্রাগুলির গায়ে নানা ধরনের কারুকার্য করা থাকত। মুদ্রাতে দেবদেবীর মূর্তি ও পশুপাখির ছবি খোদিত থাকত। সাধারণত উচ্চ ও মধ্য শ্রেণিভুক্ত লোকেদের আর্থিক সচ্ছলতা ছিল এবং এঁরা বিলাসব্যসনে জীবন অতিবাহিত করতে অভ্যস্ত ছিলেন। তবে দেশের সাধারণ মানুষ ছিলেন গরিব। অবশ্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে বা জীবনধারণের ন্যূনতম সংস্থানের অভাব কারও ক্ষেত্রে ছিল না। বিজয়নগরের আর্থিক ব্যবস্থার অন্যতম ত্রুটি হল এই যে, করভারের বোঝাটা মূলত নিম্নবিত্ত সাধারণ মানুষকেই বহন করতে হত। অবশ্য বিজয়নগরের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা বাহমনী রাজ্যের থেকে অনেক বেশি সুস্থ ও সমৃদ্ধ ছিল।
বিজয়নগরের সমাজজীবন :
বিদেশি পর্যটকদের বিবরণ ও দেশীয় সূত্র থেকে বিজয়নগরের সমাজজীবনের বিস্তারিত চিত্র পাওয়া যায়। জাতিভেদ প্রথা এবং আনুষঙ্গিক সামাজিক সম্পর্কের ধারা বিজয়নগরে বর্তমান ছিল। জাতিভেদ প্রথার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সমাজব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখাই রাজার অন্যতম কর্তব্য বলে বিবেচিত হত। প্রখ্যাত কবি পেড্ডান রচিত মনচরিত্রম-গ্রন্থে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রদের যথাক্রমে বিশ্রুলু, রাজুলু, মোতিকিরাতল এবং নলভজতিভারু বলে অভিহিত করা হয়েছে। সমাজে ব্রাহ্মণদের সর্বাধিক সম্মান ছিল। বিজয়নগরের রাজারা ব্রাহ্মণদের বিশেষ মর্যাদা দিতেন। ফলে সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনে ব্রাহ্মণদের বিশেষ কর্তৃত্ব তো ছিলই; ক্রমে রাজনীতিতেও তাদের প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছিল। পর্যটক নুনিজ ব্রাহ্মণদের সৎ, দক্ষ, পরিশ্রমী, তীক্ষ্ণ মেধাসম্পন্ন এবং হিসাবশাস্ত্রে পারদর্শী বলে অভিহিত করেছেন। পায়েজ লিখেছেন : “ব্রাহ্মণ স্ত্রী-পুরুষেরা ফর্সা ও সুন্দরী ; অন্যান্য জাতির লোকদের মধ্যে ফর্সার সংখ্যা খুবই কম।” সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান পালনের ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণদের অনুমোদন জরুরি ছিল। বারবোসা’র বিবরণীতেও সমাজের বর্ণভেদের কথা স্বীকৃত হয়েছে। তিনি লিখেছেন : “গ্রামাঞ্চলে হিন্দুর সংখ্যাই বেশি, মুসলমান ছিল খুবই সংখ্যাল্প। হিন্দু-সমাজে ক্ষত্রিয়রা ছিলেন যোদ্ধা ও প্রশাসক গোষ্ঠীর অন্তর্গত। রাজা নিজেও এই শ্রেণিভুক্ত ছিলেন। ব্রাহ্মণরা ধর্ম ও তৎসংক্রান্ত বিষয় তত্ত্বাবধান করতেন। জাতিভেদ প্রথা থাকলেও বিভিন্ন জাতির মধ্যে মেলামেশার কঠোরতা ছিল না।”
বিজয়নগরের সমাজে নারীর বিশেষ মর্যাদা ছিল। রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতির নানা ক্ষেত্রে নারীরা সক্রিয় অংশগ্রহণ করতেন। মুষ্টিযুদ্ধ, অস্ত্রবিদ্যা, মল্লযুদ্ধ কাজেও নারীরা রপ্ত ছিলেন। সংগীত, নৃত্য, সাহিত্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে নারীদের দক্ষতা ছিল প্রশংসনীয়। গঙ্গাদেবী, তিরুমালাম্মা ছিলেন সে যুগের প্রখ্যাত কবি। রাজমহিষীরাও সংগীতে যথেষ্ট পারদর্শিনী ছিলেন। পায়েজ লিখেছেন : “অন্তঃপুরে অনেক স্ত্রীলোক ছিল—যাদের হাতে ঢাল-তলোয়ার থাকত, যারা তুরী, বাঁশি বা অন্য বাদ্যযন্ত্র বাজাত। কুক্তি লড়ার জন্যেও মেয়েছেলে ছিল।” নুনিজের বর্ণনা থেকেও এই বক্তব্য সমর্থিত হয়। তিনি লিখেছেনঃ “বিজয়নগরের রাজা নারী মল্লযোদ্ধা, নারী-দ্বাররক্ষী, নারী-জ্যোতিষী ও নারী-হিসাবরক্ষক নিয়োগ করতেন।” বিদেশিদের বিবরণ অনুযায়ী বিজয়নগরের নারীদের দুটি ভাগে ভাগ করা যায়; যথা—গৃহস্থঘরের নারী ও ভ্রষ্টা নারী। গৃহস্থঘরের নারীরা ছিলেন সুন্দরী এবং কদাচিৎ তাঁরা ঘরের বাইরে বেরোতেন। এই কারণে পায়েজ এদের ‘অসামাজিক’ বলে অভিহিত করেছেন। স্রষ্টা নারীদের দু-ভাগে ভাগ করা যায়; যথা- (১) যারা রাজধানীতে হালকা অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে স্বাধীনভাবে জীবিকা সংগ্রহ করতেন এবং (২) দেবদাসী। দেবদাসীদের ভরণপোষণ চলত মন্দিরের আয় থেকে। পর্যটকরা দেবদাসীদের ভ্রষ্টচরিত্রা বলে উল্লেখ করেছেন। তবে সাধারণ দেহোপজীবিনীর সাথে দেবদাসীদের পার্থক্য নির্ণয় করা বিদেশি পর্যটকদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। সাধারণ দেহোপজীবিনীদের অবস্থা খুবই সচ্ছল ছিল। আবদুল রজ্জাক লিখেছেন : “এদের বাড়ির জাঁকজমক, এঁদের সৌন্দর্য ও কটাক্ষ বর্ণনার অতীত। তাদের দেহ দামী পোশাক ও মণিমুক্তায় সুশোভিত থাকে।”
সমাজে বাল্যবিবাহ, পুরুষদের বহুবিবাহ এবং সতীদাহ প্রথা প্রচলিত ছিল। সতীদাহ পুণ্যকাজ বলে বিবেচিত হত। সচ্ছলশ্রেণির লোকের বিবাহে পণপ্রথার ব্যাপকতা ছিল। বিদেশি পর্যটকরা রাজাদের অসংখ্য পত্নী দেখে বিস্মিত হয়েছেন। নিকোলো কন্টি লিখেছেন : “দেবরায়ের বারো হাজার পত্নী ছিলেন।” নুনিজ লিখেছেন : “রাজা অচ্যুতরায়ের পত্নীর সংখ্যা ছিল পাঁচ শত।” তবে পায়েজের বিবরণ থেকে জানা যায় যে, “রাজা কৃষ্ণদেবরায়ের আইনসম্মত বারোজন রানি ছিলেন, তার মধ্যে মাত্র তিন জন রানির সন্তান সিংহাসনের দাবিদার হতে পারত।” যাই হোক, এই পরিসংখ্যান কিছুটা অতিরঞ্জিত হলেও একথা অনস্বীকার্য যে, মুঘল হারেমের তুলনায় বিজয়নগরের রাজাদের অন্তঃপুর ছিল অনেক বড়ো।
খাদ্যাভ্যাসের দিক থেকে বিজয়নগরের অধিকাংশ মানুষ ছিলেন মাংসভোজী। কেবল ব্রাহ্মণরা নিরামিষভোজী ছিলেন। রাজাও মাংস ভক্ষণ করতেন। গোরু বা বলদের মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। নুনিজ লিখেছেন : “বাজারে অবাধে পশুপাখির মাংস কেটে বিক্রি করা হত।” তবে বিজয়নগরের রাজা ও অব্রাহ্মণদের খাদ্যতালিকা দেখে ড. ভি. স্মিথ কিছুটা বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। হিন্দুত্ববাদের রক্ষক এবং বৈষ্ণবধর্মাবলম্বী শাসক ও সাধারণ মানুষের এত বেশি মাংসভোজী হওয়ার কথা এবং প্রাণীহত্যার ঘটনা তাঁর কাছে কিছুটা অবাস্তব মনে হয়েছে।
বিজয়নগরের সংস্কৃতির ধারা :
বিদেশি পর্যটকরা বিজয়নগরের উন্নত ও সুস্থ সাংস্কৃতিক জীবনের প্রশংসা করেছেন। সাহিত্য ও শিক্ষা-সংস্কৃতিতে বিজয়নগরের খ্যাতি ছিল সর্বজনবিদিত। রাজা কৃষ্ণদেবরায় ছিলেন পণ্ডিত ও সাহিত্যের একান্ত অনুরাগী। অন্যান্য রাজারাও সাহিত্য-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। রাজাদের উদ্যোগে ভাষা-সাহিত্যের অভাবনীয় উন্নতি ঘটে। এ যুগে সংস্কৃত, তেলেগু, তামিল ও কানাড়ি ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। সংস্কৃত ভাষার প্রভাবমুক্ত তামিল ভাষা-সাহিত্যের বিকাশ এ যুগের প্রধানতম অবদান। সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত ও বেদের ভাষ্যকার সায়নাচার্য এবং তাঁর ভাই মাধব বিদ্যারণ্য বিজয়নগরের উত্থানের সাথে যুক্ত থেকে এই রাজ্যকে একটি সাংস্কৃতিক ভিত্তি দেন। কৃষ্ণদেব রায়ের আমলে সাহিত্যকীর্তি গৌরবের শীর্ষে আরোহণ করে। সমকালীন বহু পণ্ডিত, সাহিত্যিক, দার্শনিক, জ্যোতির্বিদ, নাট্যকার তাঁর রাজসভা অলংকৃত করেন। এঁরা অষ্টদিগ্গজ নামে খ্যাত ছিলেন। কৃষ্ণদেব স্বয়ং বহু সাহিত্য রচনা করেছেন। রাজপরিবারের সদস্য, কর্মচারী প্রমুখও বিজয়নগরের সাংস্কৃতিক ধারার বিকাশে বিশেষভাবে সচেষ্ট ছিলেন। এদের আগ্রহে দর্শন, তর্কবিদ্যা, ব্যাকরণ, সংগীত, নৃত্যকলা, নাটক ও জ্ঞানবিজ্ঞানের অন্যান্য নানা বিষয়ে এ যুগে বহু সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছিল।
শিল্পস্থাপত্যের দিকটিও বিজয়নগর রাজ্যে অবহেলিত ছিল না। শিল্পস্থাপত্যের প্রতি বিজয়নগরের রাজাদের সহজাত আকর্ষণ ছিল। রাজা কৃষ্ণদের রায় ছিলেন এক মহান নির্মাতা। নীলকণ্ঠ শাস্ত্রীর মতে, বিজয়নগর রাজ্যে দক্ষিণ ভারতীয় শিল্পস্থাপত্য স্বাধীন, স্বতন্ত্র ও চূড়ান্ত রূপে প্রকাশ পায়। বিজয়নগরের শাসকদের প্রধান লক্ষ্য ছিল মুসলমানদের আক্রমণের পরে অবশিষ্ট যে হিন্দু শিল্পস্থাপত্য টিকে আছে, তাকে রক্ষা করা এবং ব্যাপক সংস্কারের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত সৌধ, মন্দির ইত্যাদিকে স্বমহিমায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা। পুরোনো মন্দিরগুলিকে সংযোজিত হলঘর, মণ্ডপ ইত্যাদি দ্বারা অধিকতর প্রশস্ত ও সুন্দর করে তোলার প্রয়াস নেওয়া হয়। মন্দিরের বামদিকে গড়ে তোলা হয় ‘কল্যাণমণ্ডপ’। অসংখ্য থামবিশিষ্ট ছাদের নীচে ঠিক মাঝখানে রাখা হয় একটি মঞ্চ। এখানে রাজকীয় উৎসব-অনুষ্ঠানে দেবতার প্রতিষ্ঠা ও আরাধনা করা হত। থাম বা স্তম্ভগুলির বিচিত্র ও জটিল অলংকরণ ছিল বিজয়নগর শিল্পরীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য। বিশালাকার এক-একটি পাথরখণ্ডের ওপর অসংখ্য ভাস্কর্যকর্ম দ্বারা স্তম্ভগুলিকে অলংকৃত করা হত। তুঙ্গভদ্রার দক্ষিণতীরের প্রায় সর্বত্র বিজয়নগর শিল্পরীতির নিদর্শন ছড়িয়ে আছে। তবে সর্বাধিক সুন্দর ও বিচিত্র শিল্পগুণে সমৃদ্ধ ছিল বিজয়নগর শহরটি। বিজয়নগরের দুটি দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য সৃষ্টি হল ‘হাজার-রাম’ মন্দির ও ‘বিঠলস্বামী’ মন্দির। কৃষ্ণদেব রায়ের আমলে হাজার মন্দিরটিকে বিশেষজ্ঞরা “হিন্দুস্থাপত্যশৈলীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন” বলে উল্লেখ করেছেন।
বিজয়নগরের স্থাপত্যকর্মের আর একটি অমর দৃষ্টান্ত হল ‘বিঠলস্বামী মন্দির’। পর্যটকেরা বিজয়নগর শহর ও রাজপ্রাসাদের নির্মাণশৈলীর প্রশংসা করেছেন। রাজপ্রাসাদটি ছিল অতি-সুরক্ষিত দুর্গবিশেষ। আব্দুর রজ্জাক লিখেছেন : “সারা পৃথিবীতে বিজয়নগরের মতো শহর চোখে দেখিনি, কানেও শুনিনি। সাতটি প্রাচীর দিয়ে নগরটি তৈরি হয়েছে। প্রত্যেকটি প্রাচীর দুর্গ দ্বারা সুরক্ষিত। নগরের মধ্যস্থলে আছে সপ্তম দুর্গটি, এই দুর্গটি হিরাট শহরের প্রধান বাজারটির দশগুণেরও বেশি জমি অধিকার করে আছে।” পায়েজের মতে, “বিজয়নগর রাজপ্রাসাদটি লিসবনের দুর্গের থেকেও বড়ো।” বিজয়নগরের স্থাপত্যকর্মে ইন্দোসারাসেনীয় (বা ইন্দোপারসিক) স্থাপত্যরীতির প্রভাব স্পষ্ট। মন্দিরগুলির ক্ষেত্রে পল্লব বা জৈনরীতির প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। বিজয়নগর রাজ্যটি ইসলামের বিরুদ্ধে হিন্দুধর্মের রক্ষক হিসেবে গড়ে উঠলেও, ধর্মীয় অনুদারতা এই রাজ্যকে গ্রাস করেনি। নাগরিকদের ধর্মাচরণের ক্ষেত্রে অবাধ স্বাধীনতা ছিল, সামরিক বাহিনীতে বহু মুসলমান সদস্য ছিল। নাগরিকদের মধ্যে যেমন মুসলমানরা ছিল, তেমনি শিল্পের ক্ষেত্রেও ইসলামীয় রীতির চর্চা অব্যাহত ছিল। শিল্প, সাহিত্য, স্থাপত্য, ধর্ম—প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিজয়নগর রাজ্য এক সমন্বয়ী নিরপেক্ষ ও আদর্শবোধ দ্বারা উদ্বুদ্ধ ছিল। বিজয়নগরের উন্নত সংস্কৃতিমনস্কতার প্রেক্ষিতে জনৈক ঐতিহাসিক লিখেছেন : “The empire brought about a synthesis of South Indian culture.”
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।