আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “‘বীরাঙ্গনা কাব্য’-এর ‘সোমের প্রতি তারা’ পত্রে ‘তারা চরিত্র কতটা বিদ্রোহিনী তা আলোচনা করে দেখাও” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
‘বীরাঙ্গনা কাব্য’-এর ‘সোমের প্রতি তারা’ পত্রে ‘তারা চরিত্র কতটা বিদ্রোহিনী তা আলোচনা করে দেখাও
“অতএব পাঠকবর্গ সেই বাল্মীকিবর্ণিতা বিকটা শূর্পণখাকে স্মরণপথ হইতে দূরীকৃত করিবেন”। বীরাঙ্গনা কাব্য-এর ‘লক্ষ্মণের প্রতি শূর্পণখা’ পত্রের সূচনায় মধুসূদনের এই উক্তি স্মরণে রেখে তাঁর সৃষ্ট শূর্পণখা চরিত্রের বৈশিষ্ট্যগুলি পরিস্ফুট করে কবির মৌলিকতা নির্দেশ করো।
কবি মাইকেল মধূসূদন দত্ত ‘লক্ষ্মণের প্রতি শূর্পণখা’ পত্রের শুরুতে বলেছেন, “যৎকালে রামচন্দ্র পঞ্চবটী বনে বাস করেন, লঙ্কাধিপতি রাবণের ভগিনী শূর্পণখা রামানুজের মোহন রূপে মুগ্ধ হইয়া, তাঁহাকে এই নিম্নলিখিত পত্রিকাখানি লিখিয়াছিলেন। কবিগুরু বাল্মীকি রাবণের পরিবারবর্গকে প্রায়ই বীভৎস রস দিয়া বর্ণনা করিয়া গিয়াছেন; কিন্তু এ স্থলে সে রসের লেশ মাত্রও নাই। অতএব পাঠকবর্গ সেই বাল্মীকি বৰ্ণিতা বিকটা শূর্পণখাকে স্মরণ পথ হইতে দূরীকৃতা করিবেন।” সুতরাং, মধুকবি শূর্পণখা চরিত্রটিকে বীভৎসা রাক্ষস রমণী হিসাবে নয়, এক মানবী হিসাবেই এখানে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
পত্রের শুরুতেই বর্ণিত হয়েছে শূর্পণখার কৌতূহল। বিজয় অরণ্যে বিভূতি-ভূষিত অঙ্গে লক্ষ্মণ ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাঁর সেই পূর্ণশশী সদৃশ দেখে মোহিতা শূর্পণখা তাঁর পরিচয় জানতে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। এখানে শূর্পণখার রূপমুগ্ধতার পরিচয় পাওয়া যায়। শুধু রূপমুগ্ধতা নয়, Love at frist sight-এর মতো শূর্পণখার হৃদয়ে অঙ্কুরিত হয়েছে রূপানুরাগের বীজ, তিনি লক্ষ্মণের মাথায় জটাভার দেখে বলেন ‘ফাটে বুক জটাজুট হেরি তব ফিরে।” শুধু কী তাই, লক্ষ্মণ ভূতলে শয়ন করে জেনে তিনিও পালঙ্কে শয়ান ত্যাগ করেন। লক্ষ্মণের আহার ফলমূল জেনে তিনিও সুস্বাদু রাজভোগ ত্যাগ করেন। এমনকি বনবাসীর বনবাস জীবনের দুঃখকষ্টের কথা চিন্তা করে তিনি রাজপুরীতে থাকতে নিরানন্দ বোধ করেন। শূর্পণখার এ মনোভাব তো প্রেমিকার জন্য আত্মত্যাগে পরিপূর্ণ।
শূর্পণখার এই ভেবে বিস্ময় জাগে লক্ষ্মণ কেন এ নব-যৌবনে সমস্ত রকম পার্থিব মুখ ও আনন্দ ছেড়ে বনে এসেছেন। কোন অভিমানে তিনি রাজবেশ ত্যাগ করেছেন? তিনি কি মৈনাকের মতো শত্রু ভয়ে ভীত হয়ে এই ‘বন-সাগরে’ আত্মগোপন করেছেন? যদি তাই হয় তবে শূর্পণখা সেই শত্রুকে দমন করার জন্য সবরকম ব্যবস্থা নেবেন। যদি অর্থের প্রয়োজন হয়, তবে তিনি তাঁর জন্য “অলকার ভাণ্ডার খুলিব তুষিতে তোমার মনঃ।” যদি লক্ষ্মণ প্রেমে ব্যর্থ হয়ে এই জীবন গ্রহণ করেন, তবে তিনি যেন তার কথা বলেন। শূর্পণখা সেই যুবতীর রূপ ধরে চিরদিন লক্ষ্মণের সেবা করবেন। তিনি নিত্যদিন পারিজাত ফুল এনে কাব্যে রচনা করবেন। তাঁর শত সহস্র সখী নৃত্যগীতে লক্ষ্মণের মনে আনন্দ রচনা করবে। যদি এসব কিছু না লক্ষ্মণের ভালো লাগে, তবে রাজকুমারী শূর্পণখার সবকিছু ত্যাগ করে বনবাসী হয়ে তাঁর চরম সেবা করবে।
মোটকথা, প্রেমপাগলিনী শূর্পনখা প্রেমের জন্য সবরকম ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত। তিনি শুধু চান তাঁর প্রেমাস্পদ যেন এই পত্রখানি পড়ে গোদাবরী তীরে এসে তাঁর প্রেমতৃষ্ণা নিবারণ করেন। পত্রটি লিখতে লিখতে শূর্পণখা সখীর কাছ থেকে জানতে পারেন লক্ষ্মণের পরিচয়। জেনে খুশী হন তিনি। কারণ তাঁর প্রেমাস্পদ অত্যন্ত মহান। বিনা স্বার্থে তিনি ভ্রাতা রামচন্দ্রের সঙ্গে বনবাসী হয়েছেন। শূর্পণখা নিশ্চিত হন, যাঁর এমন দয়ার শরীর তিনি কখনোই এই ঐকান্তিক প্রেম প্রার্থনাকে বিফলে যেতে দেবেন না। তিনি পত্রে লক্ষ্মণকে স্বর্গলঙ্কায় যাওয়ার আহ্বান জানান। তিনি জানেন, লক্ষ্মণ তাঁকে বিবাহ করলে লঙ্কেশ্বর রাবণ যৌতুক স্বরূপ তাঁদের অযোধ্যা সদৃশ শতেক রাজ্য উপহার দেবেন। শূর্পণখার এই প্রেম-আকুলতা, প্রেমিকের জন্য ত্যাগ স্বীকারের এই বাসনা, প্রেমিকের জন্য এই গর্ববোধ, প্রেমিকার চরণে নিজের সর্বস্ব সমর্পণের আকুলতা, তাকে শুধু রাক্ষস-রমণী মাত্র নয়, এক উজ্জ্বল মানবী প্রেমিকা রূপে চিত্রিত করেছে।
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।