বৈদিক যুগের ধর্মীয় জীবন

আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “বৈদিক যুগের ধর্মীয় জীবন” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।

বৈদিক যুগের ধর্মীয় জীবন

ভারতীয় সমাজ মূলত ধর্মাশ্রয়ী। ভারতীয় জীবনচর্চার প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে ধর্মের বিশেষ ভূমিকা বর্তমান। সামাজিক জীবনধারা, রীতি-নীতি, শিল্প ও সাহিত্যচর্চা ইত্যাদি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই যুগ যুগ ধরে ধর্মচিন্তা ও দর্শন ভারতবাসীকে পথনির্দেশ করে আসছে। এই কারণে প্রাগৈতিহাসিক কালেও যেমন ভারতীয় জীবনচর্চায় ধর্মের গুরুত্ব অনুভূত হয়েছে তেমনি বর্তমান একবিংশ শতকের সূচনাতেও ধর্ম-বিমুক্ত ভারতীয় জীবনধারার কল্পনা করা প্রায় অসম্ভব। এই ধর্মভাবনার পশ্চাৎপটে ইহজাগতিক বস্তুগত চিন্তা যেমন সক্রিয়, তেমনি আধ্যাত্মিক ও দর্শনভিত্তিক চেতনার ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। স্বভাবতই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভারতের সমাজজীবনে যেমন রূপান্তর এসেছে, তেমনি ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রেও ধ্যান-ধারণা ও আচার-আচরণের পরিবর্তন ঘটেছে। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে লিখিত উপাদানের অভাব যতটা অনুভূত হয়, ধর্মীয় জীবনের ক্ষেত্রে ততটা হয়। না। কারণ আদিকাল থেকেই, বিশেষত বৈদিক যুগ থেকে ধর্মভিত্তিক সাহিত্যের প্রাচুর্য এই কাজে অনেকটা সহায়ক হয়েছে। ড. নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ‘ধর্ম ও সংস্কৃতি’ : প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপট’ শীর্ষক গ্রন্থে লিখেছেন, “প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের অন্যান্য শাখার ধারাবাহিকতা, পারম্পর্য ও রূপান্তরের প্রকৃতি যথার্থ প্রদর্শনের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত উপকরণের অভাব কিছুটা বাধার সৃষ্টি করে, কিন্তু ধর্মের ইতিহাসের ক্ষেত্রে এই অসুবিধা অনেকটা কম। প্রতিটি ধর্মমতের মূল শাস্ত্ররাজি এবং বিভিন্ন যুগে রচিত সেগুলির টীকাভাষ্য যেমন একদিকে এই সকল মতের তত্ত্বগত বিকাশ, ব্যাপ্তি ও রূপান্তরের পরিচয় দেয়, তেমনি অন্যান্য সাহিত্যগত উপাদান, লেখসমূহ, ধর্মীয় স্থাপত্য, মঠ-মন্দির ও নানা সম্প্রদায়ের দেবদেবীর অজস্র মূর্তি বিভিন্ন ধর্মমত এবং তাদের শাখা-প্রশাখা সমূহের ভৌগোলিক বণ্টন, প্রভাবের ক্ষেত্র, স্থানান্তর গমন প্রভৃতি বিষয়ের উপর আলোকপাত করে।”

আদি-বৈদিক যুগের ধর্মভাবনা সম্পর্কে আমাদের মূল উপাদান হল আর্যদের ধর্মগ্রন্থ ঋগ্বেদ। ঋগ্বেদের সহস্রাধিক (১০২৮ টি) স্তোত্রে বৈদিক আর্যদের ধর্মচিন্তা ও আচার-আচরণ বর্ণিত হয়েছে। ড. রোমিলা থাপার লিখেছেন, “আর্যদের প্রাচীনতর দেবতাদের প্রারম্ভিক কল্পনা খুঁজে পাওয়া যায় ইন্দো-ইউরোপীয় অতীতে।” ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর ধর্মবিশ্বাসের সাথে আর্যদের প্রাথমিক ধর্মবিশ্বাসের কিছু সাদৃশ্য পাওয়া যায়। ইরানীয় ধর্মগ্রন্থ আবেস্তার সাথে বৈদিক গ্রন্থ ঋগ্বেদের তুলনামূলক আলোচনা থেকে ভারতে অভিপ্রয়াণের প্রাক্ মুহূর্তে ইন্দো-ইরানীয় দেব দেবীর একটা ধারণা পাওয়া যায়, যা ঋগ্বেদিক ধর্মভাবনা পুনর্গঠনের সহায়ক। এই পর্বে অসুর (অহ্বর) ও দেবতা (দেবা)র মিলিত সংখ্যা মাত্র তেত্রিশ। এই অসুরেরা ঋগ্বেদে এসে দৈত্য নামে পরিচিত হন আর আবেস্তায় দেবতারা পরিচিত হন দৈত্য রূপে। আবেস্তায় প্রধান অসুর আহুর মাজদা, এখানে দেবতা রূপে বন্দিত। ঋগ্বেদে ইনি স্বর্গীয় স্রষ্টা বরুন। বরুনের ঘনিষ্ঠ মিত্র, আবেস্তায় মিথ্র নামে উল্লিখিত। ঋগ্বেদের মহান দেবতা ইন্দ্র বা বৃত্রাহন আবেস্তায় নিছক এক দৈত্য বেরেথ্রাঘনা। ঋগ্বেদে মৃত্যুর দেবতা যম, আবেস্তায় বিমা, একইভাবে ঋগ্বেদের ঋত আবেস্তায় আশা নামে। উপস্থাপিত। বৈদিক পুরোহিত অথর্বন আবেস্তায় আথ্ররন। তবে ভারতে আর্যদের ধর্মভাবনা এদেশের প্রকৃতি ও পরিস্থিতির ভিত্তিতেই রূপ লাভ করেছিল। আর্যদের ধর্মবিশ্বাসের মূল ছিল প্রকৃতির পূজা। আদিম সর্বপ্রাণবাদ ছিল বৈদিক ধর্মের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আর্যরা তাদের চতুষ্পার্শে যে সকল প্রাণী বা শক্তিকে দেখত, তার মধ্যে প্রাণের অস্তিত্ব আছে বলে বিশ্বাস করত। আকাশ, বজ্র, বিদ্যুৎ, সমুদ্র, চন্দ্র, সূর্য, পাহাড়-পর্বত ইত্যাদি প্রাকৃতিক বস্তুর মধ্যে প্রাণের অস্তিত্ব কল্পনা করত এবং অলৌকিক শক্তি হিসেবে পূজার্চনার মাধ্যমে সন্তুষ্ট রাখতে চেষ্টা করত।

ঋগ্বেদে আর্যদের দেবদেবীর নাম ও প্রকাশ বর্ণনা করা হয়েছে। তবে দেবতাদের ক্ষমতাগত অবস্থান সম্পর্কে কোন উল্লেখ নাই। তাই কে বড় বা কে ছোট তা বলা সম্ভব নয়। সম্ভবত, আর্যরা যখন যে দেবতার পূজা করত, তখন তাকেই সর্বোচ্চ সম্মান ও মর্যাদা দিত। তবে ঋক্‌বৈদিক দেবতারা ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত হলেও একেশ্বরবাদের ধারণা বৈদিকধর্মের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। স্থানভেদে ও কর্মভেদে একই দেবতা ভিন্ন নামে পরিচিত হন। ড. বিধানচন্দ্র ভট্টাচার্য লিখেছেন, “ঋগ্বেদের ঋষিরা এক ঈশ্বর সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন এবং সমস্ত দেবতাকে সেই একেরই বিভিন্ন প্রকাশ রূপে কল্পনা করিয়াছেন। ববীশ্বরবাদ ঋগ্বেদের আপাত প্রতীতি মাত্র। বহু দেবতার উপরে সর্বাধ্যক্ষ এবং পরমব্যোম একজনের কথা ঋষিরা কখনও বিস্মৃতি হন নাই। সেই একজনই হইলেন সমগ্র সৃষ্টির কারণ, তাঁহাতেই সমস্ত সৃষ্টি বিধৃত।” এদিক থেকে ঋক্-বৈদিক ধর্মের সাথে হরপ্পা সংস্কৃতির দুটি বৈশিষ্ট্যগত প্রভেদ লক্ষণীয়—(১) হরপ্পার ধর্মে একেশ্বরবাদী চেতনার অভাব ছিল। এবং (২) হরপ্পা-সংস্কৃতিতে মাতৃকাদেবীর প্রাধান্য ছিল। কিন্তু ঋগ্বেদে নারী-দেবতার নাম উল্লেখ থাকলেও, এখানে পুরুষ দেবতারাই ছিলেন সর্বেসর্বা। আবেস্তা বা ঋগ্বেদ কোথাও মূর্তিপূজার সংকেত চিহ্ন নেই। অনুমান করা হয় যে প্রাচীন আর্যরা নিরাকার উপাসনায় অভ্যস্ত ছিলেন। নিরাকার দেবকল্পনা থেকে বহুগুণ সমন্বিত সাকার দেবতার কল্পনা কীভাবে বাস্তবরূপ পেল, তা অনুমান সাপেক্ষ। হাবিব ও ঠাকুরের মতে, ঋগ্বেদ ও আবেস্তায় পশুর তুলনায় মনুষ্য মূর্তির প্রাধান্য চোখে পড়ে। তাই সাধারণ ইন্দো-ইরানীয় দেবমূর্তিগুলি আশ্চর্যজনকভাবে মনুষ্যকার। এই প্রবণতা কালক্রমে মনুষ্যরূপী সাকার দেব কল্পনার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল।

পশুপালক ও কৃষিজীবী সমাজের বৈশিষ্ট্য অনুসারে ঋগ্বেদে উল্লিখিত দেবদবীর মধ্যে দেবতারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। দেবীরা সংখ্যায় কম এবং বলাবাহুল্য তাঁদের প্রভাবও নগণ্য। ঋগ্বেদের দেবদেবী তিন শ্রেণীতে বিভক্ত ছিলেন। (১) দ্যুলোক বা স্বর্গের দেবদেবী ছিলেন মিত্র, পুষা, আদিত্যগণ, বিষু, ঊষা, অশ্বিদ্বয় প্রমুখ। (২) অন্তরীক্ষ বা আকাশের দেবতা ছিলেন ইন্দ্র, মাতারিশ্বা, রুদ্র, মরুৎ, বায়ু, পর্জন্য প্রমুখ। (৩) ভূলোক বা পৃথিবীর দেবতা ছিলেন অগ্নি, পৃথিবী, সোম। তিন শ্রেণীর দেবতার ক্ষেত্রেই প্রাকৃতিক পটভূমি স্পষ্ট, যেমন—ঊষা, অগ্নি, সূর্য, বায়ু, দৌঃ প্রমুখ। তবে এই সকল প্রাকৃতিক শক্তিগুলিকে মানবীয় রূপ দেবার একটা প্রয়াস ঋগ্বেদে দেখা যায়। দৌঃ-এর অর্থ আকাশ। গ্রীক দেবতা জিউস-এর সাথে নামটির সাযুজ্য পাওয়া যায়। দৌঃ-এর প্রণয়িনী হলেন পৃথিবী। উভয়ে একত্রে পরিচিত দাব্যা—পৃথিবী নামে এবং বিশ্বজগতের পিতামাতার হিসেবে স্বীকৃত।

সূর্য দেবতা একাধিক। এঁদের অন্যতম হলেন মিত্র। আবেস্তায় তিনি মিথ্র নামে উল্লিখিত। ঋগ্বেদে দেবতা হিসেবে মিত্রের গুরুত্ব কিছুটা কম। তিনি কার্যত বরুণের পার্শ্বচর রূপেই বর্ণিত হয়েছেন। মাত্র একটি সুক্তে মিত্র এককভাবে বন্দিত হয়েছেন। তিনি বরুণের চক্ষুরূপে কল্পিত। সূর্য নামেও একজন সৌর দেবতার উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি সর্বদ্রষ্টা এবং বরুণ, অগ্নি, মিত্র সহ অন্যান্য দেবতাদের চক্ষু বিশেষ। ঊষা তাঁকে প্রকাশিত করেন, যদিও তিনি অদিতি ও দৌঃ-এর পুত্ররূপে বর্ণিত হয়েছেন। সবিতৃ বা সবিতাও সূর্যদেবতা। গায়ত্রীমন্ত্রে তাঁর মহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে। পুষণ বা পুষাও একজন সূর্য দেবতা। উষা কল্পিত হয়েছেন একজন মোহময়ী নারী রূপে। মানুষের মতই তিনি প্রেমিকের কাছে নিজের রূপ-যৌবন উন্মোচিত করেন। ঋগ্বেদে তাঁর উদ্দেশ্যে কুড়িটি সুক্ত নিবেদিত হয়েছে। এটি তাঁর গুরুত্ব নির্দেশ করে। ঊষা পূর্বদিকে উদিত হয়ে নিজ কান্তি প্রকাশ করেন। তিনি রাত্রির ভগিনী, সূর্যের মাতা এবং প্রণয়িনীও বটে।

অন্তরীক্ষের দেবতাদের মধ্যে অগ্রণী ছিলেন বরুণ। সম্ভবত আদি বৈদিক ধর্ম সংগঠনে বরুণ ছিলেন প্রধানতম। তিনি যাবতীয় প্রাকৃতিক ও নৈসর্গিক নিয়মসমূহের (ঋত) রক্ষক। এজন্য তাঁর উপাধি ধৃতব্রত। অসংখ্য চরের সাহায্যে তিনি বিশ্বপ্রকৃতির গতিবিধির উপর নজরদারী করেন। মায়া শক্তির পাশে বদ্ধ করে সকল অন্যায়ের প্রতিরোধ করেন। তিনি বর্ষণের দেবতা এবং ঋতু সমূহের নিয়ামক। বরুণ তাঁর প্রধান সহযোগী। কালক্রমে ইন্দ্রের ক্ষমতা বৃদ্ধি ঘটলে বরুণ পিছনের সারিতে চলে যান।

বস্তুত ঋগ্বেদের দেব মণ্ডলে সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন ইন্দ্র। তিনি বীর, যোদ্ধা এবং মহানায়ক। দুটি কিংবা হাজার অশ্বটানা রথে চড়ে তিনি শত্রুদের পুর (নগরী) ধ্বংস করেন। দানব দলনের পাশাপাশি তিনি আর্যদের শত্রু দাস (দস্যু)-দেরও দমন করেন। ইন্দ্রের প্রধান আয়ুধ বজ্র। এছাড়া তিনি বৃষ্টি আনেন। বৃত্ত নামক যে দানব প্লাবন প্রবাহকে আটকে রেখেছিল বজ্রাঘাতে তাকে হত্যা করে তিনি প্লাবনের জলকে বাধামুক্ত করেন। অর্থাৎ ইন্দ্রদেবের দপ্তরাবলীর মধ্যে বজ্র, আকাশ, মেঘ ও বৃষ্টির সমাহার ঘটেছিল। তিনি অপরিমেয় সোমরস পান করে হন সোমপা। মহিষের মাংস তাঁর অতি প্রিয়। ঋগ্বেদে কেবল ইন্দ্রের স্তুতিমূলক ২৫০টি স্তোত্র নিবেদিত হয়েছে। ড. হাবিব ও ঠাকুরের মতে, “একজন রাজার দেবমূর্তি এমনভাবে ইন্দ্রের প্রতীক হয়ে উঠেছে যে, সেটি স্পষ্টভাবে রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উত্থানের বিষয়টি আমাদের জানিয়ে দেয়।”

আমরা আগেই দেখেছি যে, প্রকৃতির দৃশ্যমান বৈশিষ্ট্যগুলি দেবী মর্যাদা পেয়েছে। এমন ধরনের দেবদেবী হিসেবে সূর্য ও ঊষার কথা আগেই জেনেছি। এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত আরো একজন প্রভাবশালী দেবতা ছিলেন অগ্নি (আগুন)। তিনি চির নবীন। প্রত্যহ দুটি অরণির ঘর্ষণে তাঁর উদ্ভব ঘটে। তিনি দেবতাদের পুরোহিত, আবার যজ্ঞে প্রদত্ত আহুতি যেমন কাষ্ঠ, ঘৃত, সোমরস তিনি খাদ্য রুপে গ্রাস করেন। গৃহস্থদের সাথেও তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। প্রতি গৃহে পূজাগ্নি হিসেবে তিনি নিত্য বিরাজমান। তিনি দূত। তিনি মৃতকে পিতৃগণের কাছে পৌঁছে দেন। পার্থিব দেবতা হিসেবে সোম কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ঋগ্বেদের সমগ্র নবম মণ্ডল সোমদেবের উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত। সোমলতার শীর্ষদেশ পেষাই করে প্রাপ্ত এই রস অমৃততুল্য। সোম মৃত সঞ্জীবনী স্বরূপ। এই রস রোগমুক্তির উপাদান হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ।

আদি বৈদিক ধর্মাচারে দেবীদের অস্তিত্ব ও ভূমিকা ছিল গৌণ। ঊষা, অদিতি কিছুটা গুরুত্ব পেলেও, অন্যরা কেবল পুরুষ দেবতাদের স্ত্রীরূপে উল্লিখিত হয়েছেন। দেবতার নামের সাথে ‘আনী’ প্রত্যয় যোগ করে তাঁদের নামকরণ করা হয়েছে, যেমন ইন্দ্রাণী, বরুনানী ইত্যাদি। নদীকে দেবতার আসনে স্থাপনের দৃষ্টান্তও ঋগ্বেদে আছে। ঋগ্বেদিক দেবী সরস্বতী বর্তমানের জ্ঞান বা বচনের দেবী নন, এঁর উৎস নদী সরস্বতী। তবে ভারতে প্রবাহিত সরস্বতী নদী এবং ঋগ্বেদে কল্পিত দেবী সরস্বতী স্বতন্ত্র।

যাগ-যজ্ঞের ধারণা আদি ইন্দো-ইরানীয় ঐতিহ্য থেকেই চলে এসেছিল। যাগ-যজ্ঞের মাধ্যমে দেবতাদের অনুগ্রহ লাভের চেষ্টা করা হত। বৈদিক আর্যরা ব্যক্তিগত ভাবে পারিবারিক যজ্ঞের আয়োজন করতেন। আবার সীমিতভাবে হলেও সর্বসাধারণের মঙ্গল কামনায় যজ্ঞানুষ্ঠানের আয়োজন করা হত। আদিম যাদুবিশ্বাসের অংশ হিসেবে অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দেবার প্রথাই ক্রমে মন্ত্র ও আচার বিশিষ্ট যজ্ঞের বিকাশ ঘটায়। ঋগ্বেদে বলা হয়েছে যে প্রথম মহাজাগতিক যজ্ঞ থেকেই জগতের সৃষ্টি হয়েছে। প্রজাপতি (পরবর্তীকালে ব্রহ্মা নামে পরিচিত) হলেন আদি মানব। সমষ্টিগত যজ্ঞানুষ্ঠানে বহু পশুবলি দেওয়া হত। দেবতাদের উদ্দেশ্যে দুধ, ননী, বার্লি, বৃষ ও ছাগল ও ভেড়া উৎসর্গ করা হত। ঋগ্বেদের দুটি সুক্তে অশ্বমেধের উল্লেখ আছে। অবশ্য এটি পরবর্তী বৈদিক যুগের অশ্বমেধ যজ্ঞের সাথে সম্পর্কযুক্ত নয়। ঋগ্বেদে যাগযজ্ঞের কঠোরতা বা আচার নিষ্ঠা সম্পর্কে বিশেষ কিছু বলা হয়নি। পরবর্তী সংহিতা ও ব্রাক্ষ্মণ গুলিতে এই যজ্ঞ প্রক্রিয়া প্রচুর জটিলতা ধারণ করেছে। তবে যজ্ঞের পরিচালক হিসেবে পুরোহিত ও ব্রাহ্মণ শ্রেণীর সামাজিক উত্থান ঋগ্বৈদিক যুগেই সূচিত হয়েছিল। শাসক বা যজমানদের মঙ্গলার্থে যজ্ঞ পরিচালনা যাঁরা করতেন সেই পুরোহিত শ্রেণীর গুরুত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে। যজ্ঞের সাফল্যকে পুরোহিতের সাফল্য বলেই বিশ্বাস করা হত। দশরাজার যুদ্ধে রাজা সুদাসের সাফল্যকে রাজপুরোহিত বশিষ্ঠদেবের কৃতিত্ব বলেই গ্রহণ করা হয়েছিল। পুরোহিতের পরেই ছিলেন হোত্রীগণ। এঁরা আচারগুলি সম্পাদন করতেন। তবে বলিদান প্রক্রিয়া সম্পাদনের জন্য একাধিক পুরোহিত (ছয়জন বা বেশী) থাকতে পারেন, এমন ইঙ্গিত ঋগ্বেদে আছে। এইভাবে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পরিচালনার সূত্রে ‘ব্রাহ্মণ’ নামক একটি সাধারণ শ্রেণী সৃষ্টি হয়।

ঋগ্বেদে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে উল্লেখ থাকলেও, তা খুব স্পষ্ট নয়। এ প্রসঙ্গে একটা সংশয় সর্বব্যাপী বৈশিষ্ট্য হিসেবে উপস্থিত। মৃত্যুর পর জীবের পরিণতি সম্পর্কে ঋগ্বেদে একাধিক বক্তব্য রাখা হয়েছে। একটি মত, মৃত্যুর পর দেহ পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যায়। অন্য মতে, মৃত্যুর পর মানুষের স্থান হয় যমলোকে। যমই প্রথম মানুষ যিনি মারা গিয়েছিলেন। আবার অন্যত্র বলা হয়েছে যে, মৃত্যুর পর মানুষ সূর্যালোকেও যেতে পারে। দেবযান ও পিতৃযান সম্পর্কেও কিছু পরোক্ষ উল্লেখ ঋগ্বেদে আছে। অর্থাৎ‍ মানুষ পরবর্তী পরিণতি সম্পর্কে আদি বৈদিক যুগে কোনরূপ স্বচ্ছ ধারণা গড়ে ওঠেনি।

জগৎ সৃষ্টির প্রসঙ্গটিও ঋগ্বেদে স্থান পেয়েছে। মূলতঃ বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সৃষ্টিরহস্য উন্মোচনের প্রয়াস দেখা যায়। একটি সূক্তে প্রশ্ন করা হয়েছে, প্রথম জাতককে কে দেখেছে? কোথা থেকে জীবন ও জগতের সৃষ্টি হয়েছে? এ প্রসঙ্গে গ্রীক দার্শনিক থালেস-এর মন্তব্যে ঋগ্বেদের প্রতিধ্বনি শোনা যায়। উভয় ক্ষেত্রেই বিশ্বসৃষ্টির আদি উপাদান হিসেবে জলকে চিহ্নিত করা হয়েছে। ১০/১২১ সূক্তে বলা হয়েছে এই আদিম জলরাশি থেকেই হিরণ্যগর্ভের উৎপত্তি যিনি আগে থেকেই উপস্থিত উপাদান সমূহের সাহায্যে বিশ্বচরাচর সৃষ্টি করেছেন। তবে বিরাজমান উপাদান কে সৃষ্টি করেছেন, সে বিষয়ে ঋগ্বেদ নীরব। আবার পুরুষসূক্তে বলা হয়েছে (১০/৯০) সমস্ত সৃষ্টিকর্ম এক আদিম যজ্ঞ সঞ্জাত। অর্থাৎ‍ জগৎসৃষ্টির সহস্য সম্পর্কে ঋগ্বেদের ধারণাও অস্পষ্ট। ঋগ্বেদের ঋষিরাও এ-ক্ষেত্রে সংশয়াচ্ছন্ন ছিলেন। এই সংশয়ের ছবিটি প্রকট হয়েছে নাসদীয় সূক্তে (১০/১২৯)। এখানে আদিমতম এমন একটি সময়ের কথা বলা হয়েছে যখন পৃথিবী, আকাশ, জল, রাত্রি, দিন কিছুই ছিল না। মৃত্যু ছিল না, অমরত্বও ছিল না। কেবল সেই একমাত্র বস্তু বায়ুর সাহায্য ছাড়াই আত্মামাত্র অবলম্বন করে বিদ্যমান ছিলেন। তপস্যার দ্বারা সেই একবস্তুর উদ্ভব ঘটেছিল। এভাবেই সর্বপ্রথম মনের উপর কামের সৃষ্টি হল। সেখান থেকেই উৎপত্তির কারণ নির্গত হল। কিন্তু এর পরেই পুনরায় সংশয়বাণী উচ্চারিত হয়েছে নাসদীয় সুক্তে। বলা হচ্ছে, কেই বা জানে জগৎ সৃষ্টির প্রকৃত রহস্য। কারণ দেবতাদের আবির্ভাব ঘটেছে জগৎ সৃষ্টির পরে। হয়ত পরমধামে বিরাজমান যিনি প্রভু স্বরূপ তিনিই জানেন প্রকৃত সৃষ্টিরহস্য; হয়ত তিনিও জানেন না প্রকৃত সত্য কি। লক্ষণীয় যে সূক্তটিতে যেমন সৃষ্টির পূর্বের অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে, তেমনি সৃষ্টির পূর্বে পরমাত্মার উপলব্ধিও স্থান পেয়েছে। প্রকৃতির যে সকল কার্য এবং সৌন্দর্যকে ঋষিগণ দেবতা বলে পূজো করতেন, তাঁরা আদি দেব নন। তাঁরাও সৃষ্ট অর্থাৎ কার্যমাত্র। এভাবেই ঋষিকুলের মনে দর্শন চিন্তার উদয় হয়। এই সূক্তের ভাষ্যটি ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন ভাবধারা ও বিষয়বস্তুর সূচনা করে। অস্তিত্ব-অস্তিত্বহীনতা, বাস্তব-অবাস্তব, সত্য-মিথ্যা ও সৎ-অসৎ ইত্যাদি এখান থেকেই বৈদিক চিন্তাভাবনার কেন্দ্রে স্থান পেয়েছে। প্রাচ্য সংস্কৃতির বিশিষ্ট গবেষক এ. এল. ব্যাশাম (A. L. Basham) বলেছেন, “সম্ভবত এই সূক্তটির মধ্য দিয়েই বিশ্বসাহিত্যে সর্বপ্রথম একটা দার্শনিক প্রশ্ন প্রস্ফুটিত হয়েছে এবং ভারতীয় চিন্তা-ভাবনার এটি এক বিশেষ লক্ষণ।” তাঁর মতে, এটি জিজ্ঞাসু মনের প্রকাশ, যে মন সৃষ্টির রহস্য সম্পর্কে যেমন তেমন একটা বক্তব্য মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। এখানে অপ্রমাণিত তত্ত্বকে স্বীকার করে নেওয়ার পরিবর্তে, অজ্ঞাতকে স্বীকার করে নেওয়ার দৃঢ়তা ব্যক্ত হয়েছে।

এই প্রসঙ্গে ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে সংকলিত পুরুষ সূক্তটি ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও বৈদিক সমাজের বিকাশ ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ। আদিবৈদিক ও পরবর্তী বৈদিক যুগের সংযোগ পর্বে (খ্রিঃ পূঃ ১০০০ অব্দে) রচিত পুরুষ সূক্তে বলা হয়েছে যে, এক বিশালাকার দৈত্য ‘পুরুষ’ যার আকৃতি বর্তমান ব্রহ্মাণ্ড থেকেও বৃহৎ, ছিল প্রথম ও একমাত্র ‘অস্তিত্ব’। সেই ‘অস্তিত্ব’টি একাকীত্ব অবসানের জন্য নিজে দ্বিখণ্ডিত হয়ে একটি ‘নারী-অস্তিত্ব’ ‘বিরাজ’ সৃষ্টি করে। বৃহদারণ্যক উপনিষদের ভাষ্য অনুসারে পুরুষ ও বিরাজ-এর মিলনে দ্বিতীয় পুরুষ সৃষ্টি হয়। তারপরে সৃষ্টি হয় দেবকুলের। দেবতারা এই দ্বিতীয় পুরুষকে পিতার নিকট উৎসর্গ করেন। তাঁকে হত্যা করা হয়। সেই দেহ থেকে সৃষ্টি হয় ব্রহ্মাণ্ড ও মানবগণ।

আবার এই পুরুষ সূক্তে বৈদিক সমাজের বর্ণভেদ ব্যবস্থা ও চতুবর্ণের সূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। খণ্ডিত পুরুষের মুখমণ্ডল থেকে সৃষ্টি হয় ব্রাহ্মণের, দু’বাহু থেকে ক্ষত্রিয়, উরুদ্বয় থেকে বৈশ্য এবং পদযুগল থেকে শূদ্রের সৃষ্টি হয়। ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, উৎসর্গীকৃত পুরুষের মন থেকে চন্দ্র, চোখ থেকে সূর্য, প্রাণ থেকে বায়ু, নাভি থেকে আকাশ, মস্তক থেকে স্বর্গ, দু’চরণ থেকে ভূমণ্ডল ইত্যাদি সৃষ্টি হয়। উৎসর্গ অর্থাৎ বলিদান পুরুষ সূক্তের বৈশিষ্ট্য। তাই বৈদিক ধর্মাচারে যজ্ঞ ও বলিদান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বস্তুতঃ নানা সম্ভাবনার কল্পনা দ্বারা ঋগ্বেদের ঋষিকুল জগৎ ও জীবন সৃষ্টির রহস্যকে জটিলতর করে তুলেছেন।

ব্রাক্ষ্মণগুলিতে দেবতাদের চরিত্র চিত্রণ ঋগ্বেদের ভাবনা থেকে বেশ স্বতন্ত্র। আদি বৈদিক ধর্মভাবনায় উৎসর্গের ফলাফল হিসেবে যান্ত্রিকভাবে দেবতারা আবির্ভূত হতে বাধ্য হতেন। কিন্তু পরবর্তী বৈদিক দেব-ভাবনায় পরিবর্তন স্পষ্ট। এখানে দেবতারা মানবিক দোষ-গুণের অধিকারী। শতপথ ব্রাহ্মণ গ্রন্থে (১.১.১–১৪) দেবতাদের সংকীর্ণ স্বার্থরক্ষার প্রয়োজনে ছলনা ও প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণকারী ও অনৈতিক কাজে আগ্রহী বলে চিত্রিত করা হয়েছে। যেমন, অন্যান্য দেবতাদের ইন্ধনে একদল পিঁপড়ে ভগবান বিষ্ণুর বিরুদ্ধে এমন চাল দিল যে বিষু নিজের মাথাই কেটে ফেললেন, যা সূর্য হয়ে গেল। বাজসেনিয়া সংহিতায় (১৫/২০) রুদ্রকে ‘তস্করদের দেবতা, ভ্রাম্যমান ডাকাত’ বলা হয়েছে।

পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যের সাক্ষ্য অনুযায়ী এই সময় ঋগ্বেদের দেবতাদের চরিত্র ও স্থান পরিবর্তন ঘটেছিল। এমনকি, কোন কোন দেবতার অবলুপ্তিও ঘটেছিল। ঋগ্বেদের মহানায়ক ইন্দ্র পরবর্তীকালে প্রায় বিস্মিতপ্রায় দেবতা। আবার সেকালের গুরুত্বহীন দেবতা বিষ্ণু ও রুদ্র একালে উচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। ব্রাহ্মণ রচনার কাল থেকে এঁরা দু’জন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেবতা রূপে উঠে আসেন। শতপথ ব্রাহ্মণে বলা হয়েছে রুদ্র ও অগ্নি অভিন্ন দেবতা। আবার তিনি নানা স্থানে ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত হতেন। পূর্ব দেশের মানুষেরা তাঁকে বলে শর্ব। আবার বাহিকাদের (বাহ্লীক দেশ) কাছে তিনি ভব; পশুপতি নামেও তিনি অভিহিত হন। এই দেবতা রুদ্রই পরবর্তীকালে জনপ্রিয় দেবতা শিব-এর পূর্বরূপ। সম্ভবত তিনি অনার্য উৎস থেকেই উদ্ভূত হয়েছেন। অবশ্য বর্তমানে প্রচলিত লিঙ্গপূজার কোন উল্লেখ পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে নেই। ডি. ডি. কোশাম্বী মনে করেন যে, আর্যদের কাছে আত্মদমর্পণকারী অনার্য জনগোষ্ঠী পূজার যেসব আচার বহন করে এনেছিল, তার প্রভাবেই দেবতাদের চিত্রায়ণ এভাবে পাল্টে যাচ্ছিল।

বিষ্ণুর মর্যাদা বৃদ্ধি এবং নতুন দেবতা হিসেবে ক্ষমতার কেন্দ্রে প্রজাপতির আবির্ভাব এ-যুগের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। শতপথ ব্রাক্ষ্মণে তিনি ত্রিলোকের (পৃথিবী, বায়ুমণ্ডল ও আকাশ) দেবতা রূপে চিত্রিত। ঐতরেয় ব্রাক্ষ্মণ অনুসারে অসুর নিধনের কাজেও তিনি ইন্দ্র বরুণের মতই কৃতিত্বের অধিকারী। দেবতাশ্রেষ্ঠ হিসেবে বিষ্ণুর অবতারণা একাধিক ব্রাহ্মণে দেখা যায়। ঋগ্বেদে প্রজাপতির উল্লেখ নেই। পরবর্তী যুগে সম্পূর্ণ নতুন দেবতা হিসেবেই তাঁর আবির্ভাব ঘটেছে। প্রজাপতির কল্পনায় একেশ্বরবাদী প্রবণতা দেখা যায়। তিনি বিশ্বচরাচরের স্রষ্টা ও রক্ষাকর্তা হিসেবে কল্পিত। তপ ও আত্ম নিগ্রহের মধ্য দিয়ে তিনি জগৎ সৃষ্টি করেছেন। আবার কোথাও বলা হয়েছে যে, প্রজাপতি স্বয়ং আদিম জলরাশি থেকে অথবা ব্রষ্ম থেকে কিংবা অবিদ্যমান সত্তা থেকে সৃষ্টি হয়েছেন।

পরবর্তী বৈদিক যুগে ধর্মাচারের অতি আবশ্যিক উপাদান হিসেবে যাগযজ্ঞের গুরুত্ব ও জটিলতা বৃদ্ধি পায়। যজ্ঞের পরিচালক হিসেবে পুরোহিত শ্রেণীর গুরুত্ব অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছিল। রাজসূয়, অশ্বমেধ প্রভৃতি ব্যয় বহুল ও জটিল ক্রিয়া বিশিষ্ট যজ্ঞের পাশাপাশি নানা ধরনের ছোট ছোট যজ্ঞানুষ্ঠান ধর্ম জীবনের প্রধান অঙ্গে পরিণত হয়। এক একটি যজ্ঞে সতের জন পুরোহিতের প্রয়োজন পরবর্তী সাহিত্যে উল্লেখ করা হয়েছে। এই বৃহদাকার (শ্রৌত যজ্ঞ) যজ্ঞের পাশাপাশি ঘরোয়া যজ্ঞ (গুহা যজ্ঞ) প্রচলিত ছিল। তবে এই দুধরনের যজ্ঞের মধ্যে পার্থক্য ছিল নিছক পরিমাণগত, আনুষ্ঠানিক ক্রিয়া ছিল একই। নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য যজ্ঞের জটিলতা বৃদ্ধির সাথে শ্রেণী বিভক্ত সমাজের উদ্ভব ও শক্তিশালী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন। ঋগ্বেদের যুগে যজমানরা অর্থাৎ যারা নিজ স্বার্থে যজ্ঞ করেন, নিজেরাই সমবেত ভাবে পৌরহিত্য করে যজ্ঞকর্ম সম্পাদন করতেন, গঙ্গনাথ ঝাঁ একে communistic sacrifice বলেছেন। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে যজমানরা কোন সমষ্টিগত সত্ত্বা নয়। এখন যজমান একক এবং ধনবান, যিনি পুরোহিতদের নিয়োগ করে ব্যক্তিগত ভাবে যজ্ঞানুষ্ঠান সম্পাদন করেন। এর পরিণামে যাগযজ্ঞে শাসকদের ভূমিকা মুখ্য হয়ে ওঠে। উপরন্তু ব্রাহ্মণ পুরোহিত শ্রেণী দেবতাদের তুষ্ট করার একমাত্র অনুমোদিত গোষ্ঠী হিসেবে প্রতিভাত হলে, এই শ্রেণীর মর্যাদাও প্রতিপত্তি ঊর্ধ্বগামী হয়। রাজা এবং পুরোহিতের মধ্যে একটা ঘনিষ্ঠ যোগ স্থাপিত হয়। ব্রাহ্মণ সাহিত্যে যজ্ঞকে সর্বোচ্চ মহাজাগতিক শক্তি রূপে তুলে ধরা হয়েছে। তবে এই যজ্ঞানুষ্ঠান জটিল আচার-অনুষ্ঠান ও নানাস্তরের পুরোহিত শ্রেণীর মন্ত্রোচ্চারণ দ্বারা সমৃদ্ধ এক বিশাল কর্মকাণ্ড। অথর্ববেদে বর্ণিত যাদু বিশ্বাসের প্রভাব এই যজ্ঞে স্পষ্ট। উইন্টারনিজ (W. Winternitz)-এর মতে উত্তর আমেরিকার আদিম অধিবাসী, নিগ্রো, মোঙ্গল প্রভৃতি জনগোষ্ঠীর মধ্যে জনপ্রিয় ও প্রচলিত যাদুমন্ত্র ও ক্রিয়াকলাপের প্রভাব অথর্ববেদের পরিকল্পনায় লক্ষ্য করা যায়। অথর্ববেদে যেমন যাদুবিশ্বাসের প্রাধান্য, তেমনি সংহিতা ও ব্রাহ্মণগুলিতে যাদু বিশ্বাস থেকে উপজাত যাগযজ্ঞ ও ক্রিয়াকলাপের ছড়াছড়ি। রাজা এবং পুরোহিত উভয়শ্রেণীর রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্তৃত্ব বৃদ্ধির অভিলাষে অশ্বমেধ, বাজপেয়, রাজসূয় প্রভৃতি ব্যয়বহুল যজ্ঞ এই পর্বে অনুষ্ঠিত হত। পশুবলি ছিল যজ্ঞের আবশ্যিক উপাচার।

বেদের অন্তর্ভাগ (বেদান্ত) হিসেবে দুই গুচ্ছ পাঠ প্রচারিত হলে বৈদিক যুগে ভারতের ধর্মভাবনা আর একটি নতুন পথে চালিত হতে শুরু করে। আরণ্যক ও উপনিষদগুলি যাগ-যজ্ঞকে অস্বীকার না করেও ধর্মবিশ্বাসের সাথে ভাববাদের সংযোজন ঘটায়। সম্ভবত আরণ্যক গ্রন্থগুলি উপনিষদের কিছু আগে রচিত হয়েছিল। তবে দুটি পাঠগুচ্ছ থেকেই যজ্ঞ নির্ভর ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপের বিকল্প ধর্মাচারের ধারণা পাওয়া যায়। আরণ্যকগুলি ব্রাহ্মণসাহিত্য ও উপনিষদের মধ্যে যোগসূত্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। আরণ্যক ও ব্রাহ্মণ গ্রন্থ সমূহের বিষয়বস্তুর মধ্যে যেমন কিছু মিল দেখা যায়, তেমনি উপনিষদের কোন কোন বক্তব্যের পূর্বাভাষাও আরণ্যকে পাওয়া যায়। গ্রন্থগুলির নামকরণের মধ্যেও এর আভাস মেলে। যেমন, একটি আরণ্যকের নাম জৈমিনীয় উপনিষদ্ ব্রাহ্মণ, আবার একটি উপনিষদের নাম বৃহদারণ্যক উপনিষদ্।

আরণ্যক নামকরণ থেকে অনুমিত হয় যে এই সাহিত্যাবলী অরণ্যচারী ঋষিদের রচনা। এঁরা কৃষিজীবী স্থায়ী সমাজ-জীবনের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না এবং ধর্মাচারের কেন্দ্রীয় বিষয় হিসেবে যজ্ঞের গুরুত্ব সম্পর্কে সন্দিহান ছিলেন। অরণ্যের শান্ত-স্নিগ্ধ পরিবেশে এঁরা মননশীলতা চর্চা দ্বারা একটি সত্যের অনুসন্ধানে রত ছিলেন। শেষ পর্যন্ত এঁরা উপলব্ধি করেন যে, জটিল ও আচার সর্বস্ব যাগযজ্ঞের দ্বারা মুক্তি লাভ সম্ভব নয়; মুক্তির পথ হল মনঃসংযোগের দ্বারা ধ্যান ও প্রকৃত জ্ঞান অর্জন করা। এখানে ধ্যান-যোগকে মানস-যজ্ঞ বিবেচনা করা হয়েছে। ব্রাহ্মণগুলিতে ব্যাখ্যাত হয়েছে কর্ম-মার্গ এবং উপনিষদে গুরুত্ব পেয়েছে জ্ঞান-মার্গ। এই দুয়ের মধ্যে সেতুবন্ধন করেছে আরণ্যক।

উপনিষদ্গুলিকে আপাতভাবে বৈদিক যুগের পুরোহিতকেন্দ্রিক যাগযজ্ঞমূলক ধর্মাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। সাধারণভাবে এগুলিতে সত্যজ্ঞান ও কর্মকে ধর্ম ও মুক্তির মুখ্য বিষয় হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে এই বিশাল সাহিত্য সম্ভাবের বিষয়বস্তু সর্বদা একমুখী ছিল না। প্রায় দুই শতাধিক উপনিষদ্ পাওয়া গেছে। এগুলিতে ব্রষ্মবিদ্যা ও ব্রষ্মজ্ঞান প্রাধান্য পেলেও, যাগযজ্ঞভিত্তিক আচার সম্পূর্ণ বর্জিত হয়নি। বুদ্ধের জন্মের আগে রচিত উপনিষগুলির মধ্যে বৃহদারণ্যক ও ছান্দোগ্য উপনিষদ বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

উপনিষদের মূল প্রতিপাদ্য হল ব্রষ্মের সাথে আত্মার সমীকরণ। ব্রষ্ম ও আত্মা দুটি শব্দেরই অতীত অস্তিত্ব আছে। ঋগ্বেদে আত্মা (আত্মন) শব্দের অর্থ প্রাণ, অহং ইত্যাদি। ব্রাহ্মণে এর অর্থ জীবের ‘আত্মস্বরূপ’। উপনিষদে এর অর্থ দাঁড়াল আত্মা বা বিশুদ্ধ চৈতন্য, যা শরীর থেকে স্বতন্ত্র। ব্রহ্ম শব্দের অর্থ ঋগ্বেদে প্রার্থনা, ব্রাহ্মণে এর অর্থ দাঁড়াল বিশ্বজনীন পবিত্রতা। উপনিষদে তাই পরিণত হয়েছে চরম সত্তায়। ব্রহ্ম ও আত্মার ঐক্যের অর্থ হল চরম সত্তা ও জীবাত্মার মিলন। আত্মার সাথে অভিন্ন ব্রষ্ম বিশুদ্ধ চৈতন্যস্বরূপ। উপনিষদের শব্দগুচ্ছ ‘অহং ব্রহ্ম অস্মি’, ‘তৎ ত্বম্ অসি’ বিশ্বাত্মার সাথে জীবাত্মার ঐক্য চিহ্নিত করে।

ব্রত্নতত্ত্বের সহজ ব্যাখ্যা হল জগৎ ব্রহ্মেরই প্রকাশ। জগৎসংসারের সকল প্রাণী ও বস্তু সেই এক, অনাদি ও অন্য ব্রশ্নের সৃষ্টি এবং ব্রহ্মের সাথে অভিন্ন। শরীর যখন প্রয়াত হয়, তখন সজীব আত্মার সেই শরীর ত্যাগ করে পরমাত্মার সাথে মিলিত হয়। সজীব আত্মা অমর, কিন্তু তা কখনোই একজন স্বতন্ত্র মানুষের সত্তা নয়। এই গূঢ় সত্য অনুধাবন করতে পারলেই সে চরম সত্যের দিকে এগিয়ে যেতে পারে। এখানেই উপনিষদ্ আরো একটি নতুন তত্ত্ব নিয়ে এল, তা হল ধর্ম ও কর্মগুণ। আতভাগ যখন যাজ্ঞবল্ক্যকে প্রশ্ন করেছিলেন যে, মৃত্যুর পর আত্মা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হলে কি হয়? তার উত্তরে যাজ্ঞবল্ক্য বলেছিলেন যে, “আর ওরা যার কথা বলে তা হলো কর্ম, ওরা যার প্রশংসা করে তা হলো কর্ম” (বৃহদারণ্যক উপনিষদ্, তৃতীয়, ২.১৩-১৪)। অর্থাৎ আত্মা হলো ‘ভাল কাজের প্রয়োজনীয় উৎস।’

বাস্তব জীবনের ক্ষেত্রে অধিকতর তাৎপর্যময় ‘আত্মার পুনর্জন্ম বিষয়ক ধারণা’ উপনিষদ্ থেকেই পাওয়া যায়। এর অর্থ হল সকল জীবিত প্রাণী মৃত্যুর পর তাদের সত্তার মাধ্যমে এই জগতে পুনরায় জন্মগ্রহণ করে। এবং এই নবজন্মের চরিত্র নির্ধারিত হয় বিগদ জীবনের আচরণ ও কর্মের ভিত্তিতে। বৃহদারণ্যক ও ছান্দোগ্য উপনিষদে এই জন্মান্তরবাদ ও কর্মবাদের তত্ত্ব ঘোষিত হয়েছে। সৎকর্ম অনুশীলন দ্বারা জন্ম-জন্মান্তরে উন্নত থেকে উন্ননতর জীবন লাভ করা যায়। অন্যদিকে অসৎকর্ম দ্বারা জন্মান্তরে নিম্ন থেকে নিম্নতর জীবন লাভ ঘটে। উপনিষদ কথিত কর্মবাদের মধ্যে সমকালের নৈতিকতা নিহিত আছে বলে মনে করা যায়। এই ধারণা সৎপথে থেকে সৎকর্মে দ্বারা জীবিত মানুষকে উন্নততর নবজন্ম লাভে অনুপ্রেরণা দেয়। আবার প্রতিটি ব্যক্তির মধ্যে ব্রহ্ম বা বিশ্বাত্মাকেপ্রত্যক্ষ করার ফলে সর্বভূতে আত্মদর্শন ও সার্বজনীন সৌভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে ওঠার সম্ভাবনা দৃঢ় হয়।’

উপনিষদকে পরবর্তী বৈদিক সূত্রের মননশীল চর্চার শ্রেষ্ঠ ফসল বলে অনেকেই মনে করেন। কিন্তু উপনিষদের বক্তব্য সংকীর্ণ ও রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থার প্রচারক ছিল বলে রোমিলা থাপার, ধর্মানন্দ কোশাম্বী, নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য প্রমুখ মন্তব্য করেছেন, উপনিষদে যে বিশুদ্ধ জ্ঞান বা ব্রহ্মজ্ঞান অর্জনের কথা বলা হয়েছে, তার সাথে জাগতিক জ্ঞান বা কর্মজ্ঞানের কোন যোগ নেই। উপনিষদের বিশিষ্ট ভাষ্যকার পল ডয়সন (Paul Deussen)-এর মতে, জাগতিক জ্ঞানের সাথে ব্রষ্মজ্ঞানের কোন সম্পর্ক নেই। এমনকি, অভিজ্ঞতালব্ধ বাস্তব জ্ঞান ব্রহ্মজ্ঞান লাভের পথে বাধাস্বরূপ। অর্থাৎ বিশুদ্ধ ব্রষ্মজ্ঞান তারাই অর্জন করতে পারে যাদের মন ও জ্ঞান বস্তুগত জীবনের কর্মের অভিজ্ঞতা দ্বারা ভারাক্রান্ত হয় না। এটা তখনই সম্ভব হয় যখন সমাজের একটা অংশ অপরাংশের শ্রমে উৎপাদিত উদ্বৃত্তে জীবনধারণ করার সুযোগ লাভ করে। দৈহিক শ্রমের সাথে যুক্ত থাকার সুবাদে প্রাত্যহিক বস্তুজীবনের স্থূল বিষয়গুলির প্রতি কোন দায়বদ্ধতা, দৈহিক ও মানসিক সৃষ্টি হয় না। উপনিষদের কাহিনীতেই এই সত্য ফুটে উঠেছে (ছান্দোগ্য উপনিষদ)। শ্বেতকেতু শ্রম-বিমুক্ত বিপুল জ্ঞানের অধিকারী হয়েছিলেন। তাঁর পিতা উদ্দালক কয়েকদিন তাঁকে অভুক্ত রেখে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে অন্নই হচ্ছে ব্রয়, সকল জ্ঞানের মূল। কিন্তু উপনিষদ এই উপলব্ধিতে স্থিত হতে পারেনি। সেখানে তুচ্ছ জাগতিক বিষয় সংক্রান্ত জ্ঞান প্রকৃত অর্থে ‘অজ্ঞান’ ও ‘অবিদ্যা’ হিসেবেই বর্জনীয় বিবেচিত হয়েছে। সামাজিক ভেদাভেদের বীজও এখানে সযত্নে লালিত হয়েছে। বৃহদারণ্যক উপনিষদে বলা হয়েছে যে ব্রষ্ম উন্নততর মানুষ হিসেবেই ব্রাক্ষ্মণ ক্ষত্রিয়দের সৃষ্টি করেছেন। ছান্দোগ্য উপনিষদে চণ্ডালকে কুকুর ও শূকরের সমপর্যায়ভুক্ত জীব বলে গণ্য করা হয়েছে। দৈহিক শ্রম ও তজনিত লব্ধ জ্ঞান ব্রষ্মজ্ঞান লাভের পরিপন্থী বলে চিহ্নিত হয়েছে।

অধ্যাপক হাবিব ও ঠাকুর উপনিষদের জন্মান্তর তত্ত্বকে বর্ণবিভক্ত সমাজের নিশ্চলতার প্রতিবেদন বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। উপনিষদের ভাষ্য অনুযায়ী কোন ব্যক্তির অবস্থান ও নবজন্ম তার পূর্ববর্তী জীবনের দোষ-গুণের নিরিখে স্থির হয়ে থাকে। বংশানুক্রমিক বর্ণ-ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে জন্মান্তরের উপনিষদের ধারণা একটি আদর্শগত স্তম্ভের কাজ করেছে। নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের ভাষায়, “এ দর্শন শুধু শ্রম ফলভোগী উচ্চবর্ণের, শ্রম প্রদানকারী শুদ্রের নয়।”

আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।

Leave a Comment