আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “ব্যক্তিগত ডায়েরি কীভাবে বহুজনের আস্বাদ্য হয়ে ওঠে তা বিচার করো। একটি সাহিত্যিক পদবাচ্য ডায়েরির বিষয় ও রীতি—বিশ্লেষণ করো” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
ব্যক্তিগত ডায়েরি যখন নিজ গুণে সাহিত্যিক মর্যাদায় উন্নীত হয় তখন তা বহুজনের আস্বাদ্য হয়ে ওঠে। তাই আমাদের আগে জানতে হবে ডায়েরি কখন সাহিত্যিক মর্যাদা প্রাপ্ত হয়।
(i) ডায়েরির সাহিত্যিক মর্যাদা লাভের প্রথম শর্ত হল ব্যক্তিক অভিজ্ঞতাকে বিশ্বজনীন করে তোলা অর্থাৎ ব্যক্তিক জীবনের আনন্দ-নিরানন্দ, আশা-হতাশা, প্রয়োজন কিংবা অভিজ্ঞতাকে দেশ কাল সমাজের আভাসে সমৃদ্ধ করে তোলার মধ্য দিয়ে ডায়েরি সাহিত্য পদবাচ্য হয়ে ওঠে।
(ii) ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ ব্যক্তি জীবনের অভিজ্ঞতা অন্তরঙ্গ একক স্বরের মধ্য দিয়ে যখন সবিশেষ দর্শন মূল্যে উত্তরিত হয় তখন ডায়েরি সাহিত্যের মর্যাদা লাভ করে।
(iii) সাহিত্য হল যে-কোনো রসময় উপস্থাপন। দিনলিপির বস্তুগত উপাদান যখন ব্যক্তিজীবনের রসময় অভিব্যক্তির আভাসে সুখকর হয়ে ওঠে, তখন তা সাহিত্য পদবাচ্য হয়। আর এই সাহিত্য পদবাচ্য হলেই তা বহুজনের আস্বাদ্য হয়ে ওঠে।
একটি সাহিত্যিক পদবাচ্য ডায়েরি হল কালিদাস নাগের ‘ডায়েরি’। এর বিষয় ১৯১৬-১৯১৯ সালের যৌবন থেকে পরিণত বয়স পর্যন্ত প্রতিটি দিন তিনি লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন অচ্যুত নিষ্ঠায়। এই ডায়েরিতে নিজের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা ছাড়াও সামাজিক ইতিহাস শিল্প-কলা-বিজ্ঞান-ধর্ম-দর্শন প্রভৃতি বিষয়ক টুকরো টুকরো চিত্র ভরপুর। উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি পরিষ্কার করা যাক— ১০/৩/১৯১৭ তারিখে লেখা—“আজ প্রফুল্ল সেনের বিবাহে নিমন্ত্রণ খাওয়া গেল।”
১৪/৩/১৯১৭ রিখে রবীন্দ্রনাথের কথা উল্লেখ করে লিখেছেন—“আজ কবির আহ্বানে সন্ধ্যায় সকলে হাজির হলুম। গান, গল্প ইত্যাদি হল সাহিত্য পরিষদ ও বঙ্গীয় ছাত্রবৃন্দ সম্বন্ধে কবির সঙ্গে কিছু কথা হল”।
২৪/৩/১৯১৭-তে লেখা—“কবিকে আজ চিঠি লিখলুম।”
এমন তথ্য পরিবেশনের সঙ্গে সঙ্গে এ ডায়েরির ভেতর দিয়ে ঝলসে উঠেছে দৈনন্দিনতার ঊর্ধ্বে অন্য দেশ অন্য সমাজের কথাও। রবীন্দ্রনাথের জাপান যাত্রার কথা, ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের সঙ্গে আলাপচারিতা প্রসঙ্গে এ ডায়েরিতে মূর্ত। ড. নাগের ডায়েরি জানাচ্ছে—জাপান সরকার রবীন্দ্রনাথের ইন্টারভিউ ও বক্তব্যে অপ্রসন্ন হয়ে তার প্রতি সমাদর কমিয়ে দিয়েছিলেন। তাতে কবি দেশটাকে ও বেসরকারি দলকে ভালো করে দেখতে কমিয়ে দিয়েছিলেন। তাতে কবি দেশটাকে ও বেসরকারি দলকে ভালো করে দেখতে পেরেছিলেন। জাপানিদের শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কে যে মূল্যায়ন রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন তার পরিচয়ও এ ডায়েরি দেয়— ‘‘আমরা শুনে আসছি এবং দেখে আসছি জাপানি জাত শিল্পে অতুলনীয়, এখন দেখছি সাধারণভাবে একথা বললে ভুল করব। প্রথমে ভাস্কর্যে, স্থাপত্যে, জাপানি বিশেষ কৃতিত্ব দেখায়নি, সংগীতের রসবোধ আছে কিনা সে বিষয়ে দারুণ সন্দেহ। জাপানি কলা বোধ কেন্দ্রীভূত হয়েছে চিত্রে এবং নৃত্যে।”
এ ক্ষেত্রে ড. নাগের ডায়েরি দৈনন্দিনতা ছাড়িয়ে সর্বজনীন হয়ে উঠেছে। নিছক রোজনামচা না থেকে হয়ে উঠেছে দর্শনও। এ ডায়েরি যেমন নানান পণ্ডিত মনিষার পরিচয়ে ঐতিহাসিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ তেমন চিরন্তন মনের, মননের ও স্পর্শে ঋদ্ধ। এটি তুচ্ছ দিন যাপনের বর্ণনায় যেমন অমলিন তাৎপর্যে মহিমা লাভ করেছে, তেমনি অসাধারণ ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য বর্ণনায় ও তাদের মূল্যায়নে এ ডায়েরি সাহিত্য মূল্য শিল্প মূল্য অর্জন করেছে। যেমন ৮/৫/১৯১৭ তারিখে রবীন্দ্র জন্মোৎসব প্রসঙ্গে শ্রী নাগ লিখেছেন— “নিজের জীবনের কথা বলতে কবিকে এরকম বিচলিত কখনও দেখিনি।”
এই প্রসঙ্গে শ্রীনাগ রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যের বয়ান যেভাবে ডায়েরিতে ধরেছেন তা একই সঙ্গে দর্শন মূল্যে ও সাহিত্য মূল্যে উত্তরিত। এখানে মানব জীবনের শৈশব, যৌবন ও প্রৌঢ়ত্বের বিভাজক ও প্রৌঢ়ত্বে এসে জীবনের প্রতি নবীন টানের বর্ণনা যেমন রসময় তেমন প্রজ্ঞাযুক্ত মননশীলও।
কালিদাস নাগের ডায়েরিতে তাঁর সমকালের বিদ্বজনের, আত্মীয়-স্বজনের ছবিও ধরা পড়েছে। ১১/৫/১৯১৭-তে লিখেছেন আজ club-এ সুকুমার criticism true and false এই বিষয়ে আলোচনা করলেন। কিরণশঙ্কর রায় বলেছিলেন, তর্ক বেশ জমলো। ২৭/৬/১৯১৭ তারিখে লেখা—শ্রীশবাবুর সঙ্গে বলাকা পাঠ চলছে। ২৪/১০/১৯১৭-তে লেখা—“সকালে নতুন মামির সঙ্গে রবিবাবুর কিছু কিছু পাঠ করা গেল।”
অর্থাৎ সামগ্রিক বিচারে ড. নাগের ডায়েরি সাহিত্য পদবাচ্য ডায়েরির একটি নিদর্শন।
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।