আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “ভারতে মধ্যপ্রস্তর যুগ” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
ভারতে মধ্যপ্রস্তর যুগ
পুরাপ্রস্তর যুগের অবসান এবং নব্যপ্রস্তর সংস্কৃতির আবির্ভাবের মধ্যবর্তী সময়কাল মধ্যপ্রস্তরযুগ বা মধ্যাশ্মীয় সংস্কৃতি নামে পরিচিত। এই যুগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল ক্ষুদ্রতর হাতিয়ারের ব্যাপক ব্যবহার। এক থেকে তিন সেন্টিমিটার লম্বা সূক্ষ্মদানা প্রস্তরখণ্ড থেকে তৈরী অসংখ্য হাতিয়ার মধ্যপ্রস্তরযুগে পাওয়া গেছে। এই হাতিয়ারগুলিকে ইংরাজিতে ‘Mycrolith’ (মাইক্লোলিথ) বলা হয়। এই কারণে মধ্যপ্রস্তরযুগ ‘ক্ষুদ্রপ্রস্তর’ বা ‘ক্ষুদ্রাশ্মীয়’ যুগ নামেও অভিহিত হয়। তবে ছোট ছোট হাতিয়ারের পাশাপাশি বড় বড় পাথরের হাতিয়ারের ব্যবহারও ছিল। সাংস্কৃতিক স্তর-বিন্যাসের প্রেক্ষিতে প্লাইস্টোসিন যুগ বা তুষারযুগের অবসানের পর হলোসিনযুগে মধ্যপ্রস্তর সংস্কৃতি বিকশিত হয়েছিল। পুরাপ্রস্তর যুগের শিকারী মানুষ এবং নব্যপ্রস্তরযুগের খাদ্য উৎপাদনকারী মানব সংস্কৃতির মধ্যবর্তী এই স্তরে মানুষ গৃহপালিত পশু অর্থনীতির সাথে পরিচিত হয়েছিল। তুষার যুগের অবসানের পর ভূ-প্রাকৃতিক পরিবেশে নানা পরিবর্তন ঘটে। উদ্বৃতার বৃদ্ধির ফলে তুষার গলে যাওয়ায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতার তারতম্য ঘটে। বৃষ্টিপাত বৃদ্ধি পায়, সৃষ্টি হয় গভীর অরণ্যের।
প্রস্তরযুগের বিভিন্ন পর্বের সময়কাল নির্ধারণের কাজের সমস্যা বা মতভেদ মধ্যপ্রস্তর যুগের ক্ষেত্রেও বর্তমান। মূলতঃ রেডিও কার্বন পদ্ধতির প্রয়োগ দ্বারা ক্ষুদ্রপ্রস্তর সংস্কৃতির সময়কাল নির্ধারণের চেষ্টা করা হয়েছে। তবে একই ধরনের একাধিক কেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত তারিখগুলির বিভিন্নতা কিছুটা বিভ্রান্তি বা বিতর্কের জন্ম দেয়। ভারতবর্ষে প্রাপ্ত ক্ষুদ্রপ্রস্তর যুগের নিদর্শনগুলি নিশ্চিতভাবেই খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ অব্দ এবং তার আগে-পরে কিছু সময়কালে বিকশিত হওয়ার সাক্ষ্য দেয়। কিন্তু কোন কোন অঞ্চলে খ্রিষ্টীয় দশম-একাদশ শতকের মৃৎপাত্রের টুকরোর পাশাপাশি ক্ষুদ্রপ্রস্তর হাতিয়ারও পাওয়া গেছে। বীরভূম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া জেলায় এমন নিদর্শন পাওয়া যায়। এ কারণে গবেষক দিলীপকুমার চক্রবর্তী মন্তব্য করেছেন যে, কেবল মাটির ওপর ছড়িয়ে থাকা ‘মাইক্রোলিথ’ দেখে সেটিকে ক্ষুদ্রপ্রস্তর যুগের নিদর্শন বলা সঠিক হবে না। তাম্রপ্রস্তরযুগেও মানুষ হয়তো নিত্য প্রয়োজনে এমন কার্যকরী ক্ষুদ্রাশ্মীয় আয়ুধ নির্মাণ ও ব্যবহার করতো।
বিভ্রান্তি ও বিতর্ক সত্ত্বেও, প্রত্নতাত্ত্বিকরা বিভিন্ন প্রত্নক্ষেত্রের প্রাপ্ত নিদর্শন বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, ভারতবর্ষে ক্ষুদ্রপ্রস্তর যুগ হলোসিন যুগের (আধুনিক যুগ) গোড়াতেই শুরু হয়েছিল এবং এর সময়কাল খ্রিষ্টপূর্ব ১২/১১ হাজার থেকে ৯/৮ হাজার বছরের অন্তর্বর্তীকাল। উত্তরপ্রদেশের প্রতাপগড় জেলায় সরাইনাহার রাই থেকে পাওয়া তারিখটি হল ৮৩৯৫ (+১০০) খ্রিষ্টপূর্ব। রাজস্থানের ভিলওয়াড়া জেলায় বাগোর গ্রামে প্রাপ্ত ক্ষুদ্রাশ্মীয় সংস্কৃতির তারিখ মোটামুটি খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ ও চতুর্থ শতকের ভেতর। মধ্যপ্রদেশের ভীমবেঠকা থেকে ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগের কিছু তারিখ পাওয়া যায়। শোন উপত্যকায় বাঘোর গ্রামের ২ নং প্রত্নতাত্ত্বিক অঞ্চলের সম্ভাব্য তারিখ খ্রিষ্টপূর্ব অষ্টম সহস্রাব্দ। আবার বিহারের পৈসরা প্রত্নক্ষেত্রের তারিখ আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৭ হাজার অব্দ। হোসংগাবাদের কাছে আজমগড় অঞ্চলে আবিষ্কৃত হাতিয়ার বিশ্লেষণ করে এগুলিকে আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের বলে মনে করা হয়েছে। এটি মধ্যপ্রস্তরযুগের নাকি পরবর্তীকালে তাম্রশ্মীয় যুগের মানুষ ব্যবহার করেছিল, সে বিষয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।
পুরাপ্রস্তর সংস্কৃতি যে সকল অঞ্চলে বিরাজমান ছিল, তাদের সর্বত্র মধ্যাশ্মীয় সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল, এমনটি নয়। এমন বহু প্রত্নক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে যেখানে মধ্যপ্রস্তর বা ক্ষুদ্রাশ্মীয় সংস্কৃতির নিদর্শন পাওয়া গেছে, যদিও পুরাপ্রস্তরযুগে সেগুলিতে মনুষ্য বসতি ছিল, তা প্রমাণিত নয়। হিমালয়ের পাদদেশ অপেক্ষা মালভূমি বা সমুদ্র উপকূল অঞ্চলে মধ্যাশ্মীয় সংস্কৃতির নিদর্শন বেশী পাওয়া গেছে। রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, বিহারসহ মধ্য-গাঙ্গেয় উপত্যকায় ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় জীবনযাত্রার বহু সাক্ষ্য আবিষ্কৃত হয়েছে। ভি. এন. মিশ্র (V. N. Mishra) বিংশ শতকের ষাটের দশকে রাজস্থানের ভিলওয়াড়া জেলার বাগোর গ্রাম-সন্নিহিত অঞ্চলে মধ্যপ্রস্তরযুগীয় প্রত্নক্ষেত্র আবিষ্কার করেন। বাগোর প্রত্নক্ষেত্রকে ‘উপমহাদেশের সর্বাধিক তথ্যনিষ্ট মধ্যাশ্মীয় সংস্কৃতির ক্ষেত্র (‘best documented Mesolithic site in the subcontinent’) বলে মনে করা হয়। গ্রামের উপকণ্ঠে কোঠারি নামে একটি নদীখাতের পাশে এই প্রত্নক্ষেত্রটি পাওয়া গেছে। এখানে তিনটি পর্যায়ে বসতি স্তর নির্দিষ্ট করা হয়। প্রথম পর্যায়টি খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০০ অব্দ থেকে ৪০০০ অব্দ পর্যন্ত বিকশিত হয়েছিল। এখান থেকে পরবর্তী প্রায় একহাজার বছর পর্যন্ত (৪০০০-৩০০০ খ্রিঃ পূঃ) দ্বিতীয় পর্যায়ের অস্তিত্ব ছিল। তৃতীয় পর্যায়টিকে ঐতিহাসিককালের ঘটনা বলে মনে করা হয়। ড. মিশ্র এই সয়মকালটি খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ থেকে ২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বলে নির্দিষ্ট করেছেন।
বাগোরের প্রথম পর্যায়টি ক্ষুদ্রপ্রস্তর যুগীর সাক্ষ্য হিসেবে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বসতির সর্বত্র ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হাতিয়ারের নিদর্শন ছড়িয়ে আছে। সবগুলিই ছোট ছোট চিলকা থেকে বানানো। হাতিয়ারগুলির দৈর্ঘ্য সর্বাধিক ৪০ সেন্টিমিটার এবং সর্বনিম্ন মাত্র ৫ মিলিমিটার। তবে ১০ থেকে ২০ সেন্টিমিটার দীর্ঘ হাতিয়ারই বেশী। চিলকা তোলার জন্য কোয়ার্টজ ও চার্ট উভয় ধরনের পাথরই ব্যবহার করা হত। বৃষ্টিপাত কম হত। তবে নানারকম বুনো শস্য সংগ্রহ করা সম্ভব হত। তাছাড়া বুনো হরিণ পর্যাপ্ত পাওয়া যেত। নদীর মাছ খাদ্য হিসেবে প্রিয় ছিল। ছোট ছোট পাথর সাজিয়ে চাতাল তৈরী করে মৃত জন্তুজানোয়ারের মাংস কাটা হত। পাথরের ব্লেড দিয়ে এই কাজ করা হত। সম্ভবত গৃহপালিত গরু, ভেড়া, ছাগল ইত্যাদির অস্তিত্ব ছিল। অবশ্য একই ধরনের বুনো পশুও ছিল। দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়েও অনুরূপ চিল্কা তোলা ছোট ছোট হাতিয়ার ব্যবহার করা হত। তবে বাগোরের দ্বিতীয় পর্যায়ে ক্ষুদ্রাশ্মীয় প্রস্তরায়ুধের পাশাপাশি মৃৎপাত্র, তামা, সুতো কাটার তলি ইত্যাদিও পাওয়া গেছে। এগুলি অবশ্যই ক্ষুদ্র প্রস্তর সংস্কৃতির নিদর্শন নয়, পরবর্তীকালের। অর্থাৎ এখানে বাগোর দ্বিতীয় এবং তৃতীয় পর্যায়ে উন্নততর পর্ব অর্থাৎ নব্য-প্রস্তর সংস্কৃতির অস্তিত্বের পাশে ক্ষুদ্রাশ্মীয় আয়ুধও থেকে গিয়েছিল। গুজরাটের লাংঘনাজ, লেখাইয়া, বাঘাইঘোর (মির্জাপুর) থেকেও অনুরূপ মিশ্র-সাংস্কৃতিক পর্যায়ের অস্তিত্ব দেখা যায়। মধ্যপ্রদেশের আজমগড় থেকে ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় স্তরে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান থেকে খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম সহস্রাব্দের সংস্কৃতির সাক্ষ্য পাওয়া গেছে। এখানে আনুমানিক ২৫ হাজার ক্ষুদ্রাশ্মীয় আয়ুধ এবং পোষা কুকুর, ছাগল, মোষ, গোরু, শুয়োরের অস্তিত্ব জানা গেছে। এছাড়া গোসাপ, সজারু, হরিণ, খরগোশ ইত্যাদি বুনো জন্তুও এখানে ছিল।
মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকার একাধিক ক্ষেত্র থেকে মধ্যপ্রস্তর সংস্কৃতির নিদর্শন পাওয়া গেছে। তবে কোন কোন অঞ্চলে যেমন এলাহাবাদ, বেনারস, জৌনপুর, সুলতানপুর প্রভৃতি জেলায় এমন কিছু হাতিয়ার আবিষ্কৃত হয়েছে, যেগুলি পুরাপ্রস্তর যুগের তুলনায় ছোট হলেও, ক্ষুদ্রপ্রস্তর আয়ুধের (microlith) থেকে সামান্য বড়। তাই প্রত্নতাত্ত্বিকরা এই পর্যায়টিকে ‘উত্তর পুরাপ্রস্তর পর্ব’ বলেছেন। ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত একটি বিবরণে অনুরূপ ১৯৮টি প্রত্নক্ষেত্রের নামোল্লেখ পাওয়া যায়। তবে মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকার তিনটি কেন্দ্রে, চোপানি মানডো, সরাই নাহার-রাই এবং মহাদহতে, ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় সংস্কৃতির বিপুল নিদর্শন পাওয়া গেছে। তিনটি ক্ষেত্রই উত্তরপ্রদেশের অন্তর্গত। চোপানি-মান্ডো ক্ষেত্রটি এলাহাবাদ জেলার মেজা মহকুমার বেলান নদীর তীরে অবস্থিত। মধ্যাশ্মীয় যুগে কুটির নির্মাণ বিদ্যার সাথে আদিমানবের পরিচয় এখানে স্পষ্ট। চারপাশে কিছুটা অন্তর সরু সরু খুঁটি দিয়ে কুটিরগুলি চিহ্নিত করা হয়েছিল। মেঝেতে ছড়ানো অসংখ্য পাথরের টুকরো। সর্বত্রই ক্ষুদ্রাশ্মীয় আয়ুধ তৈরীর উপকরণ ছড়ানো ছিল। শেষদিকের কুটিরগুলি গোলাকার বা ডিম্বাকৃতি। চারদিকে প্রস্তরখণ্ড রেখে সীমানা নির্দিষ্ট করা ছিল। পেযাই করার উপযোগী পাথর, পোড়ামাটি, হাড়ের টুকরো ইত্যাদি পাওয়া গেছে। কুটিরের সংখ্যা তুলনায় কম হলেও, এখানে অনেকগুলি উনুন (চুলা) পাওয়া গেছে। কিছু বুনো ধানের অবশিষ্ট, একটি পাথরের পুঁতি, বেত জাতীয় উদ্ভিদের অস্তিত্ব চিহ্নিত করা হয়েছে।
মহাদহ এলাকাটি অপেক্ষাকৃত নিচু এবং সহজেই জল জমা হয়ে থাকত। অনুমান করা হয় যে, বিন্ধ্য অঞ্চল থেকে ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় মানুষ এই সকল দহ অঞ্চলে এসে বসতি গড়েছিল। খননকার্য থেকে মহাদহে তিনটি স্বতন্ত্র কেন্দ্র চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রথমটি বসতি অঞ্চল। এখানে একাধিক গোলাকার বা ডিম্বাকৃতি চুলার অস্তিত্ব আছে। দৈর্ঘ্য, প্রস্থ বা গভীরতার দিক থেকে এগুলি খুবই ছোট। কাঠকয়লার অস্তিত্ব নেই। সম্ভবত ডাল-পালা দিয়ে আগুন জ্বালানো হত। এখানে পনেরোটি কবর পাওয়া গেছে। ২টি কবরে দু’টি করে কঙ্কাল আছে। একটি নারী, অন্যটি পুরুষের। সব দেহই লম্বালম্বিভাবে শোয়ানো। কবরে কঙ্কালের পাশে হাড়ের গয়না, জন্তুর হাড়, পাথরের ছোট ছোট হাতিয়ার পাওয়া গেছে। দ্বিতীয় কেন্দ্রটি মৃত পশু কাটার কাজে ব্যবহৃত হত বলে অনুমান। এখানে খণ্ড খণ্ড হাড় প্রচুর পাওয়া যায়। হরিণের হাড়ই বেশী। এছাড়া বুনো মোষ, গরু, শুয়োর ইত্যাদি কাটা হত। যে সকল গহনা পাওয়া যায়, সেগুলি সবই হরিণের হাড় থেকে তৈরী। তৃতীয় কেন্দ্রটি দহের একেবারে প্রান্তে। এখানেও বিভিন্ন পশুর টুকরো করা হাড়, পেষাই করার উপযোগী পাথর পাওয়া গেছে। মধ্য-উত্তরপ্রদেশের আর একটি ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় কেন্দ্র হল সরাই-নাহার-রাই। এখানেও এগারোটি কবর এবং নারী-পুরুষের লম্বালম্বি শায়িত দেহাংশ পাওয়া গেছে। দেহগুলি মহাদহের মতই পূর্ব-পশ্চিমে বা পশ্চিম-পূর্বে শায়িত। একইরকমভাবে পশুর হাড়, গয়না ইত্যাদিও পাওয়া যায়, রেডিও কার্বন বিশ্লেষণ অনুসারে এই কেন্দ্রটির বয়স প্রায় দশ হাজার বছর। গাঙ্গেয় উপত্যকায় ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগের আর একটি কেন্দ্র হল প্রতাপগড় জেলার দমদমা। কেন্দ্রটির আয়তন প্রায় ৮৮০০ বর্গমিটার। এখানেও ব্যবহৃত চুলা এবং কঙ্কালসহ কবর আবিষ্কৃত হয়েছে। পাথরের অসংখ্য হাতিয়ার, হাড়ের জিনিস, পেষাই উপযোগী পাথর এবং পোড়া শস্যদানা পাওয়া গেছে। একই কবরে একাধিক দেহ সমাহিত করার প্রমাণ এখানেও আছে। প্রাপ্ত দগ্ধ শস্যদানাটি সম্ভবত কোন বুনো ফসলের দানা।
আগেই দেখেছি যে, মধ্যপ্রস্তরযুগের হাতিয়ারগুলির ক্ষুদ্র অবয়ব-এর নিরিখে এগুলিকে ক্ষুদ্রাশ্মীয় আয়ুধ (microlith) বলা হয় এবং এই পর্বটিকে ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগও বলা হয়। হাতিয়ারগুলি প্রধানত ১ থেকে ৩ সেন্টিমিটার বিশিষ্ট এবং সূক্ষ্ম দানাযুক্ত প্রস্তরখণ্ড থেকে নির্মিত হত। সব থেকে বেশী লম্বা হাতিয়ারটি ছিল ৮ সেন্টিমিটার। জ্যামপার, অ্যাগেট, চার্ট, কোয়ার্টজ ইত্যাদি সূক্ষ্ম দানাদার পাথর থেকে এগুলি নির্মিত হয়েছিল। হাতিয়ারগুলি গোলাকার, আয়তাকার এবং ছুঁচালো মুখযুক্ত হত। হাতিয়ারের মধ্যে ছিল হাতকুঠার, বাটালি, সমপার্শ্বযুক্ত এবং উত্তল-অবতলবিশিষ্ট চাঁচনি, তুরপুন, তীরের ফলা ইত্যাদি। হাতিয়ারগুলির প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং নিখুঁত আকার ছিল বিস্ময়কর। পাথর ছাড়া পশুর হাড়, শিং, কাঠ প্রভৃতিও হাতিয়ার নির্মাণের উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হত। তবে এইসকল জৈব উপাদানের হাতিয়ার অধিকাংশই কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। তাই খননকার্য থেকে এগুলির নিদর্শন বিশেষ পাওয়া যায়নি।
ভারতীয় উপমহাদেশে শিল্পচর্চা :
পুরাপ্রস্তর সংস্কৃতির বিস্ময়কর ও বিশিষ্ট দিক্টি হল শিকারী মানুষের শৈল্পিক ক্রিয়াকাণ্ড। বহির্ভারতে আলতামিরা গুহাচিত্র কিংবা ল্যাকো (ফ্রান্স) গুহাচিত্রের অস্তিত্ব বহু আগেই জানা গেছে। সাম্প্রতিক ভারতবর্ষেও আদিম মানুষের সৃষ্ট প্রত্নাশ্মীয় যুগের গুহাচিত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। গিরিচূড়া, গিরিগাত্রে বা মেঝেতে নিছক অলংকরণের তাগিদ বা ধর্মীয় উদ্দেশ্যে পুরাপ্রস্তরযুগের গুহা চিত্রগুলি অঙ্কিত হয়েছিল। ভারতে মধ্যপ্রদেশের ভীমবেঠকা গুহাশ্রয়ে প্রস্তরযুগীয় গুহাচিত্রের নিদর্শন আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে। গুহাচিত্রের বিষয়বস্তু মূলত জীবজন্তু বা মানুষের পশুশিকারের দৃশ্যাবলী। কোন কোন চিত্রে কেবল মানুষ আর পশুর সহাবস্থান প্রদর্শিত হয়েছে। কেবল জ্যামিতিক রেখাচিত্রের মাধ্যমেও চিত্রচর্চার নিদর্শন আছে। সম্পূর্ণ রঙিন ছবি অঙ্কনের প্রত্যাশা সেকালে না-করাই স্বাভাবিক। তবে কিছু কিছু চিত্রের বহিরেখায় প্রাকৃতিক রঙের ব্যবহার দেখা যায়। মেঝেতেও গোলাকার পাথরের ঘা মেরে মেরে শিল্পাঙ্কনের আভাস দেখা যায়। তবে দীর্ঘকাল পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকার ফলে এবং পরবর্তীকালে বহু মানুষের গমনাগমনের ফলে তাদের অনেককিছুই বিলীন বা বিকৃত হয়ে গেছে।
আদিম মানুষের চিত্রাঙ্কনের অনুপ্রেরণা কী থেকে এসেছিল, সুনিশ্চিতভাবে বলা কঠিন স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনা করে গর্ডন চাইল্ড মনে করেন যে, প্রস্তরযুগীয় ভাস্কর্য ও চিত্রাঙ্কন কেবলমাত্র রহস্যময় ‘শৈল্পিক আবেগ’-এর প্রকাশ ছিল না। এর পেছনে শিল্পীর একটা ভাললাগার পাশাপাশি সম্ভবত ধর্ম-বিশ্বাস জাতীয় একটা উপাদান সক্রিয় ছিল। ছবিগুলি আদিম মানুষের বসবাসের স্থলে অঙ্কিত হয়নি। এগুলি ছিল লোকচক্ষুর আড়ালে। গুহার গভীর কন্দরে, যেখানে দিনের আলো ঢুকতে পারে না, ছবিগুলি আঁকা হয়েছে। সাধারণভাবে গুহার ঐ অংশে সহজে মানুষ পৌঁছাতে পারত না। আলো-আঁধারিতে ঘেরা, স্যাঁতস্যাতে গুহার ঐ অংশে শিল্পীকে বেশিরভাগ সময় চিৎ হয়ে শোয়া অবস্থায় ছবি আঁকতে হত। ক্ষীণ কৃত্রিম আলোর সাহায্যে শিল্পকর্ম চালাতে হত। পশুর চর্বি ও শ্যাওলার সলতে এই কাজে সাহায্য করতো।
গুহার গভীরে অঙ্কিত চিত্রগুলি মূলত হরিণ, বাইসন প্রভৃতি পশু শিকারের দৃশ্য। সম্ভবত লোকচক্ষুর আড়ালে কোন অদৃশ্য শক্তির উদ্দেশ্যে চিত্রগুলি কল্পিত হয়েছিল। তাহলে কী আদিম মানুষ ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে চিত্রাঙ্কনে লিপ্ত হয়েছিল। তবে বর্তমানে ধর্মভাবনা বলতে যা বোঝায়, আদিম পশুশিকারী, খাদ্য সংগ্রাহক মানুষের মধ্যে নিশ্চয়ই তা ছিল না। প্রত্নতাত্ত্বিকদের অনুমান এই আদিম গুহাচিত্রের একটা উপাদান ছিল যাদুবিশ্বাস। বিজ্ঞান সচেতনার প্রাক্কালে মানুষ এমনটা ভাবত যে, ছবিতে পশুর অবয়ব এবং তাকে সফলভাবে শিকার করার যে দৃশ্য অঙ্কন করা হচ্ছে, বাস্তবে সেই সাফল্য তাদের করায়ত্ব হবে। বস্তুত, শিকারী জীবনের সংগ্রাম এবং চিত্রের বিষয়বস্তু মিলে যেত। এই যাদুকেন্দ্রিক ভাবনা চিত্রাঙ্কনের অনুপ্রেরণা যোগাত।
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।