মগধের সাম্রাজ্যবাদের সহায়ক উপাদানসমূহ

আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “মগধের সাম্রাজ্যবাদের সহায়ক উপাদানসমূহ” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।

মগধের সাম্রাজ্যবাদের সহায়ক উপাদানসমূহ

খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠশতকে উত্তর ভারতে গড়ে ওঠা যোলটি মহাজনপদের মধ্যে মগধ ছাড়াও অন্ততঃ আরো তিনটি প্রায় সম ক্ষমতা সম্পন্ন জনপদ ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মগধ একছত্র রাজনৈতিক কর্তৃত্বের অধিকারী হতে পেরেছিল। এর কারণ মগধের এমন কিছু সহায়ক আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক উপাদান ছিল, যা অন্যান্যদের ছিল না। অনেকে মনে করেন যে মগধ রাজ্যে ধারবাহিক ভাবে দক্ষ ও যোগ্য রাজার আবির্ভাব তার সাম্রাজ্যবাদকে সফল করেছিল। তদুপরি অতি দক্ষ কিছু উচ্চপদস্থ আমলার উপস্থিতি মগধের সাফল্যের সহায়ক হয়েছিল। নিঃসন্দেহে বিম্বিসার, অজাতশত্রু, মহাপদ্মনন্দ, চন্দ্রগুপ্ত প্রমুখ একাধিক বিচক্ষণ, দূরদর্শী ও সাহসী রাজা মগধের সিংহাসনে আসীন হয়েছিলেন। পরিস্থিতির সুযোগ নিতে এঁদের কেউই ব্যর্থ হননি। একই সময়ে অজাতশত্রুর মন্ত্রি বসসাকর এবং চন্দ্রগুপ্তর মন্ত্রি চাণক্যর নাম স্মরণ করা হয়। বসসাকরকে ম্যাকিয়াভেলির সাথে তুলনা করা হত। অন্যদিকে চাণক্য ছিলেন কূটনীতির যাদুকর এবং অগ্রণী রাষ্ট্রবিদ। এঁদের পরামর্শ মগধের রাজনীতিকে একটা স্বতন্ত্র্য মাত্রা দিয়েছিল।

ব্যক্তিগত দক্ষতা নিঃসন্দেহে সাফল্যের অন্যতম উপাদান, কিন্তু একমাত্র উপাদান হতে পারে না। বহু জনপদেই কিছু কিছু দক্ষ ও সাহসী রাজার উপস্থিতি ছিল। কিন্তু মগধের এমন কিছু প্রাকৃতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উপাদান ছিল, যা অন্যদের ছিল না। তাই মগধ সফল হয়েছিল। মগধের ভৌগোলিক অবস্থান তার সাম্রাজ্যে উন্নীত হওয়ার প্রেক্ষাপট গড়ে দিয়েছিল। পূর্ব ভারত ও পশ্চিম ভারতের সংযোগস্থলে মগধের অবস্থান ভারতব্যাপী কর্তৃত্ব বিস্তরের পক্ষে অনুকূল ছিল। মগধের প্রথম রাজধানী রাজগৃহ (রাজগীর) পাঁচটি পাহাড় দ্বারা বেষ্টিত ছিল। প্রাকৃতিক নিরাপত্তার পাশাপাশি কৃত্রিম সুউচ্চ প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত থাকায় রাজগৃহ সুনিশ্চিত নিরাপত্তা পেয়েছিল। পরবর্তীকালে সুসজ্জিত পাটলিপুত্র নগরীতে মগধের রাজধানী স্থানান্তরিত করা হয়। এটিও গঙ্গা, শোন ও গণ্ডক নদীর সংগমস্থলে স্থাপিত হওয়ায় সুদৃঢ় প্রাকৃতিক নিরাপত্তার অধিকারী ছিল। নদী ও পাহাড় মগধকে নিরাপত্তা দানের পাশাপাশি আগ্রাসী বা সম্প্রসারণশীল নীতির সহায়ক হয়েছিল। গঙ্গানদের গতিপথ ধরে মগধের পক্ষে সামরিক অভিযানে বের হওয়া সহজ হয়েছিল। ‘জলদূর্গ (water-fort) নামে পরিচিত পাটলিপুত্র প্রকৃত অর্থেই মগধকে নিরাপত্তা দিয়ে সম্প্রসারণবাদী হতে সাহায্য করেছিল।

মগধের সাম্রাজ্যবাদী তৎপরতা ও সাফল্যের সম্ভবত সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল তার অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা। প্রকৃতি যেন দু’হাত জুড়ে মগধকে অর্থ-সম্পদ ঢেলে দিয়েছে। বনজ, খনিজ ও কৃষিজ প্রকৃতির এই তিনটি মৌল সম্পদের ভাণ্ডার ছিল মগধের করায়ত্ত। মগধ রাজ্যের অধীনে ছিল বিশাল ও ঘন জঙ্গল। জঙ্গল থেকে মগধ পেত দামি কাঠ এবং হাতি। কাঠ রপ্তানি করে আসত অর্থ, আবার হাতি সংগ্রহ করে মগধ গড়ে তুলেছিল সুবিশাল হস্তিবাহিনী। মগধের হস্তিবাহিনী সে দেশের পদাতিক সেনাদের যুদ্ধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছিল। গ্রীক বিবরণ থেকে জানা যায় যে, নন্দরাজাদের অধীনে প্রায় ৬ হাজার হাতির বাহিনী ছিল। হস্তিবাহিনীর সাহায্যে শত্রুর দূর্গ ধ্বংস করা কিংবা অগম্য স্থানে আক্রমণ চালানো সম্ভব হয়।

খনিজ সম্পদের প্রাচুর্যও মগধকে সম্প্রসারণবাদী সক্রিয় নীতি গ্রহণে সাহায্য করে। প্রাথমিক রাজধানী রাজগৃহর চতুর্দিকে লৌহ খনির অস্তিত্ব ছিল। ধলভূম, সিংভূম, গয়া জেলার বারাবার পাহাড় এবং ধারওয়ারে ছড়িয়ে ছিল একাধিক লৌহখনি। মগধ ছাড়া একমাত্র অবন্তি রাজ্যের অধীনে লৌহ খনির অস্তিত্ব ছিল। দীর্ঘ যুদ্ধের পর মগধ অবত্তী রাজ্য দখল করতে সক্ষম হলে মগধের খনিজ সম্পদের ভাণ্ডার আরও স্ফীত হয়ে ওঠে। প্রাপ্ত লোহা থেকে মগধ উন্নত যুদ্ধাস্ত্র তৈরী করতে সক্ষম হয়। অন্যদিকে উদ্বৃত্ত লৌহ সম্পদ রপ্তানি করে মগধের রাজকোষকে সমৃদ্ধ করে তোলা সম্ভব হয়। লোহার লাঙ্গল, মই ইত্যাদি কৃষি-সরঞ্জাম তৈরী করে কৃষি-উৎপাদন দ্রুত বাড়িয়ে তোলা সম্ভব হয়। মগধের ক্ষেত্রে খনিজ সম্পদের গুরুত্ব প্রসঙ্গে কৌটিল্য তাঁর ‘অর্থশাস্ত্র’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘রাজকোষ খনির ওপর নির্ভরশীল এবং সেনাবাহিনী রাজকোষের ওপর। খনিই হল যুদ্ধ রসদের গর্ভাশয়।’

মগধের সমৃদ্ধ অর্থ-সম্পদের অন্যতম ভিত্তি ছিল তার কৃষি উৎপাদন। গঙ্গা ও শোন নদী বিধৌত মগধের অধিকাংশ জমি ছিল উর্বর ও সুফসলা। পলিমাটি বিধৌত মগধের কৃষিক্ষেত্রগুলি সহজাত কারণে ব্যাপক উৎপাদন দিতে সক্ষম ছিল। লৌহজাত কৃষি সরঞ্জাম যেমন কুঠার, কাটারি, দা ইত্যাদি ব্যবহার করে বহু পতিত জমিকে চাষযোগ্য করে তোলা সম্ভব হয়। কৃষকের কাছ থেকে শুল্ক আদায় করাও সহজ হয়। এইভাবে একটি সমৃদ্ধ রাজকোষ মগধকে সুসজ্জিত ও সুবিশাল সামরিক বাহিনী গড়ে তুলতে সাহায্য করে। এই সামরিক বাহিনী দ্বারা সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ সম্ভব হয়। ড. রোমিলা থাপার লিখেছেন যে, ‘কৃষির ওপর নির্ভর করেই মগধে প্রথমে সাম্রাজ্য গঠনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। (The possibility of an imperial structure based on an essentially agrarian economy began to germinate in Indian mind.”)

বিপুল খনিজসম্পদ ও কৃষি উৎপাদনের পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যের বিস্তারও মগধের অর্থ ব্যবস্থাকে স্বচ্ছল করেছিল। গঙ্গা নদীর ওপর মগধের নিয়ন্ত্রণ নৌ-বাণিজ্যের সহায়ক ছিল। জলপথে আর্ন্তদেশীয় বাণিজ্য থেকে মগধের রাজকোষ প্রভূত শুল্ক আদায় করতে পারে। বিম্বিসার কর্তৃক অঙ্গদেশ জয়ের পর মগধ বহির্বাণিজ্যেও অংশ নিতে শুরু করে। অঙ্গ রাজ্য জয়ের মাধ্যমে চম্পা নদী এবং চম্পা বন্দরের নিয়ন্ত্রণ মগধের হস্তগত হয়। চম্পাবন্দর ছিল দূর প্রাচ্যের দেশগুলির বাণিজ্যের ব্যস্ততম কেন্দ্র। এখন মগধ রাজ্য এই বাণিজ্যের সূত্রে রাজকোষকে সবল করতে পারে। এ. এল. ব্যাসামের মতে, মগধের রাজারা জলপথের গুরুত্ব উপলব্ধি করেই চম্পা, কোশল, বৈশালী প্রভৃতি রাজ্য দখলে উদ্যোগী হয়েছিলেন। রোমিলা থাপার মনে করেন যে, অঙ্গরাজ্য জয়ের পর মগধের যে বাণিজ্যিক সক্রিয়তা বেড়েছিল তা ছিল খুবই লাভজনক।

এককেন্দ্রিক শাসন কায়েম করার ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক উদারতা ও সামাজিক সহনশীলতা সহায়ক উপাদানের কাজ করে। এ দিক থেকেও মগধ সমকালীন জনপদগুলির তুলনায় এগিয়ে ছিল। মগধের একদিকে ছিল পাঞ্জাব, যা ছিল আর্যদের প্রধান বাসভূমি এবং আর একদিকে ছিল নিম্ন গাঙ্গেয় অঞ্চল। সেখানে প্রাধান্য ছিল অনার্যদের। মগধে এই দুই সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটায় সেখানে ‘মিশ্র’ সংস্কৃতির উদ্ভব ঘটেছিল। এইরূপ মিশ্র সংস্কৃতির মানুষের চিত্তবৃত্তিকে উন্নত ও উদার করে। ফলে এখানে যেমন খুব সহজে বৌদ্ধধর্ম তার আসন পেয়েছিল, তেমনি এই রাজারা নতুন রাজ্যজয়ে পেয়েছিল জনগণের প্রেরণা। আর্য মানসিকতা ও অনার্য বাহুবলে মগধ হয়ে উঠেছিল অপরাজেয়। তাছাড়া মগধে আর্য-সভ্যতার প্রভাব পড়েছিল বেশ দেরীতে। ফলে বৈদিক-আর্যদের সামাজিক বিধি-বিধান মগধে ছিল না। মগধীয় সমাজ ছিল তুলনামূলক ভাবে উদার। এর ফলে মগধের মানুষদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল উদার। অধ্যাপক সুনীল চট্টোপাধ্যায়ের মতে, “মধ্যযুগের ভারতে দিল্লীর যে স্থান, প্রাচীন ভারতে মগধ সেই স্থান নিয়েছিল।”

বস্তুত যে-কোন সাম্রাজ্যের বিকাশের জন্য দৃঢ় অর্থব্যবস্থা, সুদক্ষ কেন্দ্রীয় শাসন, জনগণের জাতীয়তাবোধ, শাসনশ্রেণীর দৃঢ়তা ইত্যাদি উপাদানের প্রয়োজন, তেমনি বিচ্ছিন্নতার মাঝে ঐক্যবদ্ধ সাম্রাজ্য স্থাপনের জন্যও প্রয়োজন আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অনুকূল উপাদানসমূহ। খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের ভারতবর্ষে উপরিলিখিত প্রাকৃতিক ও জৈবীক অনুকূল উপাদানসমূহের সমারোহ ঘটেছিল মগধের জীবনে। সেই অনুকূল অবস্থাকে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে মগধের শাসকগণ তাকে একটি সাম্রাজ্যে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।

Leave a Comment