আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “মধ্যপ্রস্তর যুগের জীবনযাপন পদ্ধতি ও মধ্যপ্রস্তর যুগের শিল্পভাবনা” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
মধ্যপ্রস্তর যুগের জীবনযাপন পদ্ধতি :
পূর্ববর্তী যুগের তুলনায় মধ্যপ্রস্তরযুগে মানুষের জীবনধারায় অনেক উন্নতি ঘটেছিল। সূক্ষ্ম ও ধারালো হাতিয়ার তৈরীর প্রযুক্তির প্রয়োগ করে এ যুগে সহজে বন্য পশু শিকার করা সম্ভব হয়েছিল। খাদ্যাভাসেও পরিবর্তন ঘটেছিল। কাঁচা মাংস খাওয়ার অভ্যাস এইসময় পরিত্যক্ত হয় এবং সেদ্ধ বা আগুনে ঝলসানো মাংসের সুস্বাদ মানুষের কাছে পরিচিত ও জনপ্রিয় হয়েছিল। এর মূলে ছিল আগুনের ব্যাপক ব্যবহারের চিহ্ন। চোপানি মানডো, মহাদহা, সরাইনাহার রাই, পৈসরা প্রভৃতি প্রত্নক্ষেত্রে মাটি খনন করে চুলা (উনুন)র অস্তিত্ব ও সেগুলি ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। সম্ভবত শুকনো পাতা দিয়েই আগুন জ্বালানোর কাজ করা হত। পশুর মাংস ঝলসানোর পাশাপাশি হাতিয়ার নির্মাণের আগে পাথরগুলিকেও সম্ভবত গরম করে নেওয়া হত। কারণ চুলার আশেপাশে প্রচুর হাতিয়ারের অবশিষ্ট অংশ পাওয়া গেছে।
মধ্যাশ্মীয় যুগে পোড়া শস্যদানার সন্ধান পাওয়া গেলেও, মানুষ ছিল একান্তই খাদ্য সংগ্রাহক, অবশ্যই খাদ্য উৎপাদনকারী নয়। প্রধান খাদ্য ছিল আগের মতই পশু-পাখির মাংস। আবিষ্কৃত চুলার মধ্যে প্রচুর পোড়া হাড় পাওয়া গেছে। তবে এদের বসতি ছিল অরণ্যের মধ্যেই। তাই পশু শিকারের পাশাপাশি এরা পশুপালন করত বলে রামশরণ শর্মা মনে করেন। তবে ইরফান হাবিবের মতে, গোরু, ছাগল গৃহপালিত হয়েছিল, এমন প্রমাণ নেই। শিকার করা পশুগুলি সবই ছিল বুনো। তবে আগুনে ঝলসানো মাংস ভক্ষণে যে তারা রপ্ত হয়ে উঠেছিল, এ বিষয়ে সকলেই একমত। মাংসের পাশাপাশি শাকসবজি ও শস্যদানা খাদ্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত ছিল। তবে শস্যদানাগুলি ছিল বুনো। ষাঁড়, মোষ, ভেড়া, ছাগল, হরিণ, শুয়োর, গণ্ডার, কাছিম, জলহস্তি ইত্যাদির মাংস পুড়িয়ে খাওয়া হত। শিলনোড়া জাতীয় পাথরের খণ্ড নানা কেন্দ্রে পাওয়া গেছে। সম্ভবত বুনো শস্যদানা পেষার কাজে এগুলি ব্যবহার করা হত।
সাধারণভাবে মধ্যাশ্মীয় যুগের মানুষ গুহাশ্রয়ে বসবাস করত। তবে এই পর্বেই মানুষ বসতি নির্মাণের চেষ্টা শুরু করে। চোপানি-মানডো প্রত্নক্ষেত্রে কুটির নির্মাণের প্রয়াস দেখা যায়। ১০-২০ সেন্টিমিটার ব্যাসের ১২টি খুঁটির দাগ দেখা গেছে। কুটিরের চতুষ্পার্শে বড় বড় পাথরের টুকরো সাজিয়ে সীমানা চিহ্নিত করার চেষ্টাও স্পষ্ট। কুটিরগুলি গোলাকার কিংবা ডিম্বাকৃতি। কুটিরগুলিতে হাতিয়ার নির্মাণ করার নিদর্শন ছড়িয়ে আছে। কুটিরের বাইরে ৪/৫টি চুলা এবং তার ভেতরে পোড়া ছাই, হাড়ের টুকরো ইত্যাদি দেখা যায়। কিছু মৃৎপাত্র পাওয়া গেলেও, সেগুলি ক্ষুদ্রাশ্মীয় যুগের নাকি পরবর্তীকালের, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
পুরাপ্রস্তর যুগের মত মধ্যপ্রস্তর যুগেও মানুষ পোশাক হিসেবে গাছের ছাল ও পশুর চামড়াই ব্যবহার করত। হাড়ের তৈরী ছুঁচের অস্তিত্ব থেকে মনে করা হয় যে, এই পর্বে সেলাই প্রযুক্তি মানুষের আয়ত্ব হয়েছিল। তবে সুতীবস্ত্রের কোন অস্তিত্ব ছিল না। সম্ভবত পশুর ছালের টুকরো সেলাই করে পরিধান তৈরী করা হত। তখনো পর্যন্ত কুমোরের কাজ শুরু হয়নি। মহাদহে হাড়ের লকেট ও নেকলেস্ জাতীয় অলংকার পাওয়া গেছে। পাথর ও শামুক-খোলের পুঁতিও দেখা যায়। অর্থাৎ অলংকার পরিধানের বিষয়টি এ যুগে অজ্ঞাত ছিল না। তবে কবরের সাক্ষ্য থেকে বোঝা যায় যে কেবল পুরুষেরাই অলংকার পরত, নারীরা নয়। মানুষের গড় আয়ু ছিল খুবই কম। মহাদহায় তেরোটি কবরস্থ দেহ পরীক্ষা করে দেখা গেছে তাদের বয়স উনিশ থেকে আঠাশ বছরের মধ্যে। মাত্র একজন চল্লিশ-এর কিছু বেশী। তবে পঞ্চাশের ওপর কেউ নেই।
মধ্যপ্রস্তর যুগের আধিবিদ্যক চেতনা :
মধ্যপ্রস্তরযুগীয় আদিমানব সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল মানুষের মধ্যে আধিবিদ্যক চেতনার উন্মেষ। এই সময় থেকে মানুষ মৃত্যু এবং মৃত্যু পরবর্তী জীবন সম্পর্কে ভাবতে শুরু করে। ইরফান হাবিব মধ্যাশ্মীয় সমাজকে ধর্মভাবনা ও কুসংস্কারের উন্মেষপর্ব বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে মৃতদেহ সমাধিস্থ করার রীতি ও পদ্ধতি পরলোক সম্পর্কিত ভাবনার আভাস দেয়। এই পর্যায়ে মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল যে মৃত্যুর পর মানুষের নতুন জীবন শুরু হয়। দেহ সমাহিত করার সময় দেহের পাশে হাড়ের অলংকার, শিকার করা পশুর হাড় ইত্যাদি মাটিতে রেখে দেওয়া হত। নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই এই রীতি মানা হত। নারী-পুরুষের যুগ্ম দেহ একইসাথে কবরস্থ করার একাধিক দৃষ্টান্ত পাওয়া গেছে। এগুলিতে কখনো পুরুষের ও নারীর দেহ শায়িত আছে, কোথাও বা নারীর ওপর পুরুষের দেহ। তবে পরবর্তী জীবনে সঙ্গদানের জন্য অন্যজনকে জোরপূর্বক হত্যা করে সমাহিত করা হয়েছে, এমন কোন প্রমাণ নেই। বেলান উপত্যকা থেকে আবিষ্কৃত হাড়ের একটি ছোট্ট মূর্তি সেকালে দেবদেবীর ধারণার আভাস দেয়।
মধ্যপ্রস্তর যুগের শিল্পভাবনা :
প্রস্তরযুগীয় শিল্পকলার প্রধানক্ষেত্র ছিল চিত্রাঙ্কন। সম্ভবত উচ্চ পুরাপ্রস্তরযুগেই মানুষ দেওয়াল চিত্র অঙ্কনের প্রয়াস করেছিল। পরবর্তী পর্যায়ে, ক্ষুদ্রাশ্মীয় যুগে, এমন বহু গুহাবাস আবিষ্কৃত হয়েছে যেগুলির দেওয়ালে আদিম বসবাসকারীদের শিল্পকর্ম ছড়িয়ে আছে। ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের আধিকারিক এ. সি. এল. কার্লাইল (A. C. L. Carlleyle) উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যভারতে মধ্যপ্রস্তর যুগের গুহাচিত্র আবিষ্কারের দাবি করেছেন। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে প্রত্নতত্ত্ববিদ ওয়াকানকর (V.S. Wakankar) মধ্যপ্রদেশের ভীমবেঠকায় বহু গুহাশ্রয়ে মধ্যাশ্মীয় চিত্রকলা আবিষ্কার করেছেন। মনে রাখা দরকার যে, এই চিত্রকলার ধারা আদিম পর্ব থেকে ঐতিহাসিক যুগ পর্যন্ত চলে এসেছে। এমনকি, বর্তমানের বহু আদিবাসীর কুটিরের মাটির দেওয়ালে প্রাচীন চিত্রণের ধারা লক্ষ্য করা যায়। স্বভাবতই চিত্রগুলির রূপায়নের সময়কাল বিতর্কের উর্ধ্বে নয়। তবে গুহাশ্রয়গুলিতে ক্ষুদ্ৰাশ্মীয় আয়ুধের বিপুল অস্তিত্ব থেকে এগুলির প্রাচীন অস্তিত্ব বিষয়ে বিশ্বাস নিবদ্ধ করা যায়। ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল এবং উত্তর থেকে দক্ষিণ ভারতের নানাস্থানে এমনই দর্শন দেখা যায়। উত্তর পশ্চিমে বালুচিস্তান কিংবা উত্তরের লাদাখ-কারাকোরাম অঞ্চলের তুলনায় দক্ষিণের বিন্ধ্যারণ্য ও কাইমুর পাহাড়ী অঞ্চলে শিল্প নিদর্শনের সংখ্যা অনেক বেশী।
ভীমবেঠকার চিত্রগুলি চিত্রশিল্পীদের দৈনন্দিন জীবনধারার আভাস দেয়। যশোধর মঠপাল (J. Mathpal) ভীমবেঠকার গুহাচিত্রের বৈশিষ্ট্য অনুসারে সেগুলিকে তিনটি পর্বে বিভক্ত করেছেন। প্রথম পাঁচটি উপ-পর্যায়ের চিত্র মধ্যাশ্মীয়যুগের। একটি অন্তবর্তী পর্বের এবং শেষের তিনটি ঐতিহাসিক যুগের সৃষ্টি। লাল, হলুদ, সাদা, সবুজ, ইত্যাদি প্রায় ষোল রকমের রঙ ব্যবহার করা হয়েছে। মধ্যাশ্মীয় যুগের সৃষ্টিগুলিতে মূলত লাল, সবুজ ও হলুদ রং-এর ব্যবহার দেখা যায়। লাল রং-এর উৎস গেরুমাটি, সবুজ রং এসেছে সমবর্ণের চ্যালসিডোনি পাথর থেকে, সাদা রংটি চুনা পাথরের চূর্ণ। চিত্রকর্মগুলির বেশিরভাগ জ্যামিতিক ধারায় করা। মানুষের অবয়ব আঁকা হয়েছে লাইন টেনে বা ত্রিভুজ, চতুর্ভূজ জাতীয় রেখাঙ্কন দ্বারা। মহিলাদের আকৃতি কোথাও কোথাও বিষদভাবে বোঝানো হয়েছে। আবার কোথায় কেবল কাঠির আকৃতি দিয়ে। তবে চিত্রগুলির অনন্য বৈশিষ্ট্য হল এদের গতিময়তা। ভীমবেঠকার গুহাচিত্রে পশুশিকার এবং পশুর আকৃতি রূপায়ণের বিশেষ আগ্রহ স্পষ্ট। এখানে বাঘ, হাতি, গণ্ডার, হরিণ, কাঠবেড়ালী, নানারকম পাখি, মাছ, টিকটিকি ইত্যাদি প্রায় সাতাশ রকমের পশুর চিত্র পাওয়া যায়। শিকারের চিত্রে মানুষের উদ্দীপনা, তীর নিক্ষেপ, হাত-পা ছোঁড়া ইত্যাদি সুন্দরভাবে তুলে ধরার প্রয়াস দেখা যায়। শিকার ছাড়া মানুষের বাঁক বওয়া, নৌকাতে বৈঠা বাওয়া কিংবা পুঁটুলি ভর্তি ইঁদুর বহনের চিত্র দেখা যায়। একটি চিত্রে পুরোহিত বা ওঝা জাতীয় একজনকে দেখা যায়। অস্থায়ী আশ্বাসে খাদ্যের সামনে দু’টি মানবমানবী এবং একটি পুত্র বা কন্যা সন্তানের বসে থাকার চিত্রকল্পটিও চমৎকার। ভীমবেঠকার অদূরে লাখাজোয়ার নামক স্থানে সবুজ রঙে আঁকা নাচের দৃশ্যে কাঠিসদৃশ মানুষের নৃত্যরত রূপ দেখা যায়। চিত্রগুলিতে নানা বয়সের নারী-পুরুষকে দেখা যায়। সব মিলিয়ে মধ্যাশ্মীয় চিত্রাঙ্কনের অনন্য বৈশিষ্ট্য হল এদের সজীবতা ও সচলতা।
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।