মৌর্যযুগে গিল্ড বা সংঘ

আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “মৌর্যযুগে গিল্ড বা সংঘ” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।

মৌর্যযুগে গিল্ড বা সংঘ

প্রাচীন ভারতে শুঙ্গ, সাতবাহন, ইন্দো-গ্রীক প্রভৃতি আঞ্চলিক শক্তিগুলির রাজনৈতিক উত্থান পতনের মধ্যে ভারতীয় বণিক সম্প্রদায়ের অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি দৃঢ়তর হয়েছিল। উত্তর-পশ্চিম ভারতে বহির্ভারতীয় শাসকদের আবির্ভাব বাণিজ্য বৃদ্ধির সহায়ক ছিল। পশ্চিম এশিয়া, মধ্য এশিয়া, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল, চীন প্রভৃতি দেশের সাথে এই পর্বে ভারতে বাণিজ্যিক লেনদেন শুরু হয়েছিল। এই সময় বণিক শ্রেণি পেশাগত স্বার্থে শিল্প ও বাণিজ্যকে সংগঠিত রূপ দেওয়ার প্রয়োজন উপলব্ধি করেন। রোমিলা থাপারের মতে সম্ভবত ধনীদের অত্যাচার থেকে নিজেদের বাঁচানোর তাগিদে কারিগর বা শ্রমিক শ্রেণি Guild জাতীয় সংগঠন গড়ার তাগিদ অনুভব করেন এবং পরবর্তীকালে বৃত্তিগত নিরাপত্তা রক্ষার প্রয়োজনে বণিক সহ বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ সংঘ তৈরীতে উদ্যোগী হন। প্রাচীন সাহিত্যে এই ধরনের সংগঠনগুলি শ্রেণী, গণ, পুঞ্জ, নিগম প্রভৃতি বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল।

প্রাচীন ভারতে শ্রেণি বা সংঘ জাতীয় সংগঠনগুলি সম্পর্কে আমাদের প্রধান উপাদান হল বিভিন্ন সাহিত্য। বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্য, জাতক গ্রন্থ সমূহ, পুরাণ সমূহ ও বিভিন্ন স্মৃতিশাস্ত্র থেকে এবিেেয় জানা যায়। এছাড়া ভারতের নানা অঞ্চলে প্রাপ্ত কিছু লেখ ও দানপত্র থেকেও বিভিন্ন তথ্যসূত্র আমরা পাই। প্রাক-মৌর্য আমলে রচিত দীর্ঘনিকায় গ্রন্থে ২৪ ধরনের কারিগরী বৃত্তির উল্লেখ আছে। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে লেখা মিলিন্দপনহো গ্রন্থের মতে এই সংখ্যাটি ছিল ৭৫। খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতকে মহাবস্তু গ্রন্থের সাথে উপরিউক্ত গ্রন্থের বক্তব্যে ব্যাপক প্রভেদ থাকলেও একথা সত্য যে, খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকের শেষ ও খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকের শুরুতে কারিগরী শিল্পের সংখ্যা ও বৈচিত্র্য ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। জাতক বাহিনীগুলি থেকে প্রাচীন ভারতের কারিগর শ্রেণীর নিয়মিত উপস্থিতির উল্লেখ পাওয়া যায়। খ্রিস্টপূর্ব ২০০ থেকে খ্রিষ্টীয় ২০০ অব্দের মধ্যে উৎকীর্ণ অসংখ্য লেখ প্রাচীন ভারতে কারিগরী শিল্পের বিকাশ সম্পর্কে সাক্ষ্য দেয়। মথুরা, সাঁচী, ভারহৃত, অমরাবতী, ধান্যপাটক প্রভৃতি স্থানে বহু দান পত্র পাওয়া গেছে। দান পত্রে উল্লেখিত দাতার নাম ও দানকৃত বস্তুর বিবরণ থেকে তৎকালীন কারিগরদের শ্রেণি বা সংঘ গঠনের প্রাথমিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানা যায়।

প্রাচীন ভারতের শিল্প বিবরণ থেকে দুটি বিষয়ে অবহিত হওয়া যায়। 

  • সে যুগে শিল্পক্ষেত্রে বৈচিত্র্য ও বিশেষজ্ঞতার ক্রমবৃদ্ধি ঘটেছিল এবং শিল্পে ধাতুর ব্যবহার বেড়েছিল।
  • শিল্পে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের তুলনায় ব্যক্তিগত বা বেসরকারী উদ্যোগ ছিল বেশী।

রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ মূলত খনিজ শিল্পে সীমাবদ্ধ ছিল। তবে ব্যক্তিগত বা বেসরকারী শিল্পে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের অভাব থাকলেও শিল্পক্ষেত্রে নৈরাজ্য ছিল না। শ্রেণী বা সংঘের আবির্ভাব ঘটেছিল খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে। রামশরণ শর্মার মতে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ থেকে দ্বিতীয় শতকের সূচনাকালে সম্ভবত অতিরিক্ত রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের চাপে শ্রেণী বা সংঘের বিকাশ কিছুটা ব্যবহৃত হয়। পরবর্তী পর্যায়ে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ শিথিল হলে শ্রেণী জাতীয় সংগঠন সক্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। প্রাচীন ভারতের কারিগরদের শ্রেণী বা সংঘ গঠনের তাৎক্ষণিক কারণ ছিল প্রাথমিক ভাবে অস্তিত্ব রক্ষা করা এবং চূড়ান্তভাবে বৃত্তিগত নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা।

জাতক থেকে জানা যায় যে একটি নির্দিষ্ট স্থানে একটি বিশেষ শ্রেণীর কারিগরের অবস্থান পেশাগত শ্রেণী গঠনের কাজ সহজ করেছিল। ধর্মশাস্ত্রের কিছু তথ্য শ্রেণীজাতীয় সংগঠনের গুরুত্ব বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়। ধর্মশাস্ত্রের বিধান অনুযায়ী একটি অঞ্চলের কোন শিল্পের একটি সংগঠন থাকা বাঞ্ছনীয় অর্থাৎ শাস্ত্রকাররাও পেশাগত সাংগাঠনিক ঐক্যের সমর্থক ছিলেন। তবে এর ব্যতিক্রমও দেখা যায়। শক ক্ষত্রপ নহপান-এর একটি লেখতে তন্তুবায়দের দুটি সংগঠনের সহবস্থান-এর উল্লেখ পাওয়া যায়। জাতক কাহিনীগুলিতে শ্রেণী বা সংঘের প্রধান হিসাবে জেষ্ঠ্যক বা প্রমুখ-এর উল্লেখ আছে। এই পদাধিকারীরা সংঘের সর্বসম্মত নেতা ছিলেন বলে অনুমিত হয়। তবে কারিগরী কুশলতা অথবা বিশেষ অভিজ্ঞতা—কোনটি তার নির্বাচনের মাপকাটি ছিল তা সাঠক বলা কঠিন। সম্ভবত জেষ্ঠ্যক বা প্রমুখ বহু আগে থেকে শ্রেণী বা সংঘ পরিচালনার সাথে যুক্ত ছিলেন। মনুস্মৃতি ও যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতি গ্রন্থ দুটিতে শ্রেণী পরিচালন ব্যবস্থায় সংঘের নেতা ছাড়াও কার্যচিন্তক নামক পদাধিকারী হতেন সবংশ জাত কর্মকুশলী ও ন্যায়পরায়ণ। সংঘ পরিচালনার কাজে কার্যচিত্তকরা প্রমুখ বা জেষ্ঠ্যককে সহায়তা করতেন। এথেকে অনুমিত হয় শ্রেণী বা সংঘের কাজের পরিমাণ ও পরিধি দুটিই বৃদ্ধি পেয়েছিল।

সংঘ পরিচালনার জন্য নির্দিষ্ট নিয়মিত আইনকানুন-এর প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছিল। মনুস্মৃতি ও যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতিতে শ্রেণী জাতীয় সংগঠনের সদস্যদের আচরণবিধি ও নিয়মাবলীর উল্লেখ পাওয়া যায়। এই নিয়মাবলীতে সংঘের সামগ্রিক চরিত্রের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হত। উৎপাদক, কারিগর, ক্রেতা, প্রমুখের স্বার্থরক্ষা, আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা, উৎপাদনের গুণগত মান রক্ষা করা ইত্যাদি নানা বিষয়ে নিয়মাবলী তৈরী করা হয়েছিল। যেমন—

  1. সংঘভুক্ত কারিগরদের উপার্জিত সম্পদ সদস্যদের মধ্যে সমানভাবে বণ্টিত হবে। 
  2. কোন বিশেষ কারিগর কোন অভিনব কৌশল বা পদ্ধতি আবিষ্কার দ্বারা অধিক উৎপাদন বা অতিরিক্ত উপার্জন করলেও তাতে সকল সদস্যের সমান অধিকার থাকবে।
  3. কোন সদস্য চুক্তির পরিপন্থী বা সংঘের স্বার্থ বিরোধী কোন কাজ করবে না। এবং এই ধরনের কাজ করলে সংঘ বা শ্রেণীর যে আর্থিক ক্ষতি হবে উক্ত সদস্যকে সেই ক্ষতিপূরণের দায় বহন করতে হবে।
  4. সংঘের আইন-কানুন অমান্য করলে অপরাধী সদস্যকে নির্বাসন দণ্ড ভোগ করতে হবে। তবে যাজ্ঞবল্ক্য নির্বাসন দণ্ডের পাশাপাশি এই অপরাধী সদস্যের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার কথা বলেছেন।

ধর্মশাস্ত্রের বিধানগুলির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল যে এখানে শ্রেণীর আইন-কানুন বা শ্রেণী ধর্মকে রাজকীয় আইন-কানুন বা রাজধর্মের সম মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। এর ফলে শ্রেণীর সদস্য ও পরিচালকের মধ্যে গুরুতর বিরোধ দেখা না দিলে শ্রেণী পরিচালনার কাজে রাজকীয় বা প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ ঘটত না। কোন সদস্যের বিরুদ্ধে শ্রেণী শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিলে সাধারণভাবে রাজা তা অনুমোদন করতেন।

কারিগরী বৃত্তি সুসংগঠিত করার পাশাপাশি সংঘ আধুনিক ব্যাঙ্কের ভূমিকা পালন করত। নহপান-এর জামাতা ঋষভ দত্ত কৌলনিকায় নামক তন্তুবায় সংগঠনে ২০০০ কার্যাপন গচ্ছিত রেখে ১২% হারে সুদ ভোগ করতেন। আর একটি সংগঠনে ১০০০ কার্যাপন গচ্ছিত রেখে ৯% সুদ পেতেন। নাসিক লেখ থেকে জানা যায় কোন শ্রেণী গচ্ছিত রাখা মূল অর্থে হাত দিতে পারত না। কেবল বৃদ্ধি বা সুদ ব্যবহার করতে পারতো। কুষাণ রাজা হুবিষ্ক-এর আমলে মথুরাতে ময়দা তৈরির কারিগরদের একটি সংঘে অর্থ গচ্ছিত রেখে জনৈক্য রাজ কর্মচারীর প্রাপ্য সুদ থেকে একটি মন্দিরের ব্যয় নির্বাহ করতেন। শ্রেণীগুলিতে নগদ অর্থ ছাড়াও জমি, গাছ বা পুকুর জাতীয় স্থাবর সম্পত্তি আমানত হিসাবে রাখা যেত।

বিনয়পিটক গ্রন্থে শ্রেণী বা সংঘের শাসন ও বিচার ক্ষমতার উল্লেখ আছে। খ্রিঃ পূঃ চতুর্থ শতক থেকে গিল্ড রাষ্ট্র কাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ সহযোগীতে পরিণত হয়েছিল। অর্থশাস্ত্রে শ্রেণী বা সংঘের সামরিক শক্তির উল্লেখ পাওয়া যায়। একে বলা হত শ্রেণীবল, রাজা প্রয়োজন মতো এদের সাহায্য নিতেন। শ্রেণী বা সংঘের ক্রমবিকাশের আর একটি পর্যায় হল— রাজনৈতিক বৈধতা অর্জন। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির ফলে গিল্ড জাতীয় সংগঠন ক্রমান্বয়ে সামাজিক নিয়ন্ত্রণকারী একটি সংস্থায় পরিণত হয়েছিল। তবে কোশাম্বী মনে করেন ভারত-রোম বাণিজ্যের পতন ও বৌদ্ধধর্মের উত্থানের ফলে দূরপাল্লার বাণিজ্যে ভাটা পড়েছিল, ফলে গিল্ডগুলির কার্যকারিতা শিথিল হয়, কিন্তু রমেশ চন্দ্ৰ মজুমদার মনে করেন কুষাণ যুগে ও গুপ্তযুগের গোড়ায় শ্রেণী বা সংঘের কৌলিন্য ও জটিলতা দুই-ই বেড়েছিল। গিল্ডগুলি পরিণত হয়েছিল একই সাথে সামাজিক শক্তি ও অলংকারে। সমুদ্রগুপ্ত ইন্দোরলেখ এবং কুমার গুপ্তের মান্দাসোর লেখ থেকে শ্রেণী জাতীয় প্রতিষ্ঠান-এর গুরুত্ব জানা যায়।

নাসিক গুহা লিপি থেকে জানা যায় যে সংঘের কোন রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না। কারণ রাজার শুভেচ্ছার সাথে গিল্ড-এর অস্তিত্ব ও অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িত ছিল। রাজা যেমন অকারণে সংঘের কাজে হস্তক্ষেপ করতেন না তেমনি সংঘগুলিও রাজকীয় কর্তৃত্বের উপর খবরদারি করত না। প্রাচীন ভারতে শ্রেণী বা সংঘজাতীয় প্রতিষ্ঠানের সামাজিক গুরুত্ব ও জনপ্রিয়তা ছিল যথেষ্ট। তাই দেখা যায় কারিগরী শিল্পের মূলধনের যোগান, নিত্য নতুন আবিষ্কার, উৎপাদনের গুণগত মান উন্নয়ন, সংঘের সদস্যদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা, প্রশাসনিক কাজের সহায়তা প্রদান ইত্যাদি বহু উদ্দেশ্য সাধক সংস্থা হিসাবে প্রাচীন ভারতে শ্রেণী বা সংঘ (Guild) জাতীয় সংগঠনগুলি বিকাশ লাভ করেছিল।

আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।

Leave a Comment