আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “মৌর্যযুগে নগরায়ণ” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
মগধ ও মৌর্য আমলে নগরায়ণ:
মগধ ও মৌর্য আমলে জীবনযাত্রার একটি সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য ছিল ওই সময়কার শহরগুলির সমৃদ্ধি। এই সময় থেকেই একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার ভিত্তিতে নগরগুলি গড়ে উঠছিল। নগররক্ষার জন্য প্রাকার ও পরিখা নির্মাণেরও উদ্যোগ এই সময় থেকেই নেওয়া হতে থাকে। তবে তখনও পর্যন্ত দুটি শহরের গঠনশৈলীর মধ্যে প্রভূত পার্থক্য দেখা যেত। এদের মধ্যে আকারে ও জনসংখ্যায় সর্ববৃহৎ শহর ছিল রাজধানী পাটলিপুত্র। বর্তমান বিহারে পাটনা ও বাঁকিপুরের কাছে গঙ্গা ও শোণ নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত পাটলিপুত্র নগরীর পত্তন হয় খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে অজাতশত্রুর রাজত্বকালে। পরবর্তীকালে মৌর্যশাসক চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালে পাটলিপুত্র একটি সমৃদ্ধিশালী নগরীর রূপ নেয়। পাটলিপুত্রের একদা বাসিন্দা মেগাস্থিনিসের বর্ণনা অনুযায়ী পাটলিপুত্রের আয়তন ছিল পঁচিশ বর্গকিলোমিটার—যা প্রাচীন গ্রীক নগরী আলেকজান্দ্রিয়ার তিনগুণ।
এছাড়া মেগাস্থিনিস আরও লিখেছেন, মৌর্য সাম্রাজ্যের এই রাজধানীকে ঘিরে ছিল ৫৭০টি দুর্গমিনার এবং শহরে প্রবেশ করতে গেলে ৬০টিরও বেশি তোরণদ্বার অতিক্রম করতে হত। শহরের ঘরবাড়ি তৈরির প্রধান উপকরণ ছিল কাঠ। কাঠকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় শক্তপোক্ত করা হত, যাতে শতাব্দী চলে গেলেও তা ক্ষয় পেত না। এমনকি সম্রাট অশোকের রাজপ্রসাদও তৈরি হয়েছিল কাঠ দিয়ে, এবং তার প্রায় ছয়শত বছর পর চৈনিক পরিব্রাজক ফা-হিয়েন সেই প্রাসাদ দেখে বলেছিলেন : এ প্রাসাদ নিশ্চয় দেবতাদের তৈরি, কোন মানুষের নয়। পূর্ব-ভারতের আর একটি উল্লেখযোগ্য নগর ছিল প্রাচীন বাংলায় পুণ্ড্রবর্ধন। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও বাংলাদেশের বগুড়া জেলার মহাস্থানের লেখ থেকে অনুমান করা যায় খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে এই নগরীটির পত্তন ঘটেছিল। মহাস্থানগড়ে খননকার্যের ফলে পুণ্ড্রনগরের নাগরিক জীবনযাত্রার পরিচয় পাওয়া গেছে। খ্রিঃ পূঃ ২০০ থেকে খ্রিষ্টীয় ৩০০ অব্দের মধ্যে নগরায়ণ একটা দৃঢ় ও স্পষ্ট ভিত্তি পেয়েছিল। এই পর্বে মধ্য-এশিয়ার সাথে সমৃদ্ধ বাণিজ্যের ফলে উত্তর-ভারতে এবং ভারত-রোম ও ভারত-দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্যের সূত্রে দক্ষিণ ভারতে নগরায়ণ প্রক্রিয়া দ্রুততর হয়েছিল।
খ্রিঃ পূঃ ২০০ ও খ্রিষ্টীয় ৩০০ অব্দের মধ্যে নগরায়ণের ব্যাপ্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল। পতঞ্জলীর মহাভাষ্যে বিভিন্ন নগরীর উল্লেখ আছে। এগুলি ছিল অহিচ্ছত্রা, অবন্তী, তক্ষশীলা, উজ্জয়িনী, মথুরা, কৌশাম্বী, কাশী ইত্যাদি। অশ্বঘোষের ‘বুদ্ধচরিত’, ‘মিলিন্দপঞহো’ এবং ‘ললিতবিস্তারে’ নাগরিক জীবনের বিস্তৃত বর্ণনা পাওয়া যায়। উত্তর-পশ্চিম ভারতে মৌর্য আমলে অন্যতম প্রদেশে ও অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থল-বন্দর ছিল তক্ষশীলা। পরে ইন্দো-গ্রীক শাসকদের হাতে তক্ষশীলায় নগরায়ণ ত্বরান্বিত হয়। ইন্দোপার্থিয় শাসকদের সময় তক্ষশীলায় পাকা প্রাকার নির্মিত হয়।
শহরের উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত একটি প্রধান সড়ক নির্মিত হয়। বাসগৃহগুলি রাজপথের দু’পাশে যে ভাবে সজ্জিত ছিল তাতে এই সুপরিকল্পিত নগরকাঠামোর মধ্যে গ্রীক বৈশিষ্ট্যের ছাপ খুঁজে পাওয়া যায়। এজন্য প্রত্নতাত্ত্বিকরা মনে করেন, তক্ষশীলার নগরবিন্যাসে প্রাচীন ভারতীয় ভাবধারার থেকে বিদেশী চিন্তাধারার প্রভাবই বেশি। উত্তর-ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শহর মথুরার উদ্ভবও খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে বলে মনে করা হয়। সম্ভবত মথুরার উৎকর্ষ সবচেয়ে বেশি ঘটে পহ্লব ও কুষাণ আমলে। মথুরার ধ্বংসাবশেষ থেকে জানা যায়, বসতবাটীগুলিতে কাদামাটির তৈরি ইটের সাথে সাথে পোড়ামাটির ইটও ব্যবহার করা হত।
নগরীর বাইরে মূল প্রাকার ছাড়াও কেন্দ্রস্থলে নগর-প্রশাসকদের আবাসস্থল ও শাসন-দপ্তরগুলিকে ঘিরে আর একটি প্রকার বর্তমান ছিল। কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে মথুরার বস্ত্রশিল্পের বিশেষ প্রশংসা করেছেন। এছাড়াও খননকার্যের ফলে মথুরায় অন্যান্য শিল্পের উন্নতির কথা জানা যায়। আবার পতঞ্জলী তাঁর মহাভাষ্য গ্রন্থের এক জায়গায় বলেছেন, মথুরার অধিবাসীরা পাটলীপুত্রের অধিবাসীদের থেকে অনেক বেশি সংস্কৃতিমনস্ক। খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতকে রচিত ললিতবিস্তারেও মথুরা নগরীর সৌন্দর্য ও সমৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। সম্ভবত এই সময়কালের মধ্যে মথুরা নগরীর অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিপুল পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল।
উত্তর-ভারতে এই ব্যাপক নগরায়ণের সাথে সাথে বঙ্গদেশের কয়েকটি অঞ্চলেও নগরায়ণের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল বর্তমান দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার চন্দ্রকেতুগড়। প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন থেকে জানা যায়, খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকেই চন্দ্রকেতুগড় নগরী-সুলভ আয়তন ও চরিত্র লাভ করেছিল। ঐতিহাসিকগণ চন্দ্রকেতুগড়ের সমস্ত নিদর্শনকে কুষাণ আমলের বলে চিহ্নিত করলেও বঙ্গদেশে কোনদিন কুষাণরা রাজত্ব করেছিল এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে এখানে প্রাপ্ত মৃৎপাত্রের টুকরো, পানপাত্র, মুদ্রা ইতাদি নগরজীবনের বিলাসব্যসনের সাক্ষ্য বহন করে। এছাড়াও বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোটে খ্রিষ্টীয় প্রথম থেকে তৃতীয় শতকের মধ্যবর্তী সময়ে নাগরিক জীবনের সন্ধান পাওয়া গেছে।
বঙ্গদেশে প্রাপ্ত এই নগরগুলির সাথে উত্তর-ভারতের নগরগুলির চরিত্রগত সাদৃশ্য ও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকে বর্তমান বর্ধমান শহরের সন্নিকটে মঙ্গলকোটে একটি নতুন নগরের পত্তন হয়েছিল। উপকূলবর্তী এলাকায় রূপনারায়ণ নদীর তীরে তাম্রলিপ্ত (তমলুক) বন্দরের বিকাশ এই সময় ঘটেছিল। প্রাচীন বাংলার দক্ষিণ প্রান্তের প্রতিবেশী রাজ্য উড়িষ্যাতেও নগরায়ণের প্রভাব দেখা যায়। ভূবনেশ্বরের নিকট শিশুপাল গড়ে একটি বিশাল নগর প্রাকারের অস্তিত্ব আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিকরা এর নির্মাণকাল আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ২০০ থেকে খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকের মধ্যে নির্দিষ্ট করেছেন। শিশুপাল গড়ে আবিষ্কৃত সুউচ্চ তোরণদ্বারটি নতুনত্বের দাবি রাখে। জন্মু ও কাশ্মীরে নাগরিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন পঁচিশটি প্রত্নক্ষেত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। এগুলি কুষাণদের শাসনকালে গড়ে উঠেছিল। এই সময় পাঞ্জাবেও একাধিক নগরের উদ্ভব ঘটেছিল বলে ডি. এন. ঝা মন্তব্য করেছেন। এছাড়াও রাজস্থানের বিরাটনগর (জয়পুর জেলার বৈরাট) এবং মাধ্যমিকা (চিতোরগড়ের নাগরী) এই সময়কালে সমৃদ্ধ নগরীর মর্যাদা পেয়েছিল। মধ্যপ্রদেশের ত্রিপুরী ও এরান, গুজরাটে মাহেশ্বর-নাভদাটোলি বাণিজ্য নগরী হিসেবে খ্যাতি পেয়েছিল।
দাক্ষিণাত্য ও দক্ষিণ ভারতেও আলোচ্য পর্বে নগর বিকাশের ধারা লক্ষ্য করা যায়। সমকালীন শক ও সাতবাহন লেখগুলিতে নগরের প্রতিষ্ঠা ও বিকাশের উল্লেখ পাওয়া যায়। অন্ধ্রপ্রদেশে একাধিক উৎখনন কেন্দ্রে সাতবাহন আমলের নাগরিক বসতির সাক্ষ্য পাওয়া যায়। ভারতের বহির্বাণিজ্যে এই নগরগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিত। এদের মধ্যে বিশেষ উন্নত ও ব্যস্ত কয়েকটি কেন্দ্র হল ধূলিকাট্টা (করিমনগর জেলা), নাগার্জুনকোন্ডা, অমরাবতী (গুন্টুর জেলা), কোন্ডাপুর (মেডকজেলা), ইয়েলেশ্বরম (নলগোন্ডা জেলা) প্রভৃতি। কুর্নুল জেলার সাতানিকোটায় একটি প্রাকারবেষ্টিত এবং পরিখা দ্বারা সুরক্ষিত নগরের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। এটি নির্মাণে পোড়ানো ইট ব্যবহৃত হয়। এখানে একটি সুদৃশ্য তোরণদ্বারও ছিল। দাক্ষিণাত্যের পূর্বদিকে নির্মিত ইক্ষাকুদের রাজধানী বিজয়পুরী নগরটিও বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। নগরটিতে প্রশস্ত রাজপথ থেকে অসংখ্য সরু সরু রাস্তা বেরিয়ে শহরের বিভিন্ন অংশকে ছুঁয়ে গেছে। ফলে একাধিক রাস্তার সংগমস্থল প্রতীয়মান হয়। নগরটির মধ্যস্থলে একটি বহু আসন বিশিষ্ট উন্মুক্ত ক্রীড়াঙ্গন নির্মিত হয়েছিল। যা রোমান অ্যাসপিথিয়েটারের প্রায় অনুরূপ। বিভিন্ন লেখমালায় বিজয়পুরী নগরের সাংস্কৃতিক উৎকর্ষতার উল্লেখ পাওয়া যায়।
সুদূর দক্ষিণ ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন ও সঙ্গম সাহিত্যের বর্ণনা থেকে একাধিক নগরের প্রতিষ্ঠার কথা জানা যায়। পুহারের উৎখনন থেকে কাবেরী বদ্বীপের কাবেরীপত্তনম বন্দর নগরীর অস্তিত্ব জানা যায়। পুহারের চতুস্পর্শে অন্তত চল্লিশটি প্রত্নস্থলে নগরীর অবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। সঙ্গম সাহিত্যে কাবেরীপত্তনমের উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়া সাহিত্যসূত্র থেকে সুসজ্জিত কাঞ্চীপুরম (কাচ্চী) নগরীর অস্তিত্ব জানা যায়। বেগবতী নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল বন্দর শহর নিরুপ্পেয়রু। এখানে বণিকদের সুদৃশ্য অট্টালিকার পাশাপাশি মৎসজীবীদের কুঁড়ে ঘরের অস্তিত্ব ছিল। সঙ্গম সাহিত্যে একটি সুউচ্চ স্তম্ভের উল্লেখ আছে, যেটিকে বাতিঘর বলে প্রত্নতাত্ত্বিকদের অনুমান। উত্তর ভারতের নগরায়ণের প্রেক্ষিতে দক্ষিণ ভারতের নগরায়ণকে নবীন বলা যেতে পারে। খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ বা পঞ্চম শতক থেকে উত্তর ভারতে নগরায়ণের যে ধারাবাহিক গতি (মাঝে মাঝে কিছু সময়ের শৈথিল্য সহ) এবং বৈশিষ্ট্য, তার প্রভাব দক্ষিণ ভারতে দেখা অসম্ভব নয়। পোড়া ইটের ব্যবহার, প্রাচীর ও পরিখা দ্বারা নগরের নিরাপত্তা রক্ষার প্রয়াস, পাকা বেড়ের কূপ নির্মাণ, প্রশস্ত রাস্তা ইত্যাদি দক্ষিণের নগরায়ণেও উপস্থিত ছিল। উত্তর ভারত থেকে বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিণভূমিতে নগরায়ণের প্রসারের পশ্চাদপটে স্থানীয় উপাদান বা উদ্ভাবনের বিশেষ ভূমিকা ছিল না। তাই চম্পকলক্ষ্মী মন্তব্য করেছেন যে, সমুদ্র বাণিজ্য বা উত্তরের প্রভাবে দক্ষিণ ভারতে নগরায়ণের ক্ষেত্র তৈরী হলেও, তা সমাজে দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তন আনতে পারেনি।
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।