মৌর্যযুগে বন্দর সমূহ ও মুদ্রা ব্যবস্থা

আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “মৌর্যযুগে বন্দর সমূহ ও মুদ্রা ব্যবস্থা” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।

প্রাচীন ভারতে বন্দর সমূহ

পেরিপ্লাস ও টলেমির রচনা থেকে খ্রিষ্টীয় প্রথম দুই শতকে ভারতীয় বন্দরগুলির তালিকা পাওয়া যায়। ভারতের অন্যতম ব্যস্ত বন্দরছিল সিন্ধুনদের মোহনায় অবস্থিত বারবারিকাম। প্লিনীর রচনা থেকে ভারত-রোম সমুদ্র বাণিজ্যে বারবারিকাম বন্দরের বিশেষ গুরুত্ব ছিল। ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় চীনা গ্রন্থ হৌ-হান-সু-এর বক্তব্য ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন যে, নিম্ন সিন্ধু উপত্যকার (শেন-তু) সাথে রোমের লাভজনক সমুদ্র বাণিজ্য প্রচলিত ছিল। গুজরাট উপকূলের ব্যস্ততম বন্দর ছিল বারুগাজা বা ভূগুচ্ছ। টলেমি এবং পেরিপ্লাস গ্রন্থ এই বন্দরের গুরুত্ব স্বীকার করেছে। পেরিপ্লাস গ্রন্থের অজ্ঞাতনামা গ্রীক লেখক বারুগাজা বন্দরের ব্যস্ততা, সুবিধা-অসুবিধা, বাণিজ্যিক বৈশিষ্ট্য বিষয়ে যে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছেন, তা থেকে অনুমিত হয় যে, তিনি সম্ভবত বহুবার এই বন্দরে স্বয়ং উপস্থিত হয়েছিলেন। বারুগাজা বন্দরের সমৃদ্ধ পশ্চাদভূমি এই বন্দরের ব্যস্ততা বৃদ্ধির বিশেষ কারণ ছিল। দাক্ষিণাত্যের ভেতর থেকে, পূর্ব দিকে মালবের উজ্জয়িনী থেকে এবং কাবুল, পুষ্কলাবতী প্রভৃতি অঞ্চল থেকে বাণিজ্যিক পণ্য সহজেই বারুগাজা বন্দরে পৌঁছে যেত। অবশ্য এই বন্দরে জলের নাব্যতা কম থাকার কারণে জাহাজের প্রবেশ সহজ ছিল না। তাই শক ক্ষত্রপ নহপান বিদেশী জাহাজকে নিরাপদে বন্দরে আনার জন্য স্থানীয় মাঝিমাল্লাদের পথ প্রদর্শক হিসেবে সদা মোতায়েন রাখতেন। সাতবাহন শাসকদের আমলেও একই ভাবে বিদেশী জাহাজকে সুষ্ঠুভাবে বন্দরে পৌঁছে দেবার জন্য সাগরপালো নামক সরকারী কর্মচারী নিয়োজিত ছিলেন।

পেরিপ্লাস গ্রন্থ থেকে কোঙ্কন উপকূলে অবস্থিত সুপ্পারা (সোপারা), সিমুল্লা (চাউল) এবং ক্যালিয়েনা (কল্যাণ) বন্দর তিনটির গুরুত্ব জানা যায়। সাতবাহন রাজ প্রথম সাতকর্ণীর আমলে কল্যাণ বন্দর যথেষ্ট ব্যস্ত ছিল। তবে শক ক্ষত্রপ নহপানের সাথে পরবর্তী সাতবাহন রাজার (সুন্দর সাতকর্ণী) বিরোধের কারণে এই বন্দরে বিদেশী জাহাজ আসতে অনাগ্রহ দেখায়। কোঙ্কন উপকূলের দক্ষিণ ভাগে গড়ে উঠেছিল ম্যান্ডাগোরা, দাভোল, টোগারাম, ভিজাদ্রোগ ইত্যাদি বন্দর। তবে বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে দক্ষিণের বন্দরগুলির ব্যস্ততা ছিল খুব কম। কারণ উত্তর কোঙ্কনের বন্দরগুলির মত সমৃদ্ধ পশ্চাদভূমি কোঙ্কনের দক্ষিণ অংশের বন্দরগুলির ছিল না। তাই বাণিজ্যপণ্যের যোগান -ছিল কম এবং অনিয়মিত।

মালাবার উপকূলের ব্যস্ততম বন্দর হিসেবে মুজিরিস-এর নাম পেরিপ্লাস, টলেমির ভূগোল এবং স্থানীয় সঙ্গম সাহিত্যে উল্লেখ পাওয়া যায়। সঙ্গম সাহিত্যে একে মুচুরিপত্তম (মুসলিপত্তম) নামে উল্লেখ করা হয়েছে। প্লিনীর বর্ণনা মতে, রোম-ভারত বাণিজ্যের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য জাহাজগুলি মুজিরিস বন্দরে ভিড়ত। সঙ্গম সাহিত্যে বলা হয়েছে যে, যবন (গ্রীক) জাহাজগুলি স্বর্ণমুদ্রা বোঝাই করে আনত এবং তার বিনিময়ে এখন থেকে গোলমরিচ নিয়ে যেত। এখানে প্রচুর গ্রীক-রোমান জাহাজ যাতায়াতের কারণে মুজিরিস অঞ্চলে বিদেশী বণিকদের স্থায়ী নিবাস গড়ে উঠেছিল। মুজিরিস ছাড়াও মালাবার উপকূলে কম গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে নরা (ক্যান্নানোর), টুন্ডিস (পোগ্লানি), কোমারি (কন্যাকুমারি) প্রভৃতি বন্দরের অস্তিত্ব ছিল।

করমণ্ডল উপকূলের তিনটি সমৃদ্ধ বন্দরের নাম কামারা, পোডুকা ও সোপাটোমা। মাদুরার পাণ্ড্য বংশ এবং তাঞ্জোরের চোল রাজারা করমণ্ডল উপকূলবর্তী বন্দরগুলি নিয়ন্ত্রণ করতেন। পোডুকা বন্দরটিকে বর্তমানের আরিকামেডু বন্দর বলে সনাক্ত করা হয়েছে। এখানে খনন কার্যের দ্বারা রোমান বাণিজ্য কেন্দ্রের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। আনুমানিক ৫০ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত একটি গুদাম ঘরের ধ্বংসাবশেষ। রোমান ও গ্রীক প্রস্তর শিল্পের নিদর্শন এবং উজ্জ্বল লাল মৃৎপাত্র পাওয়া গেছে। কাবেরী নদীর মুখে চোল রাজ্যের অন্তর্গত কাবেরীপত্তনম বন্দরটিও বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য খ্যাত ছিল। অন্ধ্র উপকূলে কন্টকমুল্লা (প্রাচীন ঘণ্টকশাল) এবং আলোসুগনে নামক দুটি বন্দরের উল্লেখ টলেমির রচনায় পাওয়া যায়। এখানকার বন্দর থেকে সুবর্ণভূমি’র (খ্রাইসেখোরা) উদ্দেশ্যে বাণিজ্য পোত যাত্রা করত বলে পেরিপ্লাস-এ বলা হয়েছে। সুবর্ণভূমি বলতে সাধারণভাবে ব্রহ্মদেশের একাংশ, শ্যামদেশ এবং দক্ষিণ-পূর্বে এশীয় দ্বীপপুঞ্জকে বোঝানো হয়। সম্ভবত সিংহল দেশের সাথেও ভারতের দক্ষিণ উপকূলের বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল।

ভারতের পূর্ব উপকূলের বন্দরগুলি সম্ভবত রোম-ভারত বাণিজ্যে সরাসরি অংশ নিত না। এই প্রসঙ্গে ড. ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় টলেমির ভূগোল গ্রন্থের কিছু বক্তব্য বিশ্লেষণ করেছেন। টলেমির গ্রন্থে পশ্চিম উপকূলের কিছু বন্দরকে এম্পোরিয়াম’ (Emporium) আখ্যা দিয়েছেন। ড. মুখোপাধ্যায়ের মতে, যে সকল বন্দরের কাছাকাছি অঞ্চলে রোমান বণিকদের উপনিবেশ গড়ে উঠেছিল, সেগুলিকেই টলেমি ‘এম্পোরিয়াম’-এর মর্যাদা দিয়েছেন। পূর্ব উপকূলের বন্দরের ক্ষেত্রে (গঙ্গা, তাম্রলিপ্ত) এই অভিধা প্রয়োগ করা হয়নি। তাই মনে করা হয় যে, বাংলার বন্দরগুলি ভারত-রোম বাণিজ্যে সরাসরি অংশ নিত না।

ভারত-রোম বাণিজ্যের গতি-প্রকৃতি ব্যাখ্যা করলে বোঝা যায় যে, এই বাণিজ্যের ভারসাম্য ভারতের অনুকূলেই ছিল। ভারতে রোমান পণ্য আমদানি করা হত খুব কম। কিন্তু ভারত থেকে রোমে পাঠানো হত বিপুল পরিমাণ এবং নানা ধরনের মূল্যবান পণ্য। স্বভাবতই রোম থেকে ভারতে বিপুল পরিমাণ মূল্যবান ধাতুর (সোনা, রূপা) আমদানি ঘটত। ঐতিহাসিক গিবন (Gibbon) লিখেছেন যে, প্রতি বছর চার লক্ষ পাউন্ড মূল্যের সোনা রোম থেকে ভারতে চলে যেত। রোমান সম্রাট টাইবেরিয়াস অনুযোগ করেছিলেন (২২ খ্রিঃ) যে বিলাস ব্যসনের চাহিদা মেটাতে রোম সাম্রাজ্যের সম্পদের নিষ্ক্রমণ (Drain) ঘটছে। প্পিনীও ভারতীয় বাণিজ্যে রোমান স্বর্ণমুদ্রার অস্বাভাবিক বিনিয়োগ প্রসঙ্গে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

প্রাচীন ভারতে মুদ্রা ব্যবস্থা

প্রাচীন ভারতে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে দ্রব্য ও মুদ্রা দুয়েরই প্রচলন ছিল। প্রাথমিক পর্যায়ে একমাত্র বিনিময় প্রথায় পণ্য লেনদেন ঘটত। ক্রমে উৎপাদনের উদ্বৃত্ত ঘটলে তৃতীয় একটি শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে যারা উদ্বৃত্ত পণ্য সংগ্রহ করে বর্ধিত দামে বিক্রয় করে মুনাফা অর্জন করত। খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে কৃষিতে লৌহ সরঞ্জামের ব্যবহার উৎপাদনে উদ্বৃত্ত ঘটাতে সাহায্য করে। এই সময় থেকে ‘শ্রেষ্ঠিন’ নামধারী একদল ব্যবসায়ীর উত্থান ঘটে। এরা পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য মুদ্রা জাতীয় কিছু উপাদান পেতে আগ্রহী ছিলেন। তাই গৌতম বুদ্ধের সমকালে প্রাচীন ভারতে মুদ্রাকেন্দ্রিক অর্থনীতির উদ্ভব সম্ভব হয়। বৌদ্ধ সাহিত্যে ‘কহপন’ বা ‘কর্ষপন’ নামে ধাতুখণ্ডের অস্তিত্ব উল্লেখ পাওয়া যায়, যাকে ভারতের আদি মুদ্রা বলে মনে করা হয়। এ ছাড়াও “নিষ্ক’ এবং সোনা, রূপা ও তামার মুদ্রা হিসেবে কংস, পাদ, মাসক, কাকনিক প্রভৃতির উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে প্রাচীনতম ভারতীয় মুদ্রা বলতে বোঝাত অনিয়মিত আকারের রূপা অথবা ব্রোঞ্জের সমতল টুকরো। এগুলিতে কোন লিপি খোদাই করা থাকত না, তবে এদের এক পিঠে চন্দ্র, সূর্য, ফুল, বৃক্ষ, হাতি, ঘোড়া ইত্যাদি নক্‌সার ছাপ দেওয়া থাকত। তাই এগুলিকে ‘অঙ্ক চিহ্নিত মুদ্রা’ (Punch marked coin) বলা হত। ভারতের নানা স্থানে ছাপযুক্ত মুদ্রা অনেক পাওয়া গেছে। ভারতীয় প্রাচীন সাহিত্যে স্বর্ণমুদ্রার উল্লেখ থাকলেও, তেমন মুদ্রা এক-দুটির বেশী পাওয়া যায়নি। ভারতীয় টাকশালে লিপি সম্বলিত মুদ্রা খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতকের আগে নিয়মিত তৈরী হত না। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক থেকে মুদ্রা অর্থনীতির সূচনা ও বিকাশ ঘটলেও অভ্যন্তরীণ বিনিময়ের কাজে এবং বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে দ্রব্যের ব্যবহার অব্যাহত ছিল। এমনকি কুষাণ যুগে বৈদেশিক বাণিজ্য বৃদ্ধি এবং ব্যাপক হারে মুদ্রার প্রচলন ঘটলেও, গ্রামের কৃষক পরিবারগুলি স্থানীয়ভাবে দ্রব্য বিনিময়ের মাধ্যমেই লেনদেন চালাত।

মৌর্যযুগে মগধ সাম্রাজ্যে মুদ্রা অর্থনীতির ব্যবহার অনেকটাই বৃদ্ধি পায়। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে তৎকালীন মুদ্রা ব্যবস্থার বিবরণ পাওয়া যায়। অঙ্ক চিহ্নিত মুদ্রা খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে দ্বিতীয় শতক পর্যন্ত মৌর্য সাম্রাজ্যে প্রচলিত ছিল। মৌর্য আমলে প্রধান মুদ্রা ছিল রৌপ্য কর্ষপন ও তার বিভিন্ন ভগ্নাংশ। মৌর্য আমলের বহু রৌপ্য মুদ্রা পাওয়া গেছে। তবে তাম্র মুদ্রা বিশেষ পাওয়া যায়নি। সেখানে স্বর্ণমুদ্রা আদৌ প্রচলিত হয়নি। মৌর্যদের মুদ্রায় শাসকের নাম বা পরিচয় লেখা নেই। তবে মুদ্রার ধাতব শুদ্ধতা, ওজন এবং আকৃতি এত পরিণত যে এই মুদ্রা প্রচলনের পশ্চাদপটে রাজকীয় নিয়ন্ত্রণের সম্ভাবনা জোরালো হয়ে ওঠে। তবে মৌর্য আমলে ভারতে যথেষ্ট রূপো পাওয়া যেত না। তাই মুদ্রায় খাদ মেশানো হত। অবশ্য মৌর্য যুগের মুদ্রায় ধাতু ও খাদের মধ্যে নির্দিষ্ট অনুপাত বজায় রাখা হত। এই বিষয়গুলি তত্ত্বাবধানের জন্য ‘রূপ-দশক’ নামে বিশেষজ্ঞ নিযুক্ত হতেন। কোশাম্বির মতে, অশোকের আমলে মুদ্রার পরিমাণ বাড়ার কারণে খাদের অনুপাতও বেড়েছিল। রূপার যোগান ছিল কম। নতুন নতুন এলাকায় জনবসতি গড়ে ওঠায় (জনপদ নিবেশ) মুদ্রার চাহিদা ছিল ক্রমবর্ধমান। তাই খাদ বাড়িয়ে মুদ্রার যোগান বাড়ানোর প্রয়াস নেওয়া হয়। তবে প্রয়োজনের তুলনায় তা ছিল কম। তাই মৌর্য যুগে গ্রামাঞ্চলে স্বল্পমূল্যের মুদ্রা এবং কড়ি’র ব্যবহার চালু ছিল। মৌর্যযুগে তোরণ শীর্ষে বসা একটি ময়ূরের নক্শা সম্বলিত মুদ্রাটির বহুল প্রচলন ছিল। ময়ূরের নক্‌শা মৌর্যদের বংশগত পরিচয়ের দ্যোতক হতে পারে। ভারতের নানা অঞ্চল থেকে এই ধরনের মুদ্রা উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।

মৌর্য পরবর্তী প্রথম তিন শতকে ভারতে ধাতু মুদ্রা প্রবর্তনের ক্ষেত্রে বিশেষ গতিবেগ দেখা যায়। খ্রিষ্টীয় প্রথম তিন শতকে যে বিচিত্র ধরনের মুদ্রার প্রচলন ঘটে, ভারত-ইতিহাসের আর কোন পর্বে তা দেখা যায়নি। এরূপ বিচিত্র এবং বিপুল সংখ্যক মুদ্রার অস্তিত্ব আলোচ্য কালপর্বে প্রসারিত ও সমৃদ্ধ বাণিজ্যের আভাস দেয়। ইন্দো-গ্রীক শাসকরা এই সময় সোনা ও রূপার মুদ্রা নিয়মিতভাবে চালু করেছিলেন। মুদ্রায় প্রবর্তনকারী শাসকের নাম খোদাই করা থাকত। সাতবাহন রাজারাও সিসা বা পোটিন জাতীয় ধাতু মুদ্রার প্রচলন করেন। এছাড়া মধ্যভারতের নাগবংশীয় শাসকগণ, কোশাম্বী, মথুরা, অবত্তি ও অহিচ্ছত্রের মিত্র বংশীয় শাসকেরা বহু তামার মুদ্রা চালু করেছিলেন। এমনকি মধ্যভারতের কিছু উপজাতীয় গোষ্ঠী যেমন যৌধেয়, মালব, অর্জুনায়েন প্রভৃতি তাম্র মুদ্রার প্রচলন করেছিলেন। পশ্চিম ভারতে শক ক্ষত্রপ নহপান, রুদ্রদামন প্রমুখ রৌপ্য মুদ্রা প্রবর্তন করেছিলেন। প্রাচীন ভারতে মুদ্রা-ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল কুষাণ রাজাদের। তাঁরাই প্রথম ভারতীয় স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন করেন, যা পরিমাণে ছিল বিপুল এবং মুদ্রার মান ছিল অনেক উন্নত।

উত্তর ভারতের মুদ্রা ব্যবস্থায় কুষাণ মুদ্রা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কুষাণ রাজারা স্বর্ণ, রৌপ্য ও তাম্র তিন ধাতুরই মুদ্রা চালু করেছিলেন। এই মুদ্রার উপর ইন্দো-ব্যাকট্রিয় এবং রোমান মুদ্রার বিশেষ প্রভাব দেখা যায়। এর ফলে ভারতীয় মুদ্রার আকৃতি, ওজন এবং ধাতুর মান যথেষ্ট উন্নত হয়। এমনকি ভারতীয় মুদ্রার নাম করলেও বিদেশী প্রভাব স্পষ্ট। যেমন ‘দেনারিয়াম’ থেকে ‘দিনার’ কিংবা ‘ড্ৰাকমা’ থেকে ‘দ্রম্ম’ নাম নেওয়া হয়েছিল। ভারতীয় মুদ্রায় ইতিপূর্বে শাসকের নাম খোদিত হত না। এখন রোমান মুদ্রার অনুকরণে শাসকের নামাঙ্কিত বৃত্তাকার সুদর্শন মুদ্রা চালু করা হয়। কুষাণ মুদ্রার উপর ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের গবেষণা সমকালীন মুদ্রা ব্যবস্থা সম্পর্কে একটি প্রামাণ্য নথি। কুষাণ রাজা বিম কদফিসেস সম্ভবত প্রথম কুষাণ স্বর্ণমুদ্রা প্রবর্তন করেছিলেন। এই মুদ্রার উপর রোমান মুদ্রার প্রভাব স্পষ্ট। সম্ভবত রোমের সাথে বাণিজ্যে তাঁর আগ্রহ এবং রোম-ভারত বাণিজ্যের সম্ভাবনা থেকে কুষাণ রাজা ভারতীয় মুদ্রার আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর লক্ষ্যে রোমান মুদ্রার আদলে ভারতীয় মুদ্রা নির্মাণে উৎসাহী হয়েছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, প্রাক-কুষাণ আমলে ভারতে রোমান সম্রাট অগাস্টাস বা টাইবেরিয়াসের নামাঙ্কিত রোমান মুদ্রার অস্তিত্ব থাকলেও, কুষাণ যুগে তা ছিল না। তার কারণ সম্ভবত কুষাণ রাজারা রোমের স্বর্ণ মুদ্রাকে গলিয়ে তাকে কুষাণ মুদ্রায় রূপান্তরিত করেছিলেন। এমন মুদ্রা বেশী পাওয়া গেছে দাক্ষিণাত্য ও দক্ষিণ ভারতে, যা দক্ষিণের বন্দরগুলির সাথে রোমের বৈদেশিক বাণিজ্যের ব্যাপকতার প্রমাণ দেয়। ভারতের বাজারে রোমের স্বর্ণমুদ্রার ব্যাপক নিষ্ক্রমনের ফলেই দ্বিতীয় কদফিসেস্-এর সময় থেকে ভারতে ধারাবাহিকভাবে স্বর্ণমুদ্রা প্রচলন করা সম্ভব হয়েছিল।

কুষাণ রাজারা রৌপ্য ও তাম্রমুদ্রাও চালু করেছিলেন। ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের মতে, প্রধানত নিম্ন সিন্ধু এলাকাতে রৌপ্য মুদ্রার প্রচলন ছিল। বিম কদফিসিসের শাসন শুরুর আগে থেকেই ঐ অঞ্চলে রৌপ্য মুদ্রার ব্যবহার ছিল। কিন্তু মুদ্রার মানের ক্রমাবনতি ঘটছিল। সম্ভবত স্থানীয় ব্যবসায়ীরা এই সকল খাদযুক্ত রৌপ্য মুদ্রা প্রস্তুত করতেন। কুষাণ রাজা হুবিষ্কের আমলে খোদাই করা মথুরা লেখতে (১০৬ খ্রিঃ) ‘পুরাণ’ নামক এক ধরনের রৌপ্য মুদ্রার উল্লেখ পাওয়া যায়। ব্রতীন্দ্রনাথের মতে, এগুলি সরকারী উদ্যোগে তৈরী হয়নি। একই সময়ে নিম্ন সিন্ধু অঞ্চলে এমন বহু রৌপ্য মুদ্রার অস্তিত্ব ছিল যেগুলি কুষাণদের টাকশালে নির্মিত এবং যথেষ্ট উন্নত মানের। ড. বন্দোপাধ্যায় নানা তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, বেসরকারী নিম্নমানের রৌপ্য মুদ্রা বাজার ছেয়ে গেলে কুযাণ রাজারা হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হন। কারণ অতিরিক্ত খাদযুক্ত মুদ্রা বিদেশী বণিকদের নিরুৎসাহিত করার পক্ষে যথেষ্ট ছিল। ঐ সময় নিম্ন সিন্ধু এলাকা ভারত-রোম বাণিজ্যে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। মুদ্রাব্যবস্থার এই নৈরাজ্য কাটানোর প্রয়োজনে কুষাণ রাজারা নির্দিষ্টভাবে নিম্ন সিন্ধু উপত্যকার জন্য সরকারী উদ্যোগে উন্নতমানের রৌপ্যমুদ্রা প্রকাশ করেছিলেন। উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম ভারতে কুষাণ রাজারা প্রচুর সংখ্যক তাম্র মুদ্রাও চালু করেছিলেন। কুষাণ তাম্রমুদ্রা ছিল তিনটি ওজনের ১৭ গ্রাম, ৮-৮.৫ গ্রাম এবং ৪-৫ গ্রাম। মূলত স্থানীয় স্তরে দৈনন্দিন ক্রয় বিক্রয়ের কাজে তাম্রমুদ্রার ব্যবহার হত। সাতবাহন, নাগবংশ সহ বহু রাজবংশ তাম্রমুদ্রার প্রচলন ঘটিয়ে ছিলেন, এ কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। স্থানীয় স্তরে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে তাম্রমুদ্রায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তা সুনিশ্চিত। প্রাথমিক পর্বে কুষাণদের স্বর্ণমুদ্রা আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ছিল। তাই কুষাণ সাম্রাজ্যের বাইরে ভারতের অন্যান্য রাজ্যে এবং বিদেশেও কুষাণ স্বর্ণমুদ্রার সন্ধান পাওয়া গেছে। রোমান স্বর্ণমুদ্রার সমান গুণমান সম্পন্ন ছিল কুষাণদের স্বর্ণমুদ্রা। কিন্তু হুবিষ্কের আমল থেকে স্বর্ণমুদ্রায় খাদের পরিমাণ অনেকটাই বাড়িয়ে দেওয়া হয়। ফলে কুষাণ মুদ্রাও রোমান মুদ্রার ধাতুগত মূল্যে তারতম্য ঘটে এবং অনিবার্যভাবে আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে কুষাণ স্বর্ণমুদ্রার গুরুত্ব শিথিল হয়।

আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।

Leave a Comment