মৌর্যযুগে বাণিজ্য : বহির্বাণিজ্য, ভারত-রোম বাণিজ্য

আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “মৌর্যযুগে বাণিজ্য : বহির্বাণিজ্য, ভারত-রোম বাণিজ্য” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।

মৌর্যদের আমলে বাণিজ্য

মৌর্যদের আমলে একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়েছিল। বেড়েছিল রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা। স্বভাবতই তখন ব্যবসাবাণিজ্য বৃদ্ধির অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। মেগাস্থিনিসের বিবরণ ও কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকে তৎকালীন ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যের ধারণা পাওয়া যায়। রাজধানী পাটলিপুত্রের প্রশাসনিক কাজ পরিচালনার জন্য পাঁচজন সদস্যবিশিষ্ট যে ছয়টি সমিতি ছিল তার চতুর্থ সমিতির কাজ ছিল বাণিজ্য ও বণিকদের নানা দিকে তত্ত্বাবধান করা।

এ থেকে অনুমিত হয় তখন ব্যবসাবাণিজ্য যথেষ্ট সমৃদ্ধ ছিল। গ্রীক বিবরণীতে ‘এ্যাগরোনময়’ কর্মচারীদের প্রধান কাজ হিসেবে পথঘাটের রক্ষণাবেক্ষণের কথা বলা হয়েছে। এটিও তৎকালে বাণিজ্যিক গুরুত্বের নিদর্শন হিসেবে গ্রহণীয়। গ্রীক লেখক এরাটোস্থেনেস লিখেছেন যে, পাটলিপুত্র থেকে একটি রাজপথ পশ্চিম এশিয়া পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। অধ্যাপক ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় লামঘানে (আফগানিস্তান) প্রাপ্ত অশোকের অনুশাসনের ভিত্তিতে রাজা কর্তৃক পথ নির্মাণের ও তার রক্ষণাবেক্ষণের কথা বলেছেন। গ্রীক বিবরণী থেকে জানা যায়, পাটলিপুত্র থেকে সুপ্রশস্ত রাজপথ উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমে ব্যাট্রিয়া পর্যন্ত এবং পূর্বে উপকূলবর্তী বন্দর-শহর তাম্রলিপ্ত পর্যন্ত প্রসারিত ছিল।

তখন বড় বণিকেরা ‘শ্রেষ্ঠী’ বা ‘শ্রেষ্ঠীন’ নামে পরিচিত হতেন। এছাড়া ‘সার্থবাহ’ বা সাধারণ বণিকও ছিল। তখন দক্ষিণে খনিগুলিতে প্রচুর সোনা ও লোহা পাওয়া যেত। ফলে সমৃদ্ধ বাণিজ্যের লোকে বিদেশী গ্রীক-বণিকরাও ভারতীয় বাণিজ্যে অংশ নিত। কোশাম্বীর মতে, কার্লেগুহার কাছে গ্রীক-বণিকদের একটা বসতিও গড়ে উঠেছিল। স্থলপথ ছাড়া নদীপথে প্রধানত চম্পা, বারাণসী, কোশাম্বী, তাম্রলিপ্ত ইত্যাদি নদী উপকূল অঞ্চলে অন্তর্বাণিজ্য চলত।

মৌর্যযুগে বহির্বাণিজ্য

এ সময়ে স্থলপথ ও সমুদ্রপথে বহির্বিশ্বেও ভারতীয় বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। আলেকজাণ্ডারের ভারত আক্রমণের ফলে পাশ্চাত্য জগৎ ভারতের নিকটতর হয় এবং সিরিয়া, মিশর, গ্রীস ও অন্যান্য পাশ্চাত্য দেশের সাথে ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। ভারতীয় উপকূল থেকে জাহাজ যেত ব্রহ্মদেশ, শ্রীলঙ্কা ও দক্ষিণ আরবে। ভারতীয় পণ্য রপ্তানি হত গ্রীস ও গ্রীক-শাসিত দেশগুলিতে। এইসব পণ্যদ্রব্যের মধ্যে ছিল মশলা, দামী পাথর, হাতির দাঁতের কাজ করা শিল্পবস্তু ও নানাপ্রকার দুর্লভ কাঠ। ভারতের দুটি প্রধান বাণিজ্য-বন্দর ছিল সোপারা এবং ব্রোচ (ভৃগু কচ্ছ)। এই বন্দর দুটি মগধের অধীনস্থ হওয়ায় রাজধানী পাটলীপুত্র একটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। এছাড়া দক্ষিণ-পূর্ব বিহারে তাম্র আবিষ্কৃত হওয়ায় গঙ্গার বদ্বীপে অবস্থিত তাম্রলিপ্ত বন্দর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এছাড়া চীনদেশ থেকে স্থলপথে আমদানি করা হত রেশম এবং আলেকজান্দ্রিয়ার মধ্য দিয়ে আমদানি করা হত ভূমধ্যসাগরীয় প্রবাল।

মৌর্যযুগের অর্থনীতির মূল বৈশিষ্ট্য হল উৎপাদনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সর্বাত্মক নিয়ন্ত্রণ। স্বভাবতই বাণিজ্যও এর ব্যতিক্রম ছিল না। ড. রণবীর চক্রবর্তী লিখেছেন, কৌটিল্য নীতিগতভাবে মনে করতেন যে, বণিকেরা (বৈদেহক) রাষ্ট্রের পক্ষে কণ্টকস্বরূপ। তাই তাদের হাত থেকে প্রজাকুলকে রক্ষা করা রাষ্ট্রের কর্তব্য। এই লক্ষ্যে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উভয় প্রকার বাণিজ্যেই রাষ্ট্রের তরফ থেকে বিপুল পরিমাণ কর চাপানো হত। বিদেশী বণিকদের উপর আমদানি কর, রপ্তানি কর, নগর-প্রবেশ কর, চুঙ্গী কর প্রভৃতি বহুবিধ কর ধার্য করা হত। রাষ্ট্র নিজের প্রয়োজনমত দেশীয় বাজারে পণ্যের মূল্যমান নিয়ন্ত্রণ করত। পণ্যাধ্যক্ষ নামে রাজকর্মচারী পণ্যদ্রব্যের ক্রয়-বিক্রয় নিয়ন্ত্রণ করতেন ও মূল্য নির্ধারণ করতেন। সংস্থাধ্যক্ষ নামে রাজকর্মচারী নিয়োগ করা হয়েছিল যাতে ব্যবসায়ীরা ক্রেতাদের ঠকাতে না পারে সে দিকে দৃষ্টি দিতে। ব্যক্তিগত ব্যবসার পণ্য ছাড়াও ছিল রাষ্ট্রের নিজস্ব বাণিজ্যদ্রব্য যার নাম ছিল ‘রাজপণ্য’। এগুলির ক্রয়-বিক্রয়ও পণ্যাধ্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ করতেন। তবে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানিকে উৎসাহিত করতে নাবিক ও সার্থবাহদের শুল্ক থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল। এত রকম বিধিনিষেধ ও করের বিনিময়ে বণিকরা রাষ্ট্রের কাছ থেকে নিরাপত্তা লাভ করত। বাণিজ্যপথগুলিতে সতর্ক প্রহরা থাকত, পণ্য পরিবহণে ক্ষতি হলে রাষ্ট্র ক্ষতিপূরণও দিত। মৌর্যযুগে মুদ্রা-অর্থনীতির বিকাশ পূর্ণ রূপ নেয়। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে ছাপ দেওয়া মুদ্রার আবির্ভাব ও তার ব্যবহার বাণিজ্য-ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল করে ও রাষ্ট্রের অর্থনীতিতে একটি সুনির্দিষ্ট ভূমিকা পালন করতে থাকে। সংশয় নেই রাষ্ট্রায়ত্ত্ব অর্থনীতি মৌর্য আমলে উন্নতিলাভ করেছিল। কিন্তু এই সঙ্গে আরও মনে রাখতে হবে রাজকোষে সর্বদা পঞ্চাশ ভাগ অর্থ সঞ্চিত রাখার নীতি, শিল্প ও ভোগ্যপণ্যের উপর বিবিধ কর আরোপ এবং সর্বোপরি আইন ও নীতি প্রণেতাদের ব্যবসায়ীদের প্রতি সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি বাণিজ্যের আরও অগ্রগতিকে ব্যাহত করেছিল।

মৌর্য্যোত্তর যুগে (১৭৫ খ্রিস্টপূর্ব—৩০০ খ্রিস্টাব্দ) বাণিজ্য

মৌর্য্যোত্তর যুগে কৃষি-অর্থনীতির অগ্রগতির পাশাপাশি বাণিজ্যের ব্যাপক অগ্রগতি ঘটেছিল। কুষাণ বংশের শাসনকালে ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্য যে বিপুল সমৃদ্ধি পেয়েছিল, তা অভূতপূর্ব। সাতবাহন রাজাদের শাসনকালে দক্ষিণ-ভারতও বাণিজ্যিক অগ্রগতির সাক্ষী হতে পেরেছিল। ভারহৃত ও সাঁচী লেখমালা এবং প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্যের ভিত্তিতে মৌর্য্যোত্তর ভারতের সমৃদ্ধ বাণিজ্যের কথা জানা যায়। সমকালীন দানপত্রগুলিতে বণিকদের কথা গুরুত্বের সাথে উল্লেখিত হয়েছে। বাণিজ্যরত কর্মীদের ‘বণিক’, ‘সার্থবাহ’, ‘শ্রেষ্ঠী’ বা সেটঠি ইত্যাদি নানা নামে উল্লেখ করা হয়েছে। বুদ্ধ-জাতকগুলিতে এই সকল নামের বহুল উল্লেখ দেখা যায়। সম্ভবত ছোট মাপের ব্যবসায়ীকে ‘বণিক’ বলা হত। যারা গরু বা অন্যান্য পশুবাহিত শকটে পণ্য নিয়ে দূরদূরান্তে ঘুরে ঘুরে ব্যবসা করতেন, তাদের বলা হত ‘সার্থবাহ’। এদের দলে ৫০০ থেকে ১০০০ পর্যন্ত শকট থাকত। আর ‘সেট্‌ঠি’ ছিলেন সবচেয়ে ধনবান ও প্রভাবশালী বণিক। জাতক কাহিনীতে ‘শ্রেষ্ঠী’দের আর্থিক ও সামাজিক প্রতিপত্তির উজ্জ্বল চিত্র অঙ্কন করা হয়েছে।

গবেষকদের ধারণা, বৌদ্ধসাহিত্যে বর্ণিত সম্পন্ন ‘গহপতি’ গোষ্ঠী থেকেই ‘সেট্‌ঠি’ গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছিল। গহপতিদের আর্থিক প্রতিপত্তির মূল সূত্র ছিল বিপুল ভূসম্পত্তির মালিকানা। কৃষি থেকে পাওয়া উদ্বৃত্ত অর্থ এঁরা অধিকতর মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে বাণিজ্যে বিনিয়োগ করতে শুরু করেন। এইভাবে বাণিজ্যে বিনিয়োগকারী হিসেবে ‘গহপতি-সেট্‌ঠি’ শ্রেণির আবির্ভাব ঘটে। কালক্রমে এঁদের মধ্যে থেকে পুরোপুরি নগদ অর্থ বিনিয়োগকারী ব্যবসায়ী রূপে ‘সেট্‌ঠি’ দের আবির্ভাব ঘটে। এই গোষ্ঠী একান্তভাবেই বাণিজ্যজীবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান। অর্থাৎ ‘গহপতি-সেট্‌ঠি’ এবং ‘সেঠি” গোষ্ঠীর মধ্যে একটা ছেদ্ রেখা দেখা যায়। ড. অতীন্দ্রনাথ বসু জাতক কাহিনীগুলি বিশ্লেষণ করে সেট্‌ঠি’র বিপুল অর্থবলের উল্লেখ করেছেন। একজন সফল অর্থলগ্নীকারী ও ব্যবসায়ী হিসেবে ‘সেঠি’রা রাজদরবারেও বিশেষ মর্যাদা পেতেন। জাতকের বিবরণ অনুযায়ী শ্রেষ্ঠী ও রাজার মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ও সু-সম্পর্ক বজায় থাকত। বণিকশ্রেণির মুখপাত্র হিসেবে শ্রেষ্ঠী মর্যাদা ও ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। রাজকীয় প্রশাসন ও বণিকশ্রেণির মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করার কাজে শ্রেষ্ঠীদের বিশেষ ভূমিকা ছিল। এঁদের মধ্যে একদল ‘রাজ-শ্রেষ্ঠী’ নামে পরিচিত হতেন। এঁরা সম্ভবত সরাসরি রাজার হয়ে বাণিজ্যকর্ম পরিচালনা করতেন। পণ্যদ্রব্যের চলাচল ও বাজারের দিকটি রাষ্ট্র তদারক করত। কিছু কিছু পণ্যের বাণিজ্যে রাজার একচেটিয়া অধিকার স্বীকৃত ছিল। রাষ্ট্রের তরফে রাস্তাঘাট ও যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হত। বণিক ও তাদের পণ্যের নিরাপত্তা রক্ষার ভার রাষ্ট্রের উপর ন্যস্ত ছিল।

মৌর্যযুগে ভারত-রোম বাণিজ্য

মৌর্য-পরবর্তী ও প্রাক-গুপ্তযুগে ভারতীয় রাজনীতির বৈশিষ্ট্য ছিল কেন্দ্রীয় শক্তির অভাব এবং অস্থিরতা। এই পর্বে কিছু বিদেশী শক্তি ভারতে প্রবেশ করে আঞ্চলিকভাবে রাজ্য স্থাপনে সক্ষম হয়েছিল। তবে এই রাজনৈতিক পরিবর্তন পরোক্ষভাবে ভারতীয় অর্থনীতির পক্ষে অনেকটা সুফল দায়ী ছিল। বিদেশী জাতিগুলি আগমনের সূত্রে বাইরের দেশগুলির সাথে ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠা সহজ হয়েছিল। ইন্দো-গ্রীক, শক, পার্থিয়, কুষাণ প্রভৃতি বিদেশী জাতির হাত ধরে ভারতীয় বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ঘটেছিল। যেমন, ইন্দো-গ্রীক শাসকদের উৎসাহে পশ্চিম-এশিয়া ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ভারতের বাণিজ্য সম্প্রসারিত হয়। আবার শক, পার্থিয়, কুষাণ শাসকেরা ভারত ও মধ্য-এশিয়ার মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধির সহায়ক হয়েছিলেন। কালক্রমে চীনের সাথেও ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্কে গতিবেগ এসেছিল। অনুরূপভাবে দাক্ষিণাত্য ও দক্ষিণভারতে সাতবাহন সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা দাক্ষিণাত্য তথা দক্ষিণ ভারতকে বাণিজ্যের অগ্রণী ও সমৃদ্ধ কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। এর ফলে উপমহাদেশের সাথে রোমের সমৃদ্ধ বাণিজ্য দক্ষিণ ভারত সহ সমগ্র উপমহাদেশের সাথে বাণিজ্যের নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছিল।

স্থলপথে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি বাণিজ্য বৃদ্ধির অন্যতম সহায়ক উপাদান ছিল। সাধারণত নদী-উপত্যকাগুলিকে অনুসরণ করে পথগুলি তৈরী হয়েছিল। কোন কোন পথ মধ্য ও পশ্চিম এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বৌদ্ধগ্রন্থ অনুসরণ করে ড. অতীন্দ্রনাথ বসু তাঁর ‘Social and Rural Economy of Northern India’ শীর্ষক প্রবন্ধে তৎকালীন ভারতে অন্তত চারটি এমন গুরুত্বপূর্ণ পথের কথা উল্লেখ করেছেন। এগুলি হল- (১) দক্ষিণে সাতবাহনদের রাজধানী পৈঠান (প্রতিষ্ঠান) থেকে নাসিক, উজ্জয়িনী, সাঁচীর মধ্য দিয়ে উত্তরে কোশল রাজ্যের রাজধানী শ্রাবস্তী পর্যন্ত প্রসারিত, (২) পূর্বে অঙ্গের রাজধানী চম্পা থেকে উত্তর-পশ্চিমে গন্ধার দেশের রাজধানী পুষ্কলাবতী পর্যন্ত প্রসারিত, (৩) পূর্ব দিক থেকে আরো একটি পথ পাটলিপুত্র থেকে শুরু হয়ে পশ্চিম প্রান্তে সিন্ধুনদের ব-দ্বীপ অঞ্চলে পাটল পর্যন্ত প্রসারিত। ড. বসু এই পথটিকেই ‘জাতক’ গ্রন্থে বর্ণিত ‘পূর্বাস্ত থেকে অপরাস্ত’ পর্যন্ত সংযোগরেখা বলে সনাক্ত করেছেন, এবং (৪) পশ্চিম উপকূলের ব্যস্ত বন্দর ভূগুচ্ছ (ব্রোচ) থেকে কাবুল পর্যন্ত প্রসারিত। গাঙ্গেয় উপত্যকার মধ্য দিয়ে মালব অতিক্রম করে পাঙ্খাব, তক্ষশিলা, পুস্কলাবতীর মধ্যে এটি ছিল যোগসূত্র। এছাড়া স্থলপথে পাটলিপুত্রের সাথে তাম্রলিপ্ত বন্দরের যোগাযোগ ছিল। ব্রষ্মদেশ, সিংহল এবং ভারতের পূর্ব উপকূলের বাণিজ্যে তাম্রলিপ্ত বন্দরের বিশেষ গুরুত্ব ছিল। ‘পেরিপ্লাস’ গ্রন্থের মতে, পুষ্কলাবতী থেকে দক্ষিণ ভারত পর্যন্ত একটি প্রসারিত রাজপথ ছিল। স্থলপথে বাণিজ্যের সূত্রে পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলির সাথে ভারতের আর্থিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ বৃদ্ধি পায়। পূর্ব আফগানিস্তান উত্তর পশ্চিম ভারতের অংশরূপে বিবেচিত হয়। মধ্য এশিয়ার কাশগড়, খোটান, ইয়ারখন্দ, কুচি, তুরফান প্রভৃতি কেন্দ্রে ভারতীয় বণিকদের উপনিবেশ গড়ে ওঠে। মধ্য এশিয়ার সাথে ভারতের ব্যস্ত বাণিজ্যের সূত্রে চীন দেশের সাথে ভারতীয় বণিকদের যোগাযোগ স্থাপনের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায় এবং এক সময় চীনের রেশম বাণিজ্যের সাথে ভারত যুক্ত হয়ে পড়ে।

সামুদ্রিক বাণিজ্যে ভারতীয়দের ভূমিকা এই সময় বেড়েছিল। মিলিন্দ পঞহো, পেরিপ্লাস প্রভৃতি গ্রন্থ এবং প্রত্নতত্ত্বের সাক্ষ্য থেকে সামুদ্রিক বাণিজ্যের তথ্যাদি পাওয়া যায়। চোল ছাড়া অন্যান্য বণিকরা সমুদ্র বাণিজ্যে অংশ নিলেও তাদের নিজস্ব জাহাজ ছিল না। তারা সাধারণত অন্যদেশের জাহাজে পণ্য পরিবহণ করত। কেবল চোলরা নিজেদের তৈরী করা জাহাজে বাণিজ্য চালাত এবং সামরিক অভিযান চালাত। উপকূল বাণিজ্যে ছোট ছোট নৌ-যান ব্যবহার করা হত। ভারতীয় সাহিত্যে একহাজার যাত্রী বহনে সক্ষম জাহাজের উল্লেখ আছে। সম্ভবত এটি সঠিক নয়। পিণীর বক্তব্য অনুসারে বৃহত্তম জাহাজের ওজন ছিল মাত্র পঁচাত্তর টন। প্লিণীর বক্তব্য সঠিক বলে অধিকাংশ ঐতিহাসিক মনে করেন। পেরিপ্লাস গ্রন্থে বঙ্গোপসাগরের উপকূল ধরে দক্ষিণভারত অভিমুখে যাওয়ার উল্লেখ আছে। মিলিন্দপঞহো গ্রন্থের এমন বক্তব্য পাওয়া যায়। দক্ষিণ ভারতের গুরুত্বপূর্ণ বন্দরগুলি ছিল ভৃগুচ্ছ, সোপারা, পাতাল প্রভৃতি। পশ্চিম মুখে পারস্য উপসাগর ও লোহিত সাগরেও ভারতীয় বণিকদের বাণিজ্যপোত পাড়ি দিত। পূর্ব ভারতের দুটি গুরুত্বপূর্ণ নদী বন্দর ছিল চম্পা ও তাম্রলিপ্ত। তাম্রলিপ্ত বন্দর থেকে প্রথম দিকে সিংহলে বাণিজ্য চলত। খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় বাণিজ্য জাহাজ পণ্য নিয়ে যেতে শুরু করে। মৌসুমি বায়ুর গতি-প্রকৃতি অবহিত হওয়ার পরে মৌসুমি বায়ুর সাহায্য নিয়ে বড় বড় জাহাজ মালাবার উপকূলের বন্দরগুলিতে পৌঁছাতে পারে।

খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকে রোমান সাম্রাজ্যের অধীন মিশরের সাথেও ভারতের বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকের আগে মিশরের সাথে ভারতের সরাসরি বাণিজ্য চলত না। মিশরের পণ্য বোঝাই জাহাজগুলি লোহিত সাগরের মুখ থেকে বেরিয়ে সমুদ্রপথ ধরে ভারতের উপকূলে পৌঁছাতে সাহস করত না। তখন ভারতীয় ও পশ্চিমী বাণিজ্যপোতগুলি পরস্পরের অভিমুখে যাত্রা করে সম্ভবত এডেন বন্দরে পৌঁছাত। এখানেই পরস্পর পণ্য বিনিময় করে আবার স্বদেশের দিকে যাত্রা করত। পেরিপ্লাস গ্রন্থের বক্তব্য থেকে অনুমান করা হয় সম্ভবত আরব বণিকরা এই বাণিজ্যে মধ্যস্থের ভূমিকা পালন করত। খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকের দ্বিতীয়ার্ধে সরাসরি ভারত-মিশর বাণিজ্যের সুযোগ আসে। মিশরের টলেমিরা বাব-এল-মন্ডব অধিকার করার পর মিশরীয় জাহাজ সরাসরি ভারতের বন্দরে চলে আসতে পারে। ভারতীয় বণিকেরাও মিশরের উপস্থিত হন। মিশরের মেমফিস নগরে ভারতীয় উপনিবেশ গড়ে উঠেছিল, যা মিশরে ভারতীয় বণিকদের বর্ধিত কার্যকলাপের প্রমাণ দেয়। ভারতীয় বণিকরা সোকোত্রা (শুকতারা) দ্বীপে স্থায়ী বসতি গড়ে তুলেছিল বলে পেরিপ্লাসে বলা হয়েছে। টলেমির ভূগোল এবং তামিল কাব্য থেকেও এই বাণিজ্যে দক্ষিণী বণিকদের ব্যাপক অংশ গ্রহণের কথা জানা যায়।

মৌর্য্যোত্তর এবং প্রাক্-গুপ্ত ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্যের একটি বিশেষভাবে উজ্জ্বল নাম হল ভারত-রোম বাণিজ্য। প্রাচ্যের বাণিজ্য ইতিহাসে ভারত রোম বাণিজ্য বিশেষ মর্যাদার স্থান অধিকার করে আছে। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতক থেকে খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতক পর্যন্ত প্রায় চারশো বছর এই ভারত-রোম বাণিজ্য চলেছিল। প্রাথমিকভাবে স্থলপথে বাণিজ্য চালু হয় এবং পরে সমুদ্রপথে বাণিজ্যে গতি সঞ্চারিত হয়। ভারত এবং রোম উভয় দেশই পরস্পরের ঐতিহ্য সম্পর্কে আগ্রহী ও শ্রদ্ধাশীল ছিল। স্ট্যারো, এ্যারিয়ান, টলেমি, প্লিণী প্রমুখের রচনায় ভারত সম্পর্কে রোমের আগ্রহের ছবি পাওয়া যায়। অন্যদিকে ভারত থেকেও রোমান সম্রাটদের দরবারে একের পর এক দূত পাঠানোর কথা জানা যায়। খ্রিষ্টীয় প্রথম থেকে চতুর্থ শতকের মধ্যে একাধিক রোমান সম্রাট যেমন ট্রোজান (৯৮-১১৭ খ্রিঃ), হাড্রিয়ান (১১৭-১৩৮ খ্রিঃ), অ্যান্টোনিনাস পায়াস (১৩৮-১৬১ f38), অরেলিয়ান (২৭০-২৭৫ খ্রিঃ), কনস্টানটাইন (৩২৩-৩৫৩ খ্রিঃ) এবং জুলিয়ান (৩৬১-৩৬৩ খ্রিঃ) প্রমুখের কাছে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতগণ গিয়েছিলেন।

ভারতের সাথে পাশ্চাত্য তথা রোমের বাণিজ্যের পশ্চাদপটে কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা সক্রিয় ছিল। এদের অন্যতম হল রোম সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা। এর ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটে, বাণিজ্যপথের নিরাপত্তা বৃদ্ধি পায় এবং বৃহৎ শাসক গোষ্ঠীর উদ্ভব হওয়ায় বিলাস দ্রব্যের চাহিদা বৃদ্ধি পায় রোম এবং সাম্রাজ্যের অধীনস্থ পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলিতে। বিলাসদ্রব্যের মধ্যে পাশ্চাত্য দেশগুলিতে সবথেকে বেশী চাহিদা ছিল রেশমের, যা কেবল চীনে উৎপাদিত হত। এছাড়া ভারতে মধ্য এশীয় যাযাবর জাতি কুষাণরা সিন্ধু অঞ্চলে রাজ্য স্থাপন করলে রোম-ভারত স্থলপথ বাণিজ্যের পথ উন্মুক্ত হয়। ব্যাকট্রিয়া, কাবুল উপত্যকা, পাঞ্জাব, যমুনা উপত্যকা এবং উত্তর-গাঙ্গেয় উপত্যকায় ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে গঙ্গা ও ইউফ্রেটিস নদীর মধ্যে নিয়মিত বাণিজ্যের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেয়েছিল। সর্বোপরি, ৪৭ খ্রিস্টাব্দে হিপ্পলাম ভারত মহাসাগরে মৌসুমি বায়ুর গতিপ্রকৃতি আবিষ্কার করলে সমুদ্র পথে ভারত-রোম বাণিজ্যে গতিবেগের সঞ্চার ঘটে।

খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতক থেকে ভারতবর্ষ দূরপাল্লার বৈদেশিক বাণিজ্যে অংশ নিতে শুরু করেছিল। পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ার রাজনৈতিক পরিবর্তন সেই বৈদেশিক বাণিজ্যে নতুন গতি সঞ্চারিত করে। এটি হল কুষাণ সাম্রাজ্যের উদ্ভব। একটি মধ্য-এশীয় শক্তি হিসেবে ব্যাকট্রিয়াকে কেন্দ্র করে কুষাণরা তাদের কর্তৃত্বের সূচনা করেছিল। ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এক গবেষণায় দেখিয়েছেন কিভাবে কুষাণরা ব্যাকট্রিয়াকে কেন্দ্র করে পশ্চিম এশিয়া, মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার এক বিশাল ভূখণ্ডে শাসন কর্তৃত্ব কায়েম করেছিল। ভারতে কুষাণ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার রূপকার কুজুল কদফিসেস ও বিম কদফিসেস যে ভারত-রোম বাণিজ্যে সিন্ধুনদের গুরুত্ব অনুমান করেই, এই কাজে এগিয়েছিলেন, ড. মুখোপাধ্যায় তথ্য প্রমাণ দিয়ে তা উল্লেখ করেছেন। ইরানের বিকল্প শক্তি হিসেবে পশ্চিম এশিয়ায় কুষাণদের উত্থান ভারত-রোম সামুদ্রিক বাণিজ্যের প্রেক্ষাপটে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

ইউরোপের সাথে এশিয়ার বাণিজ্য সম্পর্কের সূচনা হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে। এই বাণিজ্যের দুটি প্রধান পক্ষ ছিল ইউরোপের রোম সাম্রাজ্য এবং এশিয়ায় চীন দেশের হান সাম্রাজ্য। পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের এই বাণিজ্যের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ পণ্যটি ছিল চীনের রেশম। রোমে একটি বৃহৎ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা এবং সম্পদশালী রোমান অভিজাতদের বিলাসবহুল পণ্যের চাহিদা রেশম বাণিজ্যের দ্রুত বিস্তার সম্ভব করে। উন্নতমানের এই রেশম কেবল চীনেই উৎপাদন হত। প্রাথমিক পর্বে চীনের রেশম স্থলপথে রপ্তানি করা হত। চীন থেকে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে মধ্য এশিয়ার টাকলামাকান মরুভূমির মধ্য দিয়ে পামির মালভূমি ও ইরাণ হয়ে পশ্চিম এশিয়ায় পৌঁছাত। সেখান থেকে হাতবদল হয়ে রোমান সাম্রাজ্যের নানাস্থানে চলে যেত। মহার্ঘ ও সৌখিন পণ্য রেশম চলাচলের কারণে এই পথটিকে ‘রেশম পথ’ বা Silk Route বলা হয়ে থাকে।

স্থলপথে রোম-চীন রেশম বাণিজ্য নানা কারণে সমস্যাকীর্ণ ছিল। প্রথমত, এই পথ ছিল প্রবল বিপদসঙ্কুল, ঝুঁকিবহুল এবং বণিকদের পক্ষে এই দীর্ঘ ও দুর্গম পথ পাড়ি দেওয়া ছিল কষ্টকর। স্বভাবতই পণ্যের পরিবহণ ব্যয় বৃদ্ধি পেত এবং এগুলিকে বর্ধিত দামে বিক্রি করতে হত। পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির কারণে বিক্রির পরিমাণ ক্রমশ নিম্নমুখী হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, রেশম পথের একটি বড় অংশ ইরাণের মধ্য দিয়ে গিয়েছিল। ইরাণে শক্তিশালী আর্সাকীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হলে চীন-রোম বাণিজ্যে সংকট বৃদ্ধি পায়। আসাকীয় রাজারা জানতেন যে, ভৌগোলিক কারণে ইউরোপ ও এশীয় বাণিজ্যিক যোগাযোগের বিকল্প কোন পথ নেই। তাই আসাকীয় প্রশাসন রোম-চীন বাণিজ্যে মধ্যবর্তীর ভূমিকা নিয়ে মুনাফা অর্জন করতে তৎপর হয়। তারা রোম ও চীন উভয়মুখের বাণিজ্যে চড়াহারে শুল্ক আদায় করতে শুরু করে, ফলে রেশমের বাজার মূল্য অনেকটাই বেড়ে যায়। এর অনিবার্য পরিণতিস্বরূপ বিক্রির পরিমাণ কমে যায়। এমত অবস্থায় রোম ও চীন উভয়পক্ষের বণিকরা একটা বিকল্প পথ খুঁজে পেতে বিশেষ আগ্রহ বোধ করেন। একই সময়ে মৌসুমি বায়ুর গতিপথ সংক্রান্ত হিপ্পলাসের গবেষণা রোম ও চীনের সামনে যেমন একটি বিকল্প পথের সম্ভাবনা গড়ে দেয়, তেমনি রোম-চীন বাণিজ্যে মধ্যবর্তীর ভূমিকায় কুষাণ রাজাদের আবির্ভাবের সুযোগ এনে দেয়।

হিপ্পলাস কর্তৃক মৌসুমি বায়ুর গতি-প্রকৃতি ‘আবিষ্কার তত্ত্ব’ টিকে অনেকেই ‘রোমানদের আজগুবি লোককথা’ বলে অভিহিত করেছেন। এঁদের মতে, বহুপূর্বে খ্রিষ্টপূর্ব কালে আলেকজান্ডার ভারত অভিযানের কাজে উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ুর সাহায্য নিয়েছিলেন। যাইহোক, মৌসুমি বায়ুর জ্ঞান অর্জন করার ফলে ইউরোপীয় বণিকরা উপকূল ধরে নৌচালনা বর্জন করে সমুদ্রপথ ধরে সরাসরি ক্যাম্বে প্রণালী বা দাক্ষিণাত্যে পৌঁছে যেতে পারে। মৌসুমি বায়ু ব্যবহার করে ভূমধ্যসাগরীয় বন্দর থেকে লোহিত সাগর ও আরব সাগর পেরিয়ে ভারতীয় উপকূলে পৌঁছানো সম্ভব হয়। পেরিপ্লাস-এর বর্ণনা অনুসারে জুলাই মাসে এই বায়ুপ্রবাহ শুরু হলে বণিকরা যাত্রা শুরু করতেন এবং লোহিত সাগর ও আরব সাগরের সংযোগস্থলে এডেনের কাছাকাছি কোন অঞ্চল থেকে মৌসুমি বায়ুপ্রবাহের সাহায্য নিয়ে কম সময়ে ভারতীয় উপকূলে পৌঁছে যেতেন। প্রথমদিকে রোমান বাণিজ্যপোত সিন্ধুনদের মোহনায় অবস্থিত বারবারিকাম বন্দরে আসত। পরবর্তীকালে লোহিত সাগরের বার্নিস বন্দর থেকে মৌসুমি বায়ুকে নির্ভর করে মাত্র চল্লিশ দিনে ভারতের মালাবার উপকূলে মুজিরিস বন্দরে পৌঁছানো সম্ভব হয়। রেশম বাণিজ্যে মধ্যবর্তীর ভূমিকা দখল করে কুষাণ শাসকরা যথেষ্ট শুল্ক উপার্জন করতে সক্ষম হন। সুতরাং মধ্য এশিয়া ছিল চীন ও ভারতের মধ্যে যোগসূত্র। উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতের বণিকেরা মূলত এই অঞ্চলের সাথে বাণিজ্য চালাতেন।

খ্রিষ্টীয় প্রথম শতক ও তৃতীয় শতকের মধ্যে রোম-ভারত বাণিজ্যে উদ্দীপনা দেখা যায়। রোমান সাম্রাজ্যের পূর্বাংশ ছিল ভারতীয় বিলাসদ্রব্যের প্রধান বাজার। পেরিপ্লাস গ্রন্থে রোমে প্রেরিত ভারতের রপ্তানি পণ্যের তালিকা পাওয়া যায়। ভারত থেকে রপ্তানি করা পণ্যের মধ্যে প্রধান ছিল। গোলমরিচ, রেশম, হাতির দাঁত, মুক্তা, মশলা, দামি পাথর, কচ্ছপের খোল ইত্যাদি। গোলমরিচের চাহিদা ছিল যথেষ্ট। আদি তামিল সাহিত্য অনুসারে গোলমরিচের পরিবর্তে ভারত পেত সোনা। রোমান লেখক অ্যারিসিয়াস (Aricius) এর রচনা থেকে বোঝা যায় যে, ভারতীয় মশলা রোমানদের খাদ্যাভাসে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছিল। ভারতের মশলা থেকে রোমে জীবনদায়ী ওষুধ তৈরী হত। প্লিনীর বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, ভারতের বিলাস সামগ্রীর প্রতি রোমান মহিলাদের প্রবল আকর্ষণ ছিল। মুক্তা, মসলিন, রেশম, সুগন্ধি ইত্যাদি পণ্য ক্রয় করার ক্ষেত্রে অভিজাত বা সম্পন্ন মহিলাদের আগ্রহ ছিল প্রবল। এর ফলে প্রতি বছর রোম থেকে প্রায় ১০০ মিলিয়ন সোনা কেবল ভারতে প্রবেশ করত। এজন্য প্লিনী রোমান প্রশাসনকে সতর্ক করেছেন। প্লিনীর তথ্য হয়ত অতিরঞ্জিত। তবে বাণিজ্যিক সূত্রে রোম থেকে ভারতে যে বিপুল পরিমাণ সোনা, রূপার নিষ্ক্রমণ ঘটত, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।

রোমান সাম্রাজ্য থেকে ভারতে আমদানি করা পণ্য দ্রব্যের মধ্যে ছিল সূক্ষ্মবস্ত্র, ক্ষৌমবস্ত্র, কাচের পাত্র, পোখরাজ, টিন, তামা, সিসা, সোমছাল, সুরাপত্র (অ্যাসকোরা), পালিশ করা লাল অ্যারেটাইন মৃৎপাত্র ইত্যাদি। প্রচুর পরিমাণ রোমান সোনা, রূপা ভারতে আসত মূলত বিনিময় উপাদান হিসেবে। পেরিপ্লাস অনুসারে ভারতীয় রাজপরিবারে উপপত্নী হিসেবে গ্রহণ করার জন্য অবিবাহিত সুন্দরী রোমান কন্যাদের ভারতে আনা হত।

রোমের সাথে বাণিজ্যে উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের অংশগ্রহণে প্রকৃতি স্বতন্ত্র ছিল। দক্ষিণ ভারতের সাথে রোমের সরাসরি বাণিজ্যিক লেনদেন চলত, কিন্তু উত্তর ভারতের বাণিজ্য ছিল পরোক্ষ। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পণ্যদ্রব্য প্রথমে তক্ষশিলায় জমা হত। যেমন পারস্য ও আফগানিস্তান থেকে আসত নীলকান্ত মণি, চীন থেকে আসত রেশম ইত্যাদি। তবে রোমের সাথে সামুদ্রিক বাণিজ্যে দক্ষিণ ভারতের ভূমিকা ছিল অগ্রণী। পশ্চিম এশিয়া ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে আগত যবন বণিকরা সাতবাহন রাজ্য এবং সুদূর দক্ষিণে বাণিজ্য বসতি গড়ে তুলেছিলেন। আরিকামেডু, মাদুরাই, মুজিরিস ছিল বণিকদের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। এই তিনটি কেন্দ্রেই প্রচুর রোমান মুদ্রা, মৃৎপাত্র, কাচ, পোড়ামাটির জিনিস ও রুদ্রাক্ষের মত পুঁতির মালা পাওয়া গেছে।

আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।

Leave a Comment