আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “মৌর্যযুগ ও প্রাক্ গুপ্ত যুগের বাণিজ্য, নগর, মুদ্রা” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
মৌর্যযুগের ব্যবসা বাণিজ্য
মৌর্যযুগ ও প্রাক্ গুপ্ত যুগে (৩০০ খ্রিঃপূঃ – ৩০০ খ্রিস্টাব্দ) ভারতের অভ্যন্তরীণ ও বহির্বাণিজ্যের গতিশীলতা গুপ্ত যুগের অব্যাহত ছিল। তবে ভারত-রোম বাণিজ্যে ভাঙনের ফলে গুপ্তযুগে বহির্বাণিজ্য নতুন রূপে সংগঠিত হয়েছিল। সমকালীন সাহিত্য লেখমালা ও বিদেশীদের বিবরণ থেকে গুপ্তযুগের সমৃদ্ধ বাণিজ্য কর্মের কথা জানা যায়। সমকালীন সাহিত্যে ‘শ্রেষ্ঠী’ ও ‘সার্থবাহ’ নামক বণিকশ্রেণীর ব্যস্ততার উল্লেখ পাওয়া যায়। অমর সিংহ তাঁর ‘অমরকোষ’ গ্রন্থে পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের কথা বলেছেন। ‘শ্রেষ্ঠী’ ও ‘সার্থবাহ’ গোষ্ঠীর মধ্যে কিছু তারতম্য ছিল। অমরকোষ গ্রন্থে শ্রেষ্ঠী বলতে বোঝানো হয়েছে অতি ধনী ও প্রভাবশালী গোষ্ঠীকে যাঁরা মাঝে মাঝে বণিক সম্প্রদায়ের নেতা হিসেবেও সক্রিয় ছিলেন। অন্যদিকে একদল বণিক গো-শকটের কাফেলা নিয়ে স্থলপথে দূরদেশে বাণিজ্য পণ্য নিয়ে পাড়ি দিতেন। এই জাতীয় বণিকদের ‘সার্থবাহ’ বলা হত। লেখমালাতেও ‘শ্রেষ্ঠী’ ও ‘সার্থবাহদের উল্লেখ পাওয়া যায়। তাম্রশাসনে ‘নগরশ্রেষ্ঠী’ নামক পদের উল্লেখ পাওয়া যায়। ‘নগরশ্রেষ্ঠী’ জেলা প্রশাসনে বিষয়পতি অর্থাৎ জেলার প্রশাসককে সহায়তা করতেন। সম্ভবত জেলার প্রধান নগরের অগ্রণী ব্যবসায়ী বা ধনী ব্যক্তিকে ‘নগরশ্রেষ্ঠী’ বলা হত। বৈশালীর উৎখনন থেকে ‘শ্রেষ্ঠী’ ও ‘নগরশ্রেষ্ঠী’র সিলমোহর পাওয়া গেছে। ফা-হিয়েন ও হিউয়েন সাঙ এর বিবরণী থেকেও উপমহাদেশে ভারতের বণিকদের যাতায়াতের তথ্য পাওয়া যায়। স্থলপথের পাশাপাশি জলপথেও বাণিজ্য চলত। বাংলার তাম্রশাসনগুলি থেকে জলপথ ও নৌ-বাণিজ্যের বিবরণ পাওয়া যায়। গঙ্গা, যমুনা, নর্মদা, কৃষ্ণা-গোদাবরী এবং কাবেরী নদীগুলি জলপথ রূপে ব্যবহৃত হত। অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে সূতীবস্ত্রের বিশেষ চাহিদা ছিল।
প্রাক্-গুপ্ত ভারতীয় উপমহাদেশের সামুদ্রিক বাণিজ্যের কেন্দ্রে ছিল ভারত-রোম বাণিজ্য। খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতকে ভারত-রোম বাণিজ্যে মন্দাভাব প্রকট হয়। পরে রোম সাম্রাজ্যের উপর হূন আক্রমণ ঘটলে এই বাণিজ্যের অবসান ঘটে। তবে খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত পূর্ব-রোম সাম্রাজ্যের (বাইজানটাইন সাম্রাজ্য) সাথে ভারতের কিছু বাণিজ্য চালু ছিল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাথে এই সময় ভারতের বাণিজ্যে নতুন গতিবেগ সঞ্চারিত হয়েছিল। ভারত-রোম বাণিজ্যের সময় মূলত লোহিত সাগরের মধ্য দিয়ে ভূমধ্যসাগর ও ভারত মহাসাগরে বাণিজ্য চলত। এই বাণিজ্যে আরব ও আবিসীনীয় বণিকদের প্রাধান্য ছিল। কিন্তু পূর্ব-রোম সাম্রাজ্যের সাথে প্রাচ্যের বাণিজ্য চলত মূলত পারস্য উপসাগরের মাধ্যমে। এই বাণিজ্যে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় ছিল ইরাণের সাসানীয় বংশ ও পূর্ব-রোমান সাম্রাজ্য। পারস্য উপসাগরের বাণিজ্যিক ব্যস্ততার ফলে পশ্চিম উপকূলের কল্যাণ ও চৌল বন্দরের পুনরুজ্জীবন ঘটে। দক্ষিণে কাবেরী পত্তনম বন্দরের গুরুত্বও বেড়েছিল। চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশী পারস্যের শাসক দ্বিতীয় খসরুর সাথে মৈত্রী সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। আলটবারীর বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে সপ্তম শতকে আরবসাগরীয় বাণিজ্যে ভারতের ব্যস্ততা ছিল। দ্বিতীয় পুলকেশী কর্তৃক পুরীদ্বীপ (বর্তমান এলিফ্যাস্টা দ্বীপ) দখল আরব সাগরে ভারতের বাণিজ্যিক কার্যক্রমের সাক্ষ্য দেয়।
পূর্ব উপকূলের বিখ্যাত বন্দর ছিল তাম্রলিপ্ত (বর্তমান পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুক)। এখান থেকে প্রধানত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাথে বাণিজ্য চলত। ফা-হিয়েন ও হিউয়েন সাঙ-উভয়েই তাম্রলিপ্ত বন্দরের প্রশংসা করেছেন। ফা-হিয়েন তাম্রলিপ্ত বন্দর থেকে জাহাজ ধরে শ্রীলংকা পর্যন্ত পাড়ি দেন। সেখান থেকে চীনা বাণিজ্যপোতে চড়ে জাভা হয়ে চীনে পৌঁছান।
প্রাচীন বাংলার সমতট অঞ্চলের কুমিল্লা, নোয়াখালি প্রভৃতি এলাকাও সমুদ্র বাণিজ্যে অংশ নিতে শুরু করেছিল। চীন থেকে ইথিওপিয়া (আবিসিনীয়া) পর্যন্ত বিস্তৃত সমুদ্রপথে বাণিজ্য চলত। বাণিজ্য তরী চীন থেকে যাত্রা শুরু করে ইন্দোনেশিয়া ও ভারতের পূর্ব উপকূলের মধ্য দিয়ে সিংহল পর্যন্ত যেত। আবার পশ্চিম উপকূল ধরে পারস্য ও আরবসাগর হয়ে ইথিওপিয়ায় ফিরে আসত। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত শকদের পরাজিত ও বিতাড়িত করার ফলে ভূমধ্যসাগরীয় বাণিজ্যে ভারতীয়দের অংশগ্রহণ সহজ হয়েছিল।
আমদানি ও রপ্তানি পণ্যের ক্ষেত্রে খুব বেশী পরিবর্তন ঘটে নি। আমদানি পণ্যের মধ্যে প্রধান ছিল চীন থেকে রেশম এবং ইথিওপিয়ার হাতির দাঁত। উন্নতমানের ঘোড়া আসত আরব থেকে। এছাড়া পশ্চিম ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে তামা এবং সিংহল থেকে নীলকান্তমণি আমদানি করা হত। বাণিজ্য সূত্রে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে ভারতীয় উপনিবেশ গড়ে ওঠার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রসঙ্গে ফুনান-এর নাম প্রথম। মালয় উপদ্বীপ, থাইল্যান্ড, জাভা, কম্বোডিয়াতেও ভারতীয় উপনিবেশ স্থানীয় জনজীবনে প্রভাব ফেলেছিল। চীনের সাথে ভারতের বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বীতা থাকলেও, দু’দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক রক্ষার প্রয়াস ছিল। দু’দেশের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের প্রধান সূত্র ছিল বৌদ্ধধর্ম এবং দক্ষিণ ভারতের সাথে চীনের বাণিজ্য। দক্ষিণ ভারতে চীনের তাং বংশীয় সম্রাটদের মুদ্রা পাওয়া গেছে। যা উভয়দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্কের সাক্ষ্য দেয়।
রপ্তানি পণ্যের মধ্যে আগের মতই সুস্বাদু মশলা, গোলমরিচ, সুগন্ধি দ্রব্য, মূল্যবান পাথর, চন্দন কাঠ, মুক্তা, ঔষধি, নীল ইত্যাদি ছিল প্রধান। মুক্তা বাণিজ্যে অগ্রণী ছিল পাণ্ড্য রাজ্য। কল্যাণ বন্দর থেকে তামা, সূতীবস্ত্র, তিল ইত্যাদি রপ্তানি হত। মালবার উপকূল থেকে যেত মূলত গোলমরিচ, কাশ্মীর থেকে মৃগনাভি বিদেশে যেত।
সমুদ্রপথ ছাড়া চীনের সাথে ভারতের দুটি স্থলপথের মাধ্যমে যোগাযোগ ছিল। একটি পথ মধ্য এশিয়া, ব্যাকট্রিয়া হয়ে সুলেমান পর্বতমালার গিরিপথের মধ্য দিয়ে ভারতের অভ্যন্তর পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। দ্বিতীয় পথটি কারাকোরাম পর্বত ও কাশ্মীরের মধ্য দিয়ে চীন ও ভারতের মধ্যে যাতায়াতের জন্য ব্যবহৃত হত। তবে এই পথটি ছিল খুবই দূর্গম।
সামগ্রিকভাবে বলা যায় যে, ভারত-রোম বাণিজ্য ভেঙে পড়ার পরবর্তীকালে ভারতের সমুদ্র বাণিজ্যের গতিশীলতা শিথীল হয়েছিল। পরবর্তী সাড়ে তিনশো বছরে (৩০০-৬৫০ খ্রিঃ) দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দ্বীপগুলির সাথে দূরপাল্লার সমুদ্র বাণিজ্য কিছুটা গতিশীল থাকলেও, ভারত-রোম বাণিজ্যের মত ব্যাপকতা বা ব্যস্ততা তাতে ছিল না। গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা প্রকট হলে অর্থনীতিতেও তার বিরুপ প্রভাব পড়ে। আঞ্চলিক রাষ্ট্রগুলি তাদের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা, দূর্বলতা, অস্থায়িত্ত ইত্যাদি নানা কারণে সামুদ্রিক বাণিজ্যে কর্তৃত্ব করার ক্ষমতা হারিয়েছিল। সপ্তম শতকে ইসলাম ধর্মের প্রবর্তন ও দ্রুত বিকাশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও গভীর প্রভাব ফেলে। ইসলাম ধর্মে নগরায়ণ ও ব্যবসা-বাণিজ্যকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মহাসাগরীয় বাণিজ্যে এর প্রভাব পড়ে। ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত আরব জনগণ নতুন উদ্যমে বাণিজ্যিক কাজে লিপ্ত হন। ভারত মহাসাগরে আরব বণিকদের উত্থানের ফলে ভারতের বহির্বাণিজ্য নতুন বৈশিষ্ট্য পায়। অষ্টম শতকে আরব বণিকেরা ভারতের পশ্চিম উপকূলের নানা বন্দরে বাণিজ্য পোত ভেড়াতে থাকেন। ফলে আগামী দিনগুলিতে ভারতীয় বাণিজ্যে অনিবার্য ভাঙন দেখা দেয়।
মৌর্যযুগের মুদ্রা ব্যবস্থা
ইতিহাসের কোনও একটি পর্যায়ের অর্থনৈতিক অবস্থা অনুধাবনের জন্য মুদ্রার ব্যবহার সম্পর্কে জ্ঞান জরুরী। কী ধরনের মুদ্রা ব্যবহার হত, মুদ্রার আকৃতি ও ধাতু মান ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা থাকা দরকার। গুপ্তযুগে ভারতে মুদ্রার ব্যবহারের বিষয়টি বেশী গুরুত্বপূর্ণ। কারণ গুপ্তযুগে ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাসের নানা রূপান্তর যেমন, ভূমিদানের ব্যাপকতা, ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তিকে ভূমিদান, বাণিজ্যের মন্দাগতি, নগরের অবক্ষয় ইত্যাদি বিষয়গুলি ঐতিহাসিক বিতর্কের সূচনা করেছে।
গুপ্তযুগের প্রথমদিকের মুদ্রায় শক ও কুষাণ মুদ্রারীতির প্রভাব যথেষ্ট। গুপ্তযুগের স্বর্ণমুদ্রার গঠন বৈশিষ্ট্যও নয়ন মুগ্ধকর। পরিমার্জিত ও সৌষ্ঠবপূর্ণ গুপ্তদের স্বর্ণমুদ্রা অস্তিত্ব থেকে প্রমাণিত হয় যে বিলাস সামগ্রীর আন্তর্জাতিক বাণিজ্য তখনও জনপ্রিয় ছিল। ভারত-রোম বাণিজ্য বন্ধ হওয়ার পর গুপ্ত রাজারা সোনার যোগান কীভাবে পেতেন, এমন প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। সম্ভবত পূর্ব-রোম সাম্রাজ্যের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক সোনার যোগান সম্ভব করেছিল। এই বাণিজ্য সম্পর্কের সূত্রে চীন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি থেকে গুপ্তরাজারা সোনা আমদানি করতেন। দক্ষিণ ভারতের সোনার খনি থেকেও তাঁরা সোনা সংগ্রহ করতেন। তবে এই ধারা বেশিদিন অক্ষুণ্ণ ছিল না। গুপ্তশাসনের শেষ দিকে স্বর্ণমুদ্রাগুলিতে সোনার পরিমাণ কমিয়ে খাদের পরিমাণ অনেক বাড়ানো হয়েছিল। এই পরিবর্তন গুপ্তদের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সংকট ও বাণিজ্যের অধোগতির প্রমাণ দেয়। গুপ্তযুগের রৌপ্যমুদ্রাগুলিও গুণগতমানের বিচারে বেশ উন্নত ছিল। গুপ্তদের রৌপ্যমুদ্রায় শক কুষাণ মুদ্রার প্রভাব দেখা যায়। গুপ্তরা রৌপ্যমুদ্রা চালু করেছিলেন কিছু পরবর্তী সময়ে, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের আমলে। তবে সেকালের রৌপ্যমুদ্রার কোনও সঞ্চিত ভাণ্ডার আবিষ্কৃত হয়নি। রৌপ্যমুদ্রার যা নিদর্শন পাওয়া গেছে, তার পরিমাণও খুব কম। মূলত গুজরাট অঞ্চলে গুপ্তদের রৌপ্যমুদ্রার নিদর্শন পাওয়া গেছে। সম্ভবত বহির্বাণিজ্যের বিনিময় মাধ্যম হিসেবে এগুলি ব্যবহার হত। তবে রৌপ্যমুদ্রার স্বল্পতার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। ডি. ডি. কোশাম্বি মনে করেন, রৌপ্যমুদ্রার স্বল্পতা এবং স্বর্ণমুদ্রায় ধাতুগত মানের সংকোচন, সে যুগের বাণিজ্যের অধোগতির নির্দেশক।
লক্ষণীয় যে গুপ্তরা তাম্রমুদ্রার প্রচলন করেন নি। অথচ কুষাণরা বহু সংখ্যায় তাম্রমুদ্রা প্রবর্তন করেছিলেন। গুপ্ত আমলে তামার যোগানের অভাব ছিল না। তখন ভারতে বহু তামার খনিতে উত্তোলন বজায় ছিল। খ্রিষ্টীয় পঞ্চম থেকে সপ্তম শতকে তাম্রমুদ্রার অভাব প্রকটিত হচ্ছিল। অধ্যাপক রামশরণ শর্মার মতে, স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা প্রধানত বৈদেশিক বা দূরদেশে বাণিজ্যে ব্যবহৃত হয়। অন্যদিকে তাম্রমুদ্রা মূলত দৈনন্দিন তৈজসপত্র কেনাবেচার কাজে ব্যবহার হয়। তাম্রমুদ্রার অনুপস্থিতি গ্রামাঞ্চলে কেনাবেচার ক্ষেত্রে বিনিময় প্রথার পুনরাবির্ভাব নির্দেশ করে। গ্রামগুলি স্বনির্ভর ও বদ্ধ অর্থনীতির অংশীদার হওয়ার কারণে দৈনন্দিন কাজে তাম্রমুদ্রার চাহিদা ছিল না। দৈনন্দিন বাণিজ্যিক লেনদেনের অনুপস্থিতি তাম্রমুদ্রা ব্যবহার না করার একটা কারণ হতে পারে। গুপ্তদের সমসাময়িক দাক্ষিণাত্যের বাকাটক রাজ্যেও তামার মুদ্রার সন্ধান পাওয়া যায়নি। যদিও মুদ্রা অর্থনীতির সাথে তাদের পরিচয় ছিল। কারণ তাদের প্রতিবেশী শক-ক্ষত্রপরা নিয়মিত মুদ্রা ব্যবহার করতেন। এই ঘটনাকে বাণিজ্যের অবক্ষয়ের অন্যতম দৃষ্টান্ত বলেই ড. শর্মা মনে করেন।
মৌর্যযুগের নগরের অবক্ষয়
এতাবৎ গবেষণা থেকে মনে করা হয় যে, প্রাচীন ভারতের নগরগুলি নদী তীরবর্তী অঞ্চলে কিংবা বাণিজ্যপথের ধারে গড়ে উঠেছিল। নগরগুলি সাধারণভাবে গ্রাম বেষ্টিত হত। অধ্যাপক শর্মার মতে, প্রাচীন ভারতে খ্রিস্টপূর্ব ২০০ অব্দ থেকে খ্রিষ্টীয় ৩০০ অব্দের মধ্যে ভারতের নগরগুলি চরম উৎকর্ষ লাভ করেছিল। মৌর্য, কুষাণ ও সাতবাহনদের রাজত্বে নগরসভ্যতার বিকাশ মোটামুটি অব্যাহত ছিল। তবে খ্রিষ্টীয় ৩০০ শতক থেকে নগরের সংখ্যা কমতে থাকে। বাণিজ্যে মন্দা, কারিগরী ও পণ্য উৎপাদনের সামগ্রিক অবনতি তৃতীয় শতকের পর নগরের অবক্ষয়ের কারণ হয়। উত্তরভারতে কুষাণ আমলের বহু সমৃদ্ধ নগর যেমন কোশাম্বী (এলাহাবাদ), তক্ষশিলা, অহিচ্ছত্র, পুরানা কিল্লা (দিল্লী), হস্তিনাপুর, শ্রাবস্তী, কুশীনগর, বৈশালী প্রভৃতিতে অবক্ষয়ের ছাপ স্পষ্ট হয়েছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের প্রেক্ষিতে ড. শর্মা দেখিয়েছেন খ্রিষ্টীয় চতুর্থ ও পঞ্চম শতকে গাঙ্গেয় উপত্যকার অনেক নগরে জনবসতির অস্তিত্বই ছিল না। গাঙ্গেয় উপত্যকায় বি-নগরায়ণের এই ছবি উপমহাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে দেখা যায়। খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকে অযোধ্যা ও মথুরা যথেষ্ট সমৃদ্ধ নগর ছিল। গুপ্তযুগে এগুলি গুরুত্ব হারায়। মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, গুজরাটের বিভিন্ন নগর যেমন, উজ্জয়িনী, নোহ; মহারাষ্ট্রের পৈঠান, নাসিক, কৌন্ডিন্যপুর; অন্ধের অমরাবতী, ধরণী কোটা; কর্ণাটকের মাধবপুর, চন্দ্রবল্লী, ব্রত্নগিরি প্রভৃতি নগরকেন্দ্রগুলি এই সময় অবক্ষয়ের গ্রাসে পড়েছিল। গুপ্তদের শাসনকেন্দ্র পাটলিপুত্র নগরীও এই অবক্ষয়ের কবলমুক্ত ছিল না।
অধ্যাপক শর্মার মতে ৩০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ অধিকাংশ নগর ভেঙে পড়লেও কিছু নগরের অস্তিত্ব ৬০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। বি. এন. এস যাদব কামসূত্রের বর্ণনা, কালিদাসের কাব্য এবং বিশাখদত্তের ‘মুদ্রারাক্ষস’ নাটকের ভাষ্য থেকে দেখিয়েছেন যে, তখনও কিছু নগরে ব্যয়বহুল আমোদ-প্রমোদের ধারা অব্যাহত ছিল। ক্রমে সেগুলিও ধ্বংস হয়। খ্রিষ্টীয় ১০০০ অব্দ পর্যন্ত টিকে থাকা নগরের প্রমাণ নেই বললেই চলে। ৩০০ শতকের পর নগরের অবক্ষয়ের কারণ অনুসন্ধান করেছেন অধ্যাপক শর্মা। বি. নগরায়ণের অন্যতম কারণগুলি হল, রোম-ভারত বাণিজ্যে ভাঙন। পঞ্চম-ষষ্ঠ শতকে ভারতীয় উপমহাদেশে বিক্ষিপ্তভাবে কিছু রোমান মুদ্রা (পূর্ব-রোম) পাওয়া গেলেও, তার পরিমাণ খুবই নগণ্য। খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতকের শেষ দিকে কুষাণ সাম্রাজ্যের পতন হলে পশ্চিম এশিয়ার সাথেও ভারতের বাণিজ্য বড় ধাক্কা খায়। নগরের অবক্ষয়ের পশ্চাদপটে রাজনৈতিক পরিবর্তনও দায়ী ছিল। খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতকের মাঝামাঝি সময় মধ্যভারত ও দাক্ষিণাত্যে সাতবাহন সাম্রাজ্য এবং উত্তর ভারতে কুষাণ সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে। শক্তিশালী কেন্দ্রীভূত শাসন ব্যবস্থার বিলোপ গ্রামের সাথে নগরের পারস্পরিক সম্পর্ক ভেঙে দেয়। ফলে নগরগুলিতে খাদ্য সংস্থান ও ব্যবসা বাণিজ্য শিথিল হলে ভাঙনের দিকে এগিয়ে যেতে বাধ্য হয়। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের ভিত্তিতে জানা যায় যে, অন্ধ্র, কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র ও মধ্যপ্রদেশে বহু নগর সাতবাহন শাসনকালে সজীব ছিল। কিন্তু সাতবাহনদের পতনের পর নগরগুলিও ভেঙে পড়তে থাকে। উত্তর ভারতে কুষাণ রাজ্যের নগরগুলিরও একই পরিণতি ঘটেছিল।
এই প্রসঙ্গে ড. শর্মা কলিযুগতত্ত্ব উপস্থাপন করেছেন। পুরাণ সাহিত্যে বলা হয়েছে যে কলিযুগে বর্ণসংকরের সৃষ্টি হবে যার ফলে মানুষ প্রচলিত বর্ণধর্ম পালন করতে অস্বীকার করবে। সাহিত্যে বর্ণনার প্রেক্ষিতে মনে করা হয় যে কলিযুগে অর্থাৎ আনুমানিক তৃতীয়-চতুর্থ শতকে বৈশ্য ও শূদ্ররা উচ্চবর্ণের আধিপত্য মানতে অস্বীকার করেছিলেন। বাণিজ্য কর্ম ও কর আদায় কমে গেলে সরকারের পক্ষে রাজকর্মচারী ও পুরোহিত শ্রেণীর বেতন ও ভরনপোষণ দেওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় রাজা ব্রাহ্মণ, ধর্মস্থান ও কর্মচারীদের নিষ্কর ভূমিদান করতে শুরু করেন। চতুর্থ শতকে শুরু হয়ে নিষ্কর ভূমিদান ব্যবস্থা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ভূমিভিত্তিক গ্রামীণ স্বনির্ভর অর্থনীতির উদ্ভব শিল্প-বাণিজ্যের গুরুত্ব শিথিল করে দেয়। এর প্রভাবে নগরগুলি দ্রুত শ্রীহীন হয়ে ধ্বংস হয়। এইভাবে আদি মধ্যযুগে (সপ্তম-দ্বাদশ শতক) এক নতুন অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোর উদ্ভব ঘটে, যেখানে ‘অগ্রহার’ ভূমিদানের ব্যাপক প্রচলন এক প্রভাবশালী মধ্যসত্ত্বভোগী শ্রেণীর সৃষ্টি ঘটায়, যাকে ভারতে সামন্ততন্ত্রের সূচনা বলে মনে করা হয়।
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।