আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “মৌর্য্যোত্তর ভারতের রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা : শুঙ্গ বংশ, কান্নবংশ, কলিঙ্গের চেত বংশ” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
মৌর্য্যোত্তর ভারতের রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা
মৌর্যবংশের নেতৃত্বে ভারতে যে রাজনৈতিক ঐক্য স্থাপিত হয়েছিল, মৌর্যবংশের পতনের সঙ্গে সঙ্গে তার অবসান ঘটে। পরবর্তী পাঁচশো বছর আবার বিচ্ছিন্নতা, অনৈক্য, বহিরাক্রমণজনিত অস্থিরতা ভারতের রাজনীতিকে গ্রাস করে। খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতকে পুনরায় গুপ্তরাজাদের কৃতিত্বে ভারতসাম্রাজ্য গড়ে ওঠার মধ্যবর্তীকালে দেশীয় বা বহিরাগত কোন শক্তিই ভারতের রাজনৈতিক অনৈক্য দূর করতে পারেনি। মগধে শুঙ্গবংশের, দাক্ষিণাত্যে সাতবাহন বংশের, কলিঙ্গে চেতবংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। আবার একই সময়ে অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলার সুযোগে একে একে ইন্দো-গ্রীক, শক, পার্থিয়, কুষাণ প্রভৃতি জাতি ভারতে প্রবেশ করে ও রাজ্য স্থাপন করে।
শুঙ্গ বংশ :
ভারতে শুঙ্গবংশের শাসনকাল সম্পর্কে জানার জন্য আমাদের মূলত পুরাণসমূহ, বানভট্টের হর্ষচরিত, মালবিকাগ্নিমিত্রম্, পতঞ্জলির মহাভাষ্যও বৌদ্ধগ্রন্থ দিব্যবদান প্রভৃতির উপর নির্ভর করতে হয়। পুরাণ থেকে জানা যায়, মৌর্য সম্রাট বৃহদ্রথকে হত্যা করে তাঁর সেনাপতি পুষ্যমিত্র শুঙ্গ মগধের সিংহাসন দখল করেছিলেন (১৮৭-১৯১ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)। শুঙ্গবংশের পরিচয় সম্বন্ধে মতভেদ আছে। মালবিকাগ্নিমিত্রম্ নাটকে শুঙ্গদের বৈশ্বিক বংশোদ্ভূত বলা হয়েছে। দিব্যবদানের মতে, পুষ্যমিত্র ছিলেন মৌর্যবংশোদ্ভূত এবং পুরাণের মতে, ভরদ্বাজগোত্রীয় ব্রাক্ষ্মণ। এই মতটিই অধিকাংশ পণ্ডিত গ্রহণ করেছেন।
পুষ্যমিত্র পাটলিপুত্রের সিংহাসন দখল করলেও তাঁর সাম্রাজ্য বহুদূর বিস্তৃত ছিল না। কারণ মৌর্যরাজাদের দুর্বলতার সুযোগে বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিগুলি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল ও একাধিক স্বাধীন রাজ্যের উদ্ভব ঘটেছিল। কলিঙ্গ ও দাক্ষিণাত্যে স্বাধীন রাজ্যের উদ্ভব ঘটেছিল। তাই পুষ্যমিত্রের রাজত্ব দক্ষিণে নর্মদার বেশি বিস্তৃত ছিল না। অযোধ্যা ও বিদিশায় প্রাপ্ত শুঙ্গদের শিলালেখ প্রমাণ করে যে, ঐ অঞ্চলে শৃঙ্গশাসন বিস্তৃত ছিল। জলন্ধর ও শিয়ালকোট শুঙ্গ রাজ্যভুক্ত ছিল বলে ‘দিব্যবদানে’ বলা হয়েছে। যদিও এ মতের সত্যতা প্রশ্নাতীত নয়। ‘মালবিকাগ্নিমিত্রম্’ থেকে জানা যায়, পুষ্যমিত্রের পুত্র অগ্নিমিত্র ছিলেন বিদিশার শাসক। অযোধ্যায় প্রাপ্ত একটি লিপি থেকে অনুমান করা হয় যে, কোশল হয়ত তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। পুষ্যমিত্রের সঙ্গে দক্ষিণের বিদর্ভ রাজ্যটির সংঘর্ষের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে ‘মালবিকাগ্নিমিত্রম্’ নাটকে। মগধের সিংহাসনে শুঙ্গবংশের প্রতিষ্ঠা ও বিদর্ভ রাজ্যটির উৎপত্তি প্রায় সমকালীন ঘটনা। বিদর্ভের রাজা যজ্ঞসেন ছিলেন মৌর্য রাজার মন্ত্রীর আত্মীয়। তাই সেনাপতি পুষ্যমিত্র ক্ষমতা দখল করায় মন্ত্রীর দলভুক্ত যজ্ঞসেন তার বিরোধী হয়ে পড়েন। আবার যজ্ঞসেনের ভ্রাতা মাধবসেন ছিলেন অগ্নিমিত্রের বন্ধু। যজ্ঞসেন মাধবসেনকে বন্দী করলে অগ্নিমিত্র বিদর্ভ আক্রমণ করেন। যুদ্ধে যজ্ঞসেন পরাজিত হয়। বিদর্ভ রাজ্য যজ্ঞসেন ও মাধবসেনের মধ্যে বিভক্ত হয়ে যায়। এইভাবে নর্মদার দক্ষিণের বিদর্ভ রাজ্য শুঙ্গ প্রভাবাধীন হয়ে পড়ে।
পুষ্যমিত্রের রাজত্বকালের অপর গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যবন আক্রমণ সম্পর্কে জানা যায় পতঞ্জলির মহাভাষ্য থেকে। এই যবন অর্থাৎ গ্রীকরা রাজস্থানের চিতোরের নিকটবর্তী মাধ্যমিকা পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিল। এমনকি পাটলিপুত্রের নিরাপত্তাও বিঘ্নিত হয়েছিল। মালবিকাগ্নিমিত্রম্ নাটকে উল্লেখ রয়েছে যে, সিন্ধুনদের দক্ষিণ তীরে পুষ্যমিত্রের সেনাপতি বসুমিত্রের সাথে যবনদের যুদ্ধ হয়। ঐ যুদ্ধে বসুমিত্র জয়লাভ করে। সম্ভবত এই আক্রমণকারীগণ ছিল ব্যাকট্রিয় গ্রীক ও এদের নেতা ছিল ডেমিট্রিয়াস। ভি. এ. স্মিথের মতে, পুষ্যমিত্র কলিঙ্গরাজ খারবেলের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন। খারবেল মগধ আক্রমণ করলে (১৬৫ খ্রিঃ পূঃ) পুষ্যমিত্র যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। খালবেলের বাহিনী পাটলিপুত্রের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে যেতে পারে। এমতাবস্থায় পুষ্যমিত্র মথুরার দিকে পিছিয়ে গিয়ে প্রতিরোধ গড়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু খারবেল মগধের ভেতরে আর অগ্রসর না হয়ে ফিরে যান। কয়েক বছর পরে খারবেল পুনরায় মগধ অভিযান করেন এবং শুঙ্গদের পরাজিত করে রাজকোষ লুণ্ঠন করেন। এ বিষয়ে কেউ কেউ ভিন্নমত পোষণ করেন। এঁদের মতে, হাতিগুম্ফা লেখতে জনৈক ‘বহস্তিমিতা’কে পরাজিত করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এই বহস্তিমিতা কে পুষ্যমিত্র বলে চিহ্নিত করা সঠিক হবে না। যুদ্ধবিজয় সম্পন্ন করার পর পুষ্যমিত্র দু’টি অশ্বমেধ যজ্ঞ আয়োজিত করেছিলেন এবং এখানে তিনি রাজচক্রবর্তী ও মহারাজাধিরাজ উপাধি দেন। পুষ্যমিত্রের অযোধ্যা লেখতে এই দুটি অশ্বমেধ যজ্ঞ আয়োজনের উল্লেখ আছে। কালিদাসের ‘মালবিকাগ্নিমিত্র’ নাটকেও এই অশ্বমেধযজ্ঞ ও মহাভায্য প্রণেতা পতঞ্জলি কর্তৃক পৌরহিত্য করার উল্লেখ আছে। পুষ্যমিত্র তাঁর সাম্রাজ্যকে দু’ভাগে বিভক্ত করে বিদিশা’তে পুত্র অগ্নিমিত্রকে এবং কোশলে জনৈক আত্মীয়কে শাসন দায়িত্ব দিয়েছিলেন।
পুষ্যমিত্র ছিলেন গোঁড়া হিন্দু এবং ব্রাক্ষ্মণ্যবাদের সমর্থক। অশ্বমেধযজ্ঞানুষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি ব্রাহ্মণ্যবাদের পুনরুজ্জীবন ঘটান। ব্রাহ্মণদের জন্য দানধ্যান, সংস্কৃত ভাষাশিক্ষার প্রসার এবং সূর্য ও অগ্নিউপাসনার কাজকে উৎসাহিত করে তিনি ব্রাহ্মণ্যবাদের পুনরুত্থান ঘটান। এই প্রসঙ্গে কোন কোন গ্রন্থে পুষ্যমিত্রকে প্রচণ্ড বৌদ্ধবিদ্বেষী এবং বৌদ্ধদের হত্যাকারী বলে নিন্দা করা হয়েছে। বৌদ্ধগ্রন্থ দিব্যবদান এবং তিব্বতীয় পণ্ডিত তারানাথ-এর গ্রন্থে অভিযোগ করা হয়েছে যে, পুষ্যমিত্র অসংখ্য বৌদ্ধভিক্ষুকে (শ্রমণ) হত্যা করেছিলেন এবং তাঁর নির্দেশে বহু মঠ ও স্তূপ ধ্বংস করা হয়েছিল। দিব্যবদানে বলা হয়েছে যে, পুষ্যমিত্র এক বিজ্ঞপ্তি জারি করে বলেছিলেন যে, কেউ বৌদ্ধ শ্রমণের ছিন্নমুণ্ড আনতে পারলে তাকে একশত দিনার পুরস্কার দেওয়া হবে। আধুনিক ইতিহাসচর্চায় এই সকল অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। ড. হেমচন্দ্র রায়চৌধুরীর মতে, শুঙ্গদের রাজত্বকালে ভারহূতে বহু বৌদ্ধ মন্দির, স্তূপ ইত্যাদি নির্মিত হয়েছিল। এটি প্রমাণ করে যে, ব্রাহ্মণ্যবাদের সমর্থক ও প্রচারক হলেও, শুক্তরা প্রত্যক্ষভাবে বৌদ্ধদের ধ্বংসকারী ছিলেন না (“The Buddhist remains at Bharhut during the supremacy of the Sungas do not bear out the theory which represents Pushyamitra and his descendants as leaders of militant Bhramanism”)/ ড. আর. এস. ত্রিপাঠীর মতে, পুষ্যমিত্র নিঃসন্দেহে ব্রাহ্মণ্যবাদের অন্ধ সমর্থক ছিলেন। তবে ভারহূতের অক্ষত বৌদ্ধ নিদর্শনগুলির অস্তিত্ব প্রমাণ করে যে শুঙ্গরা বৌদ্ধধর্ম ও নিদর্শন ধ্বংস করার কোন কর্মসূচী নেননি। এঁরা মনে করেন, কিছু হতাশাবাদী লেখক যাঁরা, ব্রাহ্মণ্যবাদের পুনর্জাগরণের প্রয়াসে ক্ষুদ্ধ ও শংকিত ছিলেন, তাঁরাই শুঙ্গদের অজনপ্রিয় করার লক্ষ্যে এমন বিবরণ দিয়েছেন। আসলে, রাজনৈতিক কারণে এই সময় বৌদ্ধরা সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়েছিলেন। আক্রমণকারী গ্রীকদের সাথে বৌদ্ধদের হৃদ্যতা তৎকালীন সমাজ মেনে নিতে পারেনি। তাই বৌদ্ধদের কিছু কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়েছিল।
ছত্রিশ বছর রাজত্বের পর পুষ্যমিত্র মারা যান (১৪৯ খ্রিঃ পূঃ)। সিংহাসনে বসেন তাঁর পুত্র অগ্নিমিত্র। সিংহাসনে বসার আগে তিনি বিদিশা বা পূর্বমালবের শাসক ছিলেন। তিনি আট বছর রাজত্ব করেন। পরবর্তী শাসক ছিলেন সুজ্যেষ্ঠ, যাঁর রাজত্বকালের মেয়াদ ছিল সাত বছর। এই দুই শুঙ্গরাজা সম্পর্কে কোন মুদ্রা বা লেখ থেকে কিছুই জানা যায় না। কেউ কেউ উত্তর-পাঞ্চালে প্রাপ্ত অগ্নিমিত্রের নামাঙ্কিত মুদ্রাকে শুঙ্গ রাজা অগ্নিমিত্রের বলে সনাক্ত করতে চেয়েছেন। তবে কানিংহাম সহ অধিকাংশ পণ্ডিত তা মানতে চাননি। সুজ্যেষ্ঠর পর রাজা হন সুমিত্র। তিনি সুযোদ্ধা ছিলেন এবং পুষ্যমিত্রর আমলে গ্রীক আক্রমণ প্রতিহত করেছিলেন। কিন্তু সিংহাসনে বসার পর তিনি নৃত্য, গীত ও নানা বিলাসের স্রোতে গা ভাসিয়ে দেন। এক জলসা শোনার সময় জনৈক মুকদেব তাঁকে হত্যা করেন। ইনি সম্ভবত স্বাধীন কোশল রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই অস্থিরতার কালে কৌশাম্বী, পাঞ্চাল ও মথুরার শাসকরা শৃঙ্খদের অধীনতা অস্বীকার করে স্বাধীন রাজ্য গড়ে তোলেন। সুমিত্র দশ বছর রাজত্বের পর আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ১২৩ অব্দে মারা যান। পুরাণগ্রন্থে তাঁর উত্তরসুরী হিসেবে অন্ধ্রক, পুলিন্দক ও ঘোষা’র নাম আছে। পণ্ডিতদের মতে, এঁরা কেউই শুঙ্গ বংশোদ্ভূত ছিলেন না। শুঙ্গ বংশের পঞ্চম শাসক ছিলেন ভাগবত। তিনি এবং ভিলসার নিকটবর্তী বেসনগর স্তম্ভলেখতে বর্ণিত ভাগভদ্র অভিন্ন ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর রাজত্বের চতুর্দশ বর্ষে উৎকীর্ণ এই লেখ থেকে জানা যায় যে, গ্রীক রাজা (তক্ষশিলা) এ্যান্টিয়াল কিডাসের দূত হিসেবে হেলিওডোরাস শুঙ্গ রাজ্যে এসে ভাগবত ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। বিষ্ণুর বাহন গরুঢ়ের সম্মানে একটি স্তম্ভ নির্মাণ করেছিলেন। ভাগবতের পরে সম্ভবত আরো তিনজন শাসক সিংহাসনে বসেছিলেন। এই বংশের শেষ শাসক দেবভূতি। তিনি উচ্ছৃঙ্খল প্রকৃতির ছিলেন। পুরাণ মতে, দেবভূতি দশ বছর ক্ষমতাসীন ছিলেন। তাঁর জনৈক মন্ত্রি বাসুদেব দেবভূতিকে হত্যা করলে শুঙ্গ শাসনের অবসান ঘটে। বাসুদের আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৭৫ অব্দে কান্ববংশের প্রতিষ্ঠা করেন।
কান্নবংশ :
বাসুদেব প্রতিষ্ঠিত কান্ববংশ খ্রিষ্টপূর্ব ৭৫-৩০ অব্দ পর্যন্ত শাসন করেছিলেন। পুরাণ মতে, এঁরা শুঙ্গদের অধীনস্থ ছিলেন। পুরাণে এঁদের ‘শুঙ্গভৃত্য’ বলা হয়েছে। এই বংশের চারজন রাজার নাম পাওয়া যায়। এঁরা হলেন বাসুদেব, ভূমিমিত্র, নারায়ণ এবং সুসমন। এঁরা যথাক্রমে নয় বছর, চৌদ্দ বছর, বারো বছর ও দশ বছর রাজত্ব করেছিলেন। অর্থাৎ এঁদের সম্মিলিত রাজত্বকাল ছিল ৪৫ বছর। কাল্ববংশের শাসন ক্ষেত্র সম্ভবত মগধ অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল। কারণ ইতিমধ্যে পাঞ্ঝাবে গ্রীক শাসন শুরু হয়েছিল। পশ্চিম গাঙ্গেয় উপত্যকায় মিত্র বংশীয় শাসকরা অধিষ্ঠিত ছিলেন। শেষ পর্যন্ত জনৈক অন্ধ্ররাজা সুসর্মনকে বিতাড়িত করে মগধ দখল করলে কান্ব শাসনের অবসান ঘটে। তবে এই অন্ধ্ররাজা কে ছিলেন, তা স্পষ্ট নয়। একাংশের মতে ইনি ছিলেন সিমুক। আবার কেউ কেউ এঁকে সত্ত (Satta) নামে সনাক্ত করেছেন। কাম্বদের আমলেও ব্রাহ্মণ্যধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা অব্যাহত ছিল।
কলিঙ্গের চেত বংশ :
চেদি (চেত) বংশের নেতৃত্বে খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকের শেষ দিকে কলিঙ্গকে কেন্দ্র করে একটি শক্তিশালী রাজ্যের প্রতিষ্ঠা ঘটেছিল। কলিঙ্গ রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিল কটক, গঞ্জাম, পুরী ও সন্নিহিত অঞ্চল। মৌর্য সম্রাট অশোকের লিপি থেকে জানা যায় যে, এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর তিনি কলিঙ্গ দখল করেছিলেন এবং এখান থেকেই তাঁর রাজ্যবিজয় নীতির পরিবর্তন ঘটে এবং রাজ্য বিজয়ের পরিবর্তে তিনি ধর্ম বিজয়ের পথে ব্রতী হন। মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের অব্যবহিত পরে কলিঙ্গের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে বিশেষ তথ্য নেই। তবে কলিঙ্গর প্রতাপশালী রাজা খারবেলের হাতিগুম্ফা লেখ থেকে জানা যায় যে, চেদি বংশীয় মহামেঘবাহন কলিঙ্গতে স্বাধীন শাসনের সূচনা করেছিলেন। পরবর্তী শাসক ছিলেন বক্রদত্ত। খারবেল ছিলেন কলিঙ্গ রাজ্যের তৃতীয় শাসক। তবে মহামেঘবাহনের সাথে তাঁর সম্পর্ক স্পষ্ট নয়।
খারবেলের শাসনকালের সম্ভাব্য কারণ সম্পর্কে মতভেদ আছে। হাতিগুম্ফ লেখ থেকে জানা যায় যে, খারবেল তাঁর রাজত্বের পঞ্চম বর্ষে নন্দ রাজা কর্তৃক নির্মিত ‘তিবস শত’ প্রাচীন একটি সেচখাল সংস্কার ও সম্প্রসারণ করেছিলেন। কাশীপ্রসাদ জয়সোয়াল ‘তিবস শত’ কথাটিকে ১০৩ বছর (৩ + ১০০) অর্থে গ্রহণ করেছেন। তাঁর ব্যাখ্যা অনুযায়ী নন্দ রাজার একশ তিন বছর পর খারবেল সিংহাসনে বসেছিলেন। নন্দবংশের শাসনের অবসানের আনুমানিক সময় খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৪ অব্দ। যদি একশ তিন বছর পরে খারবেল ক্ষমতাসীন হন, তাহলে তাঁর রাজত্বের সূচনাকাল হবে ৩২৪-১০৩ অর্থাৎ আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ২২৩ অব্দ। অন্য মতে, “তিবস শর্ত’ বলতে ত্রিগত বর্ষ হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। অর্থাৎ তাঁর শাসন নন্দবংশের তিনশ বছর পরে সূচিত হয়েছিল। এই ব্যাখ্যানুযায়ী ৩২৪-৩০০ অর্থাৎ ২৪ খ্রিষ্টপূর্ব নাগাদ খারবেলের রাজত্ব শুরু হয়েছিল। সাতবাহন রাজা প্রথম সাতকর্ণী সম্ভবত খারবেলের সমসাময়িক ছিলেন। এই সাতকর্ণী খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকের দ্বিতীয়ার্ধে রাজত্ব করেছিলেন। সুতরাং খারবেলের রাজত্বকে খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকের শেষভাগে স্থাপন করা যায়।
ভূবনেশ্বরের সন্নিকটে প্রাপ্ত হাতিগুম্ফা লেখ থেকে রাজা খারবেল ও স্বাধীন কলিঙ্গ রাজ্যের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। সিংহাসনে বসেই তিনি ঘূর্ণঝড়ে বিধ্বস্ত রাজধানী কলিঙ্গ নগরের প্রাকার সংস্কার করে রাজধানীর নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করেন। দ্বিতীয় বছরে খারবেল পশ্চিম দিকে অভিযান চালিয়ে মুসিকনগর পর্যন্ত অগ্রসর হন। এই স্থানটি গোদাবরী উপত্যকাসংলগ্ন বলে অনেকে মনে করেন। কারো কারো মতে, এটি ছিল কৃয়া ও মুসি নদীর সংগমে অবস্থিত নলগোল্ডা জেলার সীমান্ত অঞ্চল। এর ফলে সাতবাহন রাজা প্রথম সাতকর্ণির সাথে খারবেলের সংঘর্ষের সম্ভাবনা দেখা দেয়। তবে খারবেল মুসিকনগর দখল করেন নি। ফলে উভয়ের মধ্যে সদ্ভাব বজায় ছিল। রাজত্বের চতুর্থ বর্ষে তিনি বেরারের শাসক ভোজকদের এবং খান্দেশ ও আহমদনগরের শাসক রথিকদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে তাদের বশ্যতা আদায় করেন। অষ্টম রাজ্যবর্ষে তাঁর বাহিনী মগধের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে গয়া থেকে পাটলিপুত্রে যাওয়ার পথ ধরে বারবারা পাহাড়ের কাছে উপস্থিত হন। রাজগৃহের শাসক ডেমিট্রিয়াস মথুরায় পালিয়ে যান। তাঁর এই জয়কে স্মরণীয় করে রাখার জন্য নবম রাজ্যবর্ষে প্রাচী নদীর তীরে ‘মহাবিজয় প্রাসাদ’ নির্মাণ করেন। দশম বৎসরে খারবেল ভারতবর্ষের (ভরতব্বম) বিরুদ্ধে অভিযান পাঠান বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সম্ভবত ভারতবর্ষ বলতে উপমহাদেশের কোন বিশেষ অঞ্চলকে বোঝানো হয়েছে। কারণ তিনি কখনোই সমগ্র ভারতবর্ষের উপর কর্তৃত্ব করেন নি। এই ভারতবর্ষ বলতে মগধ, মথুরা বা উত্তরাপথকে বোঝানো হয়নি। কারণ হাতিগুম্ফা লেখতে এই অঞ্চলগুলির নাম আলাদা আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সম্ভবত গাঙ্গেয় উপত্যকার একাংশে এবং মগধ ও মথুরার অন্তর্বর্তী কোন এলাকাকে বোঝাতে ‘ভরতধ্বম’ কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে। পরের বছরে তিনি তামিল অঞ্চলে পাণ্ড্য রাজ্য পর্যন্ত অগ্রসর এবং তামিল গোষ্ঠীগুলির সম্মিলিত প্রতিরোধ চূর্ণ করে তাদের বশ্যতা আদায় করতে সক্ষম হন। দ্বাদশ রাজ্যবর্ষে খারবেল পুনরায় উত্তর ভারতে (উত্তরাপথ) অভিযান পাঠান। মগধ এবং অঙ্গরাজ্যের শাসকরা তাঁর আনুগত্য মেনে নেন এবং কর দিতে রাজি হন। এরপর খারবেল আর কোন সামরিক অভিযান চালান নি।
খারবেল ব্যাপক যুদ্ধযাত্রার মাঝেও একটি দক্ষ প্রশাসন গড়ে তোলার কাজে সফল ছিলেন। কৃষি উৎপাদনের প্রয়োজনে তিনি রাজত্বের পঞ্চম বৎসরে নন্দরাজা নির্মিত তানাসুলি জলসেচ প্রণালীকে সম্প্রসারিত করে কলিঙ্গনগর পর্যন্ত নিয়ে আসেন। বহু কূপ ও জলাশয় খনন করে জলসেচ সুনিশ্চিত করেন। প্রজাসাধারণের আমোদ-প্রমোদের বিষয়েও তিনি আগ্রহী ছিলেন। রাজকীয় উদ্যোগে নৃত্য-গীত-নাটক প্রদর্শনের আয়োজন করা হত। খারবেল জৈনধর্মাবলম্বী ছিলেন। জৈন ধর্ম প্রচারের কাজে তিনি উদ্যোগ নেন। বহু জৈন মন্দির ও উদয়গিরি, খণ্ডগিরির গুহা নির্মাণের কাজে তিনি অর্থ ব্যয় করেন। তবে জৈন ধর্মের অনুসারী হলেও অন্যান্য ধর্মের প্রতি তিনি অনুদার ছিলেন না। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারতীয় সংস্কৃতি প্রচারের কাজেও তিনি উৎসাহ দেখান। খারবেলের মৃত্যুর অল্পকালের মধ্যেই চেদী রাজ্য বিলুপ্ত হয়।
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।